আরবি-অনারবি সব ভাষার মানুষের হিদায়াতের জন্য বিশ্বনবী সা:-এর কাছে দীর্ঘ তেইশ বছরেআরবি ভাষা ও বর্ণে নাজিল করা হয়েছে আল কুরআন। সহজ করে দিয়েছেন কুরআন তিলাওয়াত।আল্লাহ তায়াালা ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই নিশ্চিতভাবে আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি। অতঃপরআছে কি কেউ চিন্তাশীল বা উপদেশ গ্রহণকারী? (সূরা কামার : ১৭, ২২, ৩২, ৪০)। কুরআনেরসার্বিক হিফাজতের দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন স্বয়ং রাব্বুল আলামিন। তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘এর (কুরআন) সংরক্ষণ ও কিরায়াতের দায়িত্ব আমারই’ (সূরা কিয়ামাহ : ১৭)। তিনি আরোইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই আমি জিকর (কুরআন) নাজিল করেছি এবং অবশ্যই আমি এর হিফাজতকারী’ (সূরা হিজর : ৯)। তাই কখনো কুরআন তিলাওয়াতে ও উচ্চারণে বিকৃতি ঘটেনি এবং কিয়ামতপর্যন্ত নিশ্চিতভাবে এর কোনোই বিকৃতি ঘটবে না ।
কুরআনের উচ্চারণ বিকৃতির গুরুতর এক ফিতনা : কুরআনের তিলাওয়াত হতে হবে সহিহ ওবিশুদ্ধ উচ্চারণে। কেউ কোনো দিন কল্পনাও করেনি যে, সহজীকরণের নামে কখনো কুরআনেরপ্রতিবর্ণায়ন হবে। সর্বপ্রথম বিংশ শতাব্দীতে তুরস্কে ১৯২৩ সালে উসমানি খিলাফতেরপতনের পর সংস্কারের নামে মুস্তাফা কামাল কুরআন প্রতিবর্ণায়নের সূচনা করে। তার এপদক্ষেপ ছিল ইসলামের প্রতি সম্পূর্ণ হিংসাপ্রসূত। ইসলামের শি’আর (ঐতিহ্য) যেমনদাঁড়ি, নারীদের হিজাব, ইসলামি পোশাক এবং আরবি ভাষা ও হরফের বিরূদ্ধে বিভিন্নবিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে সে ইসলামি তাহজিব-তমাদ্দুন ধ্বংসের কার্যক্রম শুরু করে।সেগুলোর একটি ছিল আরবি বর্ণমালার পরিবর্তে ল্যাটিন বর্ণে কুরআনের প্রতিবর্ণায়ন। এরপ্রতিবাদে বিশ্বব্যাপী খিলাফত আন্দোলন শুরু হলেও তাকে থামানো যায়নি। তবে কুরআনেরপ্রতিবর্ণায়নের বিষয়টি কেউ মেনে নেয়নি।
পরে নিখিল ভারতে হিন্দি, নাগরি, গুজরাটি ও তামিল বর্ণে কুরআন লিখনের বিষয়টি সামনেআসে। তখন ভারতীয় আলেমদের প্রচণ্ড বিরোধিতায় তা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সম্ভবত সত্তরেরদশকে বাংলা উচ্চারণে উচ্চারণ কেন্দ্রিক কুরআন বিকৃতির গুরুতর এ ফিৎনা শুরু হয় ।গবেষণা ও খোঁজখবর নিয়ে দেখা যায়, শুধু বাংলাদেশ নয়, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ এশীয়দেশগুলোর পাশাপাশি ইউরোপের কোনো কোনো দেশেও আঞ্চলিক বর্ণে কুরআন প্রতিবর্ণায়নেরনামে কুরআন বিকৃতি শুরু হয়। ‘ইংরেজি উচ্চারণে কুরআন’-এর সাথে নতুন মাত্রা যোগকরেছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ডিজিটাল কুরআনের ওয়েবসাইট খোলার পরিকল্পনাবাস্তবায়নাধীন। সেখানে মূল আরবির সাথে বাংলা ও ইংরেজি বর্ণমালায় কুরআনেরপ্রতিবর্ণায়ন দেয়া হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় আলেমদের মতামতগ্রহণ করেছে। তারা নাকি বাংলা, ইংরেজি প্রতিবর্ণায়নকে কুরআন তিলাওয়াতের সহায়ক(?) হিসেবে উল্লেখ করে এর পক্ষে মত দিয়েছেন।
বাংলা-ইংরেজি প্রতিবর্ণায়নে কুরআন লেখার কুপ্রভাব : দ্বীন সম্পর্কে জানা, কুরআনতিলাওয়াত ও বোঝার েেত্র মুসলমানদের আগ্রহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সত্যিইআশাব্যঞ্জক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সবাই ঝুঁকছে বাংলা উচ্চারণে কুরআনের দিকে।এতে কুরআন তিলাওয়াতের হক আদায় হচ্ছে কি না, এর প্রতি কারো ভ্রক্ষেপ নেই? বিভিন্নপ্রকাশক নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী তথাকথিত প্রতিবর্ণায়নের মাধ্যমে তাদের ভাষায় ‘বাংলাউচ্চারণসহ’কুরআন প্রকাশ করতে শুরু করেছে। তিক্ত হলেও সত্য এতে যেমন কিছু আলেম(?)প্রতিবর্ণায়নে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন, তেমনি আবার উচ্চারণ বিশুদ্ধ হওয়ারসার্টিফিকেটও দিচ্ছেন। অবশ্য কেউ বলেছেন, ৮৫ ভাগ উচ্চারণ বিশুদ্ধ হতে পারে, শতভাগনয়। অথচ তারা যদি এমনটি না করে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতেন এবং জনগণকে এ বিষয়ে সতর্ককরতেন তাহলে প্রকাশকেরা এককভাবে এমন পদক্ষেপ নিতে চিন্তা করতেন। এর সুদূরপ্রসারীকুপ্রভাব হিসেবে দেখা যায়।
ক. লেখালেখিতে নিজ নিজ জ্ঞান অনুযায়ী বাংলা ও ইংরেজি বর্ণে কুরআনের আয়াত ব্যবহার।খ. সরকারি ও বেসরকারি পাঠ্যপুস্তকেও দেখা যায় এর ব্যাপক প্রয়োগ। গ. নোট বুক, গাইড, ডায়রি, ফুটপাথ ও বাসে বিক্রির উদ্দেশ্যে প্রণীত বিভিন্ন ধরনের বই, নামাজ শিা, পাঞ্জসূরা, ওজিফা এমনকি বিভিন্ন যানবাহন বাস, ট্রাক, টেম্পো ইত্যাদিতে কুরআনের আয়াতও দোয়া দরুদের বিকৃত উচ্চারণের ছড়াছড়ি। ঘ.সর্বোপরি অমুসলিম তথা ইসলামবিদ্বেষী মহলকুরআন সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাবে। সুযোগ পাবে মুসলমানদের মন থেকে কুরআনেরআজমাত ও সম্মান মুছে ফেলার ল্েয ষড়যন্ত্র ফাঁদার। আমার জানা মতে,পশ্চিমা জগতেরকিছু বুদ্ধিজীবী এতে উৎসাহ জোগাচ্ছেন। উদ্দেশ্য, এভাবে বিভিন্ন ভাষার বর্ণে তথাকথিতকুরআনের মাধ্যমে মূল কুরআন থেকে মুসলিম জনগণকে বিচ্যুত করা ।
বাংলা ও ইংরেজি বর্ণে কুরআন ব্যবহারকারীরা ভেবে দেখলেন না আরবি বর্ণ ছাড়া অন্য কোনোবর্ণে কুরআন লেখা আদৌ সম্ভব কিনা? নুজুলে কুরআনের পনেরো শ’বছর পরে এমন কী প্রয়োজনদেখা দিলো যে, কুরআন স্থানীয় বর্ণে লিখতে হবে? কুরআন লেখার কি কোনো নীতিমালা নেই? এভাবে লিখিত সূরা বা আয়াতকে কুরআন বলা যাবে কি? এভাবে লিখিত সূরা বা আয়াত বা তাদেরভাষায় কুরআন পড়া হলে এতে সওয়াব হবে, নাকি হবে গুনাহ? এটা কি সরাসরি কুরআনের তাহরিফবা বিকৃতি নয় ? কুরআন কারিম আরবি ভাষা ও বর্ণে নাজিল করা হয়েছে : সব ভাষার স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালাআরবিকেই তার নাজিলকৃত সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী গ্রন্থ আল কুরআনের জন্য নির্বাচন করেছেন।কুরআন কারিম আরবি ভাষা ও বর্ণে নাজিল করা হয়েছে মর্মে আল্লাহ তায়ালা ১১টি আয়াতনাজিল করেছেন। যেমন তিনি ইরশাদ করেন, ‘সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়’ (শু‘আরা : ১৯৫)। তিনিআরো ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই আমি কুরআন নাজিল করেছি আরবি ভাষায়’ (ইউসুফ : ২)। ইবন ফারিস (মৃ: ৩৯৫ হিজরি) বলেন, ‘অবশ্যই এর বর্ণগুলো সেই নামগুলোর অন্তর্ভুক্ত যেগুলো আল্লাহআদমকে শিখিয়েছিলেন।’অতএব, এ বর্ণগুলোর উচ্চারণ বিকৃত হয় এমন প্রতিবর্ণায়ন কখনোইগ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এমনটি করা হলে প্রকারান্তরে এ কথাই বুঝানো হবে যে,আল্লাহতাঁর বান্দাদের জন্য কঠিন ভাষা ও বর্ণে কিতাব নাজিল করেছেন।কাক্সিত ও গ্রহণযোগ্য তিলাওয়াত :কুরআন নাজিল করা হয়েছে তারতিলের সাথে তিলাওয়াত ওআমল করার জন্য। তিলাওয়াত হলো কাক্সিত এক ইবাদত, যা সালাতের অন্যতম একটি রুকন।কুরআনই হলো একমাত্র আসমানি গ্রন্থ, যা না বুঝে তিলাওয়াত করলেও রয়েছে তার প্রতিটিহরফ উচ্চারণে ১০টি নেকি। তাই তিলাওয়াত হতে হবে সহিহ ও উচ্চারণিক বিকৃতমুক্ত।
হাদিসেও নবীজী সা: নিজে পড়ে পড়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় তিলাওয়াতকিভাবে করতে হবে। সাহাবা কিরাম রাসূলের অনুকরণে তাঁদের ছাত্রদের শিখিয়েছেন কুরআনতিলাওয়াত পদ্ধতি। আর এসব কিছুই অকাট্যভাবে প্রমাণ করে সহি শুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত ফরজে আইন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবীজী সা: তারতিল অনুযায়ী কুরআনতিলাওয়াতের সরাসরি নির্দেশ প্রদান করেন, ‘সুস্পষ্ট তারতিলের সাথে ধীরে ধীরে কুরআনতিলাওয়াত করুন’ (সূরা মুযযাম্মিল– ৪)
তারতিলের অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে রাগিব ইসফাহানী বলেন, ‘সহজ ও সঠিকভাবে মুখ হতে শব্দউচ্চারণ করা।’ইবন মানজুর বলেন, ‘কিরাআতে তারতিল হলো, ধীরেসুস্থে পড়া এবং হরফ ওহরকতের স্পষ্ট উচ্চারণ করা।’ হজরত আলী রা: তারতিলের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘হরফগুলোরযথাযথ সুন্দর উচ্চারণ ও বিরামস্থল সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জন হলো তারতিল।
হাদিস থেকেও আমরা নাবীজী সা:কিভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতেন জানতে পারি। ইমাম বুখারিহজরত কাতাদাহ থেকে বর্ণনা করেন, হজরত আনাস রা:’কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, নাবীজীসা:-এর কুরআন পাঠ কেমন ছিল? উত্তরে তিনি বলেন, ‘তাঁর পড়া ছিল টানা টানা। ইমামতিরমিজি ইয়া’লা ইবন মামলাক থেকে একটি বর্ণনায় বলেন, তিনি উম্মু সালামা রা:’কেতিলাওয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি হুযুর সা:-এর অনুকরণে কিছু আয়াত তিলাওয়াতকরে শোনান। তিনি এমন তিলাওয়াত করেন, যার প্রতিটি হরফ ছিল স্পষ্ট। হজরত আবদুল্লাহইবন মাসউদ এক ব্যক্তির তিলাওয়াত সংশোধন করে দেন।
উল্লিখিত আয়াত, হাদিস ও সাহাবির বর্ণনানুযায়ী বিশুদ্ধ ও তাজওয়িদ অনুযায়ী কুরআনতিলাওয়াত ফরজে আইন। আর তাই পরবর্তী সময়ে ইলমুল কিরায়াতের ইমামেরাও এ বিষয়ে স্পষ্টঘোষণা দিয়েছেন যে,তাজওয়িদের নিয়মকানুন অনুযায়ী অবশ্যই কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে।
হাফেজ ইবনুল জাজারি বলেন,‘নিঃসন্দেহে যেভাবে উম্মতের ওপর কুরআন বুঝা ও তারবিধিবিধান মেনে চলার মাধ্যমে ইবাদত ফরজ,তেমনিভাবে কুরআনিক শব্দাবলি ও হরফগুলোর ঠিকসেভাবে বিশুদ্ধ উচ্চারণও (অর্থাৎ তিলাওয়াত) ফরজ, যেভাবে কিরায়াতের ইমামরা বর্ণনাপরম্পরায় আরবি নবীর দরবার থেকে লাভ করেছেন। কোনো অবস্থাতেই তার বিরোধিতা করা যাবেনা এবং এটা বাদ দিয়ে অন্যটাও গ্রহণ করা যাবে না।’মুহাম্মাদ মাক্কী ইবন নাস্র বলেন, নবীজী সা:-এর যুগ থেকে আমাদের যুগ পর্যন্ত উম্মাতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলোতাজওয়িদসহকারে অর্থাৎ বিশুদ্ধ তিলাওয়াত ওয়াজিব। এ ব্যাপারে তাদের কেউ কখনো দ্বিমতপোষণ করেননি। আর এটা সর্বাপো শক্তিশালী একটি দলিল।