শবেবরাত দু’টি শব্দে গঠিত একটি ব্যাপক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নাম। ‘শব’শব্দটি ফারসি।যার অর্থ হচ্ছে রাত্রি। আর ‘বরাত’শব্দের অর্থ অদৃষ্ট, ভাগ্যসুতরাং শবেবরাত মানে হচ্ছে ভাগ্যরজনী।প্রচলিত অর্থে শবেবরাত বলতে আরবি শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে বোঝায় , ভারত উপমহাদেশসহ বিভিন্ন দেশের সাধারণ মুসলমানদের ধারণা, এ রাতটি হলো এমন একটি রাতযে রাতে আল্লাহ তায়ালা মানুষের তাকদির তথা এক বছরের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করেন। আগামীবছরের সময়গুলো কিভাবে কাটবে তা নির্ধারণ করেন এ রাতেই। এ রাত এমন একটি রাত যে, যদিএ রাতে ভালো ভালো খাবার খাওয়ারও ব্যবস্থা করা যায়, তবে সারা বছরই ভাগ্যে এমন খাবার জূটবে।এ রাতে নফল নামাজ আদায়ে অগণিত সওয়াব। কেউ যদি এ রাতে গোসল করে তবে গোসলের প্রতিটিফোঁটায় ৭০ জন করে ফেরেশতা তৈরি হয় আর তারা সারা রাত ওই ব্যক্তির জন্য মাগফিরাতকামনা করেন।
এসব ধারণা পোষণ করার ফলে মুসলমানদের, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের দেখতেপাই যে, তারা এ রাতে মসজিদে মসজিদে সমবেত হন। নফল নামাজ পড়ে মিলাদ মাহফিলের আয়োজনকরেন। বাসায় বাসায় হালুয়া-রুটির বন্যা বয়। একটু দেরিতে মার্কেটে গেলে গোশত পাওয়াকঠিন। জীবনে যারা ফরজ নামাজ পর্যন্ত আদায় করে না, তারা সমবেত হয় বরাতের নামাজ পড়তে।মনে হয় ফরজ নামাজের চেয়েও এ রাতের গুরুত্ব অধিক ।শুধু এখানেই শেষ নয়। এখান থেকে একদল মানুষের মধ্যে আল্লাহ সম্পর্কে কুধারণাও তৈরিহয়। সারা রাত ইবাদত আর দোয়া করার পর যখন পরবর্তীকালে তার ভাগ্যে ভালো খাবার না জোটেতখন বলে, শবেবরাতে আল্লাহ তায়ালা প্রথম দিকে বড় লোকদের জন্য লিখেছেন পরে আমাদেরজন্য লেখার সময় এলে কলমের কালি ফুরিয়ে যায়। ফলে সংক্ষেপে আমাদের জন্য লিখেছেন, ‘সাবেক হুকুম বহাল।’ (নাউজুবিল্লাহ) ফলে আমাদের ভাগ্য বদলায় না ।কোত্থেকে এ ধারণার জন্ম : এ ধারণার জন্মের পেছনে মূলত কিছু দুর্বল ও মিথ্যা হাদিসকাজ করেছে। একপর্যায়ে কিছুসংখ্যক অদূরদর্শী আলেম এসব হাদিসকে পুঁজি করে রঙচঙ লাগিয়েআলোচনা করায় সমাজে এর প্রচলন হয়ে গেছে। ফলে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর ওপরে এরঅবস্থান দেখাযাচ্ছে ।
শবেবরাতের অস্তিত্ব : সাধারণ মানুষের কাছে যে অর্থে শবেবরাত পরিচিত ইসলামি শরিয়তে এঅর্থে মূলত কোনো রাত আছে বলে কোনো মুহাককিক আলেম বলেন না। একটু চিন্তা করলে দেখব যেমূলতই ইসলামি শরিয়তে বর্ণিত অর্থে এ রাতের কোনো অস্তিত্ব নেই। তা বিভিন্ন কারণে, যেমনÑ ১. ইসলামি জীবনবিধানের মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে আল কুরআন ও হাদিসে রাসূলে। এদুটোই আরবি ভাষায়। ফলে শরিয়তের যেসব ইবাদত ইসলাম-স্বীকৃত তার আরবি পরিভাষা গোটাপৃথিবীতে ব্যাপৃত। পরবর্তীকালে সেগুলোর অনুবাদ হলেও আরবি পরিভাষা বিলোপ হয়নি। যেমনÑ সালাত, সাওম, হজ প্রভৃতি। ‘শবেবরাত’যেমন আরবি শব্দ নয়, তেমনি এটি ইসলামি পরিভাষাওনয়; ২. ইসলামি শরিয়তে কতগুলো ইবাদত অনুষ্ঠান বা মর্যাদাসম্পন্ন দিন রয়েছে তার একটিওবছরে দু’বার একই অর্থে উদযাপিত হয় না। অনেকে ‘লাইলাতুল কদর’অর্থ শবেবরাত করেন।তাদের মনে রাখা দরকার, লাইলাতুল কদর রমজান মাসে, শাবান মাসে নয়। সুতরাং শবেবরাত আরলাইলাতুল কদর একই অর্থ নয়; ৩. কোনো সময়ের মর্যাদা কতটুকু তা বর্ণনা করার অধিকারীএকমাত্র আল্লাহ তায়ালা এবং হজরত মুহাম্মদ সা: ছাড়া অন্য কেউ নয়। এমন একটি সহিহহাদিসের কিংবা কুরআন পাকের উদ্ধৃতি পাওয়া যাবে না, যাতে শবেবরাতের বর্ণিত মর্যাদারকথা বলা হয়েছে; যা বেশির ভাগ মুসলমান মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন। এসব যুক্তির নিরিখেবলা যায়, শবেবরাত নামে ইসলামে কোনো মর্যাদার রাতের অস্তিত্ব নেই।
শাবানের মধ্যরাতের মর্যাদা : শবেবরাতের অস্তিত্ব শরয়িভাবে স্বীকৃত না থাকলেও ইসলামিশরিয়তে শাবান মাসের মধ্য রাতের (লাইলাতুল নিসফুশ শাবান) যে মর্যাদা নেই, তা নয়।রাসূল সা: থেকে আমাদের পর্যন্ত বেশ কিছু হাদিস পৌঁছেছে, যাতে শাবান মাসেরমধ্যরাত্রির মর্যাদা সাব্যস্ত হয়। ওই সব হাদিসের বেশির ভাগ দুর্বল হলেও দু-একটিসহিহ বিশুদ্ধ হাদিসও রয়েছে ।
১. হজরত আলী রা: রাসূলুল্লাহ সা: থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, ‘যখন শাবান মাসেররাত আসবে, তখন সে রাত ইবাদতে কাটাবে আর দিন কাটাবে রোজা রাখার মাধ্যমে; কেননাআল্লাহ তায়ালা ওই দিন সূর্যাস্তের সাথে সাথে প্রথম আকাশে অবতরণ করে বলেন, ‘কোনোক্ষমা প্রার্থনাকারী আছো কি, যাকে আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিক অন্বেষণকারী আছো কিযাকে আমি রিজিক দেবো; কোনো বিপদগ্রস্ত আছো কি যাকে আমি বিপদ থেকে ম্ক্তু করব।’এভাবে ফজর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে ।
পর্যালোচনা : হাদিসটি ইবনে মাজাহ তার সুনানে বর্ণনা করেছেন। এর সনদে আবু বকর ইবনআবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন আবু সামিরাহ দুর্বল (জইফ) রাবি। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বলএবং ইবনে মুঈন বলেন, ‘এ লোক মিথ্যা হাদিস রটাতেন। সুতরাং হাদিসটি সহিহ নয়।’২. হজরতআয়েশা রা: থেকে এক দীর্ঘ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তাতে তিনি বলেন, ‘আমি একদারাসূলুল্লাহ রা:-কে রাতে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তখন আমি তাঁকে খুঁজতে বেরিয়ে দেখি যেতিনি বাকিতে আকাশের দিকে হাত উত্তোলন করে দোয়া করছেন। আয়েশাকে দেখে তিনি বললেন, তুমি কি মনে করেছ যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার ওপর কোনো জুলুম করেছেন!’হজরতআয়েশা বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি ধারণা করেছিলাম, আপনি আপনার অন্যকোনো স্ত্রীর কাছে পদার্পণ করেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘শাবান মাসেরমধ্যরাতে আল্লাহ তায়ালা প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হন, অতঃপর বিশালসংখ্যক মানুষকে তিনিক্ষমা করেন দেন ।
পর্যালোচনা : হাদিসটি ইমাম আহমদ, তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিজিবুখারির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, তিনি এ হাদিসটি দুর্বল বলেছেন। ৩. হজরত আবু মুসা নবীকরিম সা: থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের মধ্যরাতে একবিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতিরেকে সবাইকে ক্ষমা করে দেন ।
পর্যালোচনা : এ হাদিসখানা সহিহ। বর্তমান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস নাসিরউদ্দিন আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন ।
৪. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা: রাসূলুল্লাহ সা: থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের মধ্যরাতে এক বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। অতঃপর তিনিহিংসুক ও হত্যাকারী ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন ।
পর্যালোচনা : হাদিসটি সহিহ হওয়ার ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়াযায়। ইবনে হিব্বান তার ‘সহিহ’কিতাবে এটিকে উল্লেখ করেছেন। তাতে বোঝা যায়, তার কাছেহাদিসটি সহিহ। আবার ইমাম হাইসামি হাদিসটিকে ‘দুর্বল’বলেছেন; কেননা এর সনদে ইবনেলিহইয়া রয়েছে। সে মিথ্যা হাদিস রটনার অভিযোগে অভিযুক্ত।
৫. হজরত উসমান ইবনে আবিল আস রাসূলুল্লাহ সা: থেকে বর্ণনা করে বলেন, ‘যখন শাবানমাসের মধ্য রাত উপস্থিত হয়, তখন আহ্বানকারী (আল্লাহ তায়ালা) ডেকে ডেকে বলেন, কোনোক্ষমা প্রার্থনাকারী আছো কি, যাকে আমি আজ ক্ষমা করে দেবো, কোনো সাহায্যপ্রার্থনাকারী আছো কি যাকে আমি আজ তার প্রার্থনা অনুযায়ী দান করব। সেই দিন যে চাবেসেই পাবে। কিন্তু ব্যভিচারী ও মুশরিক ব্যক্তি ছাড়া ।
লোচনা : হাদিসটিকে কেউ কেউ ‘মুনকাতে’বলেছেন। যদি তাই হয় তবে হাদিসটি ‘দুর্বল’হাদিসের পর্যায়ভুক্ত। অবশ্য অনেকে মুত্তাসিল সনদের কথা বলেছেন। সে কথার আলোকেহাদিসটি সাহিহ ।এ মর্মে আরো বেশ ক’টি হাদিস বর্ণিত আছে। সেসব হাদিস সম্পর্কে ইবনে রজব হাম্বলি (একজন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস) বলেন, ‘এ মর্মে বর্ণিত অন্য সব হাদিস দুর্বল।
নিসফে শাবানের মর্যাদার ব্যাপারে আলেমদের অভিমত : শাবান মাসের মধ্যরাতের মর্যাদাসত্যিই আছে কি না, এ ব্যাপারে আলেমরা দুই ভাগে বিভক্ত : যথাÑ ১. বর্ণিত রয়েছেসাহাবাদের মধ্যে হজরত আলী রা: এ রাতের মর্যাদা দিতেন এবং তাবেয়িদের মধ্যে খালিদ বিনমা’দাল, মাকহুল, লোকমান বিন আমের প্রমুখ এ রাতের মর্যাদা দিতেন এবং ইবাদতে মনোনিবেশকরতেন। বাসরা ও শামের অনেকে এ মত অবলম্বন করেন। ২. আর মক্কা ও মদিনার অনেক আলেম, যেমনÑ আতা, ইবনু আবি মুলাইকা, আবদুর রহমান বিন জায়েদ এবং মালেকি মাজহাবের বেশির ভাগফকিহগণ মনে করেন, শাবান মাসের মধ্যরাতের মর্যাদাদান করা বিদআত কাজের মধ্যে শামিল।তারা মনে করেন, এ ধারণা মূলত ইসরাইলি রেওয়ায়েত থেকে মানুষের মনে জন্মলাভ করেছে এবংক্রমান্বয়ে সমাজে বিস্তৃতি লাভ করেছে।
নিরপেক্ষ মত : রাসূলুল্লাহ সা: থেকে বর্ণিত। শাবান মাসের মধ্যরাতের ফজিলত সম্পর্কিতহাদিসগুলোর পর্যালোচনার পর নিরপেক্ষভাবে এ কথা বলা যায়, ১. হাদিসগুলোর বেশির ভাগদুর্বল হাদিস। ২. ইমাম নাসিরুদ্দীন আলবানি একটা হাদিসকে সহিহ বলেছেন। সুতরাং কমহলেও এ রাতের ফজিলত সম্পর্কিত সহিহ হাদিস রয়েছে। ৩. বেশ ক’টি হাদিস এমন রয়েছে, যাকেকেউ কেউ দুর্বল বলেছেন আবার কেউ কেউ সহিহ বলেছেন ।সুতরাং বলতে পারি, শাবান মাসের মধ্যরাতের মর্যাদা সাব্যস্ত হয়েছে। তবে কয়েকটি কথাঅবশ্যই মনে রাখতে হবে : ১. ‘শবেবরাত’পরিভাষাটি ইসলামি পরিভাষা নয়। ২. প্রচলিতধারণা ‘এ রাতে গোটা বছরের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়’এ মর্মে কোনো সহিহ হাদিস নেই।সুতরাং এ ধারণা পোষণ করা যাবে না। ৩. শাবান মাসের মধ্যরাত দোয়া কবুলের রাত। যেমনপ্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ দোয়া কবুলের জন্য বিশেষিত। ৪. এ রাতে ইবাদত করতে চাইলেএকাকী বা পরিবারকে সাথে নিয়ে নিরিবিলি ইবাদত করার পদ্ধতিই অপেক্ষাকৃত ঊত্তম।
কিভাবে কাটাবেন শাবানের মধ্যরাত : যেসব আলেম শাবান মাসের মধ্যরাতের মর্যাদাকেস্বীকার করেন তারা এ রাতটি কাজে লাগানোর পদ্ধতির ব্যাপারে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছেন। (ক) একদল আলেমের মতে, এ রাতে সুরমা, সুগন্ধি ও ভালো পোশাক ব্যবহার করে মসজিদে গিয়েসারা রাত নফল ইবাদতে এবং জামাতের সাথে নামাজ আদায়ে কাটিয়ে দেয়া মুস্তাহাব। এ মতেরপক্ষে রয়েছে খালিদ বিন মাদান, লোকমান বিন আমের, ইসহাক বিন রাহওয়াইহ প্রমুখ। (খ) আরঅন্য একদল আলেমের মতে, এ রাতে নফল ইবাদত, বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা ও দোয়া করার জন্যমসজিদে জড়ো হওয়া মাকরুহ। তবে নিজস্ব পরিবেশে নফল নামাজ পড়ে দোয়া করে এ রাত কাটানোমাকরুহ নয়, বরং মুস্তাহাব। এ মত পোষণ করেছেন ইমাম আওজায়িসহ অনেকে ।
কোনটি সঠিক : একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায়, দ্বিতীয় মতটিই সঠিক; কারণ রাসূলসা: ও সাহাবায়ে কিরাম হচ্ছেন ইবাদত পালনের ধরন শিক্ষায় আমাদের জন্য বাস্তব নমুনা।তাদের কারো কারো থেকে এ রাতের মর্যাদা সম্পর্কিত বক্তব্যের কথা জানতে পাই। কিন্তুতারা জামাতের সাথে মসজিদে মসজিদে নফল ইবাদতে রাত কাটিয়েছেন এমন কোনো নজির পাওয়া যায় না।আল্লাহ আমাদের রাসূল সা:-এর দেখানো পদ্ধতিতে সর্বপ্রকার ইবাদত পালন করার তৌফিক দিন