হিজরী বছরের নবম মাস হল পবিত্র রমযান। প্রত্যেক মুসলিমের জীবনে রমযানের গুরুত্ব অপরিসীম। রমযান হল পূণ্য অর্জনের শ্রেষ্ঠ মৌসুম। দীর্ঘ এক মাসের রোযা, তারাবীহ, তাহাজ্জুদ, কুরআন তেলাওয়াত, কুরআন অধ্যয়ন, কুরআনের দারস ও অন্যান্য নেক আমলের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন করে এবং সব ধরনের গুনাহ থেকে বিরত থেকে অর্জন করে হƒদয় ও আত্মার পরিশুদ্ধি। মাসজুড়ে তাকওয়ার অনুশীলনের মাধ্যমে তৈরি হয় বছরের বাকি দিনগুলো পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত থাকার যোগ্যতা। বান্দার এই অনুশীলনকে যথার্থ ও তার সংযমকে স্বার্থক করার জন্য প্রয়োজন যথাযথভাবে এ মাসের বন্দেগীগুলো আগ্রহের সঙ্গে সঠিকভাবে আদায় করা। এ লক্ষ্যেই রমযানকে সামনে রেখে রমযান থেকে শিক্ষাগ্রহণের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়েছে।
প্রথমে জেনে নেই দীর্ঘ একটি মাস এই প্রচণ্ড গরমের সিয়াম সাধনা করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমরা কি পাবো?
হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে: রোযাদারে প্রতিদান আল্লাহ নিজে দিবেন: রোযার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দিবেন, কেননা রোযা একমাত্র আল্লাহর জন্য। শুধু আল্লাহর ভয়েই বান্দা পানাহার থেকে বিরত থাকে। নইলে পৃথিবীর কোন শক্তি এমন আছে যা তাকে গোপনে এক ঢোক পানি পান করা থেকে বিরত রাখতে পারে? রোযাদার পিপাসায় কাতর হয়, ওযুর জন্য মুখে পানি নেয়, কিন্তু এক কাতরা পানি হলকের নিচে নামতে দেয় না। কার ভয়ে, কার মুহাব্বতে পান পানি পান করা হতে বিরত থাকে? একমাত্র আল্লাহ তাআলার ভয়ে, আল্লাহ তাআলার মুহাব্বতে। কেউ দেখছে না, কিন্তু আল্লাহ দেখছেন। কেউ জানছে না, কিন্তু আল্লাহ জানছেন। আহা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি এই অনুভূতি লাভ করতে পারতাম! এজন্যই তো রোযার প্রতিদান দিবেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। তাঁর শান অনুযায়ী। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বনী আদমের প্রতিটি আমলের প্রতিদান বহু গুণে বৃদ্ধি হতে থাকে, ১০ গুণ থেকে ৭০০গুণ, এমনকি আল্লাহ চাইলে তার চেয়েও বেশি দেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তবে রোযার বিষয়টি ভিন্ন। কেননা, রোযা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি স্বয়ং এর প্রতিদান দিব। বান্দা একমাত্র আমার জন্য পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ থেকে বিরত থাকে। রোযাদারের জন্য দু’টি আনন্দ : এক ইফতারের মুহূর্তে দুই রবের সঙ্গে সাক্ষাতের মুহূর্তে। আর রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও উত্তম।-(সহীহ মুসলিম হাদীস : ১১৫১)
পঙ্কিলতামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় ও সামগ্রিক কল্যাণ প্রত্যাশায় রমযানকে আমরা স্বাগতম জানাচ্ছি: ‘স্বাগতম মাহে রমযান’ পবিত্র মাহে রমযান আমাদের মাঝে সমাগত। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের সাওগাত নিয়ে আসছে মাহে রমযান। রমযান আসে আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে উৎসাহের আমেজ নিয়ে। বন্দেগীর অনুভূতি নিয়ে যে রমযান আসে, তা আমাদের জীবনকে তার প্রকৃত শিক্ষা থেকে সামান্যতম উজ্জীবিত করে। আমরা রমযান পালন করি এক ধরনের লোকাচারের মত। গতানুগতিক ধারায় ইফতার করি, সেহরী খাই। ফলে রমযান কেন্দ্রিক সমাজ গড়ার অঙ্গীকার আমাদের জীবনবোধকে আপ্লুত করে না। রমযান আমাদের কাছে যা প্রত্যাশা করে, সংযম কৃচ্ছতার মাধ্যমে বছরের অবশিষ্ট এগার মাস অনুশীলন বা প্রশিক্ষণ মত চলার যে শুদ্ধ চেতনা জাগ্রত করার কথা থাকে , তা বাস্তবে দেখা যায় না। রমজান শারীরিক ইবাদত, একই সাথে মানসিক ও রিপুকে সংযত করে একমাত্র আল্লাহর রাহে নিজকে কোরবান করার যে মানসিক প্রস্তুতি রমযান আমাদের শিক্ষা দেয়, তা আমাদের অতিআনুষ্ঠানিকতার ডামাডোলে হারিয়ে যায়। কারণ লক্ষ্য করলে দেখা যায়; রমযানের রোযা শেষ হওয়ার আগ থেকেই বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও প্রেক্ষাগৃহগুলো নতুন নতুন ছায়াছবি ও নাটকের বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকে। এগুলো না থাকলে হয়ত রোযাদারগণ আরো কিছুদিন প্রশিক্ষণকে ধরে রাখতে পারতো। রমযান আসে মানুষের ঈমান আমলকে বিশুদ্ধ করতে। এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদ আসে রোযাদারদেরকে আনন্দ দিতে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো: টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করে থাকে ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে এই নাটক সেই ছবি ইত্যাদি। রমযানের রোযা কি প্রতি বছর এই জন্যই আসে? না রমযানের পরে ঈদের আনন্দ একমাত্র তাদের জন্য, যারা রমযানের রোযাগুলো সঠিকভাবে রাখতে পেরেছে। এবং যার অন্তর এই সাক্ষ্য দেয় যে, রমযানের রোযা তার বিগত জীবনের গুনাহগুলো মাফ হয়েছে।
রোযার শিক্ষা যেমন সার্বজনীন, তেমনি সার্বক্ষণিকও। আমরা এটাকে গতানুগতিক রেওয়াজে রূপান্তর করছি। এই রোওয়াজকে ইবাদতের সঠিক মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ করা সম্ভব হলে রোযার শপথ আমাদের সমাজ বদলের নিয়ামক শক্তি হতে পারে। মহান আল্লাহ আমাদের সেই ভাবে রোযা রাখার তাওফীক দান করুন। আমীন