জিয়াউল হক
ইসলাম একটি ধর্মের নাম বটে তবে এ ধর্ম আমাদের চেনা জানা আরও দশটি ধর্মের মত নয়। ‘ইসলাম’ নামের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে থাকে জীবনের সবকটি অঙ্গনে, সব ক’টি বিভাগে। মনুষ্য জীবনের এমন কোন বিভাগ নেই, এমন কোন অঙ্গন নেই, যেখানে ইসলাম তার প্রভাব বিস্তার করে না। ‘ইসলাম’ নামটির রয়েছে অনেক গভীর ও তাৎপর্যপূর্র্ণ অর্থ। এই নামের মধ্যেই রয়েছে ‘শান্তি’র একটি অভিধা, তেমনি এরই মাঝে রয়েছে ‘আনুগত্য’র একটি অঙ্গীকার, ‘আত্মসমর্পনের একটি সুস্পষ্ট ঘোষণা। এই শান্তি, এই আত্মসমর্পন, এই আনুগত্য একজন মানুষের সারাটি জীবনের প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মহুর্ত ব্যাপি। এই ‘শান্তি’ একজন মানুষের জীবনের প্রতিটি নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই ‘আত্মসমর্পণ’ একজন মানুষের জীবনের প্রতিটি ইচ্ছা অনিচ্ছার সাথে সম্পর্কিত।
ইসলামের যত শিক্ষা আর দর্শন রয়েছে, তার সবকটিই আবর্তিত হয় একজন ব্যক্তিকে ঘিরে। অথবা আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, এই আবর্তনের সূত্রপাত হয় একজন ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তাকে ঘিরে। এর পরে এর ব্যাপ্তি ও পরিধী ছড়িয়ে পড়ে ব্যক্তি হতে পরিবারে, সমাজে, কোন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বা দেশে এবং সর্বপোরি সমগ্র বিশ্বসমাজে। এই কারণেই আমরা বলি ইসলাম একটি বৈশ্বিক ধর্ম, সার্বজনীন মতবাদ।
জেনে বা না জেনে, বুঝে বা না বুঝে যারা, যে সব হতভাগা এর বিরোধিতা করেন তাদের কথা আলাদা। তাদের সাথে বিতর্কে জড়ালে আর কোন অর্থবহ আলোচনাই সম্ভব নয়। তবে এর মানে এই নয় যে, ইসলামের যথার্থতা নিয়ে কোন বিতর্ক চলতে পারেনা। পারে এবং ইসলাম সে বিতর্ককে বরং আমন্ত্রণ জানায়!
পূর্ণ আত্মবিশ্বাস আর আস্থার সাথে বিশ্বের যে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যে বা যাঁরা সত্যিকার অর্থেই জানতে বুঝতে চান, যারা সত্যিকার অর্থেই যুক্তি ও প্রমাণ নিয়ে আলোচনা করতে চান, তর্ক বিতর্কে মেতে উঠতে চান সত্য উদ্ঘাটনের জন্য, ইসলাম সব সময়ই তাদের সমাদরের সাথে আমন্ত্রণ জানায়। আহ্বান জানায়, বিতর্কে অংশ নেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। আল কুরআনের সচেতন পাঠক মাত্রই এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন যদি গভীর মনোযোগের সাথে আল কুরআনটি একবার পড়ে দেখতে যান অর্থ বুঝে বুঝে।
আমি এই নিবন্ধের শুরুতেই এক পর্যায়ে বলেছি, ইসলাম তার সকল শিক্ষা আর আহ্বান, তার সকল দাবী আর নির্দেশের প্রারম্ভেই একজন ব্যক্তিকে টার্গেট করে। অর্থাৎ ইসলাম মনুষ্য চরিত্রে যে পরিবর্তনের দাবী করে, যে পরিবর্তনের সূত্রপাত করে বা করতে বলে বা আহ্বান জানায়, তার প্রাথমিক টার্গেট হলো একজন মানুষের ব্যক্তি চরিত্র। একজন মানুষের ব্যক্তিমানস, তাঁর ভেতর বাহির, তাঁর চিন্তা-চেতনা, শিক্ষা-আদর্শ, তাঁর চিন্তাধারা, কর্মধারা এবং এক কথায় তার পুরো জীবনধারাকেই সে টার্গেট করে।
যদি বাস্তবিকই কোন অর্থবহ পরিবর্তন হতে হয়, তবে তা হতে হবে আগে এবং সর্বাগ্রে এই ব্যক্তি মন মানসে, এই ব্যক্তি মনোজগতে। মনোজগতের এই পরিবর্তনের প্রকাশ হতে হবে তার কাজ-কর্মে, ব্যক্তির উঠা-বসায়, চলা-ফেরায়, তার জীবন ধারণে, তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি মুহূর্তে।
ইসলাম যে শান্তি আর সমৃদ্ধির কথা বলে, আশ্বাস দেয়, ইসলাম যে মুক্তি আর প্রগতির কথা নির্দেশ করে, যে আনুগত্য ও অঙ্গীকারের নির্দেশনা দেয়, তা এই ব্যক্তি জীবনেই সর্বাগ্রে প্রতিফলিত হতে বাধ্য। আর আমাদের আজকের আলোচনাও এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক পরিবর্তনকে নিয়েই।
আমরা ইতিমধ্যেই বলেছি যে, ইসলাম একজন ব্যক্তির ব্যক্তি মানসেই সবার আগে পরিবর্তনের সূচনা করতে চায়, করতে বলে। এই মৌলিক ক্ষেত্রটিতে কোন পরিবর্তন ছাড়া তার বাহ্যিক আচার আচরণে যতই পরিবর্তন হোকনা কেন বা হয়েছে বলে মনে হোকনা কেন, আসলে তার কোন মূল্যই নেই, কোন গুরুত্বও নেই। এই সব হলো একটি মরিচীকার মত।
সংশ্লি¬ষ্ট ব্যক্তির কাছে এর কোন মূল্য আছে কিনা সেটা বড় কথা নয়! বড় কথা হলো ইসলামের কাছে এর কোন মূল্য নেই। ইসলামি সমাজের কাছে, এই সমাজের অন্যান্য মুসলমানের কাছে এই মেকি পরিবর্তনের কোন মূল্য যেমন নেই, তেমনি তার কোন গ্রহণযোগ্যতাও নেই।
এই বাস্তবতাকে মাথায় রেখেই আমরা যারা একটি আদর্শকে ধারণ করি, সেই আদর্শকে আমাদের সমাজ, এমনকি বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন্ দেখি, তাদের একটাবার উচিৎ ডানে বামে নয়, বাহিরে কোন দিকেও নয়, বরং একেবারে নিজের মনের গভীরে দৃষ্টি দেয়া। তীল তীল করে খুঁজে ফেরা দরকার অন্তরের অলীন্দে নীলয়ের প্রতিটি কোণে কোণে। দেখা দরকার, আমরা যারা ‘ইসলাম’ নামের একটি আদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার কথা বলি, আহ্বান জানাই, এ ব্যাপারে অন্যকে ডেকে বেড়াই, সেই আমাদের ব্যক্তি চরিত্রে কতটুকু ইসলাম আছে? কতটুকু ইসলামকে আমরা আমাদের নিজেদের চরিত্রে ধারণ করতে, আত্মস্থ করতে পেরেছি?
কোন আদর্শের একজন কর্মী হিসেবেই কেবল নয় বরং ইসলামের একজন অনুসারী মুসলমান হিসেবেই এটা বড় বেশি জরুরী বরং মৌলিক প্রয়োজনগুলোর একটি। অন্যতম একটি! এই আত্মসমালোচনাই হলো একজন ব্যক্তির আত্মগঠনের প্রথম ধাপ। এই ধাপ অতিক্রম না করে কেউ কোনদিন তার পরবর্তী ধাপে উন্নীত হতে পারে না, তেমনটা প্রত্যাশাও করা যায় না! এটা একটা অসম্ভব প্রত্যাশা, আকাশ কুসূম কল্পনা মাত্র!
আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের কথা পরে আসুক, আগে আসুক আমাদের একান্ত ব্যক্তি মন-মানসের কথা। এখানে আমরা কতটা ইসলাম ও তার শিক্ষাকে আত্মস্থ করতে পেরেছি? একজন ব্যক্তির মন-মানসকে যদি ইসলামি মূল্যবোধে বিচার করতে হয় তবে যে জিনিসটি সবচেয়ে প্রথম দেখা দরকার তা হলো, ব্যক্তির মন-মানসে কতটা আল্লাহভীতি জায়গা করে নিয়েছে বা আদৌ তা নিয়েছে কিনা।
পরিবর্তনের ধারা এখান থেকেই আরম্ভ হয় এবং যে কোন ধরনের অর্থবহ পরিবর্তনের সূচনাও হয় ব্যক্তির মন-মানসে আল্ল¬াহভীতি জায়গা করে নেবার মাধ্যমে। ইসলামি পরিভাষায় এটাকেই বলা হয় ‘ত্বাক্কওয়া’। এটাকেই বলা হয় পরহেজগারী।
এটাই হলো সেই নিয়ামক শক্তি, সেই নিয়ামক বা অনূঘটক যা একজন ব্যক্তির জীবনের সার্বিক অঙ্গণে অন্য সকল পরিবর্তনের সূচনা করে থাকে। তার সকল কাজ কর্মই কেবল নয় বরং ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, জাতি ও দেশ সকলের সাথে তার সম্পর্ককে নিধারণ করে দেয়, তার চাল চলন, আচার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে, পরিচালিত করে। এ কারণেই আল কুরআনে ত্বাকওয়াকে একটি পোশাকের সাথেই কেবল তুলনা করা হয়নি বরং সর্বোত্তম আচ্ছাদন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
এই বাস্তবতা যদি আমরা স্বীকার করে নেই, (আমরা স্বীকার করি বা না করি এটাই বাস্তবতা, এক নিরেট ও অকাট্য বাস্তবতা। অস্বীকার করার কোন কারণ নেই, সুযোগও নেই) তবে আমাদের বাঁকি কাজটুকু অর্থাৎ আত্মবিশ্লেষণের বাঁকি পথটুকু সুগম হয়ে যায়। এটিকে স্বীকার করে নিলে এর পরে আগে বাড়া সম্ভব হয়, যেখানে আমরা আমাদের মনের ভেতরে ডুব দিতে পারি, এক এক করে বিচার করে দেখতে পারি আমার বা আমাদের নিজের প্রতিটি আচার আচারণ, আর কাজ কর্ম।
বিচারের এই মানদ- কিন্তু আমাদের সামনেই আছে। আমাদের নাগালের মাঝেই সর্বক্ষণ বিরাজমান। দু’টি উৎসমূল নিয়ে গঠিত এই মানদন্ডের প্রথমটি হলো তাত্ত্বিক উৎস, যেটি আল কুরআন। আর দ্বিতীয়টি হলো সেই তাত্ত্বিক উৎস আল কুরআনের বাস্তব ব্যবহারিক গাইড, যাকে আমরা সুন্নাহ বলে জানি।
এ দুটো উৎসকে হাতের নাগালের মধ্যে নিয়ে একটু সময় করে আসুন আমরা বসি আর খুঁজে দেখি জীবনের কোন অংগণ এমন আছে, যে অংগণের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা, উদাহারণ’সহ এই দুটি উৎসে বর্ণিত হয়নি? জীবনের কোন অঙ্গণ এমন আছে, যে অঙ্গণের জন্য প্রয়োজনীয় বিধান উপমা সহকারে এই দুটি উৎসে বিবৃত হয়নি? যদি তেমনটি হয়েই থাকে তবে তা তো হয়েছে এই আমাদের জন্যই!
অতএব এখন এটা আমাদেরই দায়িত্ব, এই আমাদেরকে সেইসব উৎসে বর্ণিত নির্দেশনা আর ব্যবহারিক প্রয়োগ পদ্ধতির সাথে মিলিয়ে একবার যাচাই করে নেওয়া। বিচারের ভার আর কারো হাতে ছেড়ে দিয়ে নয় বরং নিজেদের হাতেই সে ভার রেখে, নিজেদের ভেতরে কতটুকু পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, কতটুকু ত্বাক্কওয়া আসন গেড়েছে, সে পরিমাপটুকু করে নেয়া।
এটা একটি সার্বক্ষণিক প্রক্রিয়া। প্রতিটি মুসলমানের জন্য। বিশেষ করে, এবং আবারও বলছি বিশেষ করে, সেই ব্যক্তির জন্য, যিনি ইসলামকে সমাজের সামনে, মানুষের সামনে তুলে ধরতে চান, তাদের এই আদর্শের দিকে আহ্বান জানাতে চান, ডাক দিতে চান। এই জন্যই আসুন আমরা এই সার্বক্ষণিক প্রক্রিয়ার সাথে নিজেদেরকে সচেতন ও সযত্ন প্রয়াসে জড়িয়ে রাখি। এই প্রক্রিয়াটি হলো আত্মবিশ্লেষণের প্রক্রিয়া, আত্মসমালোচনার প্রক্রিয়া।
আমরা সবাইতো যার যার জীবন জীবিকার কাজে সব সময় ব্যস্ত থাকি এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে। আমাদের এই বাস্তব জীবনে সময় খুবই কম। কম বটে কিন্তু তার পরেও দেখা যায় আমাদের বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা, কিংবা চিত্ত বিনোদনের জন্য সময় বরাদ্দ করতে সময়ের অভাব হয়না। টিভি কিংবা ভি সি আর কিংবা রাজনৈতিক মিটিং মিছিল আর ভারী ভারী নামের আড়ালে সেমিনার- সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা চালিয়ে দেই! রাজনৈতিক বিতর্কে একবার পড়লেতো আমাদের রাতটাই পার হয়ে যায় ঐ এক বিতর্কেই। সেখানে আমাদের অঢেল সময়! অঢেল ফুরসৎ!!
অভাব কেবল এই আত্মসমালোচনা করার জন্য হাতে গোণা ক’টা মিনিট! আচ্ছা তা না হয় হলো, সময় যখন নেই, সময়ের যখন এতই অভাব! তখন একটি কাজতো করা যায়, ক্লান্ত শরীরে বিছানায় একটু সকাল সকাল গা এলিয়ে দেয়া যায়।
এটা খুবই সহজ কাজ, এবং এই সহজ কাজটিতে অবশ্য আমাদের কারোরই কোন আলস্যতা নেই। অতএব, আসুন এই সহজ কাজটিই করি, একটু সকাল সকাল বিছানায় গা এলিয়ে দেই। দু’চোখ জুড়ে ঘুমটি নামার আগে দশটি মিনিট চোখ বুঁজে পড়ে থাকি, মনে মনে কল্পনা করে নেই ‘আমি মহান আল্ল¬াহর সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে আমার সারা জীবনের নয়, বরং কেবলমাত্র আজকের এই একটি দিনে যা যা করেছি, যেভাবে চলেছি তার হিসাব নিকাশ চলছে, সারাটি দিনে আমার দ্বারা সম্পাদিত প্রতিটি কথা আর কাজের ব্যাপারে তিনি এক এক করে প্রশ্ন করে চলেছেন আর আমি তার জবাব দিয়ে চলেছি’।
আসুনতো দেখি, আমরা আমাদের এই বিশাল জীবনের হাজার হাজার দিনের মধ্য থেকে মাত্র একটি দিনের মাঝে কৃত সকল কর্মকাণ্ডের জবাবদীহিতায় উত্তীর্ণ হতে পারি কিনা!
এটা একটি পরীক্ষমূলক মহড়া মাত্র! এই মহড়াতেই যদি আমরা ফেল করি, তা হলে ভাবুন সেই আসল প্রশ্নোত্তরের দিনটিতে কি অবস্থা হবে? তখন কি অবস্থা দাঁড়াবে এই আমাদের?
অতএব এটা সহজেই বোধগম্য যে, সময় থাকতে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়াটাই হলো বুদ্ধিমানের কাজ। আসুন আমরা একটি দিনের ১৪৪০ মিনিটের মধ্যে থেকে খুব বেশি সময় যদি নাও পারি, তবে অন্তত মাত্র ১৫ টি মিনিট বরাদ্দ করি! একটু বুদ্ধিমানের পরিচয় দিতে পারি কিনা সে চেষ্টা করি।
আসুন সময় থাকতে একটু সাধন করে নেই, সময় চলে গেলে কিন্তু এই সাধনটুকুও আর হবেনা। আমরা যেন ভুলে না যাই প্রখ্যাত লোক সংগীতের সেই বিখ্যাত পংক্তি ‘ সময় গেলে সাধন হবে না’!