মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা মানব জাতিকে দু’টি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন, এক শ্রেণীর নাম পুরুষ, অপর শ্রেণী হলো নারী। তিনি প্রকৃতিগত কারণে পুরুষ ও নারীকে একে অপরের পরিপূরক হিসাবে গঠন করেছেন। একজন পুরুষ যেমনি নারী ছাড়া তার জীবনের পূর্ণতা খুঁজে পায়না, তেমনি একজন নারীও জীবনসংঙ্গী হিসাবে একজন পুরুষ ছাড়া জীবনের পরিপূর্ণতা কল্পনা করতে পারেনা। আল্লাহ তাআলা নারী- পুরুষের এ সুন্দর বন্ধন সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের সূরা আরাফের ১৮৯ নম্বর আয়াতে খুবই সুন্দর করে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন-
‘তিনি আল্লাহ, যিনি তোমাদেরকে একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং একই সত্ত্বা থেকে তোমাদের জুড়ি বানিয়েছেন যেন তোমরা (পুরুষরা) তাদের (নারীদের) থেকে শান্তি ও স্থিতি লাভ করতে পার।’ এবং কুরআনে পাকের সূরা বাকারার ১৮৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ নারী পুরুষের এ মধুর বন্ধন তথা সম্পর্কের কথা আরো সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন-
‘তারা (নারীরা) হচ্ছে তোমাদের (পুরুষদের) পরিচ্ছেদ আর তোমরা (পুরুষরা) তাদের (নারীদের) পরিচ্ছেদ।’ এ আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ পাক নারী- পুরুষকে যে একে অপরের পরিপূরক তা সুস্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন। সূরা বাকারার ২২৮ নম্বর আয়াতে নারী- পুরুষের অধিকার সম্পর্কে উল্লেখ করে তিনি ইরশাদ করেন-
‘নারীর ওপর পুরুষের যেমন অধিকার রয়েছে, সেরকম তাদের ওপরও নারীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে।’ এ আয়াতে তিনি নারী ও পুরুষের সমান অধিকারকে নিশ্চিত করেছেন। উপরে বর্ণিত কুরআনের আয়াতের আলোকে আমি আমার মূল আলোচ্য বিষয়ের দিকে ফিরে যেতে চাই। সম্মানিতা মা ও বোনেরা: এখানে আমার আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ইসলামে নারীর মর্যদা এবং বর্তমান নারী সমাজ। আমার আলোচ্য বিষয়কে আমি দু’টি ভাগে বিন্যস্ত করেছি। প্রথম ভাগে আলোচনা করবো ‘ইসলামে নারীর মর্যাদা’। দ্বিতীয় ভাগে ‘বর্তমান নারী সমাজ’ নিয়ে।
ইসলামে নারীর মর্যাদা: পবিত্র কুরআন ও হাদীস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ইসলাম নারীজাতিকে যে মর্যাদা দিয়েছে, সে মর্যাদা বা সম্মান ইতোপূর্বে কোন ধর্ম দিতে পারেনি।
মহান আল্লাহ নারীজাতি তথা মায়ের জাতিকে সম্মান ও মর্যাদা দিতে গিয়ে কুরআনের যেখানেই পুরুষের কথা উল্লেখ করেছেন, সেখানেই নারীর কথা উল্লেখ করেছেন। এতে করে তিনি উভয়ের মর্যাদা, অধিকারকে সমান ও সমুন্নত করেছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে ইসলাম নারীজাতিকে সমান অধিকারের জায়গায় বরং বেশি অধিকারই দিয়েছেন। যেমন: বিবাহে দেন মোহর প্রাপ্তি, মাতা-পিতার রেখে যাওয়া সম্পদের অধিকার ইত্যাদি। তাছাড়া নারীদের বিবাহপূর্ব ভরণ-পোষণের দায়িত্ব থাকে মা-বাবার ওপর আর বিবাহের পর সে দায়িত্ব গিয়ে পড়ে তাঁর স্বামীর ওপর। আবার স্বামীর ইন্তেকালে সন্তানরাই তারঁ ভরণ-পোষণের ভার গ্রহণ করেন। কিন্তু অন্য কোন ধর্মে এ অধিকার দেওয়া হয়নি। তাছাড়া ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী এক সাহাবির ‘সবচেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার পাওয়ার হকদার কে?’ এ প্রশ্নের উত্তরে পরপর তিনবার মায়ের কথা উল্লেখ করে চতুর্থবার বাবার কথা উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু সবার মনে রাখতে হবে, অধিকার সমান হলেও দায়িত্ব যে আলাদা এবং দায়িত্বের ক্ষেত্রে পূরুষ যে আবার নারীর পরিচালক একথাও তিনি স্পষ্ট করেছেন। কারণ প্রতিটা ক্ষেত্রে একটা প্রতিষ্ঠান কিংবা সংসারে কোন একজনকে অবশ্যই পরিচালক হতে হয়। এ ক্ষেত্রে সংসারে পরিচালকের দায়িত্বটা আল্লাহ পূরুষকেই ন্যস্ত করেছেন। আল্লাহ তাআলা যেহেতু আমাদের খালেক তথা সৃষ্টিকর্তা সেহেতু তিনিই ভাল জানেন কার দায়িত্ব বা কাজ কোনটা হলে ভাল হবে, যেমন একজন মোবাইল তৈরি কারক বলতে পারবেন তার মোবাইলের কোন অংশের কি কাজ হবে। আর তাইতো তিনি সূরা নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন- ‘পূরুষরা হচ্ছে নারীদের পরিচালক।’
এভাবে রাসূল (সা.) নারীদের দায়িত্ব কর্তব্যের উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন- ‘এবং মহিলারা হচ্ছে স্বামীর ঘর ও সন্তানের রক্ষক তথা রক্ষণাবেক্ষণকারী।’ (বুখারী: ৪৯০৪)
এ হাদীসে নারীজাতির দায়িত্বের ব্যাপারে তিনি স্পষ্ট করেছেন। তিনি অন্য হাদীসে নারীজাতি তথা মায়ের জাতিকে সম্মানিতা ও মর্যদাশীলা করতে গিয়ে বলেন- ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ [নাসাঈ: হা. ৩১০৪, মুসনাদে আহমদ: হা ১৫৪৭৫] এ হাদীসে তিনি নারীজাতি তথা মায়ের জাতিকে মর্যাদার উচ্চ শিখরে বসিয়েছেন। এত অধিকার ও মর্যাদা দেওয়ার পরও বিশেষ কারণে আল্লাহ তাআলা নারীজাতির এই সব মর্যাদা ও সম্মান ধরে রাখতে তাদের চলাফেরা মেলামেশা ও আচার-আচরণের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা আরোপ করেছেন। তিনি স্বয়ং নবী করীম (সা.) এর স্ত্রী পরিজন ও মু’মিন নারীদের ব্যাপারে সূরা আহযাবের ৫৯ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন- ‘হে নবী! ‘আপনি আপনার বিবি, কন্যা এবং মু’মিন মহিলাদের বলে দিন তারা যেন তাদের শরীর ও মুখণ্ডল চাদর দ্বারা আবৃত করে রাখে।’ [সূরা আহযাব : ৫৯]
এ আয়াতে কারীমা বিশ্লেষণ করে আমরা বলতে পারি নারীরা সৃষ্টিগতভাবে একটু দুর্বল প্রকৃতির এবং সৃষ্টি বৈচিত্রে তারা হচ্ছেন আকর্ষণীয়া। তাই মহান আল্লাহ তাদের হেফাজতের জন্য একথা বলেছেন। কুরআন, হাদীস ইসলামী সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন আর যুক্তি ও চিন্তার আলোকে বলা যায়, মহান আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন উপাদানগত দিক দিয়ে পূরুষদের চোখে মোহনীয়া, আকর্ষণীয়া করেই। অনেক ক্ষেত্রে তাই তাদের লাগামহীন চলাফেরা পূরুষের সুপ্ত পাশবিকতাকে জাগিয়ে তোলে এবং অঘটনের সম্ভাবনা থাকে। এ কারণে সেদিকে খেয়াল রেখেই নারীদের চলাফেরা করা দরকার। আর এ কারণেই সমাজের প্রত্যেক কাজ কিংবা আচার-অনুষ্ঠানে তাদের অবাধ অংশ গ্রহণ বাঞ্চনীয় নয়। তবে তাদের উৎসাহ-উদ্দিপনা, ঐকান্তিক সহযোগিতা ছাড়া যে পুরুষজাতি কোন কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারবেনা তা আমি অস্বীকার করছিনা।
এ প্রসংঙ্গে কবির ভাষায় বলি-
পৃথিবীর যত সুন্দর সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।
এবার আমি বলতে চাই ইসলাম যেখানে নারীর এমন মর্যাদা দিয়েছে সেখানে বর্তমান নারী সমাজের কি অবস্থা ?
আলোচনার দ্বিতীয় ভাগে আমি তাই ‘বর্তমান নারী সমাজ’ নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
বর্তমান নারী সমাজ:
সমাজে আমাদের মা বোনদের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা কি দেখতে পাই? আমরা দেখতে পাই, তারা অধিকাংশই আল্লাহ প্রদত্ত মর্যাদা ও সম্মানের কথা ভুলে গিয়ে শয়তানের দেখানো পথেই বেশি চলছে । ফলে কি হচ্ছে ? সমাজে নানা বিশৃঙ্খলা, অশান্তি, খুন-রাহাজানী, হত্যা ধর্ষণের মতো অপরাধের প্রবণতা দিন-দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে হোটেল, সিনেমা, থিয়েটার, নাইট ক্লাব, শপিংমল, পার্ক, রেস্তোরায় ইচ্ছায়-নিচ্ছায় নারীরা হারাচ্ছে তাদের ইজ্জত আর সম্ভ্রম, হচ্ছে লাঞ্চিতা ও ধর্ষিতা। আবার অনেকে ষড়যন্ত্রের স্বীকারও হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সব দোষ যে নারীদের, পুরুষের বুঝি কোন দোষ নেই তাও আমি বলছিনা। তার মানে আমি একথাও বলছিনা যে, আমাদের সব মা- বোনেরা নষ্ট পথে পা বাড়িয়েছে; বরং আমি সেসব মা-বোনদের কথা বলছি, যারা মুসলমান তথা ইসলামের অনুসারী হয়ে ইসলামের কালচার ভুলে গিয়ে পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে পতিত হয়ে তাদের কৃষ্টি কালচারকে গ্রহণ করে নিজের খেয়াল খুশি মতো চলে নিজের জীবন ও স্রষ্টা প্রদত্ত সম্মান, মর্যাদা বিনষ্ট করতেছেন।
এটা কেন হয়েছে? কি করে হয়েছে! এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
প্রথমতঃ আমাদেরমত মুসলিমপ্রধান দেশে আমাদের মা-বোনদের ইসলাম, ইসলামী জীবন বিধান ও তার উপকারিতা সম্পর্কে ভালভাবে শিক্ষা দেয়ার মতো উল্লেখযোগ্য কোন প্রতিষ্ঠান সরকারীভাবে গড়ে উঠেনি।
দ্বিতীয়তঃ আলেম সমাজের ব্যাপক সচেতনতার অভাব, মতানৈক্য ও দলাদলি। তাছাড়া বিপথগামী কিছু যুবক-যুবতিদের মদ, জোয়া, নেশায় লিপ্ত হওয়া এর অন্যতম কারণ।
তৃতীয়তঃ দেশের প্রগতিবাদী কিছু বিবেক বিক্রেতা নারীসমাজের ইসলাম বিদ্ধেষি প্রচার-প্রচারণা, হিন্দি ও ইংলিশ ফিল্মের আগ্রাসন।
সর্বোপরিঃ আমাদের অভিভাবক মহলের অসচেতনতা, ছেলে-মেয়েদের দিকে খেয়াল না রাখা, বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে চাচাত, খালাত, মামাত, ফুফাত, ভাই ও গায়রে মুহরিমের সাথে অবাধমেলা-মেশার সূযোগ দেওয়া এবং দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে ধারনা না থাকাই এর মূল কারণ।
সিনেমা, থিয়েটার, নাইট ক্লাব, শপিংমল, পার্ক, হোটেল, রেস্তোরায় নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশার কারণে প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই কোন না কোন দুঃসংবাদ, কোন না কোনভাবে নারী নির্যাতনের খবর আমাদের দেখতে হয়। সম্প্রতি প্রতিবেশি দেশে বাস গাড়ীতেই গণধর্ষণে মেডিকেল ছাত্রী মারা যাওয়ার ঘটনাসহ দেশেও আমরা অসংখ্য ঘটনা ঘটতে দেখতে পাই, এরপরও আমরা কেন সতর্ক হচ্ছিনা? এ সমস্যা থেকে উত্তরণে আমাদের মা-বোনকেই প্রথমে উদ্যোগ নিতে হবে। যে পশ্চিমা কালচার আমাদের মা-বোনদের ধ্বংস করেছে সে পশ্চিমা মা-বোনেরাই এখন নিজেদের সর্বস্ব হারিয়ে আজ দলে-দলে ইসলামের পতাকা তলে সমবেত হচ্ছে। প্রতিদিন অহরহ মা-বোন ইসলামের সুশীতল ছায়া তলে আশ্রয় নিয়ে বাকী জীবনে আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানে নিজেকে সোপর্দ করছে। ইসলামকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম শুধু নয়; বরং মুক্তির একমাত্র শ্রেষ্ঠ ঠিকানা হিসাবে খুঁজে নিয়েছে তারা।
পরিশেষেঃ অমুসলিম মা-বোনদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন যে , ইসলাম নারীদের যে মর্যাদাপূর্ণ জীবন ও চলার পথের দিশা দিয়েছে তা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য কল্যাণকর। এ পথে চললে যে কোন ধর্ম, বর্ণের নারীসমাজ তাঁর মর্যাদাপূর্ণ জীবন ফিরে পাবে। যে জীবনে অশান্তি আর আত্মগ্লানি থাকবে না। যেভাবে মর্যাদা ফিরে পাচ্ছে পশ্চিমা নারীসমাজ। আসুন বেলেল্লাপনা, বেহায়াপনার লাগামহীন জীবনকে পদদলিত করে মুক্তির শেষ ঠিকানা ইসলামকে জীবনের পাথেয় হিসাবে গ্রহণ করে ইসলামী জীবন গঠন করি। প্রগতিবাদী মা-বোন ও তাদের অনুসারীদের কদমে হাত রেখে বলতে চাই, যে জীবনে গ্লানি সে জীবনে আত্মমর্যাদা নাই, যেখানে শান্তি নাই, সে জীবন থেকে ফিরে এসে আসুন ইসলামী জীবন গঠন করি, আল্লাহ আমাদের অভিভাবক, পুরুষজাতিসহ মা-বোনদের সবার অন্তরে দ্বীনের আলো তথা সঠিক জ্ঞান জানা বুঝা ও মানার সুযোগ করে দিন এ আশায়। আমীন ॥
* মাওলানা আবদুল জব্বার ফিরোজ