কুরআনুল কারিম আল্লাহর কালাম, যা তিনি নাজিল করেছেন তাঁর প্রিয় বান্দা আমাদের প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর। এ কিতাব নাজিল করা হয়েছে মানবজাতির হিদায়াত ও ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য। নিকট অতীতেও দেখা যেত ফরজ মনে করেই পারিবারিকভাবে সব সদস্যকে বাধ্যতামূলক কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষাখতে হতো। ধনী-গরিব সবাই এটা মেনে চলতে চেষ্টা করত। এতদসত্ত্বেও বর্তমানে কুরআন তিলাওয়াতের যে চিত্র আমাদের সামনে রয়েছে, তাতে সে দিন বেশিক্ষা দূরে নয়, যে দিন দেখা যাবে কিছু দ্বীনদার ও আলিম পরিবার ছাড়া এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না,
যে পরিবারের সব সদস্য বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে। বর্তমানে শতকরা হিসাবে কতজন সহিহ শুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে, তার ওপর জরিপ চালালে যে চিত্র আসবে তা হবে হতাশাব্যঞ্জক। আসমানি গ্রন্থগুলোর মধ্যে একমাত্র কুরআনুল কারিম না বুঝে শুধু তিলাওয়াতই নয়,শ্রবণ করলেও ছাওয়াব পাওয়া যায়।
এর অর্থ এ নয় যে,কুরআন বুঝে পড়ার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি। কুরআনের আলিমের বড়ই অভাব। কুরআন বোঝার অনুভূতি সে তো আনন্দের বিষয়। কিন্তু প্রশ্ন সবার পক্ষে কি তা সম্ভব? আর কতটুকু বুঝতে হবে? কিভাবে বুঝতে হবে? অনুবাদার্থ বা অনূদিত তাফসির অধ্যয়ন করলেই কী এ চাহিদা মিটবে? এককভাবে নিজে নিজে তা চর্চা করলে কি কুরআনের গবেষক হওয়া যাবে? চিকিৎসা বিজ্ঞান বা প্রকৌশল বিজ্ঞানসহ যেকোনো বিষয়ের মূল গ্রন্থ অধ্যয়নের যোগ্যতা অর্জন না করে সে সব বিষয়ের অনূদিত গ্রন্থগুলো ভালোভাবে পড়ে নিলেই কি একজন চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হওয়া যায়? শিক্ষাকের তত্ত্বাবধানে হাতে-কলমে অপারেশন করা না শিক্ষাখলে রোগীর কী অবস্থা হবে? প্রশিক্ষাণপ্রাপ্ত নয় এমন কোনো ড্রাইভারকে কি সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ গাড়ি চালাতে দেবেন? কিন্তু আফসোস, অনেকেই কুরআন ও হাদিসের েেত্র উস্তাদের তত্ত্বাবধানে বা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ ছাড়াই নিজে নিজে মুফাসসির ও মুহাদ্দিস এমনকি মুজতাহিদ হওয়ার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করছেন। মনে রাখতে হবে, কুরআন-হাদিস বুঝতে আগ্রহী সবাইকে অবশ্যই আরবি ভাষাসহ সংশ্লিষ্ট সব সহায়ক বিষয় সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানার্জন করতে হবে। কুরআন বোঝার উসুল (মূলনীতি) সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে, অন্যথায় নিজেও বিভ্রান্ত হবেন অন্যকেও বিভ্রান্ত করা হবে। তবে সঠিক পদ্ধতিতে কুরআন বোঝার মূলনীতি অনুসরণ করে যদি কুরআনুল কারিম বুঝে অধ্যয়ন করা যায়, তাহলে এতে রয়েছে না বুঝে কুরআন তিলাওয়াত করার চেয়ে অনেক অনেক বেশিক্ষা ছওয়াব। এখানেই হলো কুরআন না বুঝে পড়া আর বুঝে পড়ার মাঝে পার্থক্য। উভয়টাতেই ছাওয়াব রয়েছে, তবে যার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর ইরশাদ হলো, অনুবাদার্থ ‘এবং তিনি প্রত্যেক গুণীজনকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দান করবেন। হুদ : ৩
কুরআনের সংজ্ঞা : ড. সুবহী সালিহ কুরআনের সংজ্ঞায় বলেন,যে নামেই তার নাম করো না কেন, আল কুরআন হলো মুজিজা সংবলিত কালাম, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাজিলকৃত, মুসহাফসমূহে লিপিবদ্ধ, তার থেকে মুতাওয়াতির পদ্ধতিতে বর্ণিত, এর তিলাওয়াত ইবাদাত হিসেবে গণ্য। উসুলবিদ, ফকিহগণ এবং আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিশারদদের কাছে কুরআনের এ সংজ্ঞা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত। বিভিন্ন শব্দে সামান্য কমবেশিক্ষার মাধ্যমে প্রায় একই সংজ্ঞা উল্লেখ করেন ইবন তাইমিয়্যাহ, যুরকানি ও সায়্যিদ তানতাবী।এতে বুঝে পড়া না পড়ার কোনো শর্তারোপ করা হয়নি। আর এ মর্যাদা একমাত্র কুরআনের এক অনন্য বৈশিক্ষাষ্ট্য। অতএব না বুঝে কুরআন তিলাওয়াত করা যাবে এবং অবশ্যই এতে লাভও (ছাওয়াব) রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মুহাম্মাদ আবদুল আযীম যুরকানী বলেন, কুরআন নাজিলের তৃতীয় উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর মাখলুক কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে তার ইবাদত করবে, তিনি তাদেরকে তাঁর নৈকট্য দান করবেন, না বুঝে হলেও কুরআনের নিরেট শব্দ উচ্চারণে তাদেরকে আজর (ছাওয়াব) দেবেন। আর যদি তিলাওয়াতের সাথে বুঝ যোগ হয়, তাহলে তো তা হবে আজরের ওপর আজর প্রাপ্তি (যাকে আমাদের প্রবাদে বলা হয়, সোনায় সোহাগা)। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই যারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, সালাত কায়েম করে, আমি তাদেরকে যে রিজক দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করে এমন ব্যবসায়ের, যার কোনো য় নেই। এ জন্য যে, আল্লাহ তাদেরকে তাদের আমলের পূর্ণ আজর দান করবেন। ফাতির : ২৯-৩০।
তিলাওয়াত, কিরাআত ও তারতিল : কুরআন তিলাওয়াত সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, কারাআ/কিরাআত, তালা/তিলাওয়াত ও রাত্তালা/তারতিল। এগুলোর অর্থ কোনো সূত্র ছাড়াই বলা হয়েছে, বুঝে বুঝে পড়া। সবগুলোর একই অর্থ করা হয়েছে। অথচ আমার জানা মতে, প্রতিষ্ঠিত ও সর্বজনস্বীকৃত আরবি অভিধান গ্রন্থগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ রয়েছে। সংপ্তি পরিসরে ব্যাপক আলোচনা সম্ভব নয়। এগুলোর নির্যাস হলো, তাজবিদের সাথে সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করা। দ্রষ্টব্য : লিসানুল আরব, তাহজিবুল লুগাত, আল মুজামুল ওয়াসিত ইত্যাদি। অতএব কেউ যদি কোনো সূত্র ছাড়াই এগুলোর অর্থে বোঝার শর্ত জুড়ে দেয়, তবে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, কুরআন বা হাদিসে এ শব্দগুলোর অর্থ পাঠ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। একসময় মনে করতাম, কুরআন-হাদিস আরবি ভাষায় হওয়ায় আরবরা সেগুলো বোঝে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারাও সবাই কুরআন বোঝা তো দূরে থাক, তাজবিদ অনুযায়ী উচ্চারণও করতে পারে না। বিশ্বের মুসলমানদের সংখ্যার অনুপাতে আরবদের সংখ্যা কত? তা হলে বাকি আদমদের কী হবে? না বুঝে তিলাওয়াতের কারণে তাদের কোনো লাভ হবে না?
তিলাওয়াত ও কিরাআত (পাঠ) এক বিষয় এবং ফাহম (বোঝা) তাফাক্কুর (চিন্তা-ভাবনা) ও তাদাব্বুর (গবেষণা) ভিন্ন বিষয় : কুরআন তিলাওয়াত এক বিষয় এবং কুরআন বুঝা, চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কারণ, কুরআন দু’টি বিষয়ের সমষ্টির নাম। এক. শব্দাবলি, দুই. অনুবাদার্থ, ফাহম বা বোঝা, তাফসির বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ইত্যাদি। এখান থেকেই তিলাওয়াতের সম্পর্ক শব্দের উচ্চারণের সাথে। অপর দিকে বোঝা, চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করা এর সম্পর্ক সঠিক উচ্চারণে শব্দের অনুবাদার্থের সাথে। অতএব তিলাওয়াত, কিরাআত ও বোঝা এক বিষয় নয়। তিলাওয়াত ও কিরাআত এক বিষয় এবং বোঝা ভিন্ন বিষয়। এর প্রমাণ পাই আমরা কুরআনুল কারিম ও হাদিসে।
তিলাওয়াত ও তালিম: তিলাওয়াত ও তাফসির বা বোঝার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন। এর প্রমাণ কুরআন ও হাদিস থেকে পাওয়া যায়। কুরআনে তিলাওয়াত ও তালিম সম্পর্কে চারটি আয়াত রয়েছে বাকারা : ১২৯, ১৫১, আলে ইমরান : ১৬৪ জুময়া : ২। এ আয়াতগুলো থেকে জানা যায়, নাবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে চারটি দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এক. তিলাওয়াত, দুই. তাজকিয়া, তিন. তালিমুল কিতাব ও চার. হিকমাত-এর তালিম। এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, চারটি আয়াতেই প্রধান দায়িত্ব হিসেবে বলা হয়েছে তিলাওয়াত করা; আর তৃতীয় দায়িত্ব হিসেবে বলা হয়েছে তালিমুল কিতাব। বলতে পারেন, এ দু টি বিষয় এক ও অভিন্ন? এ দু টি বিষয় যদি এক ও অভিন্নই হতো তাহলে পুনরাবৃত্তির কী রহস্য? সবাই এ বিষয়ে একমত যে, এ দু টি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়, এক নয়।
তিলাওয়াতের সম্পর্ক উচ্চারণিক আর তালিমুল কিতাবের সম্পর্ক অনুবাদার্থ, ব্যাখ্যা ও তাফসিরের সাথে। সঠিক ও বিশুদ্ধ উচ্চারণ হলো তিলাওয়াত ও কিরাআত। অপর দিকে বোঝা, চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করা এর সম্পর্ক শব্দের অনুবাদার্থের সাথে। এর প্রতিটিই নেক আমল এবং ইবাদত হিসেবে গণ্য। অবশ্যই উভয়টির জন্য রয়েছে ছাওয়াব। তবে এটা বলা যেতে পারে যে, প্রথমটির (নিরেট তিলাওয়াত) ছাওয়াব হবে দ্বিতীয়টির (বোঝা ও গবেষণা করা) চাইতে কম। এবং দ্বিতীয়টির ছাওয়াব হবে প্রথমটির চাইতে বেশিক্ষা। আবার তিলওয়াতের বিভিন্নতার কারণে সেখানেও ছাওয়ারেব তারতম্য হবে যেমন বোঝার ক্ষেত্র এর তারতম্য হবে। উভয়টিরক্ষেত্রে যিনি যত বেশিক্ষা পারদর্শী হবেন তিনি তত বেশিক্ষা ছাওয়াবের অধিকারী হবেন। এ প্রসঙ্গে মাওলানা মুফতি মুহাম্মাদ শফি লিখেন, এখানে সর্বপ্রথম প্রণিধানযোগ্য যে, তেলাওয়াতের সম্পর্ক শব্দের সাথে এবং শিক্ষাদানের সম্পর্ক অর্থের সাথে। তেলাওয়াত ও শিাদান পৃথকভাবে বর্ণিত হওয়ার মর্মার্থ এই যে, কুরআন অর্থসম্ভার যেমন উদ্দেশ্য, শব্দসম্ভারও তেমনি একটি ল্য। এসব শব্দের তেলাওয়াত ও হেফাজত ফরজ ও গুরুত্বপূর্ণ এবাদত। এখানে আরো একটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, যারা মহানবী সা:-এর শিক্ষাষ্য ও সম্মোধিত ছিলেন, তারা শুধু আরবি ভাষা সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল ছিলেন না, বরং অলঙ্কারপূর্ণ আরবি ভাষার একেকজন বাগ্মী কবিও ছিলেন। তাদের সামনে কুরআন পাঠ করাই বাহ্যত তাদের শিাদানের জন্য যথেষ্ট ছিল, পৃথকভাবে অনুবাদ ও ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল না। এমতাবস্থায় কুরআন তেলাওয়াতকে পৃথক উদ্দেশ্য এবং গ্রন্থ শিাদানকে পৃথক উদ্দেশ্য সাব্যস্ত করার কী প্রয়োজন ছিল? অথচ কার্যেেত্র উভয় উদ্দেশ্যই এক হয়ে যায়। চিন্তা করলে এ থেকে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উদ্ভব হয়। প্রথম এই যে, কুরআন অপরাপর গ্রন্থের মতো নয় যাতে শুধু অর্থসম্ভারের ওপর আমল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে এবং শব্দসম্ভার থাকে দ্বিতীয় পর্যায়ে; শব্দে সামান্য পরিবর্তন পরিবর্ধন হয়ে গেলেও তির কারণ মনে করা হয় না। অর্থ না বুঝে এসব গ্রন্থের শব্দ পাঠ করা একেবারেই নিরর্থক, কিন্তু কুরআন এমন নয়। কুরআনের শব্দের সাথে বিশেষ বিশেষ বিধিবিধান সম্পৃক্ত রয়েছে। মাআরিফুল কুরআন : ৬৪। অতএব বলা যায়, বুঝে পড়ার আগে বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শেখার গুরুত্ব অনেক বেশিক্ষা।
যথাযথ কুরআন তিলাওয়াত : যথাযথ কুরআন তিলাওয়াত সম্পর্কে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, অনুবাদার্থ, ‘যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে এবং তারা তার তিলাওয়াতের হক আদায় করে (যথাযথ) তিলাওয়াত করে তারাই এর ওপর ঈমান এনেছে; আর যারা তাকে অস্বীকার করেছে তারাই তিগ্রস্থ। বাকারা : ১২১।
এ আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে আবুল ‘আলিয়া আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, যার হাতে রয়েছে আমার প্রাণ তাঁর কসম! যথাযথ তিলাওয়াত হলো, এর হালালকে হালাল মানা, এর হারামকে হারাম মানা, যেভাবে আল্লাহ তা নাজিল করেছেন সেভাবে পাঠ করা, নির্ধারিত স্থান থেকে তার ভাষ্যে বিকৃতি না আনা এবং ব্যাখ্যায় অপব্যাখ্যা না করা। তাফসিরে তাবারি : ৪০৩ ইবন জারির তিলাওয়াতের হক আদায় করে তিলাওয়াত-এর অর্থ প্রসঙ্গে অন্যদের মতো উল্লেখ করেন যে, যথাযথ পাঠ করা। তাফসিরে তাবার :৫৬৯।যথাযথ পাঠের মূল ভিত্তি হলো সহিহ উচ্চারণে কুরআন তিলাওয়াত করা। আর উপর্য্ক্তু বিষয়গুলোর সব কিছুই নির্ভর করে বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের ওপর। আর তাই এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিশুদ্ধ উচ্চারণ ছাড়া কুরআনুল কারিমের সহিহ তিলাওয়াত যেমন সম্ভব নয়, তেমনি এর গবেষণাও সম্ভব নয়।
এখন প্রশ্ন হলো কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শেখার সময় অর্থ শেখা হয় না। বিশুদ্ধ উচ্চারণ শেখানো হয়। বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিম সন্তান কুরআনের হাফিজ হচ্ছে সহিহ তিলাওয়াতের মাধ্যমে। সালাত আদায়ের জন্য সব মুসলিমকে কিছু হলেও কুরআনের সূরা মুখস্থ করতে হয়। আবার মুসলিম মাত্রই কুরআন তিলাওয়াত শেখে। তা হলে এই না বুঝে কুরআন তিলাওয়াতের কি কোনো গুরুত্ব নেই? অবশ্যই আছে। কারণ কুরআন তিলাওয়াত হলো একটি ইবাদত। আর ইবাদতের জন্য অবশ্যই সহিহ তিলাওয়াত শিক্ষাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে মাওলানা মুফতি মুহাম্মাদ শফি লেখেন, ‘অর্থ না বুঝে কুরআনের শব্দ পাঠ করা নিরর্থক নয়, সওয়াবের কাজ। এ কথা বলা কিছুতেই সঙ্গত নয় যে, অর্থ না বুঝে তোতাপাখির মতো শব্দ পাঠ করা অর্থহীন। বিষয়টির প্রতি বিশেষ জোর দেয়ার কারণ এই যে, আজকাল অনেকেই কুরআনকে অন্যান্য গ্রন্থের সাথে তুলনা করে মনে করে যে, অর্থ না বুঝে কোনো গ্রন্থেও শব্দাবলি পড়া ও পড়ানো বৃথা কালপক্ষে ণ বৈ কিছুই নয়। কুরআন সম্পর্কে তাদের এ ধারণা ঠিক নয়। কারণ, শব্দ ও অর্থ উভয়টির সমম্বিত আসমানি গ্রন্থের নামই কুরআন। কুরআনের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা এবং তার বিধিবিধান পালন করা যেমন ফরজ ও উচ্চস্তরের ইবাদত, তেমনিভাবে তার শব্দ তেলাওয়াত করাও একটি স্বতন্ত্র ইবাদত ও সওয়াবের কাজ। মাআরিফুল কুরআন : ৬৪।
প্রতিটি হরফের উচ্চারণে ছাওয়াব প্রাপ্তি : কুরআন তিলাওয়াত একটি ইবাদত এবং নেক আমল। উম্মতের কল্যাণে নবীজী সা: সর্বদা কাজ করেছেন। উম্মতকে আমলের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। প্রয়োজনে বিভিন্নরূপক্ষে বিভিন্ন পন্থায় ছাওয়াব প্রাপ্তির কথা বলেছেন। তারই ধারাবহিকতায় কুরআন তিলাওয়াতের ছাওয়াবও বর্ণনা করেছেন যেন উম্মত এতে উৎসাহিত হয় এবং কুরআন তিলাওয়াতে মনোযোগী হয়। কুরআনের সাথে যেন তাদের একটি আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাসূলুল্লাল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘যে আল্লাহর কিতাবের (কুরআন) একটি হরফ উচ্চারণ করবে, তার জন্য রয়েছে একটি নেকি। আর একটি নেকি হবে দশ গুণ। আমি বলছি না যে, আলিফ লাম মিম একটি হরফ; তবে আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ ও মিম একটি হরফ। তিরমিজি : ২৯১০। হাদিসটির ব্যাখ্যায় প্রবন্ধকার একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করেছেন। ইন্দীয়গ্রাহ্য বা মুহকামাত এবং অতীন্দ্রিয় বা মুতাশাবিহাত বলেন, প্রথমটি বুঝে পড়তে হবে। দ্বিতীয় না বুঝে পড়লেও অরে অরে দশ নেকি। জানি না প্রবন্ধকার এমন ব্যাখ্যা কোথায় পক্ষে লেন। গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা তখনই সম্ভব যদি তা সাংঘর্ষিক না হয়। একটি হাদিসে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে কুরআনের একটি হরফ উচ্চারণ করবে তার জন্য একটি নেকি লিখা হবে। আমি বলছি না যে, আলিফ লাম মিম জা-লিকাল কিতাবু (একটি হরফ); তবে আলিফ, লাম, মিম, জাল, লাম ও কাফ (একেকটি পৃথক পৃথক হরফ)। তাবারানি, আল মুজামুল কাবির : ১৪৫৬৬। অন্য একটি হাদিসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যে আল্লাহর কিতাবের একটি হরফ উচ্চারণ করবে আল্লাহ তার জন্য একটি নেকি লিখে দেবেন। আমি বলছি না যে, বিসমিল্লাহ (পুরোটাই একটি হরফ;) তবে বা, সিন ও মিম (পৃথক পৃথক একটি হরফ)। বাইহাকি, শু আবুল ঈমান : ১৯২৭। এখানে বর্ণিত জালিকাবা বিসমিল্লাহকি অতীন্দ্রিয় যে এগুলোর সাওয়াব হবে না?
কেউ কেউ আবার এটাও মনে করতে পারেন যে, প্রশিক্ষাণকালীন সময় না বুঝে তিলাওয়াতের গুরুত্ব আছে এবং তখন নেকিও পাওয়া যাবে। কিন্তু শিক্ষাখে নেয়ার পর নেকির খাতা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই বলা যায়, কুরআন বোঝার যেমন গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি বিশুদ্ধ তিলাওয়াতেরও গুরুত্ব রয়েছে অপরিসীম। এমন কথা কখনোই বলা বা লেখা উচিত নয়, যা সাধারণ মুসলিমের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথ অনুসরণের তাওফিক দিন।