দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ: অন্যান্য সংশয়
এই পরিচ্ছেদে পূর্বে উল্লেখিত সংশয়সমূহের ফলাফল ও উপসংহার স্বরূপ দুটি সংশয় অন্তর্ভুক্ত হবে। সম্মানিত সাহাবী সামুরা ইব্ন জুনদুব রাদি আল্লাহু আনহু সম্পর্কে যে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ আরোপ করা হয় তারই ফলশ্রুতিতে তাঁর উপর অনেক অন্যায় বিধান ও পঙ্কিল নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়।
তাঁর ব্যাপারে এ বিধান আরোপ করা হয় যে, তাঁর মতামত বা তাঁর ফিকহ গ্রহণ করার অযোগ্য এবং এ বিধানকে ইমাম আবু হানীফার প্রতি সম্পৃক্ত করা হয়।
তাঁর জীবনাচরণের ফলাফল স্বরূপ তাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামের অধিবাসী হিসেবে গণ্য করা হয় (আমরা আল্লাহর কাছে তাঁর জন্য এ থেকে পানাহ চাই)।
প্রিয় পাঠক! এ সব সন্দেহের বাস্তবতা, এর সত্যতা ও বিশুদ্ধতা উপলদ্ধি করার জন্য প্রথমে অভিযোগগুলো অতঃপর এর উত্তর উপস্থাপন করব। সর্বশেষ ন্যায় বিচারক হিসেবে রায় দেওয়ার দায়িত্ব আপনার উপর ছেড়ে দিব।
প্রথম সংশয়:-
ইমাম আবু হানীফা সামুরা রাদি আল্লাহু আনহুর মতামত ও ফিক্হ গ্রহণ করতেন না
শারানী তার মীযান গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, আবু মতি আল বালখী বলেন, আমি ইমাম আবু হানীফাকে বললাম, ধরুন আপনি কোন এক বিষয়ে একটি মত পোষণ করেন এবং আবু বকর সিদ্দীক রাদি আল্লাহু আনহু ভিন্ন মত পোষণ করেন, তবে কি আপনি আপনার মত পরিত্যাগ করে তাঁর মত গ্রহণ করবেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, অতঃপর আমি তাঁকে বললাম, যদি আপনি কোন বিষয়ে একটি মত পোষণ করেন এবং উমর রাদি আল্লাহু আনহু অন্য একটি মত পোষণ করেন তবে কি আপনার মত পরিত্যাগ করে তাঁর মত গ্রহণ করবেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। একইভাবে আমি উসমান, আলী রাদি আল্লাহু আনহুমার জন্য এবং আবু হুরায়রা, আনাস ইব্ন মালিক ও সামুরা ইব্ন জুনদুব ব্যতীত সমস্ত সাহাবীর উদ্দেশ্যে আমার মত পরিত্যাগ করব।
এর উত্তরে আমরা বলব:
১. শারানী এ উদ্ধৃতি ইমাম আবু জাফর শিযামারী থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, ইমাম আবু জাফর শিযামারী ইমাম আবু হানীফা পর্যন্ত তার বর্ণনা পরম্পরাসহ বর্ণনা করেন,……….কিন্তু শারানী আমাদেরকে জানাননি বর্ণনা পরম্পরার ব্যক্তিবর্গ কারা? তবেই আমরা বর্ণনার শুদ্ধতা বা অশুদ্ধতা সম্পর্কে অবগত হতে পারতাম।
২. শারানী উদ্বৃতি ‘যে ব্যক্তি বলে ইমাম আবু হানীফা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসের উপর কিয়াসকে অগ্রাধিকার দিতেন তাঁর উক্তি দুর্বল’ শীর্ষক অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
যারা ইমাম আবু হানীফার উপর এ অভিযোগ পেশ করতেন যে, তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসকে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্ব প্রদান করতেন না এবং তাঁর উপর কিয়াসকে অগ্রাধিকার দিতেন শারানী উদ্ধৃতিটি তাদের প্রতিহত করার জন্য উল্লেখ করেছেন। তিনি এ সংক্রান্ত অনেক বর্ণনাকে ভিত্তিহীন প্রমাণিত করেছেন যার মধ্যে এ উদ্ধিৃতিটিও রয়েছে যাতে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম আবু হানীফা বড় বড় সাহাবী যেমন আবু বকর, উসমান আলী রাদি আল্লাহু আনহু এর মতের বিপরীতে নিজের মত পরিত্যাগ করতেন।
৩. শারানী এ উদ্ধৃতিটি উল্লেখ করার সাথে সাথে ইমাম আবু হানীফা কর্তৃক আবু হুরাইরা, আনাস, সামুরা রাদি আল্লাহু আনহুমের মতামত গ্রহণ না করার কারণ বর্ণনা করেছেন (ইমাম আবু হানীফার উদ্ধিৃতিটি শুদ্ধ হওয়া পরিপ্রেক্ষিতে) অতঃপর তিনি বলেন, কেউ কেউ বলেন, সম্ভবত এটি তাঁদের জ্ঞানের স্বল্পতার, ইজতিহাদ ও উপলব্ধির অনুশীলন না করার কারণে তবে এটি তাঁদের ন্যায়পরায়ণতার উপর প্রভাব ফেলে না।
আমরা যদি এ জাতীয় উক্তি অর্থাৎ আবু হুরাইরা আনাস, সামুরা রাদি আল্লাহু আনহু অর্ন্তদৃষ্টি ও উপলব্ধি ক্ষমতা কম ছিল ধরে নেই তবে তা শুধুমাত্র এ উদ্ধৃতি অনুধাবনের জন্য। অতএব, ইমাম আবু হানীফা কর্তৃক উক্ত সাহাবীগণের মতামত গ্রহণ না করাতে তাদের ন্যায়পরায়ণতার কোন কমতি হয় না।
৪. এ বিষয়টি হানাফী মাযহাবে নতুন কিছু নয়। কেননা তারা সাহাবীগণকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন প্রথমত যাঁরা ফিকহ ও ইজতিহাদী শক্তিতে প্রসিদ্ধ ছিলেন, দ্বিতীয়ত যাঁরা ন্যায়পরায়ণতা, হাদীস মুখস্তকরণ ও সংরক্ষণে প্রসিদ্ধ ছিলেন কিন্তু ফিকহের ক্ষেত্রে ততটা প্রসিদ্ধ ছিলেন না। প্রথম প্রকারের মধ্যে খুলাফায়ে রাশেদুন, যায়িদ ইব্ন সাবিত, মুয়ায ইব্ন জাবাল, আবু মুসা আশআরী, আয়িশা রাদি আল্লাহু আনহুম ও সাহাবীগণের মধ্যকার ফিকহের ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ অন্যান্য সাহাবী। তাঁদের বর্ণনাসমূহ দলিল ও এমন আবশ্যক জ্ঞান যা নিজস্ব মতামতের উপর প্রাধান্যপ্রাপ্ত এবং যার উপর আমল করা আবশ্যক। তাই উক্ত বর্ণনা কিয়াসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হোক অথবা কিয়াস বিরোধী হোক। যদি তা কিয়াস বিরোধী হয় তবে কিয়াস পরিত্যক্ত হবে এবং উক্ত বর্ণনা অনুযায়ী আমল করা হবে।
ন্যায়পরায়ণতা, হাদীস মুখস্তকরণ ও সংরক্ষণে প্রসিদ্ধ হিসেবে পরিচিত সাহাবী যেমন আবু হুরাইরা, আনাস রাদি আল্লাহু আনহু ও অন্যান্য যাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্যে প্রসিদ্ধ ………..আবু হুরাইরা রাদি আল্লাহু আনহুর ন্যায়পরায়ণতা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে দীর্ঘ সাহচর্যের ব্যাপারে কেউ বিন্দুমাত্র সন্দেহ করবে না……. একইভাবে তাঁর উত্তম মুখস্তকরণ ও সংরক্ষণের ব্যাপারেও ……এতদ্ব্যতীত সাহাবী ও তাঁদের পরবর্তীগণের পক্ষ থেকে কিয়াসের মাধ্যমে তাঁর কিছু বর্ণনার বিরোধিতা প্রসিদ্ধ রয়েছে……… এ পরিসরে সালফে সালেহীন থেকে তাঁর বর্ণনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যে কিয়াস বর্ণিত হয়েছে তাঁর উপর আমল করা হবে। আর যা কিয়াসের বিরোধী সে ক্ষেত্রে যদি উম্মতের আলিমগণ উক্ত বর্ণনা গ্রহণ করে তবে সে অনুযায়ী আমল করা হবে নতুবা বিশুদ্ধ কিয়াসকেই তার বর্ণনার উপর প্রধান্য পাবে। এক্ষেত্রে কেউ কেউ ধারণা করতে পারেন যে, আমরা তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করছি আল্লাহর কাছে এ বিষয়ে পানাহ চাই। অতএব তিনি ন্যায়পরায়ণতা, মুখস্তকরণ ও সংরক্ষণে অগ্রগণ্য ছিলেন যেমনটি আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি।
এরপরও আমাদের পূর্ববর্তী সাথীরা এ জাতীয় বর্ণনাকে সম্মান করতেন, তাঁদের বর্ণনার উপর নির্ভর করতেন। ইমাম মুহাম্মদ দেখিয়েছেন যে, ইমাম আবু হানীফা মাসিক রক্তস্রাবের পরিমাণের বিষয়ে আনাস ইব্ন মালিক রাদি আল্লাহু আনহুর বর্ণনাকে গ্রহণ করেছেন। আর আবু হুরাইরা রাদি আল্লাহু আনহুর মর্যাদা তাঁর মর্যাদার উপরে। অতএব, আমরা অবগত হলাম যে, উপরিউক্ত কারণে রায় বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার জরুরী অবস্থাতে ছাড়া তাদের বর্ণনা পরিত্যাগ করতেন না।
অতএব এ দীর্ঘ আলোচনা থেকে জানা গেল যে, কতিপয় সাহাবীর বর্ণনা ফিকহের ক্ষেত্রে গ্রহণ না করা তাঁদের ন্যায় পরায়ণতা, আমানতদারী ও দ্বীনের ক্ষেত্রে কোন ত্রুটির কারণে (নাউযুবিল্লাহ) নয়। বরং হানাফী আলিমগণের দৃষ্টিতে বিষয়টি তাঁদের ফিকহী পারদর্শিতা ও ইজতিহাদী যোগ্যতার সাথে সংশ্লিষ্ট। এ কারণেই দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়। অতএব, এসব সাহাবী ছিলেন ন্যায়পরায়ণ ও বিশ্বস্ত। তাঁদের ব্যাপারে শুধুমাত্র তারাই অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। আমাদের প্রিয় সাহাবী সামুরা ইব্ন জুনদুব রাদি আল্লাহু আনহুর ক্ষেত্রে উপরোক্ত সব কথাই প্রযোজ্য।
৫. মৌলিকভাবে অভিযোগ উত্থাপনকারী এই বর্ণনার মাধ্যমে তার পক্ষে কোন প্রমাণ পায়নি। কেননা বর্ণনাটিতে যা স্পষ্ট হয়েছে তা মুসলমানদের আকীদার সাথে সামঞ্জস্য। আর তা হল, আবু বকর, অতঃপর উমর, অতঃপর উসমান, অতঃপর আলী রাদি আল্লাহু আনহু এর অবস্থান। এ বিষয়টি উক্ত ইমামদের মস্তিস্কে গেঁথে গিয়েছিল যা পর্যালোচনার কোন অবকাশ রাখে না। আবু মুতিই আল বালখী ইমাম হানীফাকে যখন প্রশ্ন করেন তখন তিনি প্রশ্নেই প্রথমে আবু বকর অতঃপর উমর রাদি আল্লাহু আনহুর নাম উল্লেখ করেন তাঁদের জ্ঞান ও বিজ্ঞতার ভিত্তিতে। যেন এটাই আবু হানীফার (রহ.)-এর দৃষ্টিতে মর্যাদা, জ্ঞান এমনকি খিলাফাতের বিবেচনায় খুলাফায়ে রাশেদুনের ক্রমধারা ।
দ্বিতীয় সংশয়:-
সামুরা জাহান্নামের অধিবাসী
বালাজুরীর আনসাব গ্রন্থে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, আমার সাহাবীদের সর্বশেষ মৃত ব্যক্তি আগুনে পতিত হবে। সর্বশেষে দুজন সাহাবী অবশিষ্ট ছিলেন, সামুরা ইব্ন জুনদুব আল ফাযারী বসরায় এবং আবু মাহজুরাহ মক্কায়। হিজায থেকে কেউ আগমন করলে সামুরা তার কাছে আবু মাহজুবার খবর নিতেন অন্য দিকে বসরা থেকে কেউ মক্কায় গেলে আবু মাহজুরা তার কাছে সামুরার খবর নিতেন। অবশেষে আবু মাহজুরা দুজনের মধ্যে প্রথমে অর্থাৎ সামুরার আগে ইন্তিকাল করেন।
এ উক্তি থেকে কেউ কেউ বুঝেছেন যে, সামুরা দোযখের আধিবাসী। এই হাদীসের কারণে তারা আনন্দে ছুটাছুটি করে।
এর উত্তর:
প্রথমত: সনদ সম্পর্কে কথা :
ইমাম যাহাবী তার সীরু আলামুন নুবালা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। হাদিসটি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার জন্য আমি ধারাবাহিকভাবে তা বর্ণনা করছি।
ক- মুআজ ইব্ন মুআজ, আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন শুবা আমাদেরকে আবু মুসলিমা থেকে, তিনি আবু নুদরা থেকে, তিনি আবু হুরায়রা রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, এক গৃহে অনেক সাহাবীবেষ্টিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের সর্বশেষে মৃত ব্যক্তি আগুনে পতিত হবে। তাঁদের মধ্যে সামুরা ইব্ন জুনদুব ছিলেন। আবু নুদরা বলেন, সামুরাই সর্বশেষ ইন্তিকাল করেন।
ইমাম যাহাবী বলেন, হাদীসটি খুবই গরীব তাছাড়া আবু হুরায়রা থেকে আবু নুদরার হাদীস শ্রবণ সাব্যস্ত হয়নি। এর আরও প্রমাণ রয়েছে।
অতএব প্রথম বর্ণনাটি শুদ্ধ নয়। ইমাম যাহাবী আরও যেসব সম্পূরক বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন তা হল:
খ- তিনি বলেন, ইসমাঈল ইব্ন হাকীম ইউনূস থেকে, তিনি হাসান থেকে, তিনি আনাস ইব্ন হাকীম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি মদীনায় যাতায়াত করতাম, একদা আবু হুরায়রা রাদি আল্লাহু আনহুর সাক্ষাত পেলাম। তিনি কোন কথা না বলেই সামুরা রাদি আল্লাহু আনহু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। যখন আমি তাঁর জীবিত থাকার সংবাদ দিলাম তখন তিনি আনন্দিত হলেন এবং বললেন, এক গৃহে আমরা দশজন ছিলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সকলের চেহারার দিকে তাকালেন অতঃপর বললেন, “তোমাদের মধ্যে সর্বশেষ মৃত ব্যক্তি আগুনে পতিত হবে”। আমাদের সে দশজনের আট জনই মারা গেছেন। এজন্য আমার কাছে মরণের চেয়ে অন্য কিছু প্রিয় নেই।
শাইখ শুআইব বলেন, হাদীসটি সহীহ নয়। ইসমাইল ইব্ন হাকীম সে যিয়াদের সাথী খুযায়ী, ইব্ন আবু হাতিম, (২/১৬৫) তার জীবনী লিখেছেন কিন্তু তার জারহ ওয়া তাদীল নিয়ে কিছু বলেননি। আনাস ইব্ন হাকীম সেও অজ্ঞাত।
আমরা বলব, এই আনাস ইব্ন হাকীমকে ইব্ন মাদাইনী তার আল মাজহুলীন গ্রন্থে হাসানের শিক্ষকদের তালিকায় উল্লেখ করেছেন। ইব্নুল কাত্তান বলেন, সে অজ্ঞাত। ইব্ন হাজর বলেন, মাসতুর (আবৃত)।
অতএব এ বর্ণনাটিও শুদ্ধ নয়।
অতঃপর যাহাবী বলেন,
গ- হাম্মদ ইব্ন সালমা আলী ইব্ন জুদআন থেকে, তিনি আউস ইব্ন খালিদ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি আবু মাহজুরার কাছে গেলে তিনি সামুরা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আমি এ ব্যাপারে তাঁকে জানালাম। তখন তিনি বললেন, আমি সে ও আবু হুরায়রা রাদি আল্লাহু আনহুম এক ঘরে ছিলাম, এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এলেন এবং বললেন, “তোমাদের মধ্যকার সর্বশেষ মৃত ব্যক্তি আগুনে পতিত হবে” আবু হুরায়রা মারা গিয়েছেন। অতঃপর আবু মাহজুরা মারা যান।
শায়খ শুয়াইব বলেন, বর্ণনাটি সহীহ নয়। আলী ইব্ন জুদআন ছিলেন ইব্ন যাইদ ইব্ন জুদআন তিনি দুর্বল বর্ণনাকারী। আউস ইব্ন খালিদ ইব্ন আবু আউস অজ্ঞাত।
বুখারী আউস ইব্ন খালিদের ব্যাপারে বলেন, সামগ্রিকভাবে তিনি সামুরা সম্পর্কে যা বর্ণনা করেছেন তা মুরসাল তাঁর সনদের ব্যাপারে কথা রয়েছে। কেননা আউস থেকে আলী ইব্ন যাইদ ছাড়া কেউ বর্ণনা করেনি। আর এ আলীর ব্যাপারে সমালোচনা রয়েছে।
আযদী বলেন, হাদীসের মুনকার বর্ণনাকারী।
ইবনুল কাত্তান বলেন, আউসের অবস্থা অজ্ঞাত। আবু হুরায়রা থেকে তার তিনটি বর্ণনা রয়েছে যা মুনকার। হাফিজ ইব্ন হাজর বলেন, অজ্ঞাত।
অতঃপর যাহাবী বলেন,
ঘ) মুআম্মার ইব্ন তাউস ও অন্যান্য থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু হুরায়রা, সামুরা ইব্ন জুনদুব ও অন্য একজনকে বলেন, তোমাদের মধ্যকার সর্বশেষ মৃত ব্যক্তি আগুনে পতিত হবে। তৃতীয় ব্যক্তিটি তাঁদের দুজনের (আবু হুরায়রা ও সামুরার) পূর্বে মারা যায়। যদি কেউ আবু হুরায়রাকে দুঃশ্চিন্তায় ফেলতে চাইত সে বলত সামুরা মারা গেছেন। তবে তিনি খুবই বিমর্ষ ও চিন্তিত হয়ে পড়তেন। অবশেষে তিনি সামুরার পূর্বে ইন্তিকাল করেন।
স্পষ্টতই হাদীসটি শুদ্ধ নয় ইব্ন তাউস ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যকার বর্ণনাকারীদের বিচ্ছিন্নতার কারণে ।
* আমরা বলব, হাদীসটি আবু আমীনের মাধ্যমে আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তাহাভীর মুশকিলাতুল আছার, ১৪/২১৪; দাওলাবীর আল-কুনাওয়াল আসমা, ৩/২৬; হারিছ ইব্ন আবু উসামার মুসনাদে, ২/৮৮০।
এই আবু আমীনকে উল্লেখ করেছেন ইব্ন আবু হাতিম কিন্তু তার জারহ ওয়া তাদীল বর্ণনা করেননি।
ইব্ন মুঈন বলেন, আমি আমার পিতা আমিনকে এই হাদীসে ছাড়া শুনিনি।
হাদিসটি শারীক সূত্রে আব্দুল্লাহ ইব্ন সাঈদ থেকে তিনি হাজর থেকে তিনি আবু মাহজুরা থেকে বর্ণনা করেছেন যা ইমাম তাহাভীর মুশকিলুল আছার গ্রন্থে (২৪/২১৫) বর্ণিত হয়েছে অথবা আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত হয়েছে যেমন আদ দাওলাবীর আল কুনী ওয়াল আসমা গ্রন্থে (৪/৩৬৫) উল্লেখিত হয়েছে।
আমরা বলব, এই হাজরের কোন জীবনী রিজালশাস্ত্রের গ্রন্থে পাওয়া যায়নি।
অতএব, পূর্ববর্তী আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল সকল বর্ণনাই দূষণীয় এবং অশুদ্ধ।
দ্বিতীয়ত মতনের দিক থেকে হাদীসটি দুটি কারণে প্রত্যাখ্যাত (মুনকার হাদীস)
১। অসামঞ্জস্যতা: এক বর্ণনায় দেখা যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দশজন সাহাবীর সামনে হাদীসটি ইরশাদ করেছেন। কোন বর্ণনায় দেখা যায় সাত জনের সামনে আবার কখনও দেখা যায় তিন জনের সামনে। কোন বর্ণনায় তৃতীয় ব্যক্তির নাম আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর ইব্ন আস, আবার কোন বর্ণনায় আবু মাহজুরা উল্লেখ করা হয়েছে। এ জাতীয় অসামঞ্জস্যতা বর্ণনাসূত্র শক্তিশালী হওয়ার বিপরীত। বিশেষ করে, যদি এ অসামঞ্জস্যতা অজ্ঞাত ও পরিচয়বিহীন অথবা পরিবর্তন-পরিবর্ধনে সিদ্ধহস্ত হিসেবে পরিচিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে হয়। এর প্রমাণ জারহ ও তাদীলের গ্রন্থসমূহে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
২- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্রে দয়া তথা রহমতকে সহজাত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর বিজ্ঞানময় কুরআনে তাঁকে রউফুর রাহীম (স্নেহশীল দয়াময়) নাম রেখেছেন। তিনি কিভাবে তাঁর তিনজন সাহাবীকে এই হাদীসের মাধ্যমে সারাটা জীবন আতংকে রাখলেন? অথচ তিনি ইসলামের শত্রু মুনাফিকদের নাম পর্যন্ত প্রকাশ করেননি। বরং তা তাঁর গোয়েন্দা প্রধান হুযায়ফা ইব্নুল ইয়ামানের কাছে গোপন অবস্থায় রেখেছিলেন। যদি কোন বিশেষ ব্যক্তির দোষত্রুটি প্রকাশ করার ইচ্ছা করতেন তবে সামষ্টিক শব্দ ব্যবহার করে বলতেন এসব লোকজনের কী হল যে, তারা এই এই করছে..।
পক্ষান্তরে হাদীসটি সব বর্ণনাসূত্র একত্রিত হয়ে যদি শুদ্ধের কাছাকাছি যায় তবে সে ক্ষেত্রে আমাদের উত্তর হল:
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী তোমাদের মধ্যকার সর্বশেষ মৃত আগুনে পতিত হবে” এর দ্বারা জাহান্নামে যাওয়া উদ্দেশ্য নয় বরং এ দ্বারা উদ্দেশ্য হল আগুনে পতিত হয়ে মারা যাওয়া অর্থাৎ দুনিয়ার আগুন।
ইমাম বুখারী আবু হুরায়রা রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আবু নুদরার হাদীসটি উল্লেখ পূর্বক বলেন, সামুরা রাদি আল্লাহু আনহু তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বলেন, তিনি আগুণে পতিত হন এবং সেখানেই মরা যান।
ইমাম তাহাবী তোমাদের সর্বশেষ মৃত্যুবরণকারী আগুনে পতিত হবে হাদীসটি নিজসূত্রে বর্ণনা করে বলেন, অতএব আমরা অবগত হলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীসে আগুন শব্দ দ্বারা যা বুঝাতে চেয়েছেন তা দুনিয়ার আগুন। আখিরাতের আগুন তথা জাহান্নাম নয়। সুতরাং এ হাদীসে যা বর্ণিত হয়েছে তা সামুরা রাদি আল্লাহু আনহুর এক অনন্য মর্যাদা যা তিনি আখিরাতে অর্জন করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে সামুরার উদ্দেশ্যে এ রূপক বর্ণনাটি ঠিক তেমন, যেমনটি তাঁর স্ত্রীগণের ব্যাপারে ছিল, “তোমাদের মধ্যে সর্বপ্রথম আমার সাথে সেই মিলিত হবে যার হাত সবচেয়ে লম্বা”। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণ কার হাত কতটুকু লম্বা তা দেখার জন্য দেয়ালে পরিমাপ করতাম। অতঃপর যয়নাব বিনত জাহাশ ইন্তিকাল করলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোট-খাট। তবে তিনি আল্লাহর পথে ব্যয় করার ক্ষেত্রে ছিলেন দীর্ঘহস্ত। এজন্য আমরা অবগত হলাম, কল্যাণের পথে আমাদের মধ্যে তাঁর হাতই লম্বা ছিল। কিন্তু তাঁর ইন্তিকালের পরেই এটি প্রকাশিত হয়। একইভাবে সামুরা রাদি আল্লাহু আনহুর ব্যাপারটিও তাঁর ইন্তিকালের পর মানুষের জন্য তা স্পষ্ট হয়েছে।
৩- সামুরা রাদি আল্লাহু আনহুর ইন্তিকালের কারণ বিশ্লেষণ করলে এ বিষয়টি আরও নিশ্চিত হওয়া যায়।
ক) ইব্ন আব্দুল বার উল্লেখ করেছেন, তিনি গরম পানি ভর্তি বড় ডেকের মধ্যে পড়ে যান। যার উপর বসে তিনি ধনুষ্টঙ্কারের উপশমের জন্য চিকিৎসা গ্রহণ করতেন। একদা তিনি ঐ ডেকের মধ্যে পড়ে যান এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
ইব্ন আব্দুল বার এ বিষয়ের উপর মন্তব্য করে বলেন, এটিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীর সত্যতা, যা তিনি আবু হুরায়রা সামুরা ও তৃতীয় একজনকে বলেছিলেন, “তোমাদের মধ্যকার সর্বশেষ মৃত আগুনে পতিত হবে”।
খ) ইমাম যাহাবী তাঁর মৃত্যুর অন্য একটি কারণ উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি থেকে বর্ণিত, সামুরা কাঠ দিয়ে ধুপ জ্বালাতে যেয়ে নিজের গায়ে আগুন লেগে অগ্নিদগ্ধ হন।
যাহাবী বিশ্লেষণ করে বলেন, এ বর্ণনাটি যদি শুদ্ধ হয়, তবে এটিই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীর উদ্দেশ্য অর্থাৎ আগুন বলতে দুনিয়ার আগুন।
তিনি তারীখুল ইসলামে আরও বলেন, এই বর্ণনা যদি শুদ্ধ হয় তবে ইনশাল্লাহ এটিই হবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী “তোমাদের সর্বশেষ মৃত আগুনে পতিত হবে” এর উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আগুনে পতিত হওয়াটি মৃত্যুর সাথে সংশ্লিষ্ট সত্তাগত নয়।
গ) বাগভী তার মুজামুস সাহাবা গ্রন্থে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেন শায়বান, আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেন জারীর ইব্ন হাযেম, তিনি বলেন, আমি আবু ইয়াযিদকে বলতে শুনেছি, সামুরা রাদি আল্লাহু আনহু অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ঐ অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর রোগটি ছিল শরীর হিম হয়ে যাওয়া। এর জন্য সামনে-পিছনে, ডানে-বামে চারিদিকে একটি করে অগ্নিকু- তৈরি করা হয়। অথচ তাতেও তাঁর রোগের উপশম হচ্ছিল না। তখন তিনি বারবার বলছিলেন, আমার অন্তরে লুকায়িত রোগ তা আমি কী করব? এ অবস্থায় তিনি ইন্তিকাল করেন।
বর্ণনাটি ইব্ন সায়াদ তাঁর তাবাকাত গ্রন্থে ওয়াহাব ইব্ন জারীর ইব্ন হাযেম থেকে, তিনি তার পিতা থেকে, তিনি আবু ইয়াযিদ মাদানী থেকে বর্ণনা করেছেন।
অতএব উপসংহারে দাড়াল-
১- বর্ণনাটি শুদ্ধ নয়। এ বিষয়ে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
২- যদি শুদ্ধ হয়ও তবে হাদীসটির উদ্দেশ্য হবে, আগুনে পতিত হয়ে ইন্তিকাল করা, অর্থাৎ আগুন তাঁর মৃত্যুর কারণ হবে। আখিরাতে আগুনে যাওয়া উদ্দেশ্য নয়।
সমাপনী:-
সম্মানিত সাহাবী সামুরা ইব্ন জুনদুব রাদি আল্লাহু আনহু সম্পর্কিত বিভিন্ন সংশয় নিয়ে পথ চলার শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছি। যদিও আমরা তাঁর সম্পর্কিত সব সংশয় এখানে উল্লেখ করিনি।
প্রিয় পাঠক! জেনে রাখুন তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অন্যান্য অভিযোগগুলো একই ধরণের। এর থেকে আলাদা কিছু নয়। এসব সংশয় যা আমরা উল্লেখ করছি এবং যা উল্লেখ করেনি তা নিরপেক্ষ এবং প্রবঞ্চনা, গোড়ামী, কট্টর প্রবৃত্তির চাহিদামুক্ত গবেষণার সামনে টিকে থাকতে পারে না।
এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটি বিষয়ই প্রমাণিত হয় তা হল তাঁদের কেন্দ্রিক যে মিথ্যা, অসত্য ও ভিত্তিহীন কথা প্রচলিত হয়েছে তা থেকে ঐ সব পবিত্র ব্যক্তিবর্গ সম্পূর্ণভাবে মুক্ত। আর এ জাতীয় বর্ণনার উদ্দেশ্য তাঁদের সম্মানহানী, তাঁদের ব্যাপারে সংশয় সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁদের দ্বীনের ব্যাপারে সন্দেহ তৈরী।
এ এক দিক, অন্য দিক থেকে যারা এ জাতীয় সংশয় উল্লেখ করেছে তাদের কুইচ্ছা ও অনিষ্টকর উদ্দেশ্য প্রমাণিত হয়েছে বিভিন্নভাবে। যেমন বর্ণনাসমূহ সমালোচনার নীতিমালা প্রয়োগ থেকে দূরে থাকা, ন্যায়ভিত্তিক গবেষণা পদ্ধতি থেকে বিমূখতা, ইসলামের ধারক ও বাহকদের মধ্যে তো বটে এমনকি বিশ্বাসের দিক থেকে যারা তাদের বিরোধী তাদের ক্ষেত্রেও তারা এ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু সত্য-মিথ্যার মধ্যে সংঘাতের যে আল্লাহর নীতি তা অবশিষ্ট থাকবেই। ইসলামের শত্রুরা বর্তমান থাকবেই। মহান আল্লাহ যা খুশি তাই নির্ধারণ করেন, যা ইচ্ছা তাই ফয়সালা করেন কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।