তাওহিদ ইসলামী জীবনব্যবস্থার মূলভিত্তি। ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করার জন্য এবং তদনুযায়ী জীবন পরিচালিত করার জন্য তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস অপরিহার্য। তাওহিদ মুসলিম জাতির প্রাণশক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত। জীবনে-মরণে, সুদিনে-দুর্দিনে একমাত্র বিশ্বনিয়ন্তা, সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভরতাই তাওহিদের মূলকথা।
তাওহিদের শাব্দিক অর্থ : তাওহিদ আরবি শব্দ। তাওহিদের আভিধানিক অর্থ একত্ববাদ বা কাউকে একক বলে স্বীকার করা। তাওহিদ শাব্দিক একক ওয়াদুন মূল ধাতু থেকে নির্গত। যার অর্থ এক বা একক। সুতরাং তাওহিদ এর অর্থ হলো একক বলে স্বীকার করা। এক বলে মেনে নেয়া, কোনো সত্তাকে এক বা একক বলে স্বীকৃতি দেয়া। প্রচলিত অর্থে তাওহিদ শব্দের অর্থ আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ।
তাওহিদের পারিভাষিক অর্থ : মহান আল্লাহ তায়ালাকে একমাত্র ইবাদতের যোগ্য একক সত্তা হিসেবে স্বীকার করা ও বিশ্বাস করাই তাওহিদ। ইসলাম ধর্মকেও তাওহিদ বলা হয়। কেননা এর ভিত্তি হলো আল্লাহ তায়ালা এক ও একক এবং তাঁর মতায় ও কর্মে কোনো অংশীদার নেই। তিনি সত্তাগতভাবে একক এবং গুণগতভাবেও একক। যার কোনো সমতুল্য নেই। আর তিনি উপাসনার দিক থেকেও একক এবং ইবাদত ও দাসত্বের েেত্রও একক। তার সমক কেউ নেই। তিনি মানুষের সব চিন্তা ধারণার ঊর্ধ্বে। তিনি অনাদি ও অনন্ত। তিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। তিনি সৃষ্টিকর্তা ও বিশ্বজগতের প্রতিপালক। তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন এবং যেভাবে ইচ্ছা সৃষ্টি পরিচালনা করেন। তিনি অসীম জ্ঞানের অধিকারী এবং সমস্ত জ্ঞানশক্তি ও মঙ্গলের উৎস।
আল্লাহর অস্তিত্ব ও পরিচয় : ‘আল্লাহকে পাওয়ার পথ সৃষ্ট প্রাণিকুলের সংখ্যার সমান’। এক শ্রেণীর বিশেষজ্ঞের মুখে মুখে এই কথাটি প্রচলিত। এক কথায় তার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ অস্তিত্ব প্রমাণের দলিল একটি বা দু’টি নয়, তা তত যত সংখ্যার প্রাণী এ দুনিয়াতে আছে। কথাটি যথেষ্ট বিস্ময় উদ্দীপক। বিশেষ করে যারা আল্লাহ সম্পর্কিত জ্ঞানের গভীরতা অর্জন করতে পারেনি, যারা তাওহিদের নিগূঢ় তত্ত্ব আয়ত্ত করতে অম রয়েছে তাদের ব্যপারে ওই কথাটি কী করে সত্য হতে পারে? দুনিয়ায় প্রাণিকুলের সংখ্যা কি কেউ গুনে শেষ করতে পক্ষে রেছে? তাহলে কী করে বলা যায় দুনিয়ায় যত প্রাণী আছে, আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ তত?
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর তাৎপর্য : সবার ওপরে রয়েছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কথাটির স্থান। এ হচ্ছে সেই জ্ঞান, যা খোদ আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক যুগে তার নবীদের মাধ্যমে মানুষের কাছে প্রেরণ করেছেন। এ জ্ঞান সবার আগে তিনি হজরত আদম আ:-কে দিয়ে তাকে দুনিয়ায় অবতীর্ণ করেছিলেন। আদম আ:-এর পরে এ জ্ঞান লাভ করেছিলেন হজরত নূহ আ:, হজরত ইবরাহিম আ:, হজরত মুসা আ: ও অন্য সব পয়গাম্বর। আবার এ জ্ঞান নিয়েই সবার শেষে দুনিয়ায় তাশরিফ এনেছিলেন হজরত মুহাম্মদ সা:। এ নির্ভুল জ্ঞানের মধ্যে কোনো অজ্ঞতার স্পর্শ নেই। শিক্ষারক, মুনাফেকি ও কুফরের যত রূপ আছে, মানুষ পয়গাম্বরদের শিা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজস্ব উপলব্ধি ও বুদ্ধিবৃত্তির ওপর নির্ভর করেছে বলেই তাতে জড়িত হয়েছে।
আল্লাহ একমাত্র রব : আল্লাহ তায়ালা সব কিছুর রব বা প্রতিপালক ও বিশ্ব অধিপতি এবং সব কিছুর স্রষ্টা। সব প্রাণীর রিজিকদাতা। আর তিনিই জীবন ও মৃত্যুদাতা। ভালোমন্দ তিনিই করে থাকেন। বিপদে আপদে একমাত্র তিনিই বান্দার আহ্বানে সাড়া দেন। সমগ্র সৃষ্টি জগৎ নিয়ন্ত্রণের েেত্র আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন এক ও অভিন্ন রব ও প্রতিপালক। তিনি অফুরন্ত নিয়ামতের মাধ্যমে গোট সৃষ্টি জগৎকে প্রতিপালন করছেন। সব মতা তাঁরই জন্য এবং তাঁরই হাতে নিহিত রয়েছে সকল মঙ্গল। তিনি যা ইচ্ছা করেন এবং তা করতে সম। তাঁর সার্বভৌমত্যে কারো কোনো অংশীদারিত্ব নেই। আল-কুরআনে এ বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে হুকুমদান ও আইনবিধান প্রদানের কর্তৃত্বে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো অধিকারের প্রতি একবিন্দু স্বীকৃতি বা অনুমতি দেয়নি। আল্লাহ ছাড়া মানুষকে আর কেউ কোনো কাজের আদেশ দিতে পারে না। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন’ (আ’রাফ : ৫৪)।
আল্লাহ একমাত্র ইলাহ : প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে সর্বাবস্থায় দাসত্ব এককভাবে আল্লাহর জন্যই সুনির্দিষ্ট করা এবং ইবাদতের ব্যাপারে তার সাথে কাউকেও অংশীদার স্থির না করা। অর্থাৎ ইবাদত এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য করা যাবে না। একমাত্র আল্লাহকেই তাঁর সমগ্র সৃষ্টি জগতের ওপর দাসত্ব ও আনুগত্যের অধিকারী হিসেবে জানা এবং স্বীকার করা এবং যাবতীয় ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর একত্বের প্রমাণ দান করাই এই প্রকার তাওহিদের উদ্দেশ্য। মানুষের অধিকার নেই এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে মাবুদ হিসেবে গণ্য করার। সে যত বড় দাপটের বা ক্ষমতার বা সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হোক না কেন। সব বিবেচনায় আল্লাহই পূর্ণত্বের অধিকারী। ইবাদত পাওয়ার একমাত্র যোগ্য সত্তা তিনিই। ফলে এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত যেমন যুক্তিবিরোধী, বিবেকবুদ্ধি পরিপন্থী তেমনই ইসলামী শরিয়তেও নিষিদ্ধ। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহরই ইবাদত করো এবং তাঁরই ওপর ভরসা রাখো আর তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে তিনি বেখবর নন’ (হুদ : ১২৪)।
আল্লাহর গুণাবলি : আল্লাহ তায়ালা শ্রেষ্ঠ, মহত্ব ও সৌন্দর্যের যাবতীয় গুণাবলিতে এক ও একক এবং নিরঙ্কুশভাবে পূর্ণতার অধিকারী। ক্ষেত্রে কোনোক্রমেই কেউ তাঁর অংশীদার হতে পারে না। আল-কুরআনে আল্লাহ তায়ালার যেসব গুণবাচক নাম রয়েছে অথবা রাসূল সা: আল্লাহ তায়ালার যে গুণাবলির উল্লেখ করেছেন সেগুলোর প্রতি সমভাবে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা যাবতীয় গুণে গুণান্বিত ও ভূষিত। জ্ঞান, শক্তি, সামর্থ্য, চিরঞ্জীব প্রভৃতি বহু মহৎ গুণ আল্লাহ তায়ালার রয়েছে যা আল-কুরআনে উল্লেখ আছে।
আল্লাহ তায়ালার প্রতিটি গুণ অন্য গুণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একটি অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। যেমন- আল্লাহ তায়ালার ইলম বা জ্ঞান। তাঁর গোটা সত্তাই ইলম। ঠিক যখন তিনি কুদরতগুণে ভূষিত তখন তার সত্তার জ্ঞানের বাস্তবতা কুদরতের বাস্তবতা থেকে ভিন্ন নয়; বরং এর প্রত্যেকটি অপরটির মধ্যে নিহিত। আর এসবের ব্যাপক সমন্বয় রয়েছে আল্লাহর মহান সত্তায়। পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘তিনিই আল্লাহ তিনি ব্যতীত অন্য কোনো উপাস্য নেই। তিনি দৃশ্য অদৃশ্যকে জানেন। তিনি পরম দয়ালু ও অসীমদাতা। তিনি আল্লাহ তিনি ব্যতীত অন্য কোনো উপাস্য নেই। তিনিই একমাত্র মালিক, পবিত্র, শান্তি ও নিরাপত্তাদাতা, আশ্রয়দাতা, পরাক্রান্ত, মহানশীল। তারা যাকে অংশীদার করে আল্লাহ তায়ালা তা থেকে পবিত্র। তিনিই আল্লাহ, স্রষ্টা, উদ্ভাবক, রূপদাতা উত্তম নামসমূহ তাঁরই। নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে সবই তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়’ (হাশর : ২২-২৪