আমর বিল মারুফ এবং নাহি আনিল মুনকার ইসলামী পরিভাষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় বিষয়। মানব সমাজে এর কার্যকর অবস্থান অত্যন্ত জরুরি।
আমর বিল মারুফ এবং নাহি আনিল মুনকারের পরিচয় : আমর শব্দের অর্থ নির্দেশ করা বা কমান্ড করা এবং মারুফ শব্দের অর্থ ভালো কাজ। অর্থাৎ আমর বিল মারুফ শব্দটির অর্থ ভালো কাজের নির্দেশ করা। নাহি শব্দের অর্থ নিষেধ করা বা বাধা প্রদান করা। মুনকার অর্থ খারাপ বা মন্দকাজ। অতএব নাহি আনিল মুনকার শব্দের অর্থ হচ্ছে মন্দ কাজে বাধা প্রদান বা মন্দ কাজ করতে নিষেধ করা। পরিভাষায় আমরা বলতে পারি, যাবতীয় ভালো কাজের আদেশ করা এবং মন্দ কাজে বাধা প্রদান করে সমাজ থেকে সব খারাপ কাজ দূরীভূত করে ভালো কার্যাবলি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা।
মারুফ ও মুনকারের গুরুত্ব : সমাজে বা রাষ্ট্রে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে মারুফ ও মুনকার কাজের যথাযথ প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত, এ কাজ রাষ্ট্রের। যেমন সূরা আল হাজের ৪১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি যাদের হাতে ক্ষমতা প্রদান করি, তাদের চারটি কাজ সম্পাদন করা জরুরি। তারা সালাত কায়েম করবে, জাকাত আদায় করবে, ভালো কাজের নির্দেশ দেবে এবং খারাপ কাজে বাধা প্রদান করবে।’ আলোচ্য আয়াতে প্রমাণিত হয়, সমাজের যাবতীয় খারাপ কাজ বন্ধ করে ভালো কাজের প্রচলন ঘটানো এবং সমাজে তার সফল কার্যকর বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।
সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে : আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা মানুষকে কল্যাণের পথে ডাকবে, ন্যায়ের আদেশ দেবে এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে, তারাই হচ্ছে সফলকাম।’ (সূরা আলে ইমরান, ১০৪)। ওই আয়াত প্রমাণ করে, রাষ্ট্রীয়ভাবে আমর বিল মারুফ এবং নাহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব বাস্তবায়ন যেমন জরুরি তেমনিভাবে সম্মিলিত জনমত গড়ে তুলে এটি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখাও প্রয়োজন।
উম্মতে মুহাম্মদীর কাজ : আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের সর্বোত্তম জাতি হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে এই জন্য, তোমরা মানুষের কল্যাণে ভালো কাজের নির্দেশ দেবে এবং খারাপ কাজে বাধা প্রদান করবে আর আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে।’ (সূরা আলে ইমরান, ১১০)। আলোচ্য আয়াতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, উম্মতে মুহাম্মদীর নির্ধারিত কর্মপরিধিগুলোর মধ্যে ভালো কাজের নির্দেশ এবং খারাপ কাজে বাধা প্রদান করাও একটি ঈমানি দায়িত্ব।
খারাপ কাজে বাধা না দেয়া অন্যায় : সূরা আল মায়েদার ৭৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তারা যে সব মন্দ কাজ করত, তা থেকে পরস্পরকে নিষেধ করত না, তাদের এ কাজটি ছিল অত্যন্ত গর্হিত।’ অতএব খারাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকার জন্য আমর বিল মারুফ এবং নাহি আনিল মুনকারের কাজে সময় দান আমাদের ঈমানি দায়িত্ব।
মন্দ কাজে সহযোগিতা মুনাফিকের কাজ : সূরা তাওবার ৬৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘মুনাফিক পুরুষ ও নারী পরস্পর সমান। তারা অসৎ কাজের নির্দেশ দেয় এবং সৎ কাজে নিষেধ করে।’ অতএব মুনাফিকি থেকে বাঁচতে হলে এই দায়িত্ব পালন করতে হবে।
মুমিনের কাজ : সূরা তাওবার ৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘মুমিন পুরুষ ও নারী পরস্পরের বন্ধু। তারা সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজে নিষেধ করে।’ অতএব ঈমানের পূর্ণতা বিকাশে এই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে।
অন্যায়ে বাধাদানের স্তর : হাদিস মতে তিন স্তরে মন্দ কাজে বাধা প্রদান করতে হবে। যেমন রাসূল সা: বলেন, ‘তোমাদের যে কেউ মন্দ কিছু করতে দেখবে, সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিরোধ করে, না পারলে জবান দিয়ে প্রতিবাদ করবে, এতেও না পারলে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে। আর এটি হচ্ছে দুর্বলতম ঈমানের পরিচয়।’
মুনকার কাজে বাধা না দেয়ার শাস্তি : সমাজে প্রচলিত মুনকার কাজে যদি বাধা প্রদান না করা হয়, তাহলে সে জাতির ওপর আল্লাহর আজাব আরোপিত হবে। যেমন রাসূল সা: বলেন, ‘যার হাতে আমার জীবন নিহীত, তাঁর কসম করে বলছি অবশ্যই তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে। নইলে সত্বর আল্লাহ তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের ওপর শাস্তি প্রেরণ করবে। অতপর তোমরা দোয়া করবে কিন্তু তা আর কবুল হবে না। যার বাস্তব নিদর্শন আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি। তাই আমাদের আরো সতর্ক হওয়া উচিত।
মন্দকে ভালো কাজের দ্বারা প্রতিরোধ করা : মন্দ কাজকে মন্দ কাজ দ্বারা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তাই মন্দকে ভালো আচরণের মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘ভালো ও মন্দ সমান নয়। তুমি ভালো দ্বারা মন্দকে প্রতিরোধ কর। ফলে তোমার ও যার মধ্যে শত্রুতা রয়েছে সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে।’ (সূরা হামিম সিজদা : ৩৪-৩৫) এ গুণের অধিকারী কেবল তারাই হতে পারেন, যারা ধৈর্য্য ধারণ করতে পারেন।
সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে : আমর বিল মারুফের কাজ সুন্দর উপদেশ ও প্রজ্ঞাবান আচরণের মাধ্যমে সম্ভব। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রভুর পথে আহ্বান কর প্রজ্ঞাবান আচরণের দ্বারা এবং সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে।’ (সূরা আন নাহল, ১২৫)।
সর্বোপরি আমরা বলতে পারি, আমর বিল মারুফ এবং নাহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব পালন করা ঈমানি আমলগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।
–