Originally posted 2013-09-01 06:21:58.
রবিউল আউয়াল মাসে আমাদের প্রিয় রাসুল, সর্বশেষ নবী এবং বিশ্ব মানবতার ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তিদূত হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর আগমন ঘটেছিল এবং এ মাসে তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যপ্রাপ্ত হন। মাসটি মুসলিম উম্মাহর জন্য একই সঙ্গে আনন্দের, আবেগের ও বেদনার। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রিয় রাসুল সম্পর্কে পবিত্র কোরআন শরীফে ঘোষণা করেছেন, ‘আমি আপনাকে সারা বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দুনিয়ায় সাম্য, শান্তি এবং সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে আমাদের শেষ নবী (সা.) চিরজাগরুক থাকবেন, চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। দয়ায়, ক্ষমায়, দানে, কর্মে, উদারতায়, মহত্ত্বে, জ্ঞানে, ধর্মে সাইয়িদুল মুরসালিন, প্রিয় নবী (সা.) সর্বকালের মানুষের সর্বোত্কৃষ্ট আদর্শ।
নবুওয়তির ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ মিশন হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর হাতে পূর্ণতা লাভ করে। তাঁর মিশনের লক্ষ্য ছিল জুলুমের অবসান ঘটিয়ে মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ কায়েম করা। যে লক্ষ্য নিয়ে তিনি দুনিয়ায় আবির্ভূত হন, ২৩ বছরে প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে তিনি তা কার্যকর করেন সার্থকভাবে। তাঁর উপস্থাপিত জীবন ব্যবস্থা ছিল মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে সবদিক দিয়ে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নিয়ামক ও চালিকা শক্তি। আল্লাহ্ তায়ালার নির্দেশনা অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ্ (সা.) সমাজে ন্যায়বিচারের মানদণ্ড সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। জাতি-ধর্ম, বর্ণ-শ্রেণী, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ধনী-দরিদ্র, প্রভু-ভৃত্য সবাইর ক্ষেত্রে বিচার সমান, এখানে বিন্দুমাত্র হেরফেরের অবকাশ ছিল না। দয়া বা পক্ষপাতিত্ব আল্লাহ্র বিধান কার্যকরকরণে কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ্ (সা.) তাঁর নিজস্ব ব্যাপারে কারও কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি (হাফিয আবু শায়খ ইস্ফাহানি, আখলাকুন্ নবী (সা.), পৃ. ১৯)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় মুহাজির ও আনসারদের ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করার যে মহত্ কর্ম সম্পাদন করেন তা মানব ইতিহাসের এক গৌরবদীপ্ত মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এটা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনন্য রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ। তিনি ঘোষণা করেন, ‘আল্লাহর পথে তোমরা দু’জন দু’জনে ভাই ভাই হয়ে যাও।’ সে সময় মুসলমানরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হন, এ ভ্রাতৃত্বের বিধান ছিল তার চমত্কার সমাধান। সামাজিকতা, মানবিকতা ও পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে দীন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে প্রত্যেকের হাদিয়া-উপঢৌকন কবুল করতেন এবং বিনিময়ে তাদেরও উপহার-উপঢৌকন দিতেন। রাজা-বাদশাহদের পক্ষ থেকে উপহার গ্রহণে তাঁর কোনো দ্বিধা ছিল না। মুসলমানদের বৈরী শক্তি পারস্য সম্রাট কর্তৃক প্রেরিত কিছু হাদিয়া তিনি কবুল করেন। আয়েলার শাসক রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে একটি শ্বেত খচ্চর উপহার দেন, প্রতিদানে তিনি তাকে একটি চাদর প্রদান করেন (জামে তিরমিযি, ৪খ,পৃ. ১৮৩; সহিহ বুখারি, ৪খ, পৃ.৩৬৩)।
মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) শিশুদের প্রতি অকৃত্রিম স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করতেন এবং সোহাগভরা ব্যবহার দিয়ে তাদের শিষ্ঠাচার শিক্ষা দিতেন। সফর থেকে গৃহে প্রত্যাবর্তনের সময় পথিমধ্যে যেসব শিশু পাওয়া যেত তিনি সওয়ারির অগ্র-পশ্চাতে তাদের তুলে নিতেন এবং পথে-ঘাটে খেলাধুলারত শিশুদের সঙ্গে দেখা হলে মুচকি হেসে সালাম দিতেন। আনাস ইব্ন মালিক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাইতে শিশুদের প্রতি অধিক স্নেহ প্রদর্শনকারী আমি আর কাউকেও দেখিনি। রাসুলুল্লাহ (সা.) ছোটদের ‘ইয়া বুনাইয়া’ অর্থাত্ ‘হে আমার প্রিয় পুত্র’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করে না আর বয়োজ্যেষ্ঠদের শ্রদ্ধা করে না সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়; হতভাগ্য ব্যক্তি ছাড়া কারও কাছ থেকে দয়া-মমতা ছিনিয়ে নেয়া হয় না; দয়াবানদের আল্লাহ দয়া করেন, তোমরা পৃথিবীবাসীদের প্রতি দয়া করো তাহলে আকাশবাসী (আল্লাহ তায়ালা) তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’
হজরত মোহাম্মদ (সা.) ইতিহাসে সর্বপ্রথম মহামানব যিনি হতভাগ্য দাস-দাসীদের প্রতি অনুপম সহানুভূতি ও মহানুভবতা প্রদর্শনপূর্বক দাসপ্রথা উচ্ছেদের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। দাসমুক্তির লক্ষ্যে তিনি সমাজে পরিবেশ গড়ে তোলেন; মানুষের মন-মেজাজকে তৈরি করেন; বঞ্চিত মানুষের জন্য অন্তরে মানবিক প্রেরণার জোয়ার সৃষ্টি করেন এবং দাসমুক্তিকে ইবাদতরূপে চিহ্নিত করেন। দাস-দাসীদের প্রতি ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে মানবিক আচরণের মাধ্যমে তিনি তাদের মনুষ্য পর্যায়ে উন্নীত করেন; পরিবারের সদস্যরূপে বিবেচনা করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উদ্ভাবিত ও প্রবর্তিত এ পদ্ধতি দাসপ্রথা উচ্ছেদের পথে কাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনে।
আজ মুসলমানদের একটি অংশ এখন মহানবী (সা.)-এর প্রদর্শিত পথ ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত। তারা কোরআন-হাদিসের শিক্ষা ভুলে গিয়ে পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানিতে লিপ্ত; ফলে বিশ্বের বিভিন্ন জনপদে বিস্তার লাভ করছে সন্ত্রাস ও অশান্তির দাবানল। মানুষের প্রতি মানুষের করুণা, মমতা, ভালোবাসা ও প্রীতির ধারা হচ্ছে ক্ষীণতর। নির্বিচারে একে অপরকে হত্যার মতো নৃশংসতায় লিপ্ত হয়েছে মানুষ। অনিয়ম ও নৈরাজ্যই যেন পরিণত হয়েছে নিয়মে। দুর্নীতি পরিণত হয়েছে সামাজিক আচারে। মানুষ হয়ে পড়েছে আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। অথচ মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) প্রবর্তিত ধর্মের শিক্ষা হচ্ছে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ। প্রিয়নবী (সা.) মানুষের দুঃখ-কষ্ট বুক পেতে নিয়েছেন। তিনি ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী। সমাজদেহ থেকে অত্যাচারের মূলোত্পাটন করেছেন তিনি। ইসলাম শান্তি, কল্যাণ ও মানবতার ধর্ম। এটাই প্রিয়নবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ। আজ বিশ্বজুড়ে চলছে অন্যায় যুদ্ধ ও ভয়াবহ নিপীড়ন। তাঁর কালজয়ী শিক্ষা এবং দিকনির্দেশনাই অনাচার, নিপীড়ন, হানাহানি ও নৈরাজ্যের দুঃসহ অবস্থা থেকে মানুষকে মুক্তিদান করতে পারে। মহানবী (সা.)-এর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আগ্রাসী শক্তি রুখে দেয়ার লক্ষ্যে মুসলিম উম্মাহর যুবক-তরুণদের সম্মিলিত প্রয়াস নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আল্লাহ তায়ালা তাওফিক দান করুন।