ইসলামী দাওয়াত মুসলমানদের জন্য আল্লাহ তায়ালার প থেকে এক অফুরন্ত নিয়ামত। এ জন্য ইসলামে দাওয়াতের গুরুত্ব অপরিসীম। যে কারণে অসংখ্য নবী-রাসূল এ পৃথিবীতে আগমন করেছেন। ‘দাওয়াহ’আরবি শব্দ। যার শাব্দিক অর্থ আহ্বান করা, ডাকা। পরিভাষায় সব মানবসমাজকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখশান্তি, কল্যাণ ও মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে পরিচালিত কার্যক্রমকে ইসলামে দাওয়াত হিসেবে গণ্য করা হয়। এ দাওয়াত মানুষকে অশান্তি থেকে শান্তির দিকে, অকল্যাণ থেকে কল্যাণের দিকে, সঙ্কীর্ণতা থেকে উদারতার দিকে, জাহান্নাম থেকে জান্নাতের দিকে এবং পশ্চাৎপদতা থেকে প্রগতির দিকে ধাবিত করে। আল্লাহর সাথে মানবজাতির সম্পর্ক দৃঢ় করতে দাওয়াত সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
ইসলামী দাওয়াতের কর্মসূচি মানুষের জন্য কল্যাণকর। মহান আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির মধ্য থেকে কিছু লোককে বাছাই করে দাওয়াতের জন্য মনোনীত করেছেন। তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। পৃথিবীর প্রথম মানব ও নবী হজরত আদম আ: এ দাওয়াতের কার্যক্রমের সূচনা করেন। পরবর্তী সময়ে হজরত নূহ, হুদ, সালিহ, ইয়াকুব ও ইউসুফ আ: থেকে হজরত ঈসা আ: পর্যন্ত অসংখ্য নবী-রাসূলের মাধ্যমে এ ধারা অব্যাহত রাখেন। তাঁরা আল্লাহ তায়ালার প থেকে নাজিলকৃত বাণীগুলো সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবকে প্রেরণ করেছিলেন সব জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার জন্য। ফলে মহানবী সা:-এর দাওয়াত ছিল সার্বজনীন। পূর্ববর্তী নবী ও রাসূলগণ বিশেষ কোনো গোত্র, গোষ্ঠী বা অঞ্চলের অধিবাসীকে দাওয়াত দিয়েছেন। ফলে তাদের দাওয়াত সার্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। মহানবী সা: সব জাতি, গোষ্ঠীর কাছে আল্লাহ প্রদত্ত দাওয়াত দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা এ জন্যই তাকে ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন- ‘আপনি বলুন, হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর প থেকে প্রেরিত রাসূল’ (সূরা আল-আ’রাফ : ১৫৮)। তাঁর অবর্তমানে দাওয়াতের এ গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয় মুসলিম উম্মাহর প্রতি, যারা কিয়ামত পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখবে।
রিসালাতের এই দায়িত্বের কারণেই মুসলিম উম্মাহকে ‘সর্বোত্তম জাতি’ বলা হয়েছে। মুসলমানেরা যদি এই দায়িত্ব পালনে নিবৃত্ত থাকে তাহলে অন্য জাতির সাথে পার্থক্য করা যাবে না। অন্য জাতির মধ্যে না আছে কোনো বিশেষ সৌন্দর্য, আর না আছে বিশেষ মর্যাদা লাভের কোনো কারণ। আল্লাহ তায়ালারও দেখার প্রয়োজন নেই যে, তারা দুনিয়াতে সসম্মানে বসবাস করছে, না অপমানিত অবস্থায় জীবনযাপন করছে। বরং এই দায়িত্ব ভুলে যাওয়ার কারণে আগে অন্য জাতির মতো আল্লাহর অভিশাপে পতিত হবে।
ইসলামী দাওয়াত সমাজকে সুন্দরের অন্যতম হাতিয়ার। সমাজের সর্বপ্রকার অন্যায়, অবিচার, পাপাচার, মারামারি, দুর্নীতি, ব্যক্তিচরিত্র নষ্টসহ সব অপরাধ নির্মূলে ইসলামী দাওয়াত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। কেননা এ দাওয়াতের মূল বিষয়বস্তু হলো সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ। সেহেতু ব্যক্তি সর্বপ্রকার অন্যায় কাজ থেকে বিরত থেকে সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে। পাপাচারযুক্ত এ সমাজে ইসলামী দাওয়াতই মানব-সমাজের কাছে আশার আলো প্রজ্বলিত করতে পারে।
মুসলিম উম্মাহ দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করবে এটাই স্বাভাবিক। কেননা মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নির্ভর করে এ দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার ওপর। সব অন্যায়-অত্যাচারের যাঁতাকল থেকে বিশ্বমানবতাকে মুক্ত করে একটি সুখী-সমৃদ্ধ পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব এ উম্মতেরই। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠতম উম্মত। মানুষের কল্যাণার্থেই তোমাদের বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দেবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে’ ( সূরা আল ইমরান : ১১০)।
ইসলামী দাওয়াতের বাস্তবায়ন তড়িঘড়ি কোনো বিষয় নয়। ইসলামী দাওয়াতি কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকার কোনো সুযোগ মুসলিম উম্মাহর নেই। সর্বপ্রকার অন্যায়-অবিচারে পৃথিবী যখন জর্জরিত, তখনই অবিরাম দাওয়াতি কার্যক্রমই পারে বিপন্ন মানবতাকে মুক্তির সন্ধান দিতে। মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে দাওয়াতের বিকল্প কিছুই নেই। এ দাওয়াতের মাধ্যমে সমাজ-দেশ-জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী মানবতা মুক্তি ও কল্যাণ লাভ করতে পারে। এতে ছেদ পড়লে মানবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। মহানবী সা:ও এ বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন ‘আমি সেই সত্তার শপথ করে বলছি যার হাতে রয়েছে আমার প্রাণ, অবশ্যই তোমরা সৎ কাজের নিদের্শ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে। নতুবা তোমাদের ওপর শিগগিরই আল্লাহ শাস্তি অবতীর্ণ করবেন।তখন তোমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাতে থাকবে কিন্তু তোমাদের প্রার্থনা কবুল করা হবে না’ (তিরমিজি)।
অতএব সামাজিক অশান্তি দূর করা ও মানবতার মুক্তির জন্য সবাইকে একযোগে দাওয়াতি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে। নিজেদের পরিশুদ্ধ হতে হবে এবং অন্যদের মাঝে চিন্তার পরিশুদ্ধি ঘটাতে হবে। তবেই আমরা নতুন প্রজন্মের মাঝে একটি কল্যাণময় সমাজ উপহার দিতে সম হবো এবং পরকালে লাভ করতে পারব চূড়ান্ত সফলতা।
(সমাপ্ত)