তাওহীদের আক্ষরিক অর্থ একীকরণ ( কোন কিছু এক করা) অথবা দৃঢ়ভাবে এককত্ব ঘোষণা করা এবং এটার উৎপত্তি আরবী ‘ওয়াহহাদা’ শব্দ হতে যার অর্থ এক করা, ঐক্যবদ্ধ করা অথবা সংহত হওয়া। কিন্তু যখন তৌহিদ শব্দটি আল্লাহর (অর্থাৎ তৌহিদুল্লাহ) সম্বন্ধে ব্যবহৃত হয় তখন আল্লাহ সম্পর্কিত মানুষের সকল পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কর্মকান্ডে আল্লাহর এককত্ব উপলদ্ধি করা ও তা নিরবচ্ছিন্নভাবে অক্ষুন্ন রাখা বুঝায়। আল্লাহ এক, তাঁর আধিপত্যে এবং তাঁর কর্মকান্ডে (রবুবিয়াহ) কোন শরীক বা অংশীদার নেই। এটাই বিশ্বাস যে, আল্লাহ একক, তাঁর রাজত্বে এবং কর্মে কোন শরীক নেই (রবুবিয়াহ)।
তিনি তাঁর মৌলিকত্বে এবং গুণাবলীতে অতুলনীয় (আসমা ওয়াস সিফাত) এবং উপাস্যরূপে চির অপ্রতিদ্বন্দ্বী (উলুহিয়াহ/ইবাদাহ)।
এই তিনটি বিষয়কে ভিত্তি করে তাওহীদের শ্রেণী বিন্যাস করা হয়েছে। এই শ্রেণী তিনটি পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং একটির সঙ্গে অপরটি এতই অবিচ্ছেদ্য যে, কেউ যদি একটি বিষয় বাদ দেন তাহলে তিনি তাওহীদের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হবেন। উপরে বর্ণিত তাওহীদের যে কোন একটি বিষয় বাদ দেয়াকে “শির্ক” (অংশীদারী) বলে; আল্লাহকে অংশীদারদের সঙ্গে সংযুক্ত করা, যা ইসলাম অর্থে প্রকৃতপক্ষে পৌত্তলিকতা।
তাওহীদের তিন শ্রেণীকে সাধারণতঃ নিম্নলিখিত শিরোনামে উল্লেখ করা হয়ে থাকেঃ
১) তাওহীদ আর-রবুবিয়াহ (প্রতিপালকের এককত্ব অক্ষুন্ন রাখা)
২) তাওহীদ আল-আছমা ওয়াছ ছিফাত (আল্লাহর নাম ও গুনাবলীর এককত্ব বজায় রাখা)
৩) তাওহীদ আল-ইবাদাহ (আল্লাহর ইবাদতের এককত্ব বজায় রাখা)
রাসুল (সঃ) এর সময় তাওহীদের মূল তত্ত্বগুলি এমনভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন ছিল না বিধায় রাসূল (সাঃ) অথবা তাঁর সাহাবাগণ কর্তৃক তাওহীদকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়নি। তা সত্ত্বেও,কুরআনের আয়াত এবং রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাগণের ব্যাখ্যামূলক বক্তব্যের মাধ্যমে তাওহীদের শ্রেণীগুলি ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে।
তাওহীদ আর-রবুবিয়াহ
তাওহীদ আর-রবুবিয়ার মূল কথা হচ্ছে যে যখন কিছুই ছিল না তখন আল্লাহ একাই সকল সৃষ্টিকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দেন; সৃষ্টি থেকে অথবা সৃষ্টির জন্য কোন প্রয়োজন মেটানোর কারণ ব্যতিরেকেই আল্লাহ সৃষ্ট জগৎ প্রতিপালন করেন। তিনি সমগ্র বিশ্ব ও এর অধিবাসীদের একমাত্র প্রভু এবং তাঁর সার্বভৌমত্বের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। আরবী ভাষায় “রবুবিয়াহ” শব্দটির মূল ধাতু হচ্ছে “রব” (প্রতিপালক) যা একই সাথে সৃষ্টি ক্ষমতা এবং প্রতিপালন উভয় গুণের পরিচয় বহন করে। এই শ্রেণী বিন্যাস অনুযায়ী আল্লাহই একমাত্র সত্যিকার শক্তি, তিনিই সকল বস্তুর চলাফেরা ও পরিবর্তনের ক্ষমতা দিয়েছেন। তিনি যেটুকু ঘটনা ঘটাতে দেন সেটুকু ব্যতীত সৃষ্টি জগতে কিছুই ঘটে না। এই বাস্তবতার স্বীকৃতি স্বরূপ রাসূল মুহাম্মদ (সঃ) প্রায়ই “লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ”(আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত কোন বিচলন অথবা ক্ষমতা নেই) বলে বিস্ময়সূচক উক্তি করতেন।
কুরআনের বহু আয়াতে রবুবিয়াহ আকীদার ভিত্তি পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহ বলেছেন-
১) “আল্লাহ সমস্ত কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সমস্ত কিছুর নিয়ন্তা।” (সূরা আয-যুমার ৩৯: ৬২)
২) অথচ আল্লাহই তোমাদেরকে এবং তোমরা যা কর তা সৃষ্টি করেছেন? (সুরা আছ্-ছাফফাত ৩৭: ৯৬)
৩) আর তুমি নিক্ষেপ করনি যখন তুমি নিক্ষেপ করেছিলে; বরং আল্লাহই নিক্ষেপ করেছেন (সূরা আল্-আনফা’ল ৮: ১৭)
৪) “আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে কোন বিপদই আপতিত হয় না।” (সূরা আত্-তাগাবুন ৬৪: ১১)
রাসূল (সঃ) এই ধারণার আরও বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন,
واعلم أن الأمةلو اجتمعت على أن ينفعوك بشيء لم ينفعوك إلابشيء قد كتبه الله لك,وإن اجتمعواعلى أن يضروك بشيء لم يضروك إلا بشيء قد كتبه الله عليك , رفعت الأقلام وجفت الصحف رواه الترمذي وقال : حديث حسن صحيح
সাবধান, যদি সমস্ত মানব জাতি তোমাকে সাহায্য করার জন্য কিছু করতে চায়, তারা শুধু অতটুকুই করতে সক্ষম হবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য আগেই লিখে রেখেছেন। অনুরূপ, যদি সমস্ত মানব জাতি ক্ষতি করার জন্য একত্রিত হয়, তারা শুধু ততটুকুই ক্ষতি করতে সক্ষম হবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য আগেই লিখে রেখেছেন। কাজেই, মানুষ যা সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য বলে ধারণা করে তা শুধুমাত্র এই জীবনের পুর্ব নির্ধারিত পরীক্ষার অংশ। আল্লাহ যে ভাবে নির্ধারণ করে রেখেছেন সেই ভাবেই ঘটনাসমূহ সংঘটিত হয়।
তাওহীদুর রবুবিয়্যার প্রতি ঈমানের দাবী হচ্ছে নিম্নে লিখিত ক্ষেত্রে আল্লাহর একত্ব মেনে নেয়াঃ
১) “আল্লাহই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা”- সূরা আন‘আম ৬:১০২/ আরাফ ৭:৫৪/ যুমার ৩৯:৬৫/ সাফফাত ৩৭:৯৬।
২) “তিনিই আসমান, যমীন এবং এর মধ্যবতী সবকিছুর প্রতিপালক”- সূরা ফাতিহা ১:১/ শুয়ারা ২৬:২৪/ নাস ৪:১।
৩) “তিনিই সবপ্রানীর একমাত্র জীবিকা দাতা”- সূরা হুদ ১১:৬/ যারিয়াত ৫১:৫৮।
৪) “সমস্ত কিছুর একচ্ছত্র মালিকানা তাঁরই”- সূরা বাকারা ২:২৫৫/ মু’মিনুন ২৩:৮৪-৮৫।
৫) “আল্লাহই আসমান-যমীন সহ সব কিছুর পরিচালনাকারী”- সূরা সাজদা ৩২:৫।
৬) “আল্লাহই আসমান, যমীন এবং এর মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর একচ্ছত্র কতৃর্ ত্বের অধিকারী”- সূরা মু’মিনুন ২৩:৮৮।
৭) “আল্লাহই একমাত্র সার্বভৌমত্বের অধিকারী”- সূরা আলে ইমরান ৩:২৬/ ফোরকান ২৫:২/ আরাফ ৭:১৫৮।
৮) “আল্লাহই একমাত্র আইন-বিধান দাতা, হালাল-হারাম ঘোষনাকারী”- সূরা ইউসুফ ১২:৪০/ আরাফ ৭:৫৪/ রাদ
১৩:৪১/ কাসাস ২৮:৭০, ৮৮/ আন’আম ৬:৫৭/ ১০:৫৯/ ৯:৩৭/ ৫:৫০/ নাহল ১৬:১১৬।
৯) “তিনিই ভাল-মন্দ নির্ধারণকারী, সাহায্যকারী, বিপদাপদ দাতা এবং মুক্তিদাতা, রক্ষাকর্তা”- সূরা তাগাবুন ৬৪:১১/
ইউনুস ১০:১০৭/ আন’আম ৬:৬৪/ আলে ইমরান ৩:২৬/ ৭:১৮৮/ ৩:১৫০/ ৩৬:৭৪-৭৫।
১০) “তিনিই একমাত্র সন্তানদাতা এবং জীবন-মৃত্যুর মালিক”- সূরা শুরা ৪২:৪৯-৫০/ হাজ্জ ২২:৬৬।
১১) “তিনিই একমাত্র গায়েব বা অদৃশ্যের জ্ঞানী”- সূরা আন’আম ৬:৫৯/ নামল ২৭:৬৫/ লুকমান ৩১:৩৪।
তাওহীদ আল্-আছ্মা ওয়াছ-ছিফাত (আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর এককত্ব বজায় রাখা)-এই শ্রেণীর তাওহীদের চারটি প্রধান রূপ আছেঃ
১) আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর এককত্ব বজায় রাখার প্রথম শর্ত হ’ল, কুরআন এবং হাদীসে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ) আল্লাহর যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন সেভাবে ছাড়া আর কোনভাবে আল্লাহর নাম এবং গুণাবলীর বর্ণনা দেয়া যাবে না। তিনি বলেন,
আর যেন তিনি শাস্তি দিতে পারেন মুনাফিক নারী-পুরুষ ও মুশরিক নারী-পুরুষকে যারা আল্লাহ সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ করে; তাদের উপরই অনিষ্টতা আপতিত হয়। আর আল্লাহ তাদের উপর রাগ করেছেন এবং তাদেরকে লা‘নত করেছেন, আর তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জাহান্নাম; এবং গন্তব্য হিসেবে তা কতইনা নিকৃষ্ট! (সূরা আল্-ফাত্হ্ ৪৮: ৬)
কাজেই ক্রোধ আল্লাহর গুণাবলীর একটি। এটা বলা ভূল হবে যে, যেহেতু ক্রোধ মানুষের মধ্যে একটি দুর্বলতার চিহ্ন যা আল্লাহর জন্য শোভন নয় সেহেতু আল্লাহর ক্রোধ অবশ্যই তাঁর শাস্তি বুঝায়। “কোন কিছুই তাঁহার সদৃশ নহে” (সূরা আশ্-শূরা ৪২: ১১)
২) তাওহীদ আল্-আছ্মা ওয়াস-সিফাত এর দ্বিতীয় রূপ হ’ল আল্লাহর উপর কোন নতুন নাম ও গুণাবলী আরোপ না করে তিনি নিজেকে যেভাবে উল্লেখ করেছেন সেভাবেই তাঁকে উল্লেখ করা। উদাহরণস্বরূপ, যদিও তিনি বলেছেন যে তিনি রাগ করেন তথাপি তাঁর নাম আল্-গাদিব (রাগী জন) দেয়া যাবে না কারণ আল্লাহ বা তাঁর রাসুল (সাঃ) কেউ এই নাম ব্যবহার করেননি। এটা একটি ক্ষুদ্র বিষয় মনে হতে পারে,কিন্তু আল্লাহর অসত্য বা ভূল বর্ণনা রোধ করার জন্য তৌহিদ আল্-আছ্মা ওয়াছ-ছিফাত অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ সসীম মানুষের পক্ষে কখনোই অসীম স্রষ্টার সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়।
৩) তাওহীদ আল্-আছ্মা ওয়াছ-ছিফাত এর তৃতীয় শর্ত অনুযায়ী আল্লাহকে কখনোই তাঁর সৃষ্টির গুণাবলি দেয়া যাবে না। উদাহরণস্বরূপ, বাইবেল ও তৌরাতে দাবী করা হয় যে আল্লাহ ছয় দিনে বিশ্ব সৃষ্টি করেন এবং তারপর সপ্তম দিনে নিদ্রা যান। এই কারণে ইহুদি ও খৃষ্টানগণ হয় শনিবার নতুবা রবিবারকে বিশ্রামের দিন হিসাবে নেয় এবং ঐ দিন কাজ করাকে পাপ বলে গণ্য করে। এই ধরণের দাবী স্রষ্টার উপর তাঁর সৃষ্টির গুণাবলী আরোপ করে। মানুষই গুরুভার কাজের পর ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং সবলতা পুনরুদ্ধারের জন্য তাদের ঘুমের প্রয়োজন হয়। এর বিপরীতে আল্লাহ কুরআনে পরিস্কারভাবে উল্লেখ করেছেন,
‘‘তাঁহাকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।’’ (সূরা আল বাকারা ২: ২৫৫)
বাইবেল ও তৌরাতের অন্য জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে যে মানুষ যেমন তার ভূল উপলদ্ধি করে অনুতপ্ত হয় তেমনি স্রষ্টাও তাঁর খারাপ চিন্তার জন্য অনুতপ্ত হন।অনুরূপভাবে স্রষ্টা একটি আত্মা অথবা তাঁর একটি আত্মা আছে বলে দাবী করা তৌহিদ আল্-আছমা ওয়াছ ছিফাতকে সম্পুর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। আল্লাহ কোরআনের কোন জায়গায় নিজেকে আত্মা বলে উল্লেখ করেননি অথবা তাঁর রাসুল (সঃ) হাদিসে ঐ ধরণের কোন বক্তব্য প্রদান করেননি। প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহ আত্মাকে তাঁর সৃষ্টির একটি অংশ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।আল্লাহর গুণাবলী উল্লেখ করতে কোরআনের আয়াতকে মৌলিক নিয়ম হিসাবে অনুসরণ করতে হবে,
“কোন কিছুই তাঁহার সদৃশ নহে, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা আশ-শূরা ৪২ : ১১)
শ্রবণ ও দর্শন মানুষের গুণাবলী কিস্তু যখন স্রষ্টার উপর আরোপিত করা হয় তখন সেগুলি তুলনাবিহীন এবং ত্রুটিমুক্ত। যাহোক এই গুণাবলী মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চোখ ও কান অপরিহার্য, যা স্রষ্টার জন্য প্রযোজ্য নয়। স্রষ্টা সম্বন্ধে মানুষ কেবলমাত্র ততটুকুই জ্ঞাত যতটুকু তিনি তাঁর পয়গম্বরদের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। সুতরাং, মানুষ এই সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে অবস্থান করতে বাধ্য। মানুষ যদি স্রষ্টার বর্ণনা দিতে লাগামহীন বুদ্ধি প্রয়োগ করে তাহলে আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির গুণাবলীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার মত ভুলের সম্ভবনা থেকে যায়।
কল্পিত চিত্রের প্রতি আসক্তির কারণে খৃষ্টানরা মানুষ সদৃশ অগণিত চিত্র অঙ্কন, খোদাই এবং ঢালাই করে সেগুলিকে স্রষ্টার প্রতিচ্ছবি নাম দিয়েছে। এইগুলি জনগণের মধ্যে যিশুখৃষ্টের দেবত্বের স্বীকৃতি আদায় করতে সাহায্য করেছে। স্রষ্টা মানুষের মত, একবার এই কল্পনা গ্রহণযোগ্য হলে, যিশুখৃষ্টকে স্রষ্টা হিসাবে গ্রহণ করতে সত্যিকার কোন সমস্যা দেখা দেয় না।
৪) আল্লাহর নামের এককত্ব বজায় রাখার আরও অর্থ হ’ল যদি নামে আগে আব্দ’ (অর্থ ভৃত্য অথবা বান্দা) সংযোজিত না করা হয় তাহলে তার সৃষ্টিকে আল্লাহর কোন নামে নামকরণ করা যাবে না। কিস্তু ‘রাউফ’ এবং ‘রহিম’ এর মত বহু স্বর্গীয় নাম মানুষের নাম হিসাবে অনুমোদিত কারণ রাসুল (সঃ) কে উল্লেখ করতে যেয়ে আল্লাহ এই ধরনের কিছু নাম ব্যবহার করেছেন। হিসাবে স্বর্গীয় গুণে গুনাম্বিত করেছে। এঁটা করতে যেয়ে তারা সেই সব প্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি করেছে যারা স্রষ্টার অদ্বিতীয় গুণাবলির অংশীদার এবং আল্লাহর সমসাময়িক।
নিশ্চয় তোমাদের নিজদের মধ্য থেকে তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছেন, তা তার জন্য কষ্টদায়ক যা তোমাদেরকে পীড়া দেয়। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, (রাউফ) পরম দয়ালু (রহিম)। (সূরা আত্-তওবা ৯: ১২৮)
কিস্তু ‘আর-রাউফ’ (যিনি সবচেয়ে সমবেদনায় ভরপুর) এবং ‘আর রহিম’ (সবচেয়ে ক্ষমাশীল) মানুষের ব্যাপারে তখনই ব্যবহার করা যাবে যখন নামের আগে আবদ ব্যবহার করা হবে, যেমন আব্দুর-রাউফ অথবা আব্দুর রহিম। আর-রাউফ এবং আর রহিম এমন এক পূর্ণতার প্রতিনিধিত্ব করে যা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই প্রযোজ্য। তেমনিভাবে,আব্দুর-রাসূল (বার্তাবাহকের গোলাম), আব্দুন-নবী (রাসুলের গোলাম), আব্দুল-হুসাইন (হুসাইনের গোলাম) ইত্যাদি নামগুলি নিষিদ্ধ, কারণ এখানে মানুষ নিজেদেরকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের গোলাম হিসাবে ঘোষণা করেছে। এই মতবাদের ভিত্তিতে, রাসুল (সঃ) মুসলিমদের তাদের অধীনস্থদের ‘আবদী’ (আমার গোলাম) অথবা ‘আমাতী’ (আমার বাঁদী) বলে উল্লেখ করতে নিষেধ করেছেন।
তাওহীদ আল উলুহিয়্যা বা ইবাদাহ্ (আল্লাহর ইবাদতের এককত্ব বজায় রাখা)
প্রথম দুই শ্রেণীর তাওহীদের ব্যাপক গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা থাকলেও শুধুমাত্র সেগুলির উপর দৃঢ় বিশ্বাসই তৌহিদের ইসলামী প্রয়োজনীয়তা পরিপূরণে যথেষ্ট নয়। ইসলামী মতে তৌহিদকে পরিপূর্ণতা দেয়ার জন্য তৌহিদ আর-রবুবিয়াহ এবং আল্-আছমা ওয়াছ-ছিফাত অবশ্যই এদের পরিপূরক তৌহিদ আল্-ইবাদাহ্-র সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। এই বিষয়টি যে ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত তা’হল আল্লাহ নিজেই পরিস্কার ভাষায় উল্লেখ করেছেন যে রাসুলের সময়কার মুশরিকগণ (পৌত্তলিকগণ) তৌহিদের প্রথম দুই শ্রেণীর বহু বিষয় সত্য বলে স্বীকার করেছিল। কুরআনে আল্লাহ রাসুল (সঃ)-কে পৌত্তলিকদের বলতে বলেছেন,
বল, ‘আসমান ও যমীন থেকে কে তোমাদের রিয্ক দেন? অথবা কে (তোমাদের) শ্রবণ ও দৃষ্টিসমূহের মালিক? আর কে মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন আর জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন? কে সব বিষয় পরিচালনা করেন’? তখন তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ’। সুতরাং, তুমি বল, ‘তারপরও কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না’? (সুরা ইউনুছ ১০: ৩১)
আর তুমি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, কে তাদেরকে সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ।’ তবু তারা কীভাবে বিমুখ হয়? (সুরা আয-যুখরুফ ৪
আর তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন কর,কে আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন,অতঃপর তা দ্বারা যমীনকে তার মৃত্যুর পর সঞ্জীবিত করেন’? তবে তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। (সুরা আল-আনকাবুত ২৯: ৬৩
পূর্বে উল্লেখকৃত আয়াতে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কাফেররা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, রাজত্ব ও ক্ষমতা সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিল। প্রকৃতপক্ষে, ভীষণ প্রয়োজন এবং দুর্যোগের সময় তারা বিশ্বস্ততার সঙ্গে হজ্জ, দান, পশু বলি, মানত এমনকি উপাসনাও করত। এমনকি তারা ইব্রাহিমের ধর্ম অনুসরণ করছে বলেও দাবি করত। ঐ ধরণের দাবীর কারণে আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করলেনঃ
“ইব্রাহিম ইয়াহুদীও ছিল না, খৃস্টানও ছিল না,সে ছিল একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণকারী এবং সে মুশরিকদের অস্তুর্ভুক্ত ছিল না।” (সুরা আল-ইমরান ৩ঃ৬৭)
মক্কাবাসীরে তৌহিদ সম্পর্কে স্বীকারোক্তি এবং আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা সত্বেও একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি তারা অন্যান্য দেবদেবীর উপাসনা করার কারণে আল্লাহ তাদেরকে নাস্তিক (কাফের) এবং পৌত্তলিক (মুশরিক) হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন।
ফলে তৌহিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হ’ল তৌহিদ আল-ইবাদাহ অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদতে এককত্ব বজায় রাখা। যেহেতু একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত প্রাপ্য এবং মানুষের ইবাদতের ফল হিসাবে একমাত্র তিনিই মঙ্গল মঞ্জুরী করতে পারেন,সেজন্য সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহকে উদ্দেশ্য করেই করতে হবে। অধিকস্তু,মানুষ এবং স্রষ্টার মধ্যে যে কোন ধরণের মধ্যস্থতাকারী অথবা যোগাযোগকারীর প্রয়োজন নেই। আল্লাহ একমাত্র তাঁকে উদ্দেশ্য করেই ইবাদতের গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং এটাই সকল পয়গম্বর কর্তৃক প্রচারিত বার্তার সারমর্ম। আল্লাহ বলেছেন-
“আর জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ইবাদাত করবে।” (সুরা আয-যারিয়াত ৫১: ৫৬)
আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং পরিহার কর তাগূতকে। (সুরা আন-নাহল ১৬: ৩৬)
সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে উপলদ্ধি করা মানুষের সহজাত ক্ষমতার উর্দ্ধে। মানুষ একটি সসীম সৃষ্টিকর্ম এবং তার নিকট হতে অসীম স্রষ্টার ক্রিয়াকান্ড সম্পুর্ণ যুক্তিসঙ্গতভাবে উপলদ্ধি আশা করা যায় না। এই কারণে স্রষ্টা তাঁকে ইবাদত করা মানুষের স্বভাবের একটি অংশ হিসাবে তৈরি করেছেন। সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্বন্ধে পরিস্কার করে বুঝানোর জন্য তিনি পয়গম্বারদের এবং মানসিক ক্ষমতার বোধগম্য কিতাবসমূহ প্রেরণ করেছিলেন। স্রষ্টার ইবাদত (ইবাদাহ) করা উদ্দেশ্য এবং পয়গম্বারদের প্রার্থনা বার্তা ছিল একমাত্র সৃষ্টাকে ইবাদত করা, তৌহিদ আল ইবাদাহ। এর কারণে আল্লাহ ছাড়া অথবা আল্লাহসহ অন্যকে ইবাদত করা কঠিন গুনাহ, র্শিক। যে সূরা আল ফাতিহা, মুসলিম নরনারীদের নামাজে প্রতিদিন অন্ততপক্ষে সতেরবার পড়তে হয় সেই সূরার চতুর্থ আয়াত উল্লেখ করে ‘‘আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং একমাত্র তোমার কাছেই আমবা সাহায্য চাই।’’ এই বিবৃতি থেকে পরিস্কার হয়ে যায়, সকল প্রকার ইবাদত আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে করতে হবে যিনি সাড়া দিতে পারেন।
রাসূল (সাঃ) এককত্বের দর্শন দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে বলেছেনঃ তুমি যদি ইবাদতে কিছু চাও তাহলে শুধু আল্লাহর নিকট চাও এবং তুমি যদি সাহায্য চাও তাহলে শুধু আল্লাহর নিকট চাও’’ প্রয়োজনীয় এবং আল্লাহর নিকটবর্তীতা আরও দৃঢ়ভাবে প্রকাশ পায়
কুরআনের বহু আয়াতে। উদাহরনস্বরূপঃ
আর যখন আমার বান্দাগণ তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, আমি তো নিশ্চয় নিকটবর্তী। আমি আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দেই, যখন সে আমাকে ডাকে। সুতরাং তারা যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান আনে। আশা করা যায় তারা সঠিক পথে চলবে। (সূরা আল বাকারা ২: ১৮৬)
আর অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার প্রবৃত্তি তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তাও আমি জানি। আর আমি তার গলার ধমনী হতেও অধিক কাছে। (সূরা কাফ ৫০: ১৬)
তাওহীদ আল ইবাদাহ এর স্বীকৃতি,বিপরীতভাবে সকল প্রকার মধ্যস্থতাকারী অথবা আল্লাহর সঙ্গে অংশীদারের সম্পৃক্ততার অস্বীকৃতি অপরিহার্য করে তোলে। যদি কেউ জীবিত ব্যক্তিদের জীবনের উপর অথবা যারা মারা গিয়েছে তাদের আত্মার উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য মৃত্যের কাছে প্রার্থনা করে, তারা আল্লাহর সঙ্গে একজন অংশীদার যুক্ত করে। এই ধরণের প্রার্থনা আল্লাহর পাশাপাশি অন্যের উপাসনা করার মত। রাসূল (সঃ) সুস্পষ্টভাবে বলেছেনঃ “প্রার্থনাই ইবাদত” যদি কেউ রাসূল (সাঃ) অথবা তথকথিত আউলিয়া,জিন অথবা ফেরেশতাগণের নিকট সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করে অথবা প্রার্থনাকারীর পক্ষ হয়ে তাদেরকে সাহায্য করতে অনুরোধ করে তাহলে তারাও শির্ক করে। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ট এবং মহিমান্বিত বলেছেনঃ
সে (ইবরাহীম) বলল, ‘তাহলে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদাত কর,যা তোমাদের কোন উপকার করতে পারে না এবং কোন ক্ষতিও করতে পারে না’? (সূরা আল আম্বিয়া ২১: ৬৬)
আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তোমরা ডাক তারা তোমাদের মত বান্দা। (সূরা আল আরাফ ৭: ১৯৪)
যদি কেউ রাসূল (সাঃ) অথবা তথকথিত আউলিয়া, জিন অথবা ফেরেশতাগণের নিকট সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করে অথবা প্রার্থনাকারীর পক্ষ হয়ে তাদেরকে সাহায্য করতে অনুরোধ করে তাহলে তারাও শির্ক করে। মূর্খ লোকেরা যখন আব্দুল কাদের জিলানীকে গাওছি আজম উপাধীতে ভূষিত করে তখন তৌহিদের এই নিয়মে শির্ক করে। উপাধিটির আক্ষরিক অর্থ, মুক্তি প্রাপ্তির প্রধান উৎস; এমন একজন যিনি বিপদ হতে রক্ষা করার চেয়ে সবচেয়ে উপযুক্ত অথচ এই ধরণের বর্ণনা শুধু মাত্র আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য। দূর্ঘটনা ঘটলে কেউ কেউ আবদুল কাদিরেকে এই উপাধিতে ডেকে তাঁর সাহায্য এবং আত্মরক্ষা কামনা করে, যদিও আল্লাহ আগেই বলেছেনঃ
“আল্লাহ তোমাকে ক্লেশ দান করলে তিনি ব্যতীত উহা মোচনকারী আর কেউ নাই।” (সূরা আল-আন্আম ৬: ১৭)
কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, যখন মক্কাবাসিদের তাদের মূর্তিপূজার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে তারা উত্তর দিলঃ
“আমরা তাদের ইবাদত করি যাহাতে তাহারা আমাদিগকে আল্লাহর কাছাকাছি পৌছায়।” (সূরা আয্-যুমার ৩৯: ৩)
মূর্তিগুলিকে শুধুমাত্র মধ্যস্থতাকারী হিসাবে ব্যবহার করলেও আল্লাহ তাদের আচার অনুষ্ঠানের কারণে তাদের পৌত্তলিক বলেছেন। মুসলিমদের মধ্যে যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে ইবাদত করার প্রতি জোর দেয় তারা ভালভাবে এ বিষযে চিন্তা করে দেখতে পারেন।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ইবাদতে (ইবাদাহ্) শুধু রোজা রাখা, যাকাত প্রদান, হজ্জ এবং পশু কোরবানী করা ছাড়াও অনেক কিছু অন্তুর্ভুক্ত। এর মধ্যে ভালবাসা, বিশ্বাস এবং ভয়ের মত আবেগ অন্তর্ভুক্ত, যেগুলির বিভিন্ন মাত্রা রয়েছে এবং যা শুধুমাত্র স্রষ্টার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হতে হবে। আল্লাহ এই সব আবেগের বাড়াবাড়ি সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়ে উল্লেখ করেছেনঃ
আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালবাসার মত ভালবাসে। আর যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহর জন্য ভালবাসায় দৃঢ়তর। (সূরা আল-বাকারা ২ :১৬৫)
তোমরা কেন এমন কওমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর না, যারা তাদের কসম ভঙ্গ করেছে এবং রাসূলকে বহিষ্কার করার ইচ্ছা পোষণ করেছে, আর তারাই প্রথমে তোমাদের সাথে আরম্ভ করেছে। তোমরা কি তাদেরকে ভয় করছ? অথচ আল্লাহ অধিক উপযুক্ত যে, তোমরা তাঁকে ভয় করবে, যদি তোমরা মুমিন হও। (সুরা আত্-তাওবা ৯: ১৩)
ইবাদত (ইবাদাহ্) শব্দের অর্থ সম্পুর্ণভাবে আত্মসমর্পণ এবং আল্লাহকে চুড়ান্ত আইন প্রণেতা হিসাবে গণ্য করা। কাজেই স্বর্গীয় আইনের (শারীয়াহ) উপর ভিত্তি না করে ধর্মনিরপেক্ষ আইন বিধান বাস্তবায়ন স্বর্গীয় আইনের প্রতি অবিশ্বাস এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করার পর্যায়ে পড়ে। এই ধরনের বিশ্বাস আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের উপাসনা করার নামান্তর (শির্ক)। আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেনঃ
আর যারা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার মাধ্যমে ফয়সালা করে না, তারাই কাফির। (সুরা আল-মায়েদা ৫: ৪৪)।
সাহাবী আদি ইবনে হাতিম, যিনি খৃস্টান ধর্ম হতে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, রাসুল (সাঃ) কে কুরআনের আয়াত পড়তে শুনেন। তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পণ্ডিত ও সংসার-বিরাগীদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামপুত্র মাসীহকেও। অথচ তারা এক ইলাহের ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছে, তিনি ছাড়া কোন (হক) ইলাহ নেই। তারা যে শরীক করে তিনি তা থেকে পবিত্র।(সুরা আত্-তওবা ৯:৩১)
তিনি রাসুল (সাঃ) কে বললেন,“নিশ্চয়ই আমরা তাদের উপসনা করি না।” রাসূল (সঃ) তার দিকে তাকিয়ে বললেন “আল্লাহ যা কিছু হালাল করেছেন তারা কি তা হারাম ঘোষনা করেনি এবং তোমরা সকলে তা হারাম করনি এবং আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা কি তারা হালাল করেনি এবং তোমরা সকলে তা হালাল করনি?” তিনি উত্তরে বললেন নিশ্চয়ই আমরা তা করেছি। রাসূল (সঃ) তখন উত্তর দিলেন, “ঐ ভাবেই তোমরা তাদের উপসনা করেছিলে।”(আত তিরমিজি কর্তৃক সংগৃহীত)
অতএব তাওহীদ আল ইবাদাহ এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হল শরীয়াহ বাস্তবায়ন, বিশেষ করে যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলিম। বহু তথাকথিত মুসলমান দেশ, যেখানে সরকার আমদানীকৃত গনতান্ত্রিক অথবা সমাজতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত এবং যেখানে স্বর্গীয় আইন সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত অথবা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ক্ষেত্রে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে ইসলামি আইন চালু করতে হবে। অনুরূপভাবে মুসলিম দেশসমূহ যেখানে ইসলামি আইনকানুন চালু রয়েছে সেখানেও শরীয়াহ আইনকানুন প্রবর্তন করতে হবে কারণ জীবনের সকল ক্ষেত্রে এই আইনকানুন সম্পর্কযুক্ত। মুসলিম দেশে শরীয়াহ আইনের পরিবর্তে অনৈসলামিক আইনকানুনের স্বীকৃতি হল শির্ক এবং এটা একটি কুফরী কাজ। যাদের ক্ষমতা আছে তাদের অবশ্যই এই অনৈসলামিক আইনকানুন পরিবর্তন করা উচিত। যাদের সে ক্ষমতা নেই তাদের অবশ্যই কুফর এর বিরুদ্ধে এবং শরীয়াহ আইন বাস্তবায়নের জন্য সোচ্চার হওয়া উচিত। যদি এটাও সম্ভব না হয়, তাহলে আল্লাহর সস্তুষ্টি ও তৌহিদ সমুন্নত রাখার জন্য অনৈসলামিক সরকারকে আন্তরিকভাবে ঘৃণা ও অবজ্ঞা করতে হবে। জেনে রাখা প্রয়োজন যে আল্লাহ একক ইলাহ হিসেবে নিম্নের ইবাদতগুলি একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য। ইবাদতের প্রকার সমূহ যা আল্লাহ তাআ’লা নির্দেশিত করেছেন তা হচ্ছেঃ
(ক) (আল- ইসলাম)- আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সমর্পণ করা।
(খ) (আল-ঈমান)- বিশ্বাস স্থাপন করা।
(গ) (আল-ইহসান)-নিষ্ঠার সাথে কাজ করা। দয়া-দাক্ষিণ্য ও সহানুভূতি প্রদর্শন, উপকার সাধন করা।
(ঘ) (আদ-দো’য়া) প্রার্থনা, আহবান করা।
(ঙ) (আল-খাওফ) ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা ।
(চ) (আর-রাজা) আশা-আকাংখা করা ।
(ছ) (আত্-তাওয়াক্কুল) নির্ভরশীলতা, ভরসা করা ।
(জ) (আর-রাগ্বাহ) অনুরাগ, আগ্রহ।
(ঝ) (আর-রাহ্বাহ) ভয় ভীতি।
(ঞ) (আল-খূশূ) বিনয়-নম্রতা।
(ট) (আল-খাশিয়াত) অমংগলের আশংকা।
(ঠ) (আল- ইনাবাহ) আল্লাহর অভিমুখী হওয়া, তাঁর দিকে ফিরে আসা।
(ড) (আল-ইস্তে’আনাত) সাহায্য প্রার্থনা করা।
(ঢ) (আল-ইস্তে-আযা) আশ্রয় প্রার্থনা করা।
(ণ) (আল-ইস্তেগাসাহ) নিরুপায় ব্যাক্তির বিপদ উদ্ধারের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা।
(ত) (আয্-যাবাহ) আত্ব ত্যাগ বা কুরবানী করা।
(থ) (আন্-নযর) মান্নত করা।
এগুলি এবং অন্যান্য যে পদ্ধতিসমূহের আদেশ ও নির্দেশ আল্লাহ দিয়েছেন সবকিছুই তাঁর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যে। উপোরোল্লিখিত ইবাদতগুলির কোন একটি যদি কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য নিবেদন করে তবে সে মুশরিকে পরিণত হবে।