আসমা বিনতে আমীসা (রা.)
তার নাম আসমা। তিনি ছিলেন খুশআম গোত্রের মহিলা। তার পিতা ছিলেন আমীস ইবনে সাআদ ইবনে তামীম ইবনে হারেস। আর মাতা ছিলেন হিন্দ (খাওলা) ইবনেতে আওফ। পিতা ছিলেন কেনানা গোত্রের। হযরত জাফর ইবনে আবূ তালেবের সাথে তার প্রথম বিয়ে হয়। হযরত (সা.) মক্কায় দারে আরকাম-এ অবস্থানের পূর্বে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নবী (সা.) এর হাতে বায়আতের গৌরব অর্জন করেন। প্রায় একই সময় তার স্বামী জাফর ইবনে আবূ তালেবও ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি স্বামীর সাথে হাবশায় হিজরত করেন। সেখানে আবূ জাফরের ঔরসে তিনটি পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করে- মুহাম্মদ, আবদুল্লাহ্ ও আওন।
হাবশায় কয়েক বৎসর অবস্থান শেষে ৭ম হিজরীতে খয়বর বিজয়ের পর তারা মদীনায় ফিরে আসেন এবং হযরত হাফসার গৃহে যান। ইতোমধ্যে হযরত উমরও (রা.) আসেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, এ কে? জবাব এসেছে, আসমা। হযরত উমর (রা.) বললেন, হাবশাওয়ালী সমুদ্রওয়ালী! হযরত আসমা বললেন, জি হ্যাঁ, সে। এরপর হযরত উমর (রা.) হযরত আসমাকে বললেন, তোমাদের ওপর আমাদের ফজীলত রয়েছে, কারণ আমরা মোহাজের। কথাটা শুনে হযরত আসমার খুব রাগ ধরে। তিনি বলেন, হ্যাঁ, ঠিক বলছেন আপনি। কিন্তু অবস্থা হচ্ছে এই যে, আপনারা হযরতের সঙ্গে ছিলেন, অভুক্তদেরকে খাবার দিতেন, জাহেলদেরকে তা’লীম দিতেন। আর আমরা আল্লাহ্ ও রাসূলের সন্তুষ্টি বিধানের কারণে ভিন দেশে পড়েছিলাম, কেউ আমাদের জিজ্ঞাসা করার ছিল না। ধৈর্য-সহনশীলতার সাথে কঠোর বিপদাপদ মোকাবিলা করেছি। তিনি যখন এ কথাগুলো বলছিলেন, তখন নবীজী গৃহে ফিরে আসেন। হযরত আসমা তাকে সব কথা খুলে বললেন। জবাবে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, তিনি (অর্থাৎ উমর) এক হিজরত করেছেন, আর তুমি করেছ দুই হিজর। তাই এদিক থেকে তোমার ফজীলত বেশি। নবীজীর এ জবাবে হযরত আসমা ও অন্যান্য মোহাজিররা ভারী খুশি হন। হাবশায় যারা হিজরত করেছিলেন, তারা হযরত আসমার কাছে আসতেন এবং এ ঘটনার তাৎপর্য জানতে চাইতেন।
৮ম হিজরীর জমাদিউল ঊলা মাসে মুতার যুদ্ধে হযরত জাফর শহীদ হলে হযরত (রা.) হযরত আসমার গৃহে গমন করে বললেন, জাফরের সন্তানরা কোথায়? তাদেরকে আমার কাছে নিয়ে এসো। হযরত আসমা সন্তানদেরকে হযরতের খেদমতে নিয়ে আসেন। তাদেরকে দেখে নবীজী দুঃখ প্রকাশ করেন, তার চোখে পানি টলমল করে। হযরতকে অশ্রুশিক্ত দেখে হযরত আসমার অস্থির-ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! জাফরের কি কোন খবর এসেছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, সে আল্লাহ্র পথে শহীদ হয়েছে। এ হৃদয় বিদারক খবর শুনে আসমা চিৎকার করে উঠেন। পরিবারে কেয়ামত নেমে আসে। চারিদিক থেকে নারীরা ছুটে আসে, ঘরে মাতম পড়ে যায়। হযরত তাদেরকে বলেন, বুক চাপড়াবে না, বিলাপ করবে না।
হযরত (সা.) এ হেদায়ত করে ঘরে ফিরে যান। হযরত ফাতিমাকে বলেন, জাফর এর সন্তানদের জন্য খাবার প্রস্তুত কর। কারণ, আসমা আজ শোকাতহ। এর পর তিনি মসজিদে গিয়ে অতি দুঃখের সাথে হযরত জাফরের শাহাদাতের কথা ঘোষণা করেন। এ সময় এক ব্যক্তি রাসূলের দরবারে উপস্থিত হয়ে আরয করে যে, জা’ফরের পরিবার-পরিজন মাতম করছে। তিনি বললেন, যাও তাদেরকে কাঁদতে নিষেধ কর। লোকটি ফিরে এসে পুনরায় আরয করে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা বিরত হচ্ছে না। তিনি আবারও খবর পাঠান, কিন্তু কোন ফল হয় না। এবার হযরত বললেন, তাদের মুখে মাটি পুরে দাও। সহীহ বুখারীতে এটা উল্লেখ আছে যে, হযরত আয়েশা লোকটিকে বলেন, আল্লাহর কসম, তোমরা এরূপ না করলে রাসূলের (সা.) অস্থিরতা যাথারীতি বহাল থাকবে। তৃতীয়বার রাসূল (সা.) হযরত আসমার গৃহে উপস্থিত হয়ে শোক করতে বারণ করেন।
দ্বিতীয় বিয়ে
হযরত জাফরের শাহাদতের ৬ মাস পর হিজরী ৮ম সালের শাওয়াল মাসে হযরত আবূ বকর (রা.) এর সাথে হযরত আসমার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। দু’বছর পর দশম হিজরীর যিলকাদ মাসে হযরত আবূ বকর (রা.) এর ঔরসে প্ত্রু মুহাম্মদের জন্ম হয়। এ সময় আসমা হজ্ব করার জন্য মক্কায় এসেছিলেন। যুলহুলাইফায় মুহাম্মদের জন্ম হলে হযরত আসমা চিন্তিত হয়ে পড়েন যে হজ্ব কি করে আদায় করবেন। তাই তিনি এ ব্যাপারে নবীজীকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, গোসল করে এহরাম বাঁধ।
৮ম হিজরীতে স্বামীর শাহাদাতে হযরত আসমা যে আঘাত পেয়েছিলেন, তা তার জন্য কেয়ামতের চেয়ে কম ছিল না। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তিনি ধৈর্য ধারণ করেন। ১৩ হিজরীতে হযরত আবূ বকর (রা.) এর ওফাতে তিনি আবার আঘাত পান এবং আঘাত ও ধৈর্যের সাথে বরণ করে নেন। হযরত আবূ বকরের ইন্তিকালের সময় ওসিয়ত করে যান যে, স্ত্রী আসমা আমাকে গোসল করাবে। তার ওসিয়ত অনুযায়ী হযরত আসমা তাকে গোসল করান। হযরত আবূ বকর (রা.) ওফাত কালে পুত্র মোহাম্মদের বয়স ছিল আনুমানিক তিন বছর।
তৃতীয় বিয়ে
হযরত আবূ বকর (রা.) ওফাতের পর হযরত আলী (রা.) এর সাথে তার তৃতীয় বিয়ে হয়। শিশু পুত্র মোহাম্মদও মাতার সাথে হযরত আলীর (রা.) গৃহে প্রতিপালিত হয়। একদিন মুহাম্মাদ ইবনে জাফর ও মুহাম্মাদ ইবনে আবূ বকর (রা.) পরস্পরে গর্ব করে একে অপরকে বলে, আমি তোমার চেয়ে বেশি সম্মানিত, আমার পিতা তোমার পিতার চেয়ে বেশি ভালো। তাদের মধ্যে দীর্ঘকাল এ বাহাদুরী চলতে থাকে। হযরত আলী (রা.) স্ত্রী আসমাকে বললেন, তুমি এ বিতর্কের মীমাংসা কর। হযরত আসমা বললেন, আরবের নওজোয়ানদের মধ্যে জাফরের চেয়ে উত্তম কাউকে দেখিনি, আর বয়স্কদের মধ্যে হযরত আবূ বকর (রা.) এর চেয়ে ভালো কাউকে দেখিনি। এ মীমাংসার পর হযরত আলী (রা.) বললেন, তুমিতো আমার জন্য কিছুই রাখনি।
হযরত আলীর (রা.) ঔরসে এক পুত্র ইয়াহইয়া জন্ম গ্রহণ করে। মুহাম্মদ ইবনে ওমরের উদ্ধৃতি দিয়ে তবকাত-এ বলা হয়েছে যে, হযরত আলীর ঔরসে দু’জন পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করে-ইয়াহইয়া ও আওন (পৃষ্ঠা ২০৮)। কিন্তু প্রথম বর্ণনা বিশুদ্ধ বলে মনে হয়। কারণ, অধিকাংশ জীবন চরিতকার এ ব্যাপারে একমত।
হযরত (সা.) ইন্তিকালের আগে রোগাক্রান্ত হলে হযরত উম্মে সালমা ও হযরত আসমা রোগ নির্ণয় করে তাকে ঔষধ খাওয়াতে চান। কিন্তু তিনি খেতে অস্বীকার করেন। এ সময় তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলে তারা এটাকে মোক্ষম সময় মনে করে মুখে ঔষধ ঢেলে দেন। কিছুক্ষণ পর তার অচৈতন্যতা দূর হলে কিছুটা জ্ঞান ফিরে আসে। তিনি বলেন, আসমা এ পরামর্শ দিয়ে থাকবে।
৩৮ হিজরীতে তার পুত্র মুহাম্মদ ইবনে আবূ বকর মিসরে শহীদ হলে যালেমরা অতি নিষ্ঠুরভাবে তার লাশকে গাধার খালে পুরে পুড়িয়ে ফেলে। স্পষ্ট যে, হযরত আসমার জন্য এর চেয়ে কষ্টদায়ক ঘটনা ও মর্ম বিদারী দৃশ্য আর কি হতে পারে। কিন্তু তিনি অত্যন্ত ধৈর্য ধারণ করেন। এমর্ম বিদারী ঘটনার খবর পেয়ে জায়নামায নিয়ে নিয়োজিত হন। হযরত আসমা থেকে ৬০টি হাদীস বর্ণিত আছে। এসব হাদীসের রাবীরা হচ্ছেন, আবদুল্লাহ ইবনে জাফর, ইবনে আব্বাস, কাসেম ইবনে মুহাম্মদ, আব্দুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ, ইবনুল হাদ, ওরওয়া, ইবনে মোসাইয়্যের, উম্মে আওন ইবনেতে মুহাম্মদ ইবনে জাফর, ফাতমা ইবনেতে আলী, আবূ ইয়াযীদ মাদানী।
হযরত আসমার গর্ভে মোট ৭জন সন্তান জন্ম গ্রহণ করে-পাঁচ জন পুত্র ও দুজন কন্যা। প্রথম স্বামী হযরত জা’ফরের ঔরসে তিন পুত্র মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ও আওন, দ্বিতীয় স্বামী হযরত আবূ বকর এর ঔরসে এক পুত্র মুহাম্মদ এবং তৃতীয় স্বামী হযরত আলীর ঔরসে এক পুত্র ইয়াহইয়া। হিজরী চল্লিশ সালে হযরত আলী (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। প্রায় কাছাকাছি সময়ে হযরত আসমাও ইন্তিকাল করেন।