অজু অর্থ নিজেকে আল্লাহর ইবাদত করার উপযুক্ত করে নেয়ার উদ্দেশ্যে পাক-সাফ করার নিয়তে পবিত্র পানি দিয়ে যথানিয়মে শরীরের নির্দিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধুয়ে নেয়া। তবে অজু শুধু শরীরের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, হৃদয়-মনে যে গভীর মানসিক প্রভাব ও মর্যাদা অনুভব করে তা ভাষায় প্রকাশ করা অত্যন্ত দুরূহ। বিশেষত যথাযথভাবে পূর্ণতা সহকারে অজু সম্পন্ন করার পর মুসলিম ব্যক্তির জীবনে অজুর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও ভূমিকা অত্যন্ত ব্যাপক। অজু সার্বক্ষণিক একজন মুসলমানকে সচেতন, জীবন্ত এবং ইবাদতের জন্য অধিকতর উপযুক্ত রাখে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সুন্দরভাবে-উত্তমরূপে অজু করলে তার শরীর থেকে গোনাহগুলো বের হয়ে যায়, এমনকি নখের অভ্যন্তর থেকেও। যে পূর্ণভাবে অজু করে তাতে দুই হাত ও মুখমণ্ডল ধৌত করে এবং মাথা ও কান মাসেহ করে। অতঃপর ফরজ নামাজে দাঁড়ায়, তখন ওইদিনের সেসব গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। যেদিকে তার পা অগ্রসর হয়েছে, তার হাতে যা ধরেছে, কানে যা শুনেছে, চোখে যা দেখেছে, অন্তরে যে খারাপ খেয়াল সৃষ্টি হয়েছে। (আহমদ)অজুর সময় ত্বকের উপরিভাগ ভালোভাবে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করার ফলে এসব রোগ জীবাণু উধাও হয়ে যায়। বিশেষত ত্বক ঘসে মেজে, মালিস করে পরিষ্কার করার মাধ্যমে পূর্ণরূপে অজু সম্পন্ন হয়। এ কারণে অজুর পর মানুষের শরীরে সাধারণত অপরিচ্ছন্নতা ও রোগ জীবাণু আর অবশিষ্ট থাকে না।
আধুনিক চিকিত্সা বিজ্ঞানে এ কথা প্রমাণিত যে, কুলি করার কারণে মুখগহ্বর প্রদাহের যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। দাঁতের মাড়ি ফোলা, ক্ষত সৃষ্টি ও পুঁজ থেকে রক্ষা হয়। অনুরূপভাবে দাঁতকেও রক্ষা করে এবং খাদ্য গ্রহণের পরে দাঁতের ফাঁকে যেসব খাদ্যকণা আটকে থাকে তা অপসারণ করে দাঁতকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে। কুলি করার আরও একটি চমকপ্রদ উপকারিতা এই যে, তা মুখের মাংসপেশিকে শক্ত রাখে। মুখের সজীবতা ও উজ্জ্বলতা রক্ষা করে এবং চেহারাকে পরিপাটি রাখে। শরীরচর্চা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে কুলি করা শরীরচর্চার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কুলি করার সময় যদি মুখের মাংসপেশিকে যথাযথভাবে সঞ্চালন করা হয়, তাহলে তা মানসিক প্রশান্তি অর্জনে যথেষ্ট সহায়তা করে। একদল চিকিত্সকের সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, যারা নিয়মিত অজু করে তাদের অধিকাংশেরই নাক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং সব ধরনের ধুলা-ময়লা ও রোগ জীবাণু থেকে মুক্ত থাকে। এ কথা সর্বজনবিদিত, নাকের ভেতরের অংশ এমন এক স্পর্শকাতর জায়গা, যেখানে বহু ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও রোগ জীবাণু বৃদ্ধি করে। কিন্তু জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ, নাক ঝেড়ে পরিষ্কার করা এবং নাকের ভেতরের অংশ নিয়মিত ধুইয়ে ফেলার কারণে নাকের ভেতরের অংশ সব ধরনের রোগ ব্যাধি এবং জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকে। এতে পুরো শরীর পরিপূর্ণ সুস্থ থাকে। এভাবে নাক ধোয়ার ফলে মানবদেহের নাকের রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে না। মুখমণ্ডল ও দু’হাতের কনুই পর্যন্ত ধোয়ার মধ্যে বড় ধরনের উপকারিতা রয়েছে। এতে শরীরের ওই অংশ থেকে ধুলা-ময়লা ও রোগ জীবাণু অপসারিত হয়। ত্বকের উপরিভাগ থেকে ঘাম দূরীভূত হয়। অনুরূপভাবে ত্বককে সেসব তৈলাক্ত উপাদান থেকে পরিচ্ছন্ন করে, যা ত্বকের মধ্যে ‘লালাগ্রন্থি’ ছড়িয়ে দেয়। কেননা এ অবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শরীরের রোগ জীবাণু বৃদ্ধি করে। দু পা খুব ভালো করে ঘসে মেজে ধুয়ে নিলে শরীরে এক ধরনের আরাম ও প্রশান্তির অনুভূতি আসে। বিষয়টি এমন যে, মানুষের দু’পায়ের মধ্যে পুরো দেহের ব্যবস্থাপনা প্রতিফলিত হয় এবং অজু করার সময় যখন পানি দিয়ে পা দুটি ভালোভাবে ঘসে মেজে ধোয়া হয়, তখন মনে হয় যেন শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধোয়া হচ্ছে। পরম প্রশান্তি ও আরামের অনুভূতি প্রকৃত তাত্পর্য, যা প্রকৃতপক্ষে একজন মুসলিম অজুর পর পরই উপলব্ধি করতে পারেন।
মানবদেহের দু হাত ও বাহুর উপরের দিক এবং দু’পা ও হাঁটুর নিচের দিকে দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চেয়ে রক্ত চলাচলের গতি কিছুটা দুর্বল থাকে। মানবদেহের রক্ত সঞ্চালনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ‘কলব’ বা হৃিপণ্ড থেকে এগুলোর অবস্থান দূরত্বের কারণে। এ কারণে প্রত্যেক অজুর সময় এ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো যত্ন সহকারে ঘসে মেজে ধোয়া হলে রক্ত সঞ্চালনে তা সহায়কের ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি দেহ-মনের প্রশান্তি এবং প্রফুল্লতাও বৃদ্ধি পায়। আধুনিক চিকিত্সা বিজ্ঞানের গবেষণায় এ কথাও প্রমাণিত হয়েছে, সূর্যের আলোকরশ্মির প্রভাবে বিশেষত বেগুনি রশ্মি বিচ্ছুরণের ফলে ত্বকের ক্যান্সার হয়। নিয়মিত অজুর ফলে ত্বকের উপরিভাগ স্থায়ীভাবে আর্দ্র ও সিক্ত থাকার কারণে এর প্রভাব ও কার্যকারিতা প্রতিরুদ্ধ হয়। বিশেষত দেহের উন্মুক্ত অংশে ত্বকের উপরিভাগ ও অভ্যন্তর ভাগে সূর্যরশ্মির ক্ষতির প্রভাব থেকে মানবদেহকে রক্ষা করে।
অজুর ফলে মানুষের শরীর ও মন থেকে গোনাহের চিহ্ন এবং প্রভাব মুছে যায়। অজু করা লোক গোনাহ থেকে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন হয়ে আল্লাহর ইবাদত— নামাজের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
সুতরাং যার অজু যতটা পূর্ণাঙ্গ ও পুণ্যে পরিণত হবে, তার ঔজ্জ্বল্য ততটা ব্যাপক ও উদ্ভাসিত হবে। আর তা সম্ভব হবে যদি অজু করার সময় গভীর মনোযোগ ও যত্ন সহকারে প্রতিটি কাজ করা হয়, নিয়ম-নীতির প্রতি পুরোপুরি লক্ষ্য রাখা হয় এবং কোথাও কোনো অসম্পূর্ণতা বা ত্রুটি-বিচ্যুতি না থাকে সেদিকে সচেতন ও সতর্ক থেকে অজু করতে হবে।