হাদীসের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ

হাদীস :

বুখারী শরীফ

বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ

  • মূল বক্তব্য হিসাবে হাদীস তিন প্রকার:

১) কাওলী হাদীস: রাসূল (সা.) এর পবিত্র মুখের বানীই কাওলী হাদীস।

২) ফিলী হাদীস: যে কাজ রাসূল (সা.) স্বয়ং করেছেন এবং সাহাবীগণ তা বর্ণনা করেছেন তাই ফিলী হাদীস।

৩) তাকরীরী হাদীস: সাহাবীদের যে সব কথা ও কাজের প্রতি রাসূল (সা.) সমর্থন প্রদান করেছেন তাই তাকরীরী হাদীস।

  • রাবীদের (বর্ণনাকারী) সংখ্যা হিসেবে হাদীস তিন প্রকার:

     ১।খবরে মুতাওয়াতির: যে হাদীস এত অধিক সংখ্যক রাবী বর্ণনা করেছেন যাদের মিথ্যার উপর একমত হওয়া অসম্ভব।

   ২।  খবরে মাশহুর: প্রত্যেক যুগে অন্তত: তিনজন রাবী রেওয়ায়েত করেছেন, তাকে খবরে মাশহুর বলে,  তাকে মুস্তাফিজ ও বলে।

  ৩। খবরে ওয়াহেদ বা খবরে আহাদ: হাদীস  গরীব   আজিজ  এবং খবরে মাশহুর এ তিন প্রকারের হাদীসকে একত্রে খবরে আহাদ বলে, প্রত্যেকটিকে পৃথক পৃথকভাবে খবরে ওয়াহিদ বলে।

আযীয হাদীস: যে হাদীস প্রত্যেক যুগে     অন্তত: দুজন রাবী রেওয়ায়েত করেছেন, তাকে আযীয হাদীস বলে।

গরীব হাদীস: যে হাদীস কোন যুগে মাত্র একজন রাবী বর্ণনা করেছেন। তাকে গরীব হাদীস বলে।

  • রাবীদের সিলসিলা হিসেবে হাদীস তিন প্রকার

১। মারফু হাদীস: যে হাদীসের সনদ রাসূল (সা.) পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে মারফু হাদীস বলে।

২।  মাওকুফ হাদীস : যে হাদীসের সনদ সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে মাওকুফ হাদীস বলে।

৩।  মাকতু হাদীস: যে হাদীসের সনদ তাবেয়ী পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে মাকতু হাদীস বলে।

  • রাবী বাদ পড়া হিসাবে হাদীস দুই প্রকার

১।  মুত্তাছিল হাদীস: যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা সর্বস্তরে ঠিক রয়েছে কোথাও কোন রাবী বাদ পড়ে না তাকে মুত্তাছিল হাদীস বলে।

২। মুনকাতে হাদীস: যে হাদীসের সনদের মধ্যে কোন রাবীর নাম বাদ পড়েছে তাকে মুনকাতে হাদীস বলে।

  • মুনকাতে হাদীস তিন প্রকার:

১।  মুরসাল  হাদীস: যে  হাদীসে রাবীর নাম বাদ পড়া শেষের দিকে অর্থাৎ সাহাবীর নামই বাদ পড়েছে তাকে মুরসাল হাদীস বলে।

২।  মুয়াল্লাক হাদীস:  যে হাদীসের সনদের প্রথম দিকে রাবীর নাম বাদ পড়েছে অথার্ৎ সাহাবীর পর তাবেয়ী তাবে তাবেয়ীর নাম বাদ পড়েছে তাকে মুয়াল্লাক হাদীস বলে।

৩। মুদাল হাদীস: যে হাদীসে দুই বা ততোধিক রাবী ক্রমান্বয়ে সনদ থেকে বিলুপ্ত হয়  তাকে মু‘দাল হাদীস বলে।

  • বিশ্বস্ততা হিসেবে হাদীস তিন প্রকার

১। সহীহ হাদীস: যে হাদীসের বর্ণনাকারীদের বর্ণনার ধারাবাহিকতা রয়েছে,  সনদের প্রতিটি স্তরে বর্ণনাকারীর নাম, বর্ণানাকারীর বিশ্বস্ততা, আস্তাভাজন, স্বরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর কোন স্তরে তাদের সংখ্যা একজন  হয়নি তাকে সহীহ হাদীস বলে।

২।  হাসান হাদীস: সহীহ সবগুণই রয়েছে, তবে তাদের স্বরণশক্তির যদি কিছুটা দূর্বলতা প্রমাণিত হয় তাকে হাসান হাদীস বলে।

৩।  যায়ীফ হাদীস:  হাসান, সহীহ হাদীসের গুণসমূহ যে হাদীসে পাওয়া না যায় তাকে যায়ীফ হাদীস বলে।

  • হাদীসে কুদসী:

 যে হাদীসের মূল বক্তব্য আল্লাহ সরাসরি রাসূল (সা.)-কে ইলহাম বা স্বপ্ন যোগে জানিয়ে দিয়েছেন, রাসূল(সা.) নিজ ভাষায় তা বর্ণনা করেছেন তাকে হাদীসে কুদসী বলে।

  • মুদাল্লাছ হাদীস: যে হাদীসের সনদের দোষ ত্রুটি গোপন করা হয় তাকে মুদাল্লাছ হাদীস বলে।
  • সুনান: হাদীসের ঐ কিতাবকে সুনান বলা হয় যা ফিক্হ এর তারতীব অনুয়াযী সাজানো হয়েছে।
  • সুনানে আরবায়া: আবু দাউদ, নাসায়ী, তিরমীযী, ইবনে মাজাহ এই চারটি হাদীস গ্রন্থকে এক সাথে সুনানে আরবায়া বলা হয়।
  • মুসনাদ: হাদীসের ঐ কিতাবকে বলা হয় যা সাহাবায়ে কিরামের তারতীব অনুয়াযী লিখা হয়েছে।
  • সহীহাইন: বুখারী শরীফ ও মুসলীম শরীফকে এক সাথে সহীহাইন বলা হয়।
  • মুত্তাফাকুন আলাইহি: ইমাম বুখারী (র) ইমাম মুসলিম (র:)  উভয়ে একই সাহাবী হতে যে হাদীস স্ব-স্ব গ্রন্থে সংকলণ করেছেন তাকে মুত্তাফাকুন আল্লাইহি বলে।
  • জামে:  যে গ্রন্থে হাদীসসমূহকে বিষয় বস্তু অনুসারে সাজানো হয়েছে এবং যার মধ্যে আকাইদ (বিশ্বাস) ছিয়ার (ইতিহাস) তাফসির  (ব্যাখ্যা) আহকাম (বিধি-বিধান)  আদব (চরিত্র) ফিতান (কিয়ামত) রিকাক (পরকালমুখী) ও মানাকিব (সাহাবা চরিত) এ আটটি অধ্যায় রয়েছে তাকে জামে বলা হয় যেমন, জামে তিরমিযী
  • সনদ: হাদীস বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিকতাকে সনদ বলে।
  • মতন: হাদীসের মূল শব্দসমূহকে মতন বলে।
  • রেওয়ায়েত: হাদীস বর্ণনা করাকে রেওয়ায়েত বলে।
  • দেরায়েত: হাদীসের মতন বা মূল বিষয়ে আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে যুক্তির কষ্টিপাথরে যে সমালোচনা করা হয় তাকে দেরায়েত বলে।
  • রিজাল: হাদীস বর্ণনাকারীর সমষ্টিকে রিজাল বলে।
  • শায়খাইন: মুহাদ্দিসদের পরিভাষায় ইমাম বুখারী (র:)  ও মুসলিম (র:)-কে শায়খাইন বলে।
  • হাফিজ: যে ব্যক্তি সনদ ও মতনের সকল বৃত্তান্তসহ এক লক্ষ হাদীস মুখস্ত জানেন তাকে  হাফিজ বলে।
  • হুজ্জাত: যে ব্যক্তি সদন ও মতনের সকল   বৃন্তান্তসহ তিন লক্ষ্য হাদীস মুখস্ত জানেন তাকে হুজ্জাত বলে।
  • হাকিম: যে ব্যক্তি সনদ ও মতনের সকল বৃত্তান্তসহ সকল হাদীস মুখস্থ করেছেন তাকে হাকিম বলে।
  • সিহাহ সিত্তা: সিহাহ অর্থ বিশুদ্ধ, সিত্তা অর্থ ছয়। সিহাহ সিত্তা এর আভিধানিক অর্থ হল ছয়টি বিশুদ্ধ, ইসলামী পরিভাষায় হাদীস শাস্ত্রের ছয়টি নির্ভুল ও বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থকে এক কথায় সিহাহ্ সিত্তা বলা হয়।
  • সিহাহ সিত্তা হাদীস গ্রন্থগুলো এবং সংকলকদের নাম:

১। সহীহ বুখারী- আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ বিন ইসমাইল আল বুখারী (র:)- হাদীস সংখ্যা ৭৩৯৭

২। সহীহ মুসলিম – ইমাম মুসলিম বিন হাজ্জাজ (র:) হাদীস সংখ্যা- ৪০০০

৩। জামে তিরমিযী- আবু ঈসা মুহাম্মাদ বিন ঈসা আস সুলামী (র:) হাদীস সংখ্যা ৩৮১২

৪। সুনানে আবু দাউদ (র:) সুলাইমান বিন আশআছ (র:) হাদীস সংখ্যা ৪৮০০

৫।  সুনানে নাসায়ী  আহমদ বিন শুয়াইব  আল খুরাসানী (র:)  হাদীস সংখ্যা ৪৪৮২

৬। সুনানে ইবনে মাজাহ আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইয়াযিদ আল কাযভীনি (র:) হাদীস- ৪৩৩৮

  •  বেশি হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীগণ:

১।  হযরত আবু হুরায়রা (রা:) হাদীস সংখ্যা ৫৩৭৪টি। (মৃত্যু ৫৭হিজরী মৃত্যুকালীণ বয়স: ৭৮ বছর)

২।  হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) হাদীস সংখ্যা ২২১০টি। (মৃত্যু ৫৮ হিজরী মৃত্যুকালীণ বয়স: ৬৭ বছর)

৩। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) হাদীস সংখ্যা ১৬৬০ (মৃত্যু ৫৮ হিজরী মৃত্যুকালীণ বয়স: ৭১ বছর)

৪। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) হাদীস সংখ্যা ১৬৩০ (মৃত্যু ৭০ হিজরী মৃত্যুকালীণ বয়স: ৮৪ বছর)

৫। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা:) হাদীস সংখ্যা ১৫৪০ (মৃত্যু ৭৪ হিজরী মৃত্যুকালীণ বয়স: ৯৪বছর)

৬।  হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা:) হাদীস সংখ্যা ১২৮৬ (মৃত্যু ৯৩ হিজরী মৃত্যুকালীণ বয়স: ১০৩বছর)

৭।  হযরত আবু সাঈদ খুদরী হাদীস সংখ্যা ১১৭০ (মৃত্যু ৪৬ হিজরী মৃত্যুকালীণ বয়স: ৮৪ বছর)

৮। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (র:)  হাদীস সংখ্যা ৮৪৮ (মৃত্যু ৩২ হিজরী মৃত্যুকালীণ বয়স: ৬৫ বছর)

৯। হযরত আমর ইবনুল আস (র:)  হাদীস সংখ্যা ৭০০ (মৃত্যু ৬৩ হিজরী মৃত্যুকালীণ বয়স: ৮৮ বছর)

প্রসঙ্গ কথা

সকল প্রশংসা কেবল মহান আল্লাহ রাবুল আলামিনের, অসংখ্য দরূদ বিশ্ব মানবতার মহান শিক্ষক ও নেতা রাসূল পাক (সা.)  ও তাঁর বংশধরদের প্রতি এবং হাজার ও সালাম সে সব বীর মুজাহিদদের প্রতি, যারা যুগেযুগে আল্ল­াহর জমিনে আল্ল­াহর দ্বীনকে বিজয়ী করতে নিজেদের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন।

আমার প্রাণ প্রিয় জ্ঞান পিপাসু মুমিন মুত্তাকী ভাই এবং বোনেরা! আমি হাদীস শরীফের কতিপয় পরিভাষা আল্ল­াহর মেহেরবানীতে এই জন্য লিখার প্রয়োজন মনে করলাম যে, আমাদের অনেক বাংলাদেশী ভাই এবং  বোনেরা কুয়েতে বসবাস করছি, এদের ভিতর যারা আলেম তারা মাশা-আল্লাহ এ বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। কিন্তু যারা আলেম নন, কিন্তু কুরআন হাদীস পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে চান বিশেষ করে সেই সব ভাইয়েরা আশা করি অনেক উপকৃত হবেন। আমার প্রিয় রাসূল (সা.)-এর জন্য আমার ও আমার মা-বাবার জীবন উৎসর্গ হয়ে যাক। তিনি বলেছেন:

“আমি তোমাদের জন্য দুটি বস্তু রেখে গেলাম তোমরা যতদিন এ দুটি বস্তুকে আকড়ে থাকবে তোতদিন পথ ভ্রষ্ট হবে না। একটি হচ্ছেঃ আল্লাহর কিতাব আল-কুরআন, এবং অপরটি হচ্ছেঃ রাসুলের সুন্নাহ।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ! আমার এই ক্ষুদ্র হাদীসের খেদমতটুকু তখনই সার্থক হবে যখন আপনারা আহলে কুরআন এবং আহলে হাদীস হতে পারবেন। আল্লাহ পাকের দরবারে এই দোয়া কামনা করে শেষ করছি হে আমাদের মহান রব্ব তোমার দ্বীনের পথে আমাদের সকল প্রচেষ্টা কবুল করুন, আমিন।

Related Post