একজন মুসলিমদের চরম চাওয়া পাওয়া হলো জান্নাত লাভ করা। ইমাম তিরমিযী (র.) বর্ণনা করেছেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি আমার আদর্শকে ভালোবাসে, সে যেন ঠিক আমাকেই ভালোবাসে, আর যে আমাকে ভালোবাসে, সে জান্নাতে আমার সঙ্গে থাকবে। হাদীসটি সনদের দিক থেকে দুর্বল হলেও কিন্তু কুরআনের আয়াত দ্বারা এর সমর্থন পাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন: যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ করো। আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহ মাফ করে দিবেন। (আলে ইমরান: ৩১) উল্লেখিত আয়াতে রাসূলের আনুগত্যকে আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে আলোচনা করা হয়েছে। আর এ কথা সকলে বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ যাকে ক্ষমা করে দিবেন, তার ঠিকানা হবে জান্নাত। আর এই জান্নাত লাভই মুমিনের চরম চাওয়া-পাওয়া।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাসূল (সা.)-কে ‘ভালোবাসা’ এর অর্থ হলো: তাঁর আদর্শ গ্রহণ করা, তা পালন করা, রক্ষা করা। তাঁর প্রদত্ত শরীয়তকে বিলয় হতে না দেওয়া, আর এ জন্য প্রয়োজনে নিজের ধন-সম্পদ ও জীবন উৎসর্গ করা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বমানবতার জন্য আদর্শ। তাঁর ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় জীবন যেমন আমাদের জন্য আদর্শ, তেমনি তাঁর পারিবারিক, সামাজিক, ব্যবসায়িক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সৈনিক, তথা সংগ্রামী জীবনও আমাদের জন্য আদর্শ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে আমরা তাঁর সমগ্র আদর্শকে গ্রহণ না করে নিজেদের সুযোগ সুবিধে প্রয়োজন আর মর্জি মাফিক তাঁর আদর্শকে মেনে চলছি। বাতিলের মোকাবালা বা ঝুঁকি এড়ানোর উদ্দেশ্যে সংগ্রামী ও কঠিক দিকগুলো বাদ দিয়ে সহজ-সরল সুন্নাতের আংশিক অনুসরণ করেও রাসূলের খাঁটি উম্মতের দাবীদার সেজে তাঁর শাফায়াতের আশায় বসে আছি, আর কল্পনার রথে জান্নাতে পাড়ি জমাচ্ছি। কল্পনাবিলাসীদের জন্য আল্লাহর আগাম সতর্কবাণী হচ্ছে; তাদের মধ্যে এমন অনেক আছে, যারা মূর্খ ও নিরক্ষর। তারা মিথ্যে আকাক্সক্ষা ছাড়া আল্লাহর কিতাবের কিছুই জানে না, তারা বাজে কল্পনার মধ্যে ডুবে রয়েছে। (সূরা বাকারা: ৭৮)
আংশিক মানেই তো ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতা যেমনি দুনিয়াবী ব্যাপারে প্রযোজ্য তেমনি প্রযোজ্য আখেরাতের ব্যাপারে, ইসলামের ব্যাপারেও। জাগতিক নিয়মে এসএসসি থেকে মাষ্টার্স আর দাখিল থেকে কামিল পরীক্ষায় ১০ বিষয়ে মধ্যে ২/১ বিষয়ে ফেল করে অন্যান্য বিষয়ে পাস করলে এমনকি ৫০০/৭০০ মার্ক পেলেও পাসের সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না। তেমনিভাবে ইসলামের কিছু আদেশ মেনে রাসূল (সা.)কে কিছু অনুসরণ করে আর কিছুকে অমান্য-অস্বীকার অথবা শৈথিল্য প্রদর্শন করে কি জান্নাতে যাওয়া যাবে? পুণ্যের অধিকারী হয়েও কি জাহান্নামে যেতে হবে না? কারণ আল্লাহর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা হচ্ছে: তবে কি তোমরা কিতাবে কিয়দংশ বিশ্বাস করো আর কিছু অবিশ্বাস বরো- অমান্য করো? যারা এরূপ করবে, পার্থিব জীবনে দুর্গতি ছাড়া তাদের আর কোন পথ নেই। আর কিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠিন শাস্তির দিকে পৌঁছে দেওয়া হবে। আল্লাহ তোমাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে বেখবর নন। (সূরা বাকারা: ৮৫)
আমরা আল্লাহর বান্দা এবং রাসূলের উম্মতের দাবীদার হলেও আমাদের মধ্যে স্ববিরোধিতা চরমভাবে লক্ষণীয়। ‘আমি আল্লাহর সমস্ত বিধি-বিধান মেনে নিলাম, এই মর্মে ঘোষণা করেও বিধি-বিধান মানা তো দূরের কথা, আল্লাহর অনেক বিধি-বিধানের বিরোধিতা করে যে প্রকারান্তে আল্লাহদ্রোহীতা ও ধর্মদ্রোহীতাতে নিজেদেরকে শামিল করছি, তা ভাবার ফুরসৎ-ই বা আমাদের কোথায়? ধর্মীয় ঝঞ্ঝাল না হয়ে এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের। সকল কল্যাণের মূলে রয়েছে ধর্মীয় জ্ঞান। জ্ঞানীদের শ্রেষ্ঠত্বে আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে; যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে? (সূরা:?) হাদীসে বর্ণিত হয়েছে; আল্লাহ যাকে কল্যাণ দিতে ইচ্ছে করেন, তাকে দ্বীনের পূর্ণ জ্ঞান ও সমঝ দান করেন। (বুখারী) অন্যভাবে বলা যায়: আল্লাহ প্রদত্ত কল্যাণ লাভ করতে হলে ধর্মীয় জ্ঞানার্জনে ব্রতী হতে হবে। ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ বড়ই সৌভাগ্যের ব্যাপার। এ সৌভাগ্য অর্জন মানুষের পরিশ্রম, চেষ্টা-সাধনা সাপেক্ষ। মানুষ যজ্জন্য পরিশ্রম করে না, সে তা পায় না। (সূরা নাজম : ৩৯) এটা হলো আল্লাহর বিধান।
আমাদের মুক্তির জন্য রাসূল (সা.)-এর উপদেশ হচ্ছে; দুনিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন দুনিয়ার কাজ তুমি ততটুকু করবে। আর আখেরাতের কাজ ততটুকু করবে, যে পরিমাণ সময় তুমি আখেরাতে থাকবে। আল্লাহর জন্য এতটুকু কাজ করো যতটুকু তুমি আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আর দোযখের কাজ এ পরিমাণ করো, যে পরিমাণ তুমি দোযখের শাস্তি সহ্য করতে পারবে। একজন মুমিনের জন্য এর ভারসাম্য যুক্তি ও ইনসাফপূর্ণ কর্ম-নির্দেশনা পাথেয় আর কি হতে পারে?
আমরা অনেকেই বিচিত্র ধরণের রাসূল প্রেমিক। সময় সুযোগ আর নিজেদের প্রয়োজনে রাসূল (সা.)-কে অনুসরণ করি। রাসূলকে অনুসরণ করা প্রয়োজন বলে বক্তৃতা-বিবৃতি দেই। আবার সুবিধের হেরফের হলে রাসূলের আদর্শের বিরোধিতা করতেও পিছবা হই না! যার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ, যদিও ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর লোভ-লালসায় আর ক্ষমতায় তা এখন আমাদের বুঝে আসে না। কুরআন ও হাদীসের বর্ণনায় এটুকু স্পষ্ট যে, রাসূল (সা.)-কে বাস্তবে অনুসরণ না করলে তাকে অমান্য ও অস্বীকার করা হয়। আর অমান্যকারীদের পক্ষে চিরস্থায়ী জান্নাতবাসী হওয়া সম্ভব নয়। কাজেই আসুন, আল্লাহ বর্ণিত সুযোগের সদ্ব্যবহার কল্পে তথা আল্লাহর সুন্তুষ্টি ও পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে আমরা আল্লাহর আদেশ নিষেধ এবং রাসূলের উসওয়াতুন হাসানার সর্বোত্তম আদর্শের তথা সমগ্র সুন্নাতের অনুসরণ অনুকরণে যচেষ্ট হই। জীবন জীবিকার তাগিদে যেখানেই থাকি, যা-ই করি আর যা-ই হই না কেন, ধর্মীয় জ্ঞানার্জনে সচেষ্ট থাকি। হালাল খাওয়া নামায-রোযার ন্যায় ফরয বিধায় হালাল উপায়ে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করি, সুদ-ঘুসের সাথে সম্পর্ক না রাখি, শিরক-বিদআত ও কবীরা গোনাহ হতে দূরে থাকি, হক্কুল ইবাদ সম্পর্কে সচেষ্ট থাকি। গান-বাজনা অশ্লীল নাটক-সিনেমা দেখা হতে বিরত থাকি। আদালতে আখেরাতে যেন আমার আপনার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দায়ের করতে না পারে, তজ্জন্য আল্লাহর বিধি-বিধান রাসূলের তরিকায় সম্পন্ন করার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন