ঈদ মোবারক। এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতর আমাদের দ্বারে সমাগত। সিয়াম বারোজা পালন একটি মৌলিক ইবাদত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাকে কষ্ট দেয়ার জন্যএই ইবাদাত ফরজ করেননি। তিনি এই ইবাদাত ফরজ করা প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বলেছেন,”হেঈমানদার লোকেরা তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করে দেয়া হলো যেমনভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদেরওপর ফরজ করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” ( সূরা: বাকারা:১৮৩)।তাকওয়া শব্দের অর্থ আল্লাহভীতি। এই ভয় ভয়ঙ্কর কিছু দেখে ভয় পাওয়ার মতো নয়, ভালোবাসাও শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয়। এই গুণ অর্জনের মাধ্যমে বান্দার সাথে আল্লাহর এক গভীর সম্পর্কসৃষ্টি হয়। এই মাসে সুবেসাদিক থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর একজন বান্দাতাঁর নির্দেশে পানাহার ও স্ত্রী সহবাসের মতো হালাল কাজ থেকে বিরত থাকেন। অর্থাৎআল্লাহ রাব্বুল আলামীন মাহে রমজানে তার বান্দার জন্য অন্য সময়ের হালাল কাজগুলোকেওএই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হারাম করেছেন। উদ্দেশ্য বান্দাকে কষ্ট দেয়া নয়, আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আত্মউন্নয়ন। পবিত্র ঈদুল ফিতর এই উন্নত আত্মশক্তি নিয়ে বছরেরবাকী ১১ মাস সামনে এগিয়ে চলার শপথ নেয়ার দিন।
ঈদ শব্দের অর্থ খুশি। কিন্তু এই খুশি পার্থিব প্রাপ্তি কিংবা ভোগবিলাসের আনন্দেরনয়। আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে নিজেকে মানুষের কল্যাণের উপযোগী করে গড়ে তোলারআনন্দ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, “ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশিরঈদ/ নিজেকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাকিদ।” পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহর খলিফা বাপ্রতিনিধি। আল্লাহর সৃষ্টি এই সুন্দর বিশ্ব জাহানের মধ্যে সর্ব শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিমানুষ। মানুষকে তিনি ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়ে ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন।আল্লাহর সাথে সম্পর্কের বন্ধন যেন বিচ্ছিন্ন না হয় সেই জন্য তিনি যুগে যুগে নবী ওরাসূল পাঠিয়েছেন। এই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবী ও রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁরকাছে নাজিল করেছেন সর্বশেষ আসমানী কিতাব আল-কুরআন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, “রমজান মাস, এই মাসে আল কুরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানব জাতির জীবনব্যবস্থা, ভালো-মন্দ সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী।” (সূরা বাকারা: ১৮৫)। পবিত্র কুরআন নাজিলেরমাস রমজানের সাধনার একটি বড় লক্ষ্য থাকে আল্লাহর এই বিধানের আলোকে জীবন গঠন।কুরআনের আলোকে জীবন গঠনে যারা সফল হন তারা সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দেরপার্থক্য বুঝতে পারেন। এমন মানুষের সংখ্যা দুনিয়াতে যত বেশি হবে আল্লাহর সৃষ্টি এইসুন্দর পৃথিবী তত সুন্দরতর হবে। হিংসা হানা-হানি, যুদ্ধ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, প্রতারণা, ঘুষ-দুর্নীতিসহ সকল অনিয়ম অন্যায় দূর হবে।
আসুন, আমরা ঈদুল ফিতরে এই দিনে শপথ নেই, মাহে রমজানের শিক্ষার আলোয় পথচলার।
ঈদের দিনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা-
রমাদান মাসটা দেখতে দেখতে চলেই গেল। এই একটি মাসের জন্য দুই শ্রেণীর লোক সারা বছর ধরে অধীর অপেক্ষায় থাকেন – দোকানদার আর ইমানদার। অধিকাংশ দোকানদারের জন্য রমাদান হলো ব্যবসার মূল মৌসুম। ঈদকে সামনে রেখে তারা এই মাসে তাদের সমস্ত পুজি বিনিয়োগ করেন, দরকার হলে ধার-কর্জ করে হলেও ব্যবসায় টাকা খাটান। তাদের এই পরিশ্রমের ফল তারা ঈদের ঠিক আগেই পেয়ে যান।
রমাদান মাসে একজন ইমানদারের জন্য বিনিয়োগটা একটু অন্যরকম। তিনি তার সময়, শারীরিক সামর্থ আর আর্থিক সম্পদকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় ব্যয় করেন। তার রমাদানের দিনগুলো কাটে রোযা রেখে আর রাতগুলো কাটে নামায আর আল্লাহর স্মরণে। তিনি অন্য মাসের চেয়ে এই মাসে বেশি বেশি করে দান করেন, বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করেন। ইমানদারও তার প্রচেষ্টার জন্য প্রতিদানের আশা রাখেন, তবে এই দুনিয়াতে নয়, আখিরাতে।
আর কোন ইমানদার যদি একইসাথে দোকানদারও হন তবে তো সোনায় সোহাগা! এই দুনিয়াতেও লাভ, আখিরাতেও লাভ।
***-আপনি এমন কোন দোকানদারকে কি দেখেছেন যিনি শুধু রমাদান মাসে দোকানদারি করেন আর সারা বছর ঘুমিয়ে কাটান? বা মন চাইলে সপ্তাহে শুধু একদিন দোকান খোলেন? অথবা দিনে মাত্র এক বেলা দোকান খোলা রাখেন?
প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত দোকানদারই সারা বছর ধরে ব্যবসা চালিয়ে যান। বাকী এগার মাসের লাভের টাকা রমাদান মাসের জন্য পুজি হিসেবে বিনিয়োগ করেন। আর এই পুজির জোরেই তিনি রমাদানের বাড়তি লাভটুকু তুলে আনেন।
একজন দোকানদার তার ব্যবসার ব্যাপারে যতটুকু সিরিয়াস আমরা আমাদের ইমানের ব্যাপারে কি ততটুকু সিরিয়াস হতে পেরেছি? শুধু রমাদান মাসে নয়, বাকী এগার মাসেও কি আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় কুরআন এবং রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শ অনুযায়ী আমাদের জীবনকে পরিচালিত করছি? আমাদের প্রত্যেকেরই উচিৎ এই ব্যাপারে আত্মসমালোচনা করে দেখা।
***- রমাদান মাসে আমাদের করা ইবাদাতসমূহ আল্লাহর কাছে গৃহীত হয়েছে কি না তা আল্লাহই ভালো জানেন। আমরা কেউই তা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। আমরা প্রত্যেকেই রমাদান মাসে জেনে বা না জেনে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অনেক ভুল-ত্রুটি করে ফেলেছি, ফলে আমাদের সবার অন্তরেই ভয় থাকা উচিৎ যে হয়ত আল্লাহর কাছে আমাদের ইবাদাতসমূহ গৃহীত হয়নি। একইসঙ্গে আবার আশাও রাখতে হবে যে আমাদের প্রচেষ্টার জন্য আল্লাহ আমাদেরকে পুরস্কৃত করবেন, কারণ তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। একজন সত্যিকার ইমানদারের জন্য ভয় এবং আশা পাখির দুইটি ডানার মতো – উড়তে গেলে উভয় ডানার সাহায্য লাগে, শুধুমাত্র একটি ডানা দিয়ে ওড়া যায় না। একজন প্রকৃত ইমানদার আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে, তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে এবং তাঁর কাছ থেকেই উত্তম প্রতিদানের আশা রাখে।
***- যদিও আমরা জানি না যে আমাদের রমাদানের ইবাদাতসমূহ গৃহীত হয়েছে কি না, তবে কিছু আলামত থেকে তা কিছুটা হলেও ধারণা করা যেতে পারে।
প্রথমত, আমাদের মনে যদি একটা খচখচানি থাকে যে, যেভাবে রমাদান কাটানো উচিৎ ছিল আমরা সেভাবে কাটাতে পারিনি এবং মনের মধ্যে একটা অজানা আশঙ্কা থাকে যে আমাদের রমাদান আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে তো, তবে এটি একটি ভাল লক্ষন। আশা করা যায় আমাদের অন্তরের নিষ্ঠা আর প্রচেষ্টার কারণে আল্লাহ আমাদেরকে পুরস্কৃত করবেন।
আর যদি আমরা মনে মনে আত্মপ্রসাদ লাভ করি যে, দীর্ঘ এক মাস রোযা রাখলাম, রাত জেগে তারাবী আর তাহাজ্জুদ পড়লাম, কয়েকবার কুরআন খতম করলাম, আমার পুরস্কার আর ঠেকায় কে, তবে বুঝতে হবে যে লক্ষন ভাল নয়।
দ্বিতীয়ত, আমাদের ভেবে দেখতে হবে আমরা রমাদানের আগে আল্লাহর নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে যে অবস্থায় ছিলাম, রমাদানের পরেও কি সেই একই অবস্থায় আছি, তার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছি, নাকি কিছুটা হলেও অবস্থার উন্নতি হয়েছে। যদি উন্নতি হয়ে থাকে তবে ভাল, অন্যথায় বুঝতে হবে লক্ষন আসলেই সুবিধার নয়।
উদাহরণস্বরূপ, রমাদানের আগে আপনি নিয়মিত এমটিভি দেখতেন, রমাদান শেষেও নিয়মিত দেখছেন, তবে বুঝতে হবে আপনার রমাদানের ইবাদাতে মানের দিক দিয়ে ঘাটতি ছিল। আর যদি এখন এমটিভি দেখলেই আপনার অস্বস্তি লাগে, তবে বুঝতে হবে আপনি রমাদান মাসে আন্তরিকভাবেই আল্লাহর ইবাদাত করতে চেষ্টা করেছেন।
তৃতীয়ত, আমাদের জন্য যদি ভাল কাজ করা আগের চেয়ে সহজতর হয়ে থাকে তবে আশা করা যায় যে আল্লাহ আমাদের ইবাদাতসমূহ গ্রহণ করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, রমাদানের আগে আপনি ফজরের নামাযের সময় নিয়মিত ঘুম থেকে উঠতে পারতেন না, রমাদানের পরে নিয়মিতই পারছেন, তবে বুঝতে হবে যে আপনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই রমাদানে ইবাদাত করেছেন, ফলে আল্লাহ আপনার জন্য ভাল কাজ করাকে আগের চেয়ে সহজ করে দিয়েছেন।
***- ঈদ মানে আনন্দ, তবে তাদের জন্য যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পেরেছেন, আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভাল মানুষ হতে পেরেছেন। ঈদ মানে লাগামহীন আনন্দ নয়, আল্লাহর নির্দেশের অবাধ্যাচরণ করা নয়, বিনোদনের নামে যা খুশি তা করা নয়। গত এক মাসে আপনি যা অর্জন করেছেন তা কি এই একটি দিনে, আল্লাহর আবাধ্য হয়ে, ধুলিস্মাত করে দিতে চান?
আমরা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চাই, পরকালে উত্তম প্রতিদান পেতে চাই, তবে আসুন আমরা সবাই মিলে আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে যাই, তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী বাকী জীবনটুকু কাটানোর চেষ্টা করি।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাকে এবং এই লেখার সকল পাঠককে কথাগুলো উপলব্ধি করার এবং সেই অনুযায়ী জীবনকে পরিচালিত করার তৌফিক দিন। আমিন।