কুরআনের পরিচয়
কুরআন আল্লাহর নাযিলকৃত ঐ কিতাবকে বলা হয়, যা তিনি তার শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপরে দীর্ঘ তেইশ বৎসর কালব্যাপী বিভিন্ন পর্যায়ে, প্রয়োজন মোতাবেক অল্প অল্প করে অবতীর্ন করেছিলেন। ভাষা এবং ভাব উভয় দিক হতেই কুরআন আল্লাহর কিতাব। অর্থাৎ কুরআনের ভাব (অর্থ) যেমন আল্লাহর তরফ হতে আগত তেমনি তার ভাষাও।
কুরআন নাযিলের কারণ
নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষনের পরে আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ)-কে বেহেশ্ত হতে দুনিয়ায় পাঠানোর প্রাক্কালে আল্লাহ্ তায়ালা বলে দিয়েছিলেন যে, “তোমরা সকলেই এখান হতে নেমে পড়। অতঃপর তোমাদের কাছে আমার পক্ষ হতে জীবন বিধান যেতে থাকবে পরন্তু যারা আমার জীবন বিধান অনুসারে চলবে, তাদের ভয় ও চিন্তার কোন কারণ থাকবে না। (অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তিতে তারা আবার অনন্ত সুখের আধার এই বেহেশতেই ফিরে আসবে)। আর যারা উহাকে অস্বীকার করে আমার নিদর্শন সমূহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে, তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী এবং সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে”। (সূরা বাকারা আয়াত নং ৩৮,৩৯)
আল্লাহ তায়ালার উক্ত ঘোষণা মোতাবেকই যুগে যুগে আদম সন্ততির কাছে আল্লাহর তরফ হতে হেদায়েত বা জীবন বিধান এসেছে। এই জীবন বিধানেরই অন্য নাম কিতাবুল্লাহ। যখনই কোন মানব গোষ্ঠী আল্লাহর পথকে বাদ দিয়ে নিজেদের মন গড়া ভ্রান্ত পথে চলতে থাকে, তখনই কিতাব নাযিল করে আল্লাহ মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে থাকেন।
কিতাব নাযেলের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার চিরন্তন নীতি হল এই যে, তিনি যখন কোন জাতির জন্য কিতাব নাযিলের প্রয়োজনীয় অনুভব করেন, তখনই সেই জাতির মধ্য হতে মানবীয় গুণের অধিকারী সর্বোৎকৃষ্ঠ লোকটিকে পয়গাম্বর হিসেবে বাছাই করে নেন, অতঃপর ওয়াহীর মাধ্যেমে তার উপরে কিতাব নাযিল করে থাকেন।
মানব সৃষ্টির সূচনা হতে দুনিয়ায় যেমন অসংখ্য নবী-রসূল এসেছেন, তেমনি তাঁদের উপরে নাযিলকৃত কিতাবের সংখ্যাও অগণিত। নবীদের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) যেমন সর্বশেষ কিতাব। অতঃপর দুনিয়ায় আর কোন নতুন নবীও আসবে না এবং কোনও নতুন কিতাবও অবতীর্ণ হবে না।
কুরআনের আলোচ্য বিষয় ও উদ্দেশ্য
কুরআনের আলোচ্য বিষয় হল, মানব জাতি। কেননা মানব জাতির প্রকৃত কল্যাণ ও অকল্যাণের সঠিক পরিচয়ই কুরআনে দান করা হয়েছে। কুরআনের উদ্দেশ্য হল মানব জাতিকে খোদা প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থার দিকে পথ প্রদর্শন, যাতে সে দুনিয়ায়ও নিজের জীবনকে কল্যাণময় করতে পারে এবং পরকালেও শান্তিময় জীবনের অধিকারী হতে পারে।
কুরআন অমান্যকারীদের ভয়াবহ পরিণতি
(وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا أُولَـٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُوْنَ (البقرة : ۳۹
অর্থ: যারা আমার আয়াত অবিশ্বাস ও অস্বীকার করবে , তারা হবে আগুনের বাসিন্দা । সেখানে তারা চিরকাল থাকবে । ( সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ৩৯)
وَالَّذِينَ سَعَوْا فِي آيَاتِنَا مُعَاجِزِينَ أُولَـٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مِّن رِّجْزٍ أَلِيمٌ –
অর্থ: যারা আমার আয়াতকে ব্যর্থ ও পরাজিত করার অপতৎপরতায় লিপ্ত হয় , তাদের জন্যে রয়েছে দু:সহ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি । ( সূরা সাবা : আয়াত ৫)
وَسِيقَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِلَىٰ جَهَنَّمَ زُمَرًا ۖ حَتَّىٰ إِذَا جَاءُوهَا فُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِّنكُمْ يَتْلُونَ عَلَيْكُمْ ءآيَاتِ رَبِّكُمْ وَيُنذِرُونَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَـٰذَا ۚ قَالُوا بَلَىٰ وَلَـٰكِنْ حَقَّتْ كَلِمَةُ الْعَذَابِ عَلَى الْكَافِرِينَ – قِيلَ ادْخُلُوا أَبْوَابَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا ۖ فَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِينَ –
অর্থ: (কিয়ামতের দিন ফায়সালা হয়ে যাবার পর) অমান্যকারীদের দলে দলে জাহান্নামের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে । তারা সেখানে পৌঁছামাত্র জাহান্নামের দুয়ারসমূহ খুলে যাবে । তখন জাহান্নামের রীবাহিনী (বিস্ময়ের সাথে) তাদের জিজ্ঞেস করবে: ‘ কী ব্যাপার , তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে কি বাণী বাহকগণ যাননি ? তাঁরা কি তোমাদের সামনে আল্লাহর আয়াত পেশ করেননি , শুনাননি ? আর এই বিচার দিনের সম্মুখীন হতে হবে বলে সতর্ক করেননি ? ’ অমান্যকারীরা বলবে: ‘ হাঁ , শুনিয়েছিলেন এবং সতর্কও করেছিলেন (কিন্তু আমরা মানি নাই)! ’ – এই স্বীকৃতি তাদের কোনো কাজে আসবেনা , তখনতো আল্লাহর দন্ড তাদের উপর নির্ধারিত হয়েই গেছে । তখন তাদের বলা হবে : ‘ প্রবেশ করো জাহান্নামের দরজাসমূহ দিয়ে । এখন থেকে চিরকাল এই শাস্তির মধ্যেই পড়ে থাকবে । ’ দাম্ভিকদের আবাস কতোইনা নিকৃষ্ট! (সূরা ৩৯ যুমার : আয়াত ৭১-৭২)
কুরআনের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
আল কুরআনের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো :
১. আল্লাহর বাণী হিসেবে কুরআনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা- ঈমান আনা ।
২. কুরআন পড়তে শিখা ও নিয়মিত পাঠ করা ।
৩. কুরআন বুঝা এবং কুরআনে কী আছে তা জানা ।
৪. কুরআনের হুকুম বিধান মেনে চলা ও অনুসরণ করা ।
৫. যারা জানেনা , তাদেরকে কুরআন শিক্ষা দান করা ।
৬. কুরআন প্রচার করা এবং কুরআনের দিকে মানুষকে ডাকা ।
৭. কুরআনের ভিত্তিতে সমাজ গড়ার কাজ করা ।
মহান আল্লাহ্ এ প্রসঙ্গে বলেন :
فَئآمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالنُّورِ الَّذِي أَنزَلْنَا –
অর্থ: অতএব তোমরা ঈমান আনো (বিশ্বাস স্থাপন করো) আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর রসূলের প্রতি আর আমার নাযিল করা নূরের (আল কুরআনের) প্রতি । ’ ( সূরা ৬৪ আত তাগাবুন : আয়াত ৮)
وَهَـٰذَا كِتَابٌ أَنزَلْنَهُ مُبَارَكٌ فَاتَّبِعُوهُ وَاتَّقُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ –
অর্থ: আর এই বরকতময় কিতাব আমরা নাযিল করেছি , সুতরাং তোমরা এটির অনুসরণ করো এবং তার ব্যাপারে সতর্ক হও । আশা করা যায় তোমরা অনুকম্পা লাভ করবে । (সূরা ৬ আনআম : আয়াত ১৫৫)
اِتَّبِعُوا مَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ وَلا تَتَّبِعُوا مِن دُونِهِ أَوْلِيَاءَ –
অর্থ: তোমাদের প্রভুর প থেকে তোমাদের প্রতি যা (যে কিতাব) অবতীর্ণ হয়েছে তার অনুসরণ করো এবং তাকে ছাড়া অন্য অলিদের অনুসরণ করোনা । ( সূরা ৭ আ ’ রাফ : আয়াত ৩)
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ –
অর্থ: তিনিই মহান আল্লাহ যিনি তাঁর রসূলকে হিদায়াত (কুরআন) ও সত্য দীন দিয়ে পাঠিয়েছেন, যাতে করে সেটিকে সে সকল মতবাদের উপর বিজয়ী করে । ( সূরা ৬১ সফ : আয়াত ৯)
আল কুরআন কি আল্লাহর কিতাব?
যারা মনে করে, কুরআন আল্লাহর বাণী নয় , অকাট্য প্রমাণ ও যুক্তি দিয়ে কুরআন তাদের অভিযোগ খন্ডণ করেছে । কুরআনের প্রমাণ ও যুক্তির বিপেক্ষ আজো কেউ কোনো প্রমাণ এবং যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেনি । দেখুন আল্লাহর বাণী:
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ هَـٰذَا إِلا إِفْكٌ افْتَرَاهُ وَأَعَانَهُ عَلَيْهِ قَوْمٌ آخَرُونَ ۖ فَقَدْ جَاءُو ظُلْمًا وَزُورًا
– وَقَالُوا أَسَاطِيرُ الأوَّلِينَ اكْتَتَبَهَا فَهِيَ تُمْلَىٰ عَلَيْهِ بُكْرَةً وَأَصِيلًا – قُلْ أَنزَلَهُ الَّذِي يَعْلَمُ السِّرَّ فِي السَّمَوَاتِ وَالأْرْضِ إنه كان غفورارحيما-
অর্থ: অমান্যকারীরা বলে : এ (কুরআন) তো মিথ্যা মনগড়া জিনিস । ( মুহাম্মদ) নিজেই তা রচনা করেছে আর অপর কিছু লোক তাকে একাজে সহযোগিতা করেছে । ’ – মূলত এই (অমান্যকারী) লোকেরা উদ্ভাবন করেছে এক মহা অন্যায় ও ডাহা মিথ্যা কথা । তারা আরো বলে : এ (কুরআন) তো পূর্বকালের লোকদের কাহিনী যা সে লিখিয়ে নিয়েছে , আর সকাল সন্ধ্যা তারা তাকে (এ কাহিনী) শুনাচ্ছে । ’ ( হে মুহাম্মদ) তাদের বলো : এই বাণী নাযিল করেছেন তো তিনি , যিনি মহাবিশ্ব এবং এই পৃথিবীর সমস্ত রহস্য অবগত । ( সূরা ২৫ আল ফুরকান : আয়াত ৪-৬)
أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ ۖ قُلْ فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّثْلِهِ وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُم مِّن دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ –
অর্থ: তারা কি বলে যে মুহাম্মদ নিজে এটি (এ কুরআন) রচনা করেছে ? ( হে মুহাম্মদ!) তাদের বলো : তোমরা যদি তোমাদের এই অভিযোগে সত্যবাদী হয়ে থাকো , তবে এর (এই কুরআনের) মতো একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এসো । এ কাজে আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের সহযোগিতা নিতে চাও -তাদেরকেও ডেকে নাও । ’ ( সূরা ১০ ইউনুস : আয়াত ৩৮)
আল কুরআন কী ?
এ প্রশ্নের জবাব স্বয়ং কুরআনই দিয়েছে । দেখুন কুরআনের ভাষায় :
إِنَّهُ الَقُرْآنٌ كَرِيمٌ
অর্থ: নিশ্চয়ই এটি এক সম্মানিত পাঠ্যগ্রন্থ । ( সূরা ৫৬ ওয়াকিয়া : আয়াত ৭৮)
وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيزٌ
অর্থ: নিশ্চয়ই এটি এক অপরাজেয় কিতাব । ( সূরা হামিম আ সসা জদা : আয়াত ৪১)
قَدْ جَاءَكُم مِّنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ
অর্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষথেকে তোমাদের কাছে এসেছে এক আলোকবর্তিকা এবং এক উন্মুক্ত কিতাব । ( সূরা ৫ মায়িদা : আয়াত ১৫)
تِلْكَ آيَاتُ الْكِتَابِ الْحَكِيمِ
অর্থ: ‘ এগুলো বিজ্ঞানময় কিতাবের আয়াত । ’ ( সূরা ৩১ লুকমান : আয়াত ২)
وَهَـٰذَا ذِكْرٌ مُّبَارَكٌ أَنزَلْنَاهُ ۚ أَفَأَنتُمْ لَهُ مُنكِرُونَ
অর্থ: এটি এক আশির্বাদময় উপদেশগ্রন্থ আমরা নাযিল করেছি । তোমরা কি এটিকে অস্বীকার করবে ? ( সূরা ২১ আম্বিয়া : আয়াত ৫০)
ذَلِكَ أَمْرُ اللَّهِ أَنزَلَهُ إِلَيْكُمْ
অর্থ: এ হলো আল্লাহর বিধান , তিনি নাযিল করেছেন তোমাদের প্রতি । ( সূরা ৬৫ আত্ তালাক : ৫)
هَـٰذَا بَصَائِرُ مِن رَّبِّكُمْ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
অর্থ: এটি তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট জ্ঞান ও পথ নির্দেশিকা এবং মুমিনদের জন্যে অনুকম্পা । ( সূরা ৭ আরাফ : আয়াত ২০৩)
আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে আল্লাহর প্রদত্ত জীবন বিধান অনুযায়ী চলার তাওফীক দান করন, আমিন।