মাতৃভাষায় কুরআন চর্চা

th
ভাষা আল্লাহর দান। আর মাতৃভষা আল্লাহর সেরা দান। ইসলামে এর মর্যাদা তুলনাহীন। মাতৃভাষার গুরুত্ব তুলে ধরে আল্লাহপাক প্রত্যেক জাতির কাছে সে জাতিরই নিজস্ব ভাষায় একজন করে রাসূল প্রেরণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘আমি সব রাসূলকে তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার করে বুঝতে পারে।’ (সূরা ইব্রাহিম-৪)।
আসমানি কিতাব মানবজাতির মহামুক্তির সনদ। তাই এর ভাব ভাষা যাতে সহজে অনুধাবন করা যায়, সে জন্য এ কিতাবগুলো স্বগোত্রীয় ভাষায় নাজিল করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়ের মানদণ্ড, যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে।’ (সূরা হাদীদ, ২৫)। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, হজরত মূসা আ:-এর স্বগোত্রীয় ইসরাঈলদের মাতৃভাষা ছিল হিব্রু। তাই তাঁর প্রতি তাওরাত নাজিল হয় হিব্রু ভাষায়। হজরত দাউদ আ: বনি ইসরাঈলদের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যে গ্রিক ভাষার প্রচলন ছিল বেশি। তাই তার প্রতি যাবুর কিতাব নাজিল হয় গ্রিক ভাষায়। হজরত ঈসা আ: বনী ইসরাঈলদের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি যেখান থেকে দাওয়াতের সূচনা করেছিলেন, সেখানে সাধারণ মানুষের ভাষা ছিল সুরিয়ানি। তাই ঈসা সা:-এর প্রতি ইঞ্জিল কিতাব নাজিল হয় সুরিয়ানি ভাষায়। (ড. আব্দুর রহমান আনওয়ারী : মাতৃভাষা আন্দোলন ও ইসলাম, পৃ. ৪৪)।
অনুরূপভাবে মহানবী হজরত সা:-এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। তিনি যেখান থেকে দাওয়াতের সূচনা করেছিলেন, সে আরববাসীদের মাতৃভাষাও ছিল আরবি। তাই রাসূল সা:-এর প্রতি যে কিতাব নাজিল হয়, তার ভাষাও আরবি। যাতে আরববাসীরা আল কুরআনের সঠিক মর্মার্থ সহজে উপলব্ধি করতে পারে। আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি একে আরবি ভাষায় কুরআনরূপে নাজিল করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার।’ (সূরা ইউসূফ.২)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আমি একে করেছি কুরআন, আরবি ভাষায়, যাতে তোমরা বুঝতে পার।’ (সূরা যুখরূপ-৩)।
আল কুরআন যদি আরবি ভাষায় নাজিল না হয়ে অন্য কোনো ভাষায় নাজিল হতো, তবে আরববাসীরাই প্রথমে এর বিরোধিতায় নেমে পড়ত। তারা বলত, আমরা হলাম আরবিভাষী আর কুরআন নাজিল হলো অন্য ভাষায়, সুতরাং আমরা একে কেমনে বুঝব? অন্তর্যামী আল্লাহ পাক এ কথাটাই বর্ণনা করেছেন এভাবে- ‘আমি যদি অনারব ভাষায় কুরআন নাজিল করতাম, তবে অবশ্যই তারা বলত, এর আয়াতগুলো পরিষ্কার ভাষায় বিবৃত হয়নি কেন? আশ্চর্য, কিতাব অনারব ভাষায় আর রাসূল হলেন আরবিভাষী।’ (সূরা হা-মীম-সাজদা-৪৪)।
কুরআন হলো বিশ্ববাসীর মুক্তির পয়গাম, মুসিলম উম্মার শ্রেষ্ঠ সংবিধান। তাই একে বোঝার জন্য দরকার নিজস্ব ভাষায় চর্চা করার। কুরআন মাতৃভাষায় হৃদয়ঙ্গম করতে না পারলে ইবাদতের স্বাদ পেতে, কুরআনের হিদায়েত পেতে ও আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরিতে বিলম্ব হয়। তাই তো যথা নিয়মে কুরআন পাঠ করার নির্দেশ এসেছে। আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি যাদেরকে কুরআন দান করেছি যারা তা যথাযথভাবে পাঠ করে, তারাই তৎপ্রতি বিশ্বাস করে, আর যারা তা অবিশ্বাস করে, তারাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সূরা বাকারা-১২১)।
মূলত মানুষ, কুরআন ও ভাষা একই সূত্রে গাঁথা। মানুষই হলো এ পৃথিবীর আসল মেহমান, মানব জীবনের পথনির্দেশক হলো কুরআন, একে যাতে বুঝতে পারা যায়, এ জন্য আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা জ্ঞান। এ ভাষা জ্ঞান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ দান। বলা হয়েছে, ‘দয়াময় আল্লাহ, যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ এবং তাকে শিক্ষা দিয়েছেন বয়ান।’ (সূরা রাহমান-৩.৪। বয়ান বলতে সব বস’র নামসমূহ। কারো মতে অনেক ভাষায় কথা বলা। (আলুসী, রুহুল মাআনী, ১৪ খণ্ড, পৃ-৯৯)।
রাসূল সা:-এর কাছে ভিন্নভাষী কোনো লোক এলে তিনি দোভাষী নিয়োগ করতেন। যাতে তাকে সহজে দ্বীন বুঝানো যায়। মুক্তির অমিয় বাণী কুরআনকে উপলব্ধি করার তাগিদে বিভিন্ন ভাষায় কুরআন অনূদিত হয়েছে। অনারবি ভাষার মধ্যে সর্ব প্রথম ফার্সি ভাষায় কুরআন অনুবাদ করা হয়। পারস্যবাসীর অনুরোধে হজরত সালমান ফার্সি রা: ফার্সি ভাষায় সূরা ফাহিতা অনুবাদ করেন। (ইমাম সারখসী, মারসুত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৭)। আর অনারবি ভাষায় সর্ব প্রথম কুরআনের তাফসির করা হয় হাবশী ভাষায়। হজরত জাফর ইবনে আবী তালিব রা: নাজ্জাসির দরবারে সূরা মারইয়াম পাঠ করে হাবশী ভাষায় তার তাফসির করেছিলেন। কারণ নাজ্জাসির মাতৃভাষা ছিল হাবশী।
আর বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম কুরআন অনুবাদ করেন উত্তরবঙ্গের প্রাচীন জনপদ রংপুর জেলার খ্যাতিমান মহাপুরুষ মৌলভী আমীর উদ্দিন বসনিয়া। ১৮০০-১৮০১ খ্রি: মাঝামাঝি তিনি কুরআনুল কারিমের আমপারার কাব্যানুবাদ রচনা করেন। এটাই বাংলা ভাষায় রচিত কুরআনের প্রথম বঙ্গানুবাদ। (ড. মুজীবুর রহমান, বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা, পৃ. ১৭)। তার এ বঙ্গানুবাদের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চার দ্বার উন্মোচিত হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় কুরআনের মর্ম উপলব্ধিকরণ ও কুরআন চর্চাকে আরো বেগবান করে তোলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক টাঙ্গাইল জেলার আদিবাসী মাওলানা নঈমুদ্দীন সাহেব। তিনি বাংলা ভাষায় আল কুরআনের সংক্ষিপ্ত তাফসির রচনা করেন। যা সপ্তম খণ্ড ১৮৮৭ খ্রি: প্রকাশিত হয়। তবে পূর্ণাঙ্গরূপে বাংলা ভাষায় আল কুরআনের সংক্ষিপ্ত টীকা সংবলিত অনুবাদ রচনা করেন এককালীন ময়মনসিংহ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গিরিশচন্দ্র সেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর প্রচেষ্টা চালিয়ে (১৮৮১-১৮৮৬ খ্রি.) তিন খণ্ডে পূর্ণাঙ্গরূপে কুরআনের বঙ্গানুবাদ করেন। (ড. মুহাম্মদ আব্দুর রহমান আনওয়ারী; তাফসিরুল কুরআন উৎপত্তি ও এর বিকাশ. পৃ. ৪০৯)।
বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চার ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশংসনীয়। মানুষের কাছে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের মানসে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক বাংলা ভাষায় অনূদিত তাফসিরে মা আরিফুল কুরআন, আহকামুল কুরআন, তাফসিরে মাযহারী, তাফসিরে মাজেদী প্রভৃতি তাফসির গ্রন’ এবং অন্য প্রকাশনায় প্রকাশিত তাফহীমুল কুরআন ও ফী জিলালিল কুরআন; খুবই সমাদৃত।
আল কুরআনের জ্ঞান লাভে বাংলা ভাষায় অনূদিত এসব গ্রন’ যেন বাংলাভাষী মানুষের কাছে অক্ষয় পিরামিড। যা আদর্শ সমাজ গঠনের গতিকে তরান্বিত করতে বিরাট মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।
==০=

Related Post