মুসলিম স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হবে?
সোনালী নীড়ের এবারের পর্বে আমরা একটি পরিবারে স্ত্রীর যে স্বাভাবিক দায়িত্বগুলো রয়েছে, যেমন ঘরকন্না, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, অতিথি-আপ্যায়ন ইত্যাদি-এসবের ব্যাপারে ইসলামের দিক-নির্দেশনা তুলে ধরবো। আর সোনালী নীড়ের এ পর্বের মধ্য দিয়েই আমরা স্বামী এবং স্ত্রীর পারস্পরিক কর্তব্য ও দায়িত্ব সংক্রান্ত আলোচনার পরিসমাপ্তি টানবো।
“পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের একটি অঙ্গ “-এ ধরণের একটি হাদীসের সাথে আমরা সবাই মোটামুটি পরিচিত। এ সংক্রান্ত আরেকটি হাদীস এরকম- রাসূলে কারীম (সাঃ) বলেছেন, ইসলাম যেহেতু শুদ্ধ-পবিত্র, তাই তোমাদের উচিত পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে চেষ্টা করা। কারণ একমাত্র পরিস্কার-পরিচ্ছন্নরাই বেহেশতে প্রবেশ করার অনুমতি পাবে।
যে কোন সচেতন মানুষই জানেন যে, ময়লা-আবর্জনা হলো রোগ জীবানুর স্বর্গরাজ্য, সে ময়লা আপনার ঘরেই হোক আর বাইরেও হোক-একই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ফলে ঘরে ময়লা হলে তাকে যদিজমিয়ে রাখা হয়, তাহলে অবশ্যই সেখান থেকে রোগ-জীবানু ছড়াবে। তাই যত দ্রুত সম্ভবঘরের ময়লা-আবর্জনা দূর করে ঘর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা উচিত। আজকাল শিক্ষিত গৃহিনীদের কেউ কেউ ঘর পরিস্কারের কাজকে খাটো করে দেখতে চায়। এ ধরনের মানসিকতা পোষণ করা একদম ঠিক নয়। বরং শিক্ষিতদের চিন্তা করা উচিত, যারা অশিক্ষিত-তারা শিক্ষিতদের কাছ থেকে শিখবে। তাই শিক্ষিত নারীর উচিত তাদের ঘরকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা। তাহলে সমাজের জন্যে একটা সুন্দর দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে যে, শিক্ষা নারীকে সুগৃহিনী হয়ে উঠতে সহায়তা করে। ঘর-সংসারের দেখা-শোনার কাজ করে শিক্ষিত নারী গর্বিত বোধ করতে পারে এবং প্রমাণ করে দিতে পারে যে, শিক্ষিত একজন গৃহবধূ অশিক্ষিতএকজন গৃহবধূর চেয়ে অনেক শ্রেয়।
ঘরকন্নার কাজ নারীদের একটা অলিখিত দায়িত্ব। এই দায়িত্বের মধ্যে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, রান্নাবাড়া, সন্তান প্রতিপালন অন্তর্ভূক্ত। হযরত আলী (রা.)এর একটি উক্তি হলো, “তোমাদের ঘর থেকে মাকড়শার জালপরিস্কার করে ফেলবে, কেননা মাকড়শার জাল হলো দারিদ্রের কারণস্বরূপ।” তাঁর এইবক্তব্য থেকেই বোঝা যায় যে, ঘর-দোর প্রতিদিন পরিস্কার করতে হবে। কারণ মাকড়শা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জাল বোণে। দৈনন্দিন খাওয়া-দাওয়ার পর বাসন-কোসন, হাঁড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে সকল নোংরা তৈজস ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে রাখা উচিত। অবশ্য সময়-সুযোগ মতো স্বামীদেরও উচিত এসব কাজে স্ত্রীকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করা। রান্নাবান্না যেহেতু মেয়েরাই সাধারণত করে থাকে, তাই পরিস্কারের স্বাস্থ্য সুরার সুমহান দায়িত্বটি তাঁদের হাতেই বর্তায়। এ ব্যাপারে নারীরা যদি অবহেলা বা অমনযোগ দেখান, তাহলে পরিবারের সকল সদস্যই অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। তাই নারীদেরকে খাদ্যের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরী। শিক্ষিত নারীরাই এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। তাছাড়া যে সৌভাগ্যবান স্বামীর স্ত্রী ভালো রান্না করতে জানেন, তিনি কি স্ত্রীর হাতের সুস্বাদু রান্না ফেলে রেখে বাইরে খেতে যাওয়ার মতো বেরসিকের পরিচয় দেবেন ? মহানবী(সাঃ) বলেছেন, তোমাদের নারীদের মধ্যে সেই সবচেয়ে সেরা, যেনিজেকে সুগন্ধে সুরভিত করে, দক্ষতার সাথে খাবার তৈরী করে এবং অতিরিক্ত ব্যয় করেনা।
মানুষ সামাজিক জীব বলে তার রয়েছে একটি পরিসর। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী মিলেই এই পরিসরটি গড়ে ওঠে। আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বএমন একটি ব্যাপার, যা ছাড়া মানুষ হয়ে পড়ে একাকী-নিঃসঙ্গ। তাই মানুষ বন্ধু বা সঙ্গ কামনা করে, তার সঙ্গ আত্ম প্রশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যে কোন পরিবারেই তাই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের যাওয়া-আসা হয়ে থাকে। রাসূলে কারীম (সাঃ)ও আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ-খবর রাখা, তাদের বিপদ-আপদে সহযোগিতা করার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। মেহমানদারী বা অতিথি আপ্যায়ন এভাবেই মুসলমানদের একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। আর এই অতিথি আপ্যায়নের ব্যাপারটি প্রধানত গৃহকর্ত্রী অর্থাৎ স্ত্রীর ওপরই নির্ভর করে। নিঃসন্দেহে অতিথির আগমণ একটি পরিবারে আনন্দ বয়ে আনে। রাসূলে কারীম (সাঃ) বলেছেন, “অতিথির খাবার আল্লাহই বরাদ্দ করে থাকেন, আর সেই বরাদ্দ যখন অতিথিভোগ করে তখন গৃহস্থের গুণাহ মাফ হয়ে যায়। ফলে সাময়িক এবং পরকালীন দু’ধরণেরআনন্দই বয়ে নিয়ে আসে অতিথি। এছাড়া বন্ধু-বান্ধব বা অতিথি সমাবেশে এসে মানুষ অল্পসময়ের জন্যে হলেও ভুলে যেতে পারে ব্যক্তিগত বিষন্নতা বা টেনশন। আপনাদের সান্নিধ্যএতো উপকারী এবং প্রিয় হবার পরও বহু গৃহিনী আছেন, যারা অতিথি পরায়নতা পছন্দ করেননা। এর অবশ্য কিছু কারণ আছে। প্রথমতঃ ঘরের আসবাবপত্র ও তৈজস সামগ্রীর প্রতিযোগিতায়পিছিয়ে থাকা। যদিও এ বিষয়টি একেবারেই নগণ্য একটি বিষয়। ঘরের আসবাবপত্রপ্রয়োজনীয় জিনিস। কিন্তু এসবের ক্ষেত্রে সম্পদশালীরা এক ধরণের প্রতিযোগিতা সৃষ্টিকরায় বিষয়টা এক রকম ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। যে বোনেরা এ ব্যাপারে হীনমণ্যতায়ভোগেন, তাদের বলবো আপনারা রাসূলের প্রতি ভালোবাসার দিকটিকে গুরুত্ব দিয়ে তথাকথিতফ্যাশনের ব্যাপারটি ভুলে যাবার চেষ্টা করুন। দ্বিতীয় কারণটি হলো মেহমানদারীকরাটাকে আর্থিক ক্ষতি এবং শ্রমসাধ্য ব্যাপার মনে করে বিরক্তিবোধ করেন। এ দুটিরকোনটিই উচিত নয়। আপনার কিংবা আপনার স্বামীর বন্ধু-বান্ধব থাকতে পারে। তাদের বাসায়যেমন বেড়াতে যাওয়া উচিত, তেমনি তাদেরকেও আপনার বাসায় আমন্ত্রণ জানানো উচিত।কোনভাবেই বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত করলে বিরক্তিবোধ করা ঠিক নয়। স্বামী-স্ত্রীউভয়ে আলাপ আলোচনার করে দাওয়াতের বিষয়গুলো ঠিক করবেন। বাজার করা, রান্নাবাড়া করাইত্যাদি সকল কাজে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে করুন। ফলে অতিথির আগমণ আপনাদেরপরিবারে আনন্দ বয়ে আনবে। পক্ষান্তরে পলিত হবে মহানবীর একটি অন্যতম সুন্নত।