Main Menu

শিষ্টাচার ও সহনশীলতা

31160_388148162132_3537875_n[1]

বিশ্বের দেশে দেশে আজ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও চলমান রাজনৈতিক অসহনশীলতা এবং শিষ্টাচারবহির্ভূত রাজনৈতিক আচরণ দেখে আফসোস হচ্ছে। বিশেষ করে মুসলমানের দেশে। আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি শ্রেষ্ঠ জীব, যাকে আশরাফুল মাখলুকাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সে শ্রেষ্ঠত্বের কোনো আলামত পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। শ্রেষ্ঠত্বের আলামত খুঁজে পাওয়া বা আশা করা যেন ‘অরণ্য রোদন’ ছাড়া কিছু নয়। কারণ আল্লাহ তায়ালা এই আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীবের জন্য তিনি সেরা শিকও পাঠিয়েছেন। আমরা সে শিক থেকে শিা গ্রহণ না করে গোয়েবলস, ম্যাকিয়াভেলি, মুসোলিনি, হিটলার আর চেঙ্গিস খানের কাছ থেকে রাজনৈতিক শিা গ্রহণ করছি। আমাদের দেশসহ বিশ্বরাজনীতিতে আজ স্থান করে নিয়েছে গোয়েবলসের মিথ্যাচার, ম্যাকিয়াভেলির Double Standard নীতি, মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ, হিটলার আর চেঙ্গিস খানের হত্যাযজ্ঞ।

আমরা যারা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করছি, তাদের জীবনের সব দিক ও বিভাগ নিয়ে যার পথ অবশ্যই অনুকরণীয়, অনুসরণীয়, যার পথ অনুসরণ না করলে ঈমানের দাবি পূর্ণ হয় না বা মুসলমান থাকা যায় না, তিনি হচ্ছেন আমাদের, সব নবী-রাসূলগণের ও সব নেতার নেতা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও মহান শিক, আখেরি নবী মুহাম্মাদ সা:। আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ বিচার দিবসের প্রতি আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূল সা:-এর মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ’। সূরা আহজাব-২১।

রাসূল সা:-এর বাস্তব জীবনে রাজনৈতিক সহনশীলতা ও শিষ্টাচারের উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আমরা যারা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করি, তারা প্রায় সবাই জানি যে রাসূল সা: আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিতে তায়েফ গিয়েছিলেন। আর তায়েফবাসী তাঁর সাথে কী আচরণ করেছিল, তাও আমরা কম-বেশি সবাই জানি। তায়েফের বিভিন্ন গোত্রের সরদারদের কাছে রাসূল সা: দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে ফিরছিলেন। তায়েফবাসী তাঁর দাওয়াত কবুল করল না। তাঁকে সেখানকার সরদারেরা মক্কায় ফিরে যেতে বলল। তিনি মক্কার পথ ধরলেন। পথে তায়েফের সরদারদের লেলিয়ে দেয়া দুষ্ট ছেলেরা হইচই করে রাসূল সা:কে গালাগাল দিচ্ছিল আর পাথর ছুড়ে তাড়া করছিল। রাসূল সা:-এর সারা শরীর রক্তাক্ত জখম হলো। তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। তাঁর জুতা রক্তে জমাট বেঁধে গিয়েছিল। তিনি আর হাঁটতে পারছিলেন না। তায়েফ থেকে তিন মাইল দূরে মক্কার বাসিন্দা কাফের নেতাদের অন্যতম ওতবা, শায়বা ও রবিয়াদের আঙুরের বাগানে রাসূল সা: আশ্রয় নিয়ে একটি দেয়ালে হেলান দিয়ে আঙুরগাছের ছায়ায় বসে পড়লেন। রাসূল সা: দুঃখ ও বেদনা নিয়ে নিজের অমতার জন্য আল্লাহ তায়ালার সাহায্য কামনা করছিলেন।

রবিয়ার ছেলেরা রাসূল সা:কে চিনতে পেরে আত্মীয়তার সুবাদে তাদের খ্রিষ্টান কৃতদাস আদাসকে এক থোকা আঙুর দিয়ে বলল, লোকটিকে দিয়ে এসো। আদাস রাসূল সা:-এর হাতে আঙুর তুলে দিলেন। রাসূল সা: ‘বিসমিল্লাহ’ বলে খেতে শুরু করলেন। রাসূল সা: খাওয়ার শুরুতে যে বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন তা এর আগে আদাস আর কখনো কারো মুখে শোনেননি। তাই তিনি অবাক হয়ে রাসূল সা:-এর দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাসূল সা: জিজ্ঞেস করলেন তোমার নাম কী? তিনি উত্তর দিলে ‘আদাস’। রাসূল সা: প্রশ্ন করলেন, তুমি কোথাকার অধিবাসী? আদাস জবাব দিলেন, আমি ‘নিনোভার’ অধিবাসী। রাসূল সা: প্রশ্ন করলেন, তোমার ধর্ম কী? আদাস জবাব দিলেন, ‘ঈসায়ী’। রাসূল সা: বললেন, তুমি আল্লাহর পুণ্যশীল বান্দা হজরত ইউসুফ আ:-এর এলাকার অধিবাসী। আদাস জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি ইউসূফ আ:কে চেনেন? রাসূল সা: বললেন, তিনি আমার ভাই। তিনি ছিলেন নবী, আর আমিও নবী। এ কথা শুনে আদাস রাসূল সা:-এর মাথা, হাত ও পায়ে চুম্বন করলেন।

রাসূল সা: সামান্য স্বস্তি বোধ করছিলেন কিন্তু মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ। তিনি মক্কার পথ ধরে চলতে শুরু করলেন। ‘কারুনে মানায়েল’ নামক স্থানে পৌঁছলে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে জিবরাইল আ: পাহাড়ের ফেরেশতাদের সাথে নিয়ে হাজির হলেন। তাঁরা রাসূল সা:-এর অনুমতি চাইলেন, যাতে তায়েফের দুষ্ট লোকদের দুই পাহাড়ের মাঝে পিষে মেরে ফেলেন। রাসূল সা: ফেরেশতাদের সে অনুমতি দেননি বরং তিনি তায়েফবাসীর জন্য দোয়া করেছিলেন। সহিহ আল বুখারি।

হজরত আয়েশা রা: হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এক দিন রাসূল সা:কে জিজ্ঞেস করলাম, ওহুদের দিনের চেয়ে কঠিন কোনো দিন কি আপনার জীবনে এসেছিল? রাসূল সা: জবাবে বলেছিলেন, আমার জীবনের কঠিনতম দিন ছিল তায়েফের দিন। সহিহ আল বুখারি।

রাসূল সা:-এর মক্কা বিজয় : মক্কা অভিযানের আগে আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা:কে বিজয়ের আগাম সুসংবাদ দিয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছিলেন, ‘যখন আল্লাহ তায়ালার প থেকে সাহায্য ও বিজয় আসবে; তখন আপনি দেখবেন মানুষ দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে দাখিল হচ্ছে; অতঃপর (হে নবী !) আপনি আপনার মালিকের প্রশংসা করুন, আর তাঁরই কাছে মা প্রার্থনা করুন, অবশ্যই তিনি তওবাহ কবুলকারী পরম মাশীল’। সূরা আন নসর-১১০/১-৩।

অষ্টম হিজরির ১৬ রমজান রাসূল সা: মক্কার কাছে গিয়ে তাঁবু গাড়লেন। রান্নার জন্য অনেক আলাদা আলাদা চুলার ব্যবস্থা করলেন যাতে করে শত্র“র মনে ভয় সৃষ্টি হয়ে যায়। মক্কায় প্রবেশের জন্য রাসূল সা: মুসলমান সৈন্যদের চারটি ভাগে বিভক্ত করে দিলেন। প্রথম ভাগের দলনেতা ছিলেন হজরত জুবায়ের রা:। দ্বিতীয় দলের দলনেতা ছিলেন হজরত আবু উবায়দা রা:। তৃতীয় দলেন নেতা ছিলেন হজরত সা’দ বিন উবাদা রা:। চতুর্থ দলের দলনেতা ছিলেন হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা:। ১৭ রমজান হজরত আব্বাস রা: আবু সুফিয়ানকে বন্দী করে রাসূল সা:-এর সামনে পেশ করলে আবু সুফিয়ান রাসূল সা:-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। শুধু ইসলাম গ্রহণের কারণে আবু সুফিয়ানকে তার অতীত কৃতকর্ম বা অপরাধ থেকে রাসূল সা:-এর প থেকে মা ঘোষণা করা হলো।

মক্কায় প্রবেশ : অষ্টম হিজরির ২০ রমজান রাসূল সা: খালিদ বিন ওয়ালিদকে নির্দেশ দিলেন, তুমি পেছন দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করবে, কাউকে হত্যা করবে না, কারো ওপর অস্ত্র উত্তোলন করবে না। রাসূল সা: বিনা বাধায় সাদা ও কালো পতাকা নিয়ে সামনের দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করলেন। তিনি উচ্চস্বরে সূরা আল ফাতাহ তিলওয়াত করছিলেন। তাঁর মধ্যে ছিল নম্রতা ও বিনয়, যার প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর সেজদাবনত মস্তক যেন উটের কুঁজ পর্যন্ত স্পর্শ করছিল। কিন্তু খালিদ বিন ওয়ালিদ রা:-এর কাফেলার ওপর কোরাইশরা তীর বর্ষণ করল, যার ফলে তিনজন মুসলমান শাহাদাৎ বরণ করলেন। খালিদ বিন ওয়ালিদের প থেকে প্রত্যুত্তর দিতে হলো, যার ফলে কোরাইশদের ১৩ জন লোক নিহত হলো। রাসূল সা: বিষয়টি জানতে পেরে খালিদ বিল ওয়ালিদ রা:-এর কাছে এর কৈফিয়ত চাইলে তিনি বিস্তারিত বর্ণনা দেন। যাতে মনে হচ্ছিল খালিদ বিন ওয়ালিদ রা:-এর এ হেন কর্ম আল্লাহ তায়ালার প থেকেই ফয়সালা হয়েছিল।

মক্কায় সাধারণ মা ঘোষণা : রাসূল সা: অষ্টম হিজরির ২০ রমজান মক্কায় প্রবেশ করেন। তিনি প্রতিশোধ গ্রহণের পরিবর্তে মামুলি কিছু শর্তে সাধারণ মা ঘোষণা করলেন। শর্তগুলো ছিল নিম্নরূপÑ

১. যারা আপন ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকবে তারা নিরাপদ ২. যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে তারা নিরাপদ এবং ৩. যারা কা’বা ঘরে আশ্রয় নেবে তারাও নিরাপদ। কিন্তু ছয় অথবা মতান্তরে নয়জন ব্যক্তিকে এ সাধারণ মা থেকে বাদ দেয়া হলো, যাদের অপরাধ ছিল অমার্জনীয়। তাদের যেখানে পাবে সেখানেই হত্যার নির্দেশ দেয়া হলো।

কাবা গৃহে প্রবেশ : ওই দিন রাসূল সা: কা’বা ঘরে প্রবেশ করে প্রথমে মূর্তিগুলো সরানোর নির্দেশ দিলেন। তখন কা’বা ঘরে ৩৬০টি মূর্তি ও কা’বার দেয়ালে অসংখ্য চিত্র অঙ্কিত ছিল। এসব কিছুই তখন ধ্বংস করা হলো। অতঃপর রাসূল সা: তাঁর সঙ্গী সাথীদের নিয়ে কা’বা ঘরে (আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করে) দুই রাকায়াত সালাত আদায় করলেন।

মক্কায় বিজয় সমাবেশ : মক্কা বিজয়ের পরদিন অষ্টম হিজরির ২১ রমজান মক্কার সব কোরাইশ সরদার ও যারা মুসলমানদের গালাগাল করেছে, মারধর করেছে, তাদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, লুটপাট করেছে, মুসলমানদের সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে, রাসূল সা:-এর চাচা হজরত হামজা রা:-এর কলিজা চিবিয়ে খেয়েছে, রাসূল সা:কে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে, মক্কা থেকে হিজরত করতে বাধ্য করেছে তারাসহ সর্বস্তরের মানুষ উপস্থিত ছিলেন। রাসূল সা: সমবেত সবার সামনে আল্লাহ তায়ালার হামদ্ পেশ করে, সবার উদ্দেশে ঘোষণা করলেন, তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই, আজ তোমরা সবাই মুক্ত। যারা মুসলমানদের ঘরবাড়ি দখল করে নিয়েছিল তাদের কিছু না বলে বরং যাদের ঘরবাড়ি বেদখল হয়েছিল সেসব মুহাজিরকে উপদেশ দিলেন তারা যেন তাদের ঘর-বাড়ি, জমিজমা ইত্যাদির দাবি ছেড়ে দেন। রাসূল সা: মুহাজিরদের সান্ত্বনার জন্য বলেছিলেন, যা হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘মুসলমানদের ওপর শরয়ি দণ্ডবিধি কার্যকর করা হতে যত দূর সম্ভব দূরে থাকো, অভিযুক্তের নিষ্কৃতি লাভের সামান্যতম সুযোগ থাকলে তার জন্য মুক্তির পথ খুলে দাও, কেননা রাষ্ট্রপ্রধানের পে ভুল করে কাউকে মুক্তি দেয়া শাস্তিদান করা অপো উত্তম’ (তিরমিজি)। রাসূল সা:-এর এ ভাষণ শুনে আর তার আচরণ দেখে সমবেত সবাই ঘোষণা করলেন, সত্যি আপনি আল্লাহর নবী, আপনি কোনো দেশ বিজয়ী সাধারণ বীরযোদ্ধা বা বাদশা নন।

মক্কা বিজয়ের পর মুহাম্মদ সা: পরাজিত শত্র“র প্রতি আচরণ ও তার ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন, বিরল ও অভিনব ঘটনা। রাসূল সা:-এর তায়েফবাসীর প্রতি সহনশীলতা আর মক্কা বিজয়ের পর মক্কাবাসীর প্রতি রাজনৈতিক শিষ্টাচার পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। আর কোনো রাষ্ট্রনায়কের কাছ থেকে আশাও করা যায় না। রাসূল সা:-এর এহেন আচরণ ও ভাষণ থেকে আজকের রাজনৈতিক নেতাদের ও বিশ্ববাসীর শিণীয় রয়েছে, যা মানবিক সমাজ গঠনে, ভ্রাতৃত্ব পুনঃস্থাপনে ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে এক অনুপম অনুকরণীয় ও অনুস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।

আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করে এবং মানুষকে মা করে দেয়, সে যেন জেনে রাখে, অবশ্যই এটা হচ্ছে সাহসিকতার কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম’। সূরা আশ শুরা ৪৩।

Related Post