রোযার ফযীলত ও গুরুত্বপূর্ণ মাসায়েল

রোযার ফযীলত ও গুরু্বপূর্ণ মাসায়েল

রোযার ফযীলত ও গুরু্বপূর্ণ মাসায়েল

রোযার অর্থ

রোজা শব্দটি ফারসী ভাষা। আরবীতে একে বলা হয় সাওম। অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা, সংযত থাকা, সংযত রাখা, আত্মসংযম ইত্যাদি। সে হিসেবে সাওম হচ্ছে মানবজীবনে আমরা যা কিছু কামনা এবং আকাংক্ষা করি সেগুলো থেকে বিরত থাকা। ইসলামী শরীয়তের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে শব্দটির অর্থ দাঁড়িয়েছে, সিদ্ধান্ত নিয়ে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়কালে খাদ্য-পানীয় গ্রহণ ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা এবং আরো কিছু জৈবিক চাহিদা থেকে নিজকে সংযত রাখা। আসলে রোজা হচ্ছে এমন এক সার্বজনীন ইবাদত, যা রোজাদারকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ প্রভৃতি রিপু থেকে রক্ষা করে। এ রোজা একজন মানুষকে প্রদান করে ধর্মীয় মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, অন্তরের সজীবতা, অন্তরের পবিত্রতা ও চিন্তাধারার বিশুদ্ধতা। এটা মানুষের আত্মিক উন্নতি ঘটায়।

মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন:

﴿يٰأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءامَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ ٱلصّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ﴾

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর,যেন তোমরা পরহেজগারী অর্জন করতে পারা। (সূরা বাকারা-১৮৩) পবিত্র কুরআনের এ আয়াতটি রোজা ফরজ হওয়ার দলীল। হিজরী দ্বিতীয় সালে আয়াতটি নাজিল হয়। তখন থেকেই হিজরী সালের নবম মাসে পুরো রমজানে রোজা পালন করতে হয়। এ প্রসঙ্গে সূরা বাকারার-১৮৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : রমজান মাস যে মাসে নাজিল করা হয়েছে মানুষের দিশারী,সত পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যে পার্থক্যকারীরূপে আল কুরআন। সুতরাং যারা এ মাস পায় তারা যেন এ মাসে রোজা পালন করে। ২য় হিজরীর শাবান মাসে মদীনায় রোজা ফরজ হয়।

এক. রোজা পালনকারীর পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে: সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা) বলেছেন:

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله – صلي الله عليه وسلم- : ” من صام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه ” رواه أحمد وأصحاب السنن وصححه الألباني

যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসের রোজা রাখবে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমযান মাসের রাতে এবাদত করে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে কদরের রাতে ইবাদত করে কাটাবে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারী ও মুসলিম)

দুই. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজের সাথে রোজার সম্পর্ক ঘোষণা করেছেন: এমনিভাবে তিনি সকল ইবাদত-বন্দেগী থেকে রোজকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছেন। যেমন তিনি হাদীসে কুদসীতে বলেন : মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা শুধু আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব। (মুসলিম)

তিন. রোজা আদায়কারী অগণিত প্রতিদান লাভ করে থাকেন:

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم قال الله كل عمل ابن آدم له إلا الصيام، فإنه لي وأنا أجزي به، والصيام جُنّة، وإذا كان يوم صوم أحدكم فلا يرفث ولا يصخب، فإن سابّه أحد أو قاتله فليقل إني امرؤ صائم، والذي نفس محمد بيده لخلوف فم الصائم أطيب عند الله من ريح المسك، للصائم فرحتان يفرحهما إذا أفطر فرح، وإذا لقي ربه فرح بصومه

হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত: রাসূল (সা.) বলেছেন: রোযা ব্যতীত বনী আদমের সমস্ত আমল তার জন্যই। কেননা রোযা আমার জন্য রাখা হয়, আর এর প্রতিদান আমি নিজেই দেব। আর রোযা হচ্ছে ঢাল স্বরূপ। তোমাদের কেউ রোযার দিনে অশ্লীল বাক্য ও শোরগোল করবে না। যদি কেউ গাল-মন্দ করে কিংবা ঝগড়া করতে চায়, তবে বলে দাও, আমি রোযা রেখেছি। ঐ সত্ত্বার শপথ, যার হাতে আমার জান! রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধি অপেক্ষা প্রিয়। আর রোযাদারের জন্য দুটি সুসংবাদ রয়েছে: একটি ইফতারের সময় অপরটি আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়।

ব্যাখ্যা: কিন্তু অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী ও সতকর্মের প্রতিদান বিনা হিসাবে দেয়া হয় না। বরং প্রত্যেকটি নেক আমলের পরিবর্তে আমলকারীকে দশ গুণ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত প্রতিদান দেয়া হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: মানব সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের প্রতিদান দশ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন: কিন্তু রোজার বিষয়টি ভিন্ন। কেননা রোজা শুধু আমার জন্য, আর আমিই তার প্রতিদান দেব। (মুসলিম)

চার. রোজা ঢাল ও কুপ্রবৃত্তি থেকে সুরক্ষা:  রোজা পালনের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কু-প্রবৃত্তি থেকে বেঁচে থাকার দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন :

 يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ البَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ، وَأَحْصَنُ لِلْفَرجِ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِيعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ، فَإِنَّهُ لَهُ وَجَاءٌ ( بخاري و مسلم)

রাসূল (সা.) বলেছেন: হে যুবকেরা! তোমাদের মধ্য হতে যাদের সামর্থ আছে, তারা বিয়ে করে নেও, কেননা এতে দৃষ্টি অবনত থাকে, লজ্জাস্থান নিরাপদ থাকে, আর যাদের সামর্থ নেই, তারা যেন রোযা রাখে, এতে তার যৌনোত্তেজনা হ্রাস পাবে। (বুখারী ও মুসলিম)

অন্যত্র বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে এসেছে:

من صام يوما في سبيل الله بعد الله وجهه عن النار سبعين خريفا. متفق عليه

বে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একটি রোযা রাখবে, তার চেহারাকে আল্লাহ সত্তর বছর দূরত্বের অবস্থান করাবেন।  (বুখারী ও মুসলিম)

 অন্য একটি হাদীসে এসেছে:

الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَقُولُ الصِّيَامُ أَيْ رَبِّ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ وَيَقُولُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ قَالَ فَيُشَفَّعَانِ

কিয়ামতের দিন রোযা এবং কুরআন সুপারিশ করবে বান্দার জন্য। রোজা বলবে: হে আমার প্রভূ! আমি তাকে দিনের বেলায় খাওয়া-দাওয়া ও যৌন সঙ্গম থেকে বিরত রেখেছি, সুতরাং আমার সুপারিশ কবুল করুন। আর কুরআন বলবে: আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, সুতরাং আমার সুপারিশ কবুল করুন। সুতরাং তাদের উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে।

নিম্নে রোযার কিছু জরুরী মাসায়েল সম্পর্কে আলোকপাত করা হলোঃ 

নিয়তঃ

রোযা সহীহ হওয়ার জন্য নিয়ত শর্ত। তবে এ নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা জরুরী নয় বরং জরুরী মনে করাই বিদআত।রোযা রাখার উদ্দেশ্যে সেহরী খাওয়াটাই নিয়তের মাঝে গণ্য; তবে সেহরী খাওয়ার সময় রোযা রাখার নিয়ত না থাকলে সেহরী খাওয়া নিয়ত হিসেবে গন্য হবেনা, নির্ধারিত সময়ের ভিতর পৃথকভাবে নিয়ত করতে হবে।

 সেহরীঃ

রোযা রাখার উদ্দেশ্যে শেষ রাত্রে কোন কিছু পানাহার বা খাওয়াকে সেহরী বলে। এর জন্য উদর বা পেট পূর্ণ করে খাওয়া জরুরী নয়। দু এক লোকমা খাদ্য বা একটি খোরমা ভক্ষণ বা একচুমুক পানি পান করার দ্বারাই সেহরী খাওয়ার সুন্নত আদায় হয়ে যাবে। সেহরী যথাসম্ভব রাত্রের শেষাংশে খাওয়া উত্তম, কিন্তু এত বিলম্ব করা মাকরূহ যাতে সুবেহ সাদিক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়। কোন কারণে সেহরী খেতে না পারলেও রোযার কোন ক্ষতি হয় না।

 আযান পর্যন্ত সেহরী খাওয়াঃ

সেহরীর খাওয়ার শেষ সময় হলো সুবেহ সাদিকের আগে পযর্ন্ত। এই সময় সাধারণত ফজরের আযানের সাথে সম্পৃক্ত নয়। কারণ আমাদের দেশে ফজরের আযান সাধারণত সুবেহ্‌ সাদিকের পরে দেয়া হয়ে থাকে, তাই ফজরের আযান পযর্ন্তসেহরী খেলে কিংবা আযান শুনে খানা পিনা বন্ধ করে দিলেও রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। কারণ আযান পযর্ন্ত খাওয়ার অর্থ সুবহে সাদিক হওয়ার পর পযর্ন্ত খাওয়া যা রোযা ভঙ্গের কারণ। তাই ফজরের আযানের আগে সেহরী খাওয়া শেষ করতে হবে বরং সতর্কতা সরূপ ক্যালেন্ডারে লিখিত সময়ের কিছু পূর্বেই পানাহার শেষ করা উচিত।

রোযা মাকরুহ হওয়ার কারণসমূহঃ

১. রোযা থাকা অবস্থায় গীবত করা; ২. মিথ্যা কথা বলা; ৩. গালি-গালাজ করা; ৪. অপাত্রে দৃষ্টিপাত করা; ৫. পানির নিচে বায়ুত্যাগ করা; ৬. ছাই-কয়লা,মাজন,টুথপেষ্ট ইত্যাদি দ্বারা দাঁত মাজা; ৭. লিপষ্টিক,লিপজেল ব্যবহার করা (যদি মুখের অভ্যন্তরে যাওয়ার আশংকা হয়) ৮. থুথু জমা করে গিলে ফেলা; ৯. মুখে পানি নিয়ে গরগরা করা;  ১০. সৌচ কাজ  সম্পাদনের  সময় উভয় পা অতিরিক্ত বিস্তৃত করে বসা; ১১. বিনা প্রয়োজনে কোন বস্তু মুখে রাখা বা চিবানো কিংবা জিহ্বা দ্বারা এর স্বাদ গ্রহণ করা (কিন্তু গলার ভিতর উক্ত বস্তুর স্বাদ অনুভূত হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে); ১২. নাকে বা মুখে পানি দিতে অতিরঞ্জিত করা; ১৩. অস্থিরতা,ভীতি ভাব বা কাতরতা প্রকাশ করা; ১৪. স্ত্রীকে চুম্বন বা আলিঙ্গন করা; ১৫. শরীর দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা হলে রক্ত দান করা।

রোযা ভঙ্গের কারণসমূহঃ

১. কানে ওষুধ বা তৈল বা পানি দিলে (তবে অনিচ্ছাকৃতভাবে কানে পানি গেলে রোযা ভঙ্গ হবেনা); ২. নাকে ওষুধ বা তৈল বা পানি গেলে; ৩. কেউ জোর করে পানাহার করালে; ৪. মুখের অভ্যন্তরে বের হওয়া রক্ত (থুথুর সমান বা বেশী হলে) গলার ভিতর চলে গেলে; ৫. ইচ্ছাকৃতভাবে মুখভরে বমি করলে; ৬. অনিচ্ছাকৃতভাবে অধিক বমি গলার ভিতর চলে গেলে; ৭. ইচ্ছাকৃতভাবে সামান্য বমি গিলে ফেললে; ৮. রোযার কথা স্বরণ থাকা অবস্থায় (কুলি করা, গোসল করা, সাঁতার কাটার সময় ইত্যাদি যে কোন কারনে) পানি গলায় বা নাকের অভ্যন্তরে বা মস্তিষ্কে প্রবেশ করলে; ৯.হস্তমৈথুন ও পায়ুমৈথুন দ্বারা বীর্যপাত হলে; ১০. সমকামীতা কিংবা নারী পুরুষ পরষ্পরের সংস্পর্শের দরুন বীযর্পাত ঘটলে; ১১. দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা বুট পরিমাণ খাদ্য গিলে ফেললে;১২.সেহরীর সময় আছে মনে করে সুবহে সাদিকের সময় পানাহার করলে; ১৩. ভুলে স্ত্রী সহবাস বা পানাহারের পর ইচ্ছাকৃতভাবে পুনারায় স্ত্রী সহবাস বা পানাহার করলে; ১৪.তৈলাক্ত, ভিজা বা আদ্র কোন বস্তু (নল বা আঙ্গুল) স্ত্রী কিংবা  পুরুষের মলদ্বারে প্রবেশ করালে; ১৫. স্ত্রী লোকের প্রসবাঙ্গে কোন তৈল, ওষুধ, পানি ইত্যাদি প্রয়োগ করলে; ১৬. দীর্ঘ সময় পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করার দরুন মলদ্বারে পানি পৌঁছলে; ১৭.গাড়ী, কল-কারখানা, আগর বাতি, কয়েল, ধুপ ইত্যাদির ধোয়া স্বেচ্ছায় গ্রহণ করলে; ১৮. কোন বস্তু (পান ইত্যাদি) মুখে দিয়ে সুবেহ সাদিক হওয়া পযর্ন্ত ঘুমিয়ে থাকলে; ১৯. সেহরী খাওয়া অবস্থায় ফযরের আযান দেওয়ার পরও খাবার খেলে; ২০. তামাক, গুল ইত্যাদি ব্যবহার করলে; ২১. গ্লিসারিন ষ্টিক, ২২. ইনহেলার ব্যবহার করলে; ২৩. তৈলাক্ত বা আদ্র নল দ্বারা ইন্ডোসকপি করলে; ২৪. চিঠির খামের আঠা জিহ্বা দিয়ে চেটে থুথু গিলে ফেললে; ২৬. মুখে রঙ্গিন সুতা রেখে পাকানোর দরুন মুখের লালা রঙ্গিন হলে, ২৭. নলের মাধ্যমে খাদ্য গ্রহণ করলে, ২৮.পাথর, মাটি, কাগজ ইত্যাদির টুকরা গিলে ফেললে; ২৯. সূর্য অস্ত হয়ে গেছে মনে করে সূর্যাস্তের আগে ইফতার করলে রোযা ভঙ্গ হবে। আর এ সমস্ত কারণে রোযা তখনই ভঙ্গ হবে, যখন রোযার কথা স্মরণ থাকাবস্থায় উপরোক্ত কর্মসমূহ সংঘটিত হবে, রোযার কথা স্মরণ না থাকাবস্থায় রোযা ভঙ্গের কোন কারণ দেখা দিলে তাতে রোযা ভঙ্গ হবে না।

রোযা ভঙ্গ না হওয়ার কারণসমূহঃ

১. রোযা থাকাবস্থায় ভুলে পানাহার বা স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হলে; ২. সপ্নদোষ হলে; ৩. পুরুষের প্রশ্রাবের রাস্তায় কোন ওষুধ প্রয়োগ করলে ; ৪. দন্ত রোগের কারণে অনবরত রক্ত বের হয়ে গলার মধ্যে চলে গেলে; ৫. টিকা নিলে; ৬. মানব দেহের শিরায় সূচের মাধ্যমে রক্ত বা ইঞ্জেকশন বা গ্লুকোজ সেলাইন নিলে; ৭. কুচিন্তার কারণে বীযর্পাত হলে; ৮. মিছওয়াকের আঁশ গলায় প্রবেশ করলে; ৯. অনিচ্ছাকৃতভাবে ধোয়া, পোকামাকড় ইত্যাদি পেটের অভ্যন্তরে  চলে গেলে; ১০. কাঁটা কিংবা ক্ষতস্থান হতে রক্ত বের হলে ইত্যাদি কারণে রোযা ভঙ্গ হবে না। অনেকের ধারনা যখম বা ক্ষতস্থান হতে রক্ত বের হয়ে গড়িয়ে পড়লে রোযার ক্ষতি হয়, অথচ ইহা সঠিক নয়।

রোযার ক্বাযা ও কাফ্ফারার কারণসমূহঃ

১. রোযা থাকা অবস্থায় এমন জিনিস সেচ্ছায় পানাহার বা ভক্ষন করলে যা খাদ্য, ওষুধ বা আস্বাদনি হিসাবে ব্যবহৃত হয় কিংবা ২. স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হলে ক্বাযা এবং কাফ্ফারা উভয়ই আদায় করা ওয়াজীব। চোখে সুরমা লাগানো, শরীর হতে রক্ত বের হওয়া ইত্যাদি কারণে রোযা ভঙ্গ হয়ে গিয়েছে মনে করে ইচ্ছাকৃত ভাবে পানাহার করলে রোযার ক্বাযা ও কাফ্ফারা উভয়ই আদায় করা ওয়াজীব।

 একটি জরুরী জ্ঞাতব্যঃ চিকিৎসকদের মতে চোখের সাথে হলকের সরাসরি সংযোগ রয়েছে বিধায় চোখে ওষুধ ইত্যাদি দিলে গলায় এর স্বাদ-তিক্ততা অনুভূত হয়। এজন্য বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের অনেকেই রোযা থাকাবস্থায় চোখে ওষুধ ইত্যাদির ব্যবহার হতে বিরত থাকতে বলেন এবং ইহাকে রোযা ভঙ্গের কারণ বলেও মত পোষন করেন। তাই নিজ রোযার হিফাজতের জন্য চোখে কোন কিছুর ব্যবহার হতে বিরত থাকা ঈমানদারদের জন্য একান্ত কর্তব্য।

 ইফতারঃ

খেজুর দ্বারা ইফতার করা মুস্তাহাব। সূযার্স্ত হয়ে যাওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস হলে কেবল আযান হয়নি বলে ইফতারে বিলম্ব করা মাকরুহ। এ সময় দোয়া কবুল হওয়া সম্পর্কে বহু হাদীছ বর্ণিত আছে,অথচ আমরা অনেকেই এই সময় অমনোযোগী থাকি,বিশেষ করে ঘরের মহিলাদেরকে ইফতারের জন্য বিভিন্ন প্রকার খাদ্য তৈরীতে এতই ব্যস্ত রাখি যে,তারা ইফতারের দোয়া করার সময় পর্যন্ত পায়না। আমরা যদি খোরমা-খেজুর,ফলমূল ইত্যাদি সহজ প্রাপ্য খাদ্য দ্বারা ইফতার করে বাকি সময় যিকির আযকারে লিপ্ত থাকতে পারি তবে ইহা অনেক নেকী অর্জনের মাধ্যম হবে।

ইফতারের দোয়া: ذهب الظمأ و ابتلت العروق و ثبت الأجر إنشاء الله   লক্ষনীয় বিষয় যে, আমাদের সমাজে ইফতারের সময় যেভাবে সকলে হাত তুলে গুরুত্ব সহকারে সম্মিলিত ভাবে দোয়া করে তা সুন্নত পরিপন্থি। এই আমল সম্মিলিত ভাবে করার কোন প্রমান শরীয়তে নেই। ইফতারের দোয়া একটি ইনফেরাদী আমল। ইহা একাকী চুপে চুপে আদায় করবে। এ সময় মাছনুন দোয়া সমূহ পড়তে থাকবে ও আল্লাহর কাছে ইহকাল এবং পরকালের মঙ্গলের জন্য দোয়া করতে থাকবে।

মসজিদে ইফতার করাঃ

মসজিদের পূর্ণ আদব রক্ষা করে মসজিদে ইফতার করা জায়েয। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে মসজিদ নোংরা করে মসজিদসমূহের ভিতরে ইফতার করা হয় তা জায়েয নয়। কারণ ইহাতে মসজিদের অসম্মানী হয়। মসজিদ কর্তৃপক্ষের উপর ইহা জরুরী যে,মাগরিবের আযানের পর এতটুকু সময় বিলম্ব করবে যাতে মুসল্লীগণ ঘরের ভিতর ধীরস্থীরভাবে ইফতার সেরে মসজিদে পৌঁছে জামাতের সাথে নামায পড়তে পারে। অথবা রমযান মাসে ইফতার করার জন্য অস্থায়ী ঘর বা ছাপড়া নির্মাণ করা। যেখানে বসে সকলে ইফতার করতে পারে।

তারাবীহঃ

তারাবীর ৮ রাকাআত নামাজ সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। হযরত উমর (রা.) ২০ রাকাত পড়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। পূরো রমযান মাস তারাবীহ নামায পড়া একটি সুন্নত, আর তারাবীতে কুরআন খতম করা পৃথক আরেকটি সুন্নত।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : ” مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ” رواه البخاري  ومسلم

যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছোয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখে এবং (তারাবীহ,তাহাজ্জুদ ইত্যাদির মাধ্যমে) রাত্রি জাগরণ করে সে ব্যক্তি ঐ দিনের ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে যাবে যে দিন তাকে তার মাতা জন্ম দিয়েছিল।

শবেক্বদরঃ

শবেক্বদর অত্যন্ত পূণ্যময় একটি রাত, কুরআনে এ রাতকে হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম বলা হয়েছে। যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছোয়াবের আশায় এ রাতে ইবাদত করবে তার অতীতের সমস্ত গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। এ জন্য উক্ত রাত্রের তালাশে রমযানের শেষ দশকের রাত্রিসমূহে যথাসম্ভব জাগ্রত থেকে ইবাদতে মশগুল থাকা উচিত। কমপক্ষে মাগরিব, ইশা ও ফজরের নামায জামাতের সাথে আদায় করা আব্যশক। কেননা হাদীছে আছে, যে ব্যক্তি ইশার নামায জামায়াতে পড়লো সে যেন অর্ধেক রাত্রি জাগ্রত থাকলো আর যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাতের সাথে আদায় করল সে যেন সারা রাত জাগ্রত থাকলো। আর যে সারা রাত জাগ্রত থাকলো, সে তো  শবেক্বদরের বরকত পেল।

আল্লাহ পাক এই রাত্রিকে উম্মতের মঙ্গলের জন্য গোপন রেখেছেন। তাই ইহাকে কেবল ২৭ শে রমযানে নির্ধারিত করা এবং ঐ রাত্রিতে মিলাদ মাহফিলের নামে মিষ্টান্ন ভোজের আয়োজন করা ইত্যাদি পরিহার করা উচিত।

 শবেক্বদরের মত ফজিলত পূর্ণ রাত্রিতে নফল এবাদতসমূহ নিজ নিজ ঘরে একাকী আদায় করলে নেকী বেশি পাওয়া যায়। ফজিলত পূর্ণ রাত্রিসমূহে এবাদতের উদ্দেশ্যে ডাকাডাকি করে মসজিদে বা অন্যত্র একত্রিত হওয়া জায়েয নয়।

 উল্লেখ্য যে, পুণ্যময় রাত্রি সমূহ কেবলমাত্র ওয়াজ নছিহতে অতিবাহিত করা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন কর্তৃক প্রমাণিত নয়। এইজন্য উক্ত রাত্রিসমূহে ইবাদতে মাকসুদা তথা নামায, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার ইত্যাদি ইবাদতে মশগুল থেকে রাত্রি অতিবাহিত করা উচিত।

অনেক ধর্মপ্রাণ লোক শবেক্বদর ইত্যাদি উপলক্ষে মসজিদ পরিষ্কার ও ধৌত করে, জেনে রাখা আবশ্যক মসজিদ পরিষ্কার করা বড়ই পুন্যের কাজ, তবে ইহাকে কেবল পুন্যময় রাত্রিসমূহের সাথে সর্ম্পক করে প্রথা বানিয়ে নেয়া উচিত নয়। আর ইহা করতে গিয়ে নামাযি কিংবা এতেকাফরত ব্যক্তিদেরকে কষ্ট দেয়াও অন্যায়।

এতেকাফঃ

রমযানের শেষ ১০ দিন (শবেক্বদরের তালাশে) এতেকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কেফায়া অর্থাৎ মহল্লার একজন আদায় করলেই আদায় হয়ে যাবে আর কেউ আদায় না করলে সকলেই গোনাহগার হবে। একদিনের এতেকাফের দ্বারা বান্দা ও জাহান্নামের মধ্যে আসমান জমিন সমান দুরত্ব সৃষ্টি হয়। কিন্তু আফসোসের বিষয় আজকাল এ আমলের প্রতি আমাদের কোনই আগ্রহ নেই। কোন প্রকারে যেন তেন ভাবে একজনকে এতেকাফে বসাতে পারলেই আমরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচি। উল্লেখ্য যে, টাকা-পয়সার বিনিময়ে এ’তেকাফ করা বা করানো জায়েয নয়।

রমযানের অপেক্ষায় নেক কাজ মুলতবি রাখাঃ

কোন নেক কাজ করার সময় হলে গেলে বা যখন কোন নেক কাজ সামনে এসে যায় তখন উক্ত নেক কাজ যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই নেকী বেশী হয়। কোন রকম ওজর ছাড়া কেবল রমযান মাসের অপেক্ষায় বিলম্ব করা বিদআত। তবে কোন কারণ বশত রমযান মাসের আগে নির্দিষ্ট কোন নেক কাজ আদায় করতে অপারগ হলে রমযানে অবশ্যই আদায় করা উচিত।

 ঈদ:

ঈদ মূলত কতকগুলি ইবাদতের সমষ্টি, যথা: অতি ভোরে ঘুম হতে উঠা; মিছওয়াক করা; গোছল করা; শরীয়তের গন্ডির ভিতর থেকে যথাসম্ভব সাজসজ্জা করা; উত্তম কাপড় পরিধান করা ও আনন্দ প্রকাশ করা; খুশবু (আতর) লাগানো; ঈদ-উল-ফিতরের দিন ঈদ গাহে যাওয়ার আগে কোন মিষ্টি দ্রব্য খাওয়া ও ঈদ-উল-আযহার দিন কোরবানীর গোস্তের আগে কোন কিছু না খাওয়া, সদকায়ে ফিতর আদায় করা; ঈদগাহে ঈদের নামায পড়া; ঈদগাহে পায়ে হেটে এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া ও অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা এবং যাওয়ার সময় তাকবীর (আল্লাহু আকবার আল্লাহ আকবার …..) বলতে থাকা। জুমুআর খুৎবার মতো দুই ঈদের খুৎবা (ও বিবাহের খুৎবা) পাঠের সময়ও উপস্থিত শ্রোতাদের জন্য সমস্ত আমল (যিকির-আযকার, নামায, কুরআন তেলওয়াত, কথাবার্তা ইত্যাদি) হতে বিরত থেকে কেবল খুৎবা শ্রবণ করা ওয়াজীব।

বি: দ্র:

ঈদ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে পুরুষদের জন্য স্বর্ণের অলংকার ব্যবহার করা, হাতে মেহেদী লাগানো নাজায়েয।

ঈদ সহ অন্যান্য পূন্যময় রাত্রী সমূহে আতশ বাজি করা অর্থাৎ পটকা ফোটানোও জায়েয নয়। ইহা শুধু গুনাহই নয়; জান-মালেরও ক্ষতির কারণ। তাই এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। এর বিপরীতে আমরা যদি আমাদের সন্তানদেরকে টাকা-পয়সা হাতে দিয়ে দান-সদকা করার অভ্যাস করাই তবে এতে নেক কাজে অভ্যাস করানোর সাথে আমাদের আমলনামাতেও উক্ত নেকীসমূহ যোগ হতে থাকবে।

ঈদগাহে নামায পড়াঃ

শরীয়তের দৃষ্টিতে ঈদ গাহ ঐ স্থানকে বলা হয়, যা জনবসতি হতে দূরে পৃথক এক স্থান, যা শুধু ঈদের নামায পড়ার জন্যই নির্ধারণ করা হয়েছে। ঈদের নামায নিজ মহল্লায় পড়ার চেয়ে শহরের বাহিরে ঈদগাহে গিয়ে আদায় করলে বেশী ছওয়াব হবে এবং সুন্নতেরও অনুসরণ হবে।

ঈদগাহে নিজে উপস্থিত না থেকে জায়নামায পাঠিয়ে দিয়ে আগে হতেই জায়গা দখল করা জায়েয নয়। অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান ঈদ, জুমআ এবং ওয়াক্তিয়া নামাযে ছোট বাচ্চাদেরকে সাথে নিয়ে যায়, এদের কারণে যদি বড়দের নামাযে ব্যাঘাত ঘটে, তবে ঠিক নয়। অভ্যাস ঘড়ে তোলার জন্য বাচ্চাদেরকে ঈদগায়ে কিংবা মসজিদে নেওয়া দরকার। মহিলাদেরকেও ঈদের নামাযে অংশগ্রহণ করার ব্যবস্থা করা উচিত। রাসূল (সা.) মহিলাদেরকে ঈদের গায়ে আসার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন।

Related Post