ইসলামি জীবনে বাস্তবতার গুরুত্ব

imagesCAXH8AYN

মানুষের জীবনপথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এ পথে আছে হাজারো সমস্যা, চড়াই-উৎরাই, বিপদ-আপদ। মানুষের জীবন তাই আরাম-আয়েসের নয়। জীবনধারণের কোনো পর্যায়েই বিনা পরিশ্রমে অভীষ্ট বস্তু লাভ হয় না। প্রয়োজন হয় প্রচুর পরিশ্রমের। মাঠে কায়িক পরিশ্রম করে চাষাবাদের মাধ্যমে ফসল ফলাতে হয়। এমনকি খাদ্যশস্যের জোগাড় থাকলেও রান্না করার পর তা আহারের যোগ্য হয়। বীজ থেকে অঙ্কুর, অঙ্কুর থেকে পাতা ও গাছের আকৃতি এবং ধীরে ধীরে পুরো গাছ মাটির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষের ক্ষেত্রেও প্রায় একই রূপ ব্যবস্থা। মায়ের উদরে অবস্থান, দুনিয়াতে শিশুর আগমন, শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের মধ্য দিয়ে তেজোদীপ্ত মানুষের প্রকাশ সবই কালের পথ বেয়ে চলে, হঠাৎ একদিন আত্মপ্রকাশ করে না। আল্লাহর প্রকৃতিতে বিদ্যমান এই চিরন্তন নিয়মের কোনো পরিবর্তন নেই। প্রকৃতিগত এই বাস্তব ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েই মানুষের চলে জীবন পথপরিক্রমা। ক্রিয়াশীল মানবজীবনে কেউ অক্রিয়া হলে বা যথাযথ সক্রিয় হতে সক্ষম না হলে তাকে পড়ে থাকতে হয় পেছনে, অন্যের কৃপায় পাত্র হয়ে। ইসলামি জীবনযাত্রা প্রণালীতেও নিষ্ক্রিয় থাকার কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ পাক মানুষকে যে শক্তি, ক্ষমতা, মনন ও মেধা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তার প্রয়োগকৃত পরিপূর্ণ বিকশিত রূপই কেবল তাকে তার মনজিল মকসুদে পৌঁছিয়ে দিতে পারে। অন্যথায় সে ব্যর্থ। এমনকি মানবদেহ এমনভাবে সৃজিত হয়েছে যে, সে দেহ স্থবির হয়ে থাকলে দিনে দিনে সে নিষ্ক্রিয় ও নিস্তেজ হতে বাধ্য। পরিশ্রম ও অঙ্গসঞ্চালন মানবদেহকে সচল রাখে। প্রাকৃতিক নিয়মে এক দিকে যেমন মানুষকে তার জ্ঞানবুদ্ধি প্রয়োগ করে জীবনের যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতে হয়, অন্য দিকে তেমনি তার দেহকে সবল ও কর্মক্ষম রাখার জন্য দেহের প্রতিটি অঙ্গের যথাযথ সঞ্চালন অব্যাহত রাখা প্রয়োজন হয়। দেহ, বুদ্ধি ও প্রচেষ্টার দ্বারা মানুষ বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। সব প্রাণীই মোটামুটি এভাবে জীবনাতিপাত করে।
কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে একান্তভাবে আর একটি দিক আছে যা তার জ্ঞানসমৃদ্ধ আদর্শিক দিক। আল্লাহ তায়ালাকে সচেতনভাবে এবাদত করার প্রজ্ঞা ও নৈতিক দায়িত্ব কেবল মানুষকেই দেয়া হয়েছে। এটিই তার আদর্শিক দিক। এই প্রজ্ঞাই তাকে দুনিয়াতে আল্লাহর প্রতিনিধির মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। নিজের বা অন্যের খেয়ালখুশি মতো সে কোনো কাজ করার অধিকারী নয়। আল্লাহ তায়ালার প্রদত্ত পথের বাইরে তার আর কোনো পথ নেই। সৃষ্টিগতভাবে এটিই মানুষের প্রকৃত পথ। এ পথে চলতে হলে চেষ্টাসাধনা যেমন থাকতে হবে, তেমনি সে চেষ্টাসাধনা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত পথে হতে হবে। আর তখনই সে কামিয়াবি হওয়ার আশা করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘যারা আমার পথে চেষ্টাসাধনা করবে, আমি অবশ্যই তাদের পথ দেখাব।’ অর্থাৎ চেষ্টাসাধনা কামিয়াবির শর্ত। আল্লাহ পাক আরো এরশাদ করেছেন ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের মাঝে যা আছে তা পরিবর্তিত করে।’ অতএব অত্যন্ত স্পষ্ট যে, জিহাদ বা চেষ্টাসাধনা ছাড়া জীবনধারণ বা কোনো লক্ষ্য অর্জন করতে যাওয়া মানবসৃষ্টির প্রকৃতি বিরুদ্ধ। আল্লাহর হাবিব রাসূলে মকবুল সা:-কেও অসংখ্য যুদ্ধে জীবন বিপন্ন করে অংশ নিতে হয়েছিল। ওহোদের যুদ্ধে তাঁর দাঁত মোবারক শহীদ হয়েছিল, শিরস্ত্রাণ মাথার মধ্যে ঢুকে রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছিল, শত্রুদের নিরবচ্ছিন্ন তীর নিক্ষেপের সম্মুখে সাহাবিদের আড়ালে তিনি নিজেকে রক্ষা করতে প্রয়াস পেয়েছিলেন। এতদসত্ত্বেও বিনা যুদ্ধে শত্রুর বিরুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য আল্লাহ দরবারে দোয়া করার জন্য তিনি হাত তোলেননি। এতে বোঝা যায়, অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য জাগতিক নিয়মে যে প্রচেষ্টা নেয়া দরকার তা অবশ্যই করতে হবে। ভুল হলে খেসারত দিতে হবে যেমন উহুদের যুদ্ধে দিতে হয়েছিল। তবে এর পরেও কামিয়াবি দান করার মালিক আল্লাহ তায়ালা। ইসলামের ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, মুসলমানরা যখনই ইসলামি আদর্শ অনুসারে কোনো হক লক্ষ্য অর্জনে আত্মত্যাগে প্রবৃত্ত হয়েছেন, কোনো শক্তিই তাদের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। মুসলমানদের বিজয়ের শর্ত হলো খাঁটি মুসলমান হওয়া, হক লক্ষ্যে জিহাদ বা চেষ্টাসাধনা করা এবং ইসলামি আদর্শ অনুসারে করা। এর ব্যত্যয় ঘটলে আল্লাহর সাহায্য লাভের আশা করা যায় না। এ ধারণা সঠিক নয় যে, মুসলমান হলেই অমুুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের বিজয়ী করে দেবেন। ইরাক যুদ্ধের সময় অনেকের এ ধারণা ছিল যে, একাধিক নবী, সাহাবা ও হজরত গওসুল আজম আবদুল কাদির জিলানি (রহ:) যে মাটিতে সমাহিত, সেখানে কোনো কাফির-মুশরিকের বিজয় অসম্ভব। কিন্তু সে অসম্ভব সম্ভব হলো,
ইরাক যুদ্ধে মুসলমান ও ইরাক উভয়েই পর্যুদস্ত হলো। কোনো আসমানি সাহায্য নেমে এসে মুসলমানদের বিজয় নিশ্চিত করেনি। আর এর কারণ, মুসলমানরা ইসলামি আদর্শের সৈনিক ছিল না। সামান্য ভুলের কারণে ওহোদের যুদ্ধে যেখানে আল্লাহর হাবিব কর্তৃক স্বয়ং পরিচালিত যুদ্ধে বিজয় লাভ করা যায়নি, সেখানে ইসলামি আকিদা ও আমলবিবর্জিত কেবলমাত্র মুসলমান নামধারী সৈনিকদের দ্বারা যুদ্ধে জয়লাভ করা কেমন করে সম্ভবপর? সেই মুসলমান কোথায়? সেই জিহাদ কোথায়? সেই ইসলামি আদর্শ কোথায়? কোনো কোনো মজলিসে বলা হয় যে, আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে আল্লাহর পথে মেহনত করো, আল্লাহ তোমার সব কিছুই ব্যবস্থা করে দেবেন। কথাটিতে ভুল নেই। কিন্তু এ কথার সাথে সাথে বলা প্রয়োজন যে, আল্লাহর কাছ থেকে ফল লাভের আশা করতে হলে বান্দার করণীয় কাজগুলো অবশ্যই করতে হবে। ফসল লাভ করতে হলে চাষাবাদ, বীজ বপন, পানি নিষ্কাশন প্রভৃতি করতে হবে। চাকরি ও ব্যবসায়ে পরিশ্রম অপরিহার্য। সব মানুষের জন্য এটি আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ম বা ফিতরাত যা সমগ্র সৃষ্টিজুড়ে এক মহাসত্য হিসেবে বিদ্যমান। কোনো নবীও এর ঊর্ধ্বে ছিলেন না। জাগতিক নিয়ম পালন করা তাঁদের জন্য সুন্নাত ছিল। তাদের জন্য মোজেজা ছিল আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতা যা স্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। কেউ যদি মনে করেন তিনি দিনরাত নামাজ, রোজা, তাসবিহ-তাহলিলে মশগুল থাকবেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন যেন তার মাঠ ফসলে ভরে যায়, তাহলে কি ফসলে ভরে যাবে তার মাঠ? কেউ যদি স্ত্রী ছাড়া সন্তান কামনা করেন, তিনি কি সন্তান লাভ করবেন? তবে এটি ঠিক যে, আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভরশীল হয়েই আমাদের সব কাজ করতে হবে, আর তখনি কেবল আসতে পারে পরিশ্রমের তুলনায় বেশি সফলতা। আদর্শের সাথে যদি উপকরণ মজুদ না থাকে তাহলে ফল লাভ করা যায় না। আবার যদি আদর্শ কলুষিত হয়, তাহলেও আল্লাহর সাহায্য মেলে না। তবে এটিও ঠিক যে, আদর্শ ও উপকরণ সব ঠিক থাকলেও এবং কেউ আদর্শকে ছেড়ে দিয়ে শুধু উপকরণের ওপর নির্ভর করলেও আল্লাহ তায়ালা তাঁর হিকমত অনুসারে ফল দান করেন। এটি আল্লাহর জন্য খাস। সমাপ্ত

Related Post