আশুরার রোযার ইতিবৃত্ত ও তার বিধান
ইসলামের সূচনা থেকে তার পরিপূর্ণতা লাভ পর্যন্ত আশুরার রোযার বিধান এক ধরনের ছিলনা।
সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এর যে পরিবর্তন হয়েছে তা নিম্নে তুলে ধরা হল ঃ
১. ইসলামের সূচনাতে মক্কায় থাকাকালীন অবস্থায় রাসূল (সা.) আশুরার রোযা পালন করতেন, কিন্তু অন্যকে এ রোযা পালন করতে হুকুম করেননি।
২. রাসূল (সা.) যখন মদীনাতে আগমন করলেন তিনি ইহুদীদের রোযা পালন করতে দেখলেন তখন তিনি রোযা পালন করলেন অন্যদের রোযা পালন করতে নির্দেশ দিলেন। এমনকি যারা আশুরার দিনে আহার করেছিলেন তাদের দিনের বাকী সময়টা পানাহার থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিলেন। আর এটা ছিল হিজরতের দ্বিতীয় বছরে। কেননা তিনি হিজরতের প্রথম বছর মুহাররম মাস শেষ হওয়ার একমাস পর অর্থাৎ রবিউল আউয়াল মাসে মদীনাতে আগমন করেছিলেন।
৩. হিজরতের দ্বিতীয় বছর যখন রমযান মাসের সিয়াম ফরয করা হল তখন আশুরার রোযার ফরজিয়্যত (অপরিহার্যতা) রহিত হয়ে গেল এবং তা মুস্তাহাব হিসেবে গণ্য হতে লাগল। অতএব বলা যায় এক বছরের জন্য এ রোযা পালনের ফরয নির্দেশ জারী হয়ে ছিল। (ফতহুল বারী)
৪. আশুরার রোযা পালন সুন্নাত। আর তার সংখ্যা হবে দুটি। মুহাররম মাসের নবম ও দশম তারিখে অথবা দশম ও একাদশ তারিখে।
উপরে যে আশুরার রোযার চারটি ইতিবৃত্ত আলোচনা করা হল তা বহু সংখ্যক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
এর মধ্য থেকে কয়েকটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
‘আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন জাহেলী যুগে কুরাইশরা আশুরার রোযা পালন করত এবং রাসূল (সা.) ও রোযা পালন করতেন। যখন তিনি মদীনায় হিজরত করলেন তখন তিনি এ রোযা পালন করলেন ও অন্যদের পালন করতে আদেশ দিলেন। যখন রমযান মাসের রোযা ফরয হল তখন তিনি আশুরার রোযা সম্পর্কে বললেনঃ “যার ইচ্ছা আশুরার রোযা পালন করবে, আর যার ইচ্ছা ছেড়ে দিবে।” বর্ণনায় ঃ বুখারী ও মুসলিম
‘মহিলা সাহাবী রবী বিনতে মুয়াওয়াজ (রা.) থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেনঃ রাসূল (সা.) আশুরার দিনে ভোরে মদীনার নিকটবর্তী আনসারদের মহল্লায় খবর পাঠালেন যে, তোমাদের মধ্যে যে রোযা শুরু করেছে সে যেন তা পূর্ণ করে। আর যে রোযা শুরু না করে খাওয়া-দাওয়া করেছে সে যেন দিনের বাকী সময়টা পানাহার থেকে বিরত থাকে।
বর্ণনাকারী বলেন, এ কথা শোনার পর আমরা রোযা পালন করলাম এবং আল্লাহর ইচ্ছায় ছোট ছেলে-মেয়েদের দিয়ে রোযা পালন করালাম। আমরা তাদেরকে মসজিদে নিয়ে যেতাম। বাজার থেকে খেলনা কিনে নিতাম। যখন খাবার চাইত তখন হাতে খেলনা তুলে দিতাম, যেন তারা খাবারের কথা ভুলে গিয়ে রোযা পূর্ণ করতে পারে। বর্ণনায়ঃ মুসলিম
উপর্যুক্ত হাদীস দুটি দ্বারা বুঝে আসে আশুরার রোযা তখন ফরয ছিল।
আশুরার রোযা সম্পকির্ত হাদীসসমূহ একত্র করলে যে ফলাফল আসে তা হল ঃ
(ক) আশুরার রোযা ফরয ছিল, কারণ রাসূল (সা.) তা পালন করার জন্য হুকুম করেছিলেন।
(খ) এ রোযা পালনের জন্য রাসূল (সা.) সাধারণভাবে ফরমান জারী করেছিলেন।
(গ) যারা এ দিনে পানাহার করেছিলেন রাসূল (সা.) তাদের পানাহার থেকে বিরত থাকতে বলেছিলেন।
(ঘ) যখন রমযানের রোযার হকুম নাযিল হল তখন থেকে আশুরার রোযার ফরজিয়্যত বা অপরিহার্যতা রহিত হয়ে গেল।
যেমন ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেনঃ “যখন রমযানের রোযা ফরয হল আশুরার রোযা ত্যাগ করা হল।” বর্ণনায়ঃ মুসলিম
‘আশুরার রোযা ত্যাগ করা হল’ একথার অর্থ হল ফরয রোযা হিসেবে আশুরার রোযা ত্যাগ করা হয়েছে; কিন্তু সুন্নাত হিসেবে এখনো বহাল আছে। রাসূল (সা.) প্রত্যেক আশুরাতে রোযা পালন করতেন।
তাই সর্ব-সম্মত কথা হল আশুরার রোযা প্রথমে ফরয ছিল, এখন তা ফরয নয়, সুন্নাত।
ইবনে আব্দুল বারর (রহঃ) বলেছেনঃ আশুরার রোযা মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে উলামায়ে উম্মাতের ইজমা (ঐক্যমত) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তাই এটা মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
যেমন হাদীসে এসেছে
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেনঃ “আমি রাসূল (সা.) কে এ রোযা ছাড়া অন্য কোন রোযাকে এত গুরুত্ব দিতে দেখিনি। আর তা হল আশুরার রোযা ও এই রমযান মাসের রোযা।” বর্ণনায় ঃ বুখারী ও মুসলিম
ইবনে আব্বাস (রা.) আরো বলেনঃ যারা বলে যে, আশুরার রোযা তেমন গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাব নয়, সাধারণ মুস্তাহাব। তাদের এ কথা ঠিক নয়। আসল কথা হল এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাব আমল। তাইতো আমরা দেখতে পাই আল্লাহর রাসূল (সা.) প্রত্যেক আশুরাতে রোযা পালন করতেন। এমনকি ইন্তেকালের বছরও তিনি বলেছিলেনঃ “যদি আমি বেঁচে থাকি তাহলে অবশ্যই আগামী বছর মুহাররম মাসের নবম ও দশম তারিখে রোযা পালন করব।” বর্ণনায়ঃ মুসলিম
এবং এ রোযা পালন দ্বারা এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করা হয়। এ সকল হাদীস দ্বারা আশুরার রোযার গুরুত্ব উপলদ্ধি করা যায়।
আশুরার রোযার ব্যাপারে ইহুদীদের বিরোধিতা করার নির্দেশ
যে সকল বিষয়ে কোন শরয়ী হুকুম অবতীর্ণ হয়নি মদীনায় আসার পর সে সকল বিষয়ে নবী কারীম (সা.) ইহুদীদের অনুরূপ আমল করা পছন্দ করতেন। যেমন তিনি মসজিদুল আকসাকে কিবলা হিসেবে গ্রহণ করলেন। উদ্দেশ্য ছিল ইহুদীরা যেন ইসলামকে নিজেদের ধর্মের মতই মনে করে, ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। পরে যখন সত্য ধর্ম ইসলাম গ্রহণের পরিবর্তে ইহুদীদের অবাধ্যতা, হিংসা, কপটতা, বিশ্বাসঘাতকতা, বর্ণবাদী নীতি ও চরম সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশ পেল তখন সকল ব্যাপারে তাদের বিরোধিতা করার নির্দেশ দেয়া হল এবং ধর্মীয় ও সংস্কৃতিকর ব্যাপারে তাদের সাথে সাদৃশ্যতাপূর্ণ সকল আমল ও আচরণ করতে নিষেধ করা হল।
তাই রাসূল (সা.) সংকল্প করলেন আশুরার দিনে তিনি ইহুদীদের মত আর একটি করে রোযা পালন করবেন না। বরং এ রোযার সাথে মুহাররম মাসের নবম তারিখে একটি রোযা বাড়িয়ে রাখার মাধ্যমে ইহুদীদের ধর্ম ও সংস্কৃতির বিরোধিতা করবেন। এর প্রমাণ হিসেবে বহু হাদীস এসেছে।
যেমন: ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যখন রাসূল (সা.) আশুরার রোযা পালন করলেন ও অন্যকে পালন করার নির্দেশ দিলেন তখন সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেনঃ “এটা তো এমন এক দিন যাকে ইহুদী ও খ্রিস্টানরা সম্মান করে থাকে।” তখন রাসূল (সা.) বললেনঃ
“আগামী বছর আসলে ইনশা আল্লাহ আমরা নবম তারিখে রোযা পালন করব।” ইবনে আব্বাস (রা.) বলেনঃ “পরবর্তী বছর আসার পূর্বেই রসূলে কারীম (সা.) ইন্তেকাল করলেন।” বর্ণনায়ঃ মুসলিম
এ হাদীস দেখে এ কথা বুঝে নেয়ার অবকাশ নেই যে, রাসূল (সা.) আশুরার রোযাটা মুহাররম মাসের দশ তারিখের পরিবর্তে নবম তারিখে পালনের সংকল্প করেছিলেন। বরং তিনি সংকল্প করেছিলেন নবম ও দশম দু দিন রোযা পালন করার। কেননা আশুরা হল দশম তারিখ। সেদিন বাদ দিয়ে রোযা পালন করলে তা আশুরার রোযা বলে গণ্য হয় কিভাবে?
হাদীসে এসেছে “রাসূলে কারীম (সা.) আশুরার রোযা পালন করতে বলেছেন দশম তারিখে” অন্য একটি হাদীসে আরো এসেছে “আয়েশা (রা.) বলেনঃ নবী কারীম (সা.) মুহাররমের দশ তারিখে আশুরার রোযা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।” বর্ণনায়ঃ তিরমিজী
হাকাম ইবনুল আ‘ওয়াজ নামে এক ব্যক্তি ইবনে আব্বাস (রা.) কে আশুরার রোযা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “যখন মুহাররম মাসের চাঁদ দেখবে তখন থেকে হিসেব করবে এবং নবম তারিখের সকাল থেকে রোযা পালন করবে।” বর্ণনায়ঃ মুসলিম ও তিরমিজী
ইবনে আব্বাস (রা.) এর এ উত্তর থেকে এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টির আশংকা নেই যে, আশুরার রোযা আসলে কোন দিন; নবম না দশম তারিখে?
ইবনুল কায়্যিম (রহঃ) বলেনঃ “কেউ যদি আশুরা সম্পর্কিত ইবনে আব্বাস (রা.) এর বর্ণনাসমূহ একত্র করে পড়ে দেখে তা হলে তার সামনে কোন বিভ্রান্তি বা অস্পষ্টতা থাকবেনা এবং সে ইবনে আব্বাস (রা.) এর ইলম ও প্রজ্ঞার গভীরতা উপলদ্ধি করতে পারবে। বর্ণিত হাদীসে প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ কথা বলেননি যে আশুরা নবম তারিখে। তিনি শুধু নবম তারিখে রোযা আরম্ভ করতে বলেছেন। (যাদুল মাআ‘দ)
হাদীসে এসেছে; ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে, রাসূল (সা.) বলেছেনঃ “তোমরা আশুরা দিবসে রোযা পালন কর ও এ ক্ষেত্রে ইহুদীদের বিরোধিতা কর। তাই তোমরা আশুরার একদিন পূর্বে অথবা একদিন পরে রোযা পালন করবে। বর্ণনায় ঃ আহমদ
এ হাদীসে কয়েকটি বিষয় স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ঃ
(১) রাসূল (সা.) আশুরার দিনে রোযা পালন করতে বলেছেন। তাই আশুরার দিনকে বাদ দিয়ে রোযা পালন করলে তা আশুরার রোযা হবে না।
(২) আশুরার রোযা পালনের ক্ষেত্রে ইহুদীদের বিরোধিতা করতে হবে। তাই ইহুদীদের মত দশম তারিখে একটি মাত্র রোযা পালন করা যাবে না।
(৩) আশুরার একদিন পূর্বে রোযা পালন করতে হবে।
(৪) যদি আশুরার পূর্বের দিন রোযা পালন করা কোন কারণে সম্ভব না হয় তাহলে আশুরা ও তার পরের দিন রোযা পালন করতে হবে।
অতএব আশুরার দিন বাদ দিয়ে আশুরার একদিন পূর্বে ও একদিন পরে রোযা পালন করা ঠিক হবে না। তেমনি আশুরার দিনসহ একদিন পূর্বে ও একদিন পরে মোট তিনটি রোযা পালন করাও ঠিক হবে না।
ইতোপূর্বে উল্লেখিত ইবনে আব্বাস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত সহীহ হাদীসে ‘অথবা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আশুরার দিনসহ তার পূর্বের দিন অথবা তার পরের দিন রোযা পালন করতে হবে।
ইহুদীদের ধর্মীয় আচারের বিরোধিতা করার জন্য এ পদ্ধতিতে রোযা পালন করা হবে ।
যেমন হাদীসে এসেছে; আবু মুছা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ খায়বর অঞ্চলের ইহুদীরা আশুরার দিনে রোযা পালন করত ও ঈদ উদযাপন করত। এ দিনে তাদের মেয়েরা অলঙ্কারাদি পরিধান করত ও তারা উত্তম পোশাকে সজ্জিত হত। রাসূল (সা.) বললেনঃ “তাহলে তোমরা সেদিনে রোযা পালন করবে।” বর্ণনায়ঃ বুখারী ও মুসলিম
এ হাদীস দ্বারা কয়েকটি বিষয় জানতে পারা যায়ঃ
(১) অঞ্চল ও গোত্র ভেদে ইহুদীদের ধর্মীয় আচরণের বিভিন্নতা। মদীনার ইহুদীরা শুধু রোযা পালন করত আর খায়বারের ইহুদীরা রোযা পালন ও উৎসব পালন করত।
(২) যেহেতু এ দিনে ইহুদীরা ঈদ পালন করত। আর রোযা হল ঈদের বিরোধী। তাই রোযা পালন করে তাদের ঈদের বিরোধিতা করার নির্দেশ দিলেন আল্লাহর রাসূল (সা.)।
(৩) রোযা ও ঈদ পরস্পরের বিরোধী। তাই তা একই দিনে একত্র হতে পারে না।
(৪) আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর এ বাণীটি ইসলামের শেষ দিকের। কারণ খায়বর বিজয় ও হাদীসের বর্ণনাকারী আবু মুছা আল-আশ‘আরীর রাসূলের সঙ্গ লাভ তাঁর জীবনের শেষ দিকের ঘটনা। যদিও আবু মুছা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন মক্কী জীবনে।
ইবনে রজব (রহঃ) বলেনঃ “এ হাদীস দ্বারা স্পষ্টভাবে বুঝা গেল এ দিনকে উৎসবের দিন হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। আর কাফির মুশরিকদের ঈদের সাথে সংহতি প্রকাশ না করে ঐদিনে রোযা পালন করে তাদের উৎসবের বিরোধিতা করতে বলা হয়েছে।” (লাতায়েফুল মাআ’রিফ)