ঈমান ও ইসলামে কোনো উত্তরাধিকারিত্ব চলে না। পিতা অমুসলিম কিন্তু পুত্র মুসলিম কিংবা পিতা মুসলিম কিন্তু পুত্র অমুসলিম, এতে কোনো বৈচিত্র্য নেই। ইব্রাহিম আ: ছিলেন একক ও অদ্বিতীয় আল্লাহতে বিশ্বাসী পক্ষান্তরে তাঁর পিতা ছিলেন মূর্তি পূজারীগণের পুরোহিত। নূহ আ: ছিলেন আল্লাহর রাসূল কিন্তু তাঁর পুত্র ছিল অবিশ্বাসী। বিশ্বমানবের কাছে এ দু’টি উদাহরণে প্রমাণ হয় ইসলাম-ঈমানে পরিবারতন্ত্র চলে না। পরিবারভুক্ত যেকেউ ভিন্ন বিশ্বাসের ফলে অন্য ধর্মাবলম্বী হতে পারে। আবু জাহল ছিল কাফের সরদার তার পুত্র ইকরিমা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম। মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবন উবায় ইবন সলুলের পুত্র ছিলেন একজন বিদগ্ধ মুসলিম। একান্নভুক্ত হওয়া, পরিবারের সদস্য হওয়া ও মাতা পিতা মুসলিম হওয়া মুমিন হওয়ার পরিচায়ক নয়।
মুসলিম হওয়ার মাপকাঠি হলো বিশ্বাস: যারা একক ও অদ্বিতীয় আল্লাহতে বিশ্বাসী তারা হলো মুসলিম। যারা আল্লাহতে বিশ্বাসী নয় তারা কাফির বা নাস্তিক। আল্লাহতে বিশ্বাস আছে কিন্তু আল্লাহর সাথে অন্যান্য বস্তুকে অংশীদার মনে করে তারা মুশরিক বা অংশীবাদী। মুমিন-মুসলিম হওয়ার ক্ষেত্রে আরো কিছু বিষয়ে দৃঢ়বিশ্বাস রাখতে হয়, তা হলো মুহাম্মদ সা:কে মানতে হয় আল্লাহর রাসূল বা দূত হিসেবে। মুহাম্মাদ সা:-এর ওপর নাজিলকৃত গ্রন্থ হলো আল্লাহর কালাম। এ গ্রন্থ মানবজাতিকে বুঝানোর জন্য আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মাদ সা:কে মনোনীত করেছেন। তিনি মানবসমাজের সদস্য হলেও তাঁর কাজকর্ম আল্লাহর নির্দেশে পরিচালিত হতো। তাঁর দ্বারা নাবুওয়াতের সিংহদ্বার চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেছে। তিনি খাতামুন নাবিয়্যিন, তাঁর পরে ঐশীবাণী নিয়ে জগতে আর কেউ আসবেন না।
এ ছাড়া তাঁর আগে অসংখ্য নবী-রাসূলকে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সুপথে পরিচালিত করার জন্য জগতে পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা সবাই ছিলেন মানুষ। মরণের পর মানুষকে কিয়ামতকালে আবার উঠানো হবে। ভালো-মন্দের বিচার হবে। মুমিন-মুসলিমগণ জান্নাতে যাবে আর অবিশ্বাসী কাফিররা জাহান্নামের চির-অধিবাসী হবে। মোটামুটি এ বিষয়গুলো যারা বিশ্বাস করে তারা হলো মুমিন বা মুসলিম। যারা এগুলো মানে না তারা হলো কাফির বা অবিশ্বাসী। এগুলোকে মেনেও যারা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মানে না, যারা বিভিন্ন অবতারে বিশ্বাসী, এগুলোর পূজা করে এ আশা নিয়ে যে, এদের সন্তুষ্টি লাভ করলে বিভিন্ন কার্যসিদ্ধি হবে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইবাদতের মতো নানান দেব-দেবীর পূজা করে, এদের সম্মান করে তারা হলো মুশরিক।
শিরকের বিপরীত হলো তাওহিদ বা একত্ববাদ: আল্লাহর একত্ববাদে ব্যত্যয় ঘটলেই শিরকের সৃষ্টি হয়। আল্লাহর একত্ববাদ তিন ধরনের। এক. গোটা জগতের লালনপালনকারী ও সৃষ্টিকর্তা হিসেবে তাঁকে বিশ্বাস করা। দুই. ইবাদতের উপযুক্ত একমাত্র আল্লাহকে বিশ্বাস করা। তিন. আল্লাহর গুণাবলি কুরআন ও হাদিসে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবে তা ইয়াকিন করা এবং আল্লাহর সমপরিমাণ কোনো গুণ সৃষ্টিজগতের মাঝে নিহিত আছে বলে মনে না করা। আল্লাহকে রব মানা, তাঁকে ইলাহ হিসেবে জ্ঞান করা এবং তাঁর গুণাবলিকে যথাযথ সংরক্ষণ করলে শিরক হতে বাঁচা যায়, কুরআন নাজিলের সময়কার মক্কার মুশরিকদের বিশ্বাস ছিল বিশ্বজগতের প্রতিপালক হলেন আল্লাহ। আল্লাহতে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও তারা তাঁর সাথে অন্যদের শরিক করত। যেমন মুশরিকদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন : বলুন, ‘কে তোমাদেরকে আকাশ ও পৃথিবী হতে রিজক দান করেন অথবা শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কার কর্তৃত্বাধীন, কে জীবিতকে মৃত হতে নির্গত করে এবং কে মৃতকে জীবিত হতে নির্গত করে এবং কে সব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে? তখন তারা বলবে আল্লাহ।’ (সূরা ইউনুস : ৩১) অনুরূপ সূরা জুমার ৩৮ নম্বর আয়াত এবং সূরা মুমিনুনের ৮৪-৮৯ আয়াতের প্রতি লক্ষ করলে দেখা যায় অংশীবাদী মুশরিকেরা ও আসমান জমিনের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসেবে আল্লাহকে স্বীকার করে।
মহান আল্লাহকে বিশ্বজগতের নিয়ন্তা হিসেবে মান্য করাই যথেষ্ট নয়, সেই সাথে এ আকিদা পোষণ করতে হবে যে, সব ধরনের ইবাদতের একমাত্র উপযুক্ত হলেন তিনিই। তিনি ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করা যাবে না। কারো সন্তুষ্টি বিধানের জন্য কোনো কাজ করা এবং অসন্তুষ্টি হতে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে তার প্রতি বিনয়াবনত হওয়া ও ‘ইবাদত’ গায়রুল্লাহর কাছে এমনভাবে দাঁড়িয়ে কিছু চাওয়া যেভাবে আল্লাহর কাছে চাওয়া হয়, গায়রুল্লাহর নামে মান্নত করা, বায়তুল্লাহর তাওয়াফের মতো অন্য কোনো কিছুর তাওয়াফ করা, কবরস্থ ওলি-আবদালের কাছে কোনো কিছু প্রার্থনা করা এসব হলো আল্লাহর ইবাদতে শিরকের নামান্তর। সোজা কথায় বহু খোদা মানার প্রবণতা।
আল্লাহর গুণাবলিকে ঠিক সেভাবে অন্য কারো মাঝে রয়েছে বলে জ্ঞান করার নাম হলো, আল্লাহর বৈশিষ্ট্যে শিরক করা। যেমন আলিমুল গায়িব এটি কেবল আল্লাহ তায়ালার গুণ, দূর থেকে কিংবা পাশে থেকে সবার আর্তনাদ শোনার ক্ষমতা, জগতের সর্বত্রে তিনি বিরাজমান, মহাবিশ্বের সব কিছু তিনি সমানভাবে জানেন ও দেখেন, ইচ্ছেমতো তিনি এতে পরিবর্তনসাধন করতে পারেন ইত্যাদি কোনো শক্তি যদি কোনো নবী, ওলি বা বস্তুর জন্য মান্য করা হয় তাহলে সেটি হয় আল্লাহর গুণে কাউকে শরিক মনে করা।
আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই: সব নবী রাসূলের প্রধান দাওয়াত ছিল আল্লাহ একক, তিনি অদ্বিতীয়, কোনো ক্ষেত্রেই তাঁর কোনো অংশীদার নেই। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, এ দাওয়াত ছিল সব দাওয়াতের মূল। সর্বপ্রথম মানব হজরত আদম আ:কে সম্মান না করার ফলে জান্নাত থেকে বিতাড়িত ইবলিস তার সহযাত্রী করার জন্য শিরকের মিশন নিয়ে অবতীর্ণ হয়। ছলে-বলে-কৌশলে সে তার কাজ চালায়। আদম-হাওয়াকে জান্নাত থেকে বের করতে সক্ষম হয়। তাঁর প্রথম দুই সন্তানের মাঝে বিবাদ-বিসংবাদের সূত্রপাত ঘটায়। নূহ আ:-এর ছেলেকে বিভ্রান্ত করে। ইয়াগুস, ইয়াউক ও নসর ইত্যাদি প্রতিমার পূজায় প্ররোচিত করে। হজরত ইব্রাহিম আ: মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে অভিযানে নেমে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। মূসা আ: তূর পাহাড়ে আল্লাহর কিতাব আনতে গিয়ে ফিরে এসে দেখেন তাঁর জাতির অনেক মানুষ গোবৎসের পূজায় লিপ্ত হয়ে শিরকে লিপ্ত। যুগে যুগে নবীরা শিরকের বিরুদ্ধে লড়েন এবং একমাত্র এক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি মানুষকে আহ্বান জানান।
শিরকের উৎপত্তি : গায়রুল্লাহর প্রতি অতি ভক্তি হতে শিরকের উৎপত্তি হয়। পূর্বেকার কোনো মহান বুজুর্গ বা অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য তাদের ছবি ও ভাস্কর্য নির্মাণ করা হতো। প্রথম দিকে হয়তো তাদের অবদানকে স্মরণ রাখার জন্য তাদের ছবি সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু কালান্তরে ভক্তির সীমা এমনপর্যায়ে চলে যায় যে, ধীরে ধীরে তাদের মূর্তি তৈরি করে পূজা করা শুরু হয়। ইবলিস এ ব্যাপারে নানা কল্পকাহিনী রটিয়ে মানুষকে ভক্তির এমন স্তরে নিয়ে যায় যা কেবল আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত। আল্লাহর সমমানের ভক্তি প্রদর্শন করার পর আল্লাহ আর গায়রুল্লাহর মাঝে কোনো তফাত থাকে না। গায়রুল্লাহর সম্মান যখন আল্লাহর পর্যায়ে নিয়ে আসা হয় তখন আর বাকি থাকে কী? জ্ঞাতসারে হোক আর অজ্ঞাতসারে শিরকের দুয়ার খুলে যায় কোনো কাজে কেউ অভ্যস্ত হয়ে গেলে তার অন্তরে হিদায়তের আলো না থাকলে সে ওই কাজকে যথার্থ প্রমাণ করার জন্য নানান যুক্তির পেছনে দৌড়ায়। দেখুন মক্কার শিরকপন্থীদের যখন বলা হতো তোমরা এগুলোর উপাসনা করো কেন তখন তারা বলতো : ‘এগুলো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী।’ (সূরা ইউনুস : ১৮)। তারা বলে, ‘আমরা তো এদের পূজা এ জন্য করি যে, ওরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দেবে’। (সূরা : জুমার ৪)
ঈমান-ইসলামের বিনিময়: ঈমানের বিনিময় হলো জান্নাত। ঈমানের ওপর অবিচল থাকা বড়ই কঠিন। এতে রয়েছে পরীক্ষার পর পরীক্ষা। সব পরীক্ষায় উৎরে গেলে জান্নাত অবধারিত। তবে আল্লাহ তায়ালা ঈমানের সাথে আমলকেও জুড়িয়ে দিয়েছেন। ঈমান-আমলের ফলে জান্নাতের যে পুরস্কার তা অকল্পনীয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল বিভিন্ন বর্ণনা ভঙ্গিতে তা উল্লেখ করেছেন। তা জবান দিয়ে বয়ান ও কলম দিয়ে লিখে শেষ করার নয়। এখানে শুধু আল-কুরআনের কিছু উদ্ধৃতি টানা হলো। ইরশাদ হচ্ছে : ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের জন্য রয়েছে ফিরদাউসের উদ্যান। তথায় তারা স্থায়ী হবে, তা হতে স্থানান্তর কামনা করবে না।’ (সূরা কাহফ : ১০৭) ‘যারা ঈমান ও সৎকর্ম করে তারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ, তাদের প্রতিপালকের কাছে আছে তাদের পুরস্কার স্থায়ী জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে।
কুফর ও শিরকের পরিণতি: মহান আল্লাহর অস্তিত্বের অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে। বিবেকবান মানুষ সামান্য একটু চিন্তা করলেই আল্লাহর অস্তিত্বের বহু উপকরণ পাবে। উম্মি বা পড়ালেখা না জানা ব্যক্তির উচ্চাঙ্গের গ্রন্থ রচনা দূরে থাক, সাধারণ গ্রন্থ রচনা করার মতো শক্তিও তো থাকার কথা নয়। আল-কুরআনের সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার মতো একটি পঙ্ক্তি আজো রচনার কোনো দুঃসাহসিকতা কেউ দেখাতে পারেনি। মুহাম্মাদ সা: ছিলেন উম্মি। তাঁর সত্য হওয়ার প্রমাণ এটুকুই তো যথেষ্ট। এ ছাড়া আরো হাজারও প্রমাণ রয়েছে। তার পরও আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান না আনার কোনো কারণ থাকতে পারে না।
আল্লাহ ও রাসূলকে স্তর অনুযায়ী মানতে হবে। আল্লাহ হলেন সৃষ্টিকর্তা, একমাত্র উপাস্য আর রাসূল হলেন তাঁর গোলাম। রাসূলের দেখানো পথেই আল্লাহকে মানতে হবে। রাসূল প্রেমের আতিশয্যে তাঁকে আল্লাহর স্তরে নিয়ে গেলে তা হবে শিরক। কুফর ও শিরকের পরিণাম চিরস্থায়ী জাহান্নাম। শিরক এমন মহাপাপ যার কোনো ক্ষমা নেই। ইরশাদ হচ্ছে : আল্লাহ তাঁর শরিক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না।’ (সূরা নিসা : ৪৮)
কাফির মুশরিকদেরকে সৃষ্টির নিকৃষ্ট অভিহিত করে তাদের পরিণতি সম্পর্কে ইরশাদ হচ্ছে : ‘তাহলে কিতাবদের মাঝে যারা কুফরি করে তারাও মুশরিকেরা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। (সূরা : বাইয়্যিনা : ৬)। মুমিন হওয়ার পরও কথায় কাজে মুশরিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শিরকে আক্রান্ত হলে সকল ইবাদত-বন্দেগি নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি তিনি নবী রাসূল হলেও একই কথা। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে উদ্দেশ করে বলেন : ‘তুমি আল্লাহর শরিক স্থির করলে তোমার কাজ নিষ্ফল হবে। (সূরা : জুমার : ৬৫)