وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا ﴿64﴾ وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَامًا ﴿65﴾ إِنَّهَا سَاءَتْ مُسْتَقَرًّا وَمُقَامًا
‘এবং যারা রাত কাটায় তাদের রবের উদ্দেশ্যে সেজদাবনত হয়েও দাঁড়িয়ে এবং যারা বলে,হে আমাদের রব-পালনকর্তা! আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তিকে সরিয়ে দাও। নিশ্চয় এর শাস্তি নিরবচ্ছিন্ন। বসবাস ও আবাসস্থল হিসেবে এটি কতইনা নিকৃষ্ট!’
এ আয়াতগুলোর বক্তব্যের সাথে পূর্ববর্তী আয়াতের বক্তব্যের সম্পর্ক বিষয়ে শহীদ সাইয়্যেদ কুতুব রহ. বলেন-
هذا نهارهم مع الناس، فأما ليلهم فهو التقوى، ومراقبة الله، والشعور بجلاله، والخوف من عذابه.
এতো তাদের (আল্লাহর বান্দাদের) দিনের বেলায় মানুষের সাথে সম্পর্ক। আর তাদের রাতের বেলা- তা তো কাটে আল্লাহভীতি, আল্লাহ (তারেদ সবকিছু) পর্যবেক্ষণ করছেন- এ অনুভূতি, আল্লাহর মহত্ত্বের অনুভূতি ও তার শাস্তি থেকে ভয়- ভীতির মাধ্যমে। (ফী যিলালিল কুরআন, খ: ৫, পৃ: ২৫৭৮)
এ আয়াতগুলোতে রাহমান- এর বান্দাদের দু’টি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা হয়েছে। একটি হলো তারা সেজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাত কাটায়। আরেকটি হলো তারা জাহান্নামের শাস্তি থেকে আল্লাহর কাছে পরিত্রাণ চায়।
‘এবং যারা রাত কাটায় তারেদ ‘রব’ (প্রভুর) উদ্দেশ্যে সেজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে।’ তাদের দিনের বেলা কাটে আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে। বিনয়ের মাধ্যমে তারা রাতও কাটায় আল্লাহর অনুগত হয়ে। সিজদার মাধ্যমে। আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে থেকে। সিজদা ও দাঁড়ানো বলতে নামায বুঝানো হয়েছে।
সরাসরি নামায না বলে সিজদা ও দাঁড়ানো বলা হল কেন? এ প্রসঙ্গে শহীদ সাইয়্যেদ কুতুব রহ. বলেন :
সালাত (নামায)- এর পরিবর্তে সিজদা ও দাঁড়ানো বলা হয়েছে। রাতের গভীরে মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন রাহমান- এর বান্দাদের নড়াচড়াকে চিত্রায়িত করার জন্য। এরা এমন লোক যারা তাদের প্রভুর উদ্দেশ্যে সিজদা করে ও দাঁড়িয়ে রাত কাটায়। তাদের লক্ষ্য একমাত্র তাদের রব। শুধু তাঁর উদ্দেশ্যেই তারা দাঁড়ায়। শুধু তার জন্যই তারা সিজদাবনত হয়। তারা এমন লোক যারা সুখের নিদ্রা বাদ দিয়ে তারচেয়েও বেশি সুখ ও মজার বিষয় নিয়ে ব্যস্ত।
তারা তাদের প্রভুর প্রতি একনিষ্ঠ হওয়াতে ব্যস্ত। তারা তাদের আত্মা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসহ আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হতে ব্যস্ত। মানুষ ঘুমায় অথচ তারা দন্ডায়মান ও সিজদাবনত। মানুষ ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থান করছে অথচ তাদের দৃষ্টি মহিমান্বিত করুণাময়ের আরশের দিকে। (ফী যিলালিল কুরআন, খ: ৫, পৃ: ২৫৭৮)
বান্দা নানামুখী কর্মব্যস্ততার মধ্যদিয়ে দিনের সময় কাটাবে। রাতের নিস্তব্ধতায় তার মহান প্রভুর সামনে একাগ্রচিত্তে দাঁড়াবে। তাঁর সামনে মাথা নত করবে। তাঁকে সিজদা করবে। এটি আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় এ বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা হয়েছে :
تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ ﴿16﴾
‘তাদের পার্শ্বদেহ বিছানা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের প্রভুকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।’ (১৬ : সিজদা)
أَمْ مَنْ هُوَ قَانِتٌ آَنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآَخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ (سورة الزمر : 9)
‘যে ব্যক্তি রাতের বেলা সিজদার মাধ্যমে অথবা দাঁড়িয়ে ইবাদত করে, পরকালকে ভয় করে এবং তার রবের রহমত প্রত্যাশা করে (সে কি তার সমান যে এরূপ করে না)।’ (৯: যুমার)
كَانُوا قَلِيلًا مِنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ ﴿17﴾ وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ ﴿18﴾
‘তারা তাদের সামান্য অংশই নিদ্রা যেত। রাতের শেষ প্রহরে তারা (আল্লাহর কাছে) ক্ষমা প্রার্থনা করত।’ (১৭-১৮ : যারিয়াত)
রাতের বেলা ঘুম থেকে উঠে নামায পড়া, গুনাহ থেকে ইস্তিগফার করা (ক্ষমা চাওয়া), কান্নাকাটি করা আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন :
وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَكَ عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا ﴿79﴾
‘রাতের কিছু অংশ কুরআন পাঠসহ জাগ্রত থাক। এটি তোমার জন্য অতিরিক্ত। তোমার রব-প্রভু তোমাকে উত্তম মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করবেন।’ (৯৭ : বনী ইসরাঈল)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত রাত্রে জাগতেন ও নামায আদায় করতেন। এ প্রসঙ্গে আয়শা রা. বলেছেন كان النبي [ يقوم من الليل حتى تتفطر قدماه، فقلت له لم تصنع هذا يا رسول الله؟ وقد غفرلك ما تقدم من ذنبك وما تأخر، قال: أفلا أكون عبدا شكورا. (متفق عليه)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের বেলায় নামাযে (এত দীর্ঘ সময়) দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তার পা দু`টো যেন ফেটে যেত। আমি তাকে বললাম,হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এমনটি করছেন কেন? অথচ আপনার পূর্ব ও পরের সব গুনাহ মাফ হয়ে গিয়েছে। তিনি বললেন,`আমি কি (আল্লাহর) কৃতজ্ঞ বান্দাহ হব না?’ (বুখারী ও মুসলিম)
রাতের নামাযের ফজীলত ও মর্যাদা সম্পর্কে অনেক হাদীস আছে। এখানে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হলো :
عن أبى هريرة قال : قال رسول الله: أفضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم، وأفضل الصلاة بعد الفريضة صلاة الليل. (رواه مسلم)
আবু হোরাইরা রা. থেকে বর্ণিত,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘রমযানের পর সর্বোত্তম রোযা আল্লাহর মাস মহররমে রোযা ও ফরজ নামাযের পর সর্বোত্তম নামায রাতের নামায।’ (মুসলিম)
عن عبد الله بن سلام ] أن النبي [ قال : أَفْشُوا السَّلامَ ، وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ، وَصِلُوا الأَرْحَامَ ، وَصَلُّوا بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ ، تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ بِسَلامٍ. (رواه الترمذي)
আবদুল্লাহ ইবন সালাম থেকে বর্ণিত যে,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘হে লোকসকল! তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও,খাবার খাওয়াও,আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা কর এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়। (এগুলো করে) তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ কর।’ (তিরমিযী)
عن أبى هريرة قال: قال رسول الله : رَحِمَ اللَّهُ رَجُلاً قَامَ مِنَ اللَّيْلِ فَصَلَّى ثُمَّ أَيْقَظَ امْرَأَتَهُ فَصَلَّتْ فَإِنْ أَبَتْ نَضَحَ فِي وَجْهِهَا الْمَاءَ وَرَحِمَ اللَّهُ امْرَأَةً قَامَتْ مِنَ اللَّيْلِ فَصَلَّتْ ثُمَّ أَيْقَظَتْ زَوْجَهَا فَصَلَّى فَإِنْ أَبَى نَضَحَتْ فِي وَجْهِهِ الْمَاءَ (روا أبوداود)
আবু হোরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘আল্লাহ করুণা করুন ঐ ব্যক্তির উপর, যে রাতে উঠে নামায পড়ে এবং তার স্ত্রীকে জাগিয়ে দেয়। স্ত্রী যদি উঠতে না চায় তাহলে তার মুখমণ্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়। আল্লাহ করুণা করুন ঐ নারীর প্রতি, যে রাতে উঠে নামায পড়ে এবং তার স্বামীকে জাগিয়ে দেয়। স্বামী যদি উঠেতে না চায় তাহলে তার মুখমণ্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়।’ (আবু দাউদ)
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ ابن مسعود ] قال ذُكِرَ رَجُلٌ عِنْدَ النَّبِيِّ [ نَامَ لَيْلَةً حَتَّى أَصْبَحَ ، قَالَ : ” ذَاكَ رَجُلٌ بَالَ الشَّيْطَانُ فِي أُذُنِهِ (متفق عليه)
ইবন মাসউদ থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এমন একজন লোকের আলোচনা করা হল যে,ব্যক্তি সকাল পর্যন্ত ঘুমায়। তিনি বললেন,‘এ লোকটি তো এমন লোক, শয়তান যার কানে প্রস্রাব করেছে। (বুখারী ও মুসলিম)
আল্লাহর প্রিয় বান্দারা পুরো রাত ঘুমিয়ে কাটায় না। তারা ঘুমায়, ঘুম থেকে উঠে আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে যায়। নামায পড়ে। বিনয়ী হয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে। রাতে যে কোন সময় নামায পড়া যায়। তবে সর্বোত্তম সময় হচ্ছে রাতের শেষ তৃতীয় প্রহর। এ অংশটি খুবই মর্যাদার। রাতের এ অংশ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
إِنَّ فِىْ اللَّيْلِ لسَاعَةً لا يُوَافِقُهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ وَهُوَ قَائِمٌ يُصَلِّي يَسْأَلُ اللَّهَ تَعَالَى شَيْئًا إِلا أَعْطَاهُ إِيَّاهُ . (رواه مسلم)
‘রাতে এমন একটি সময় আছে যে সময়টিতে কোন মুসলমান ব্যক্তি আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখিরাতের কোন কল্যাণ চাইলে আল্লাহ তাকে সেটি প্রদান করেন।’ (মুসলিম)
আর এ পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ সময়টি হচ্ছে শেষ তৃতীয় প্রহর:
عن أبي هريرة أن رسول الله [ قال: يَنْزِلُ رَبّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَىَ كُلّ لَيْلَةٍ إِلَىَ السّمَاءِ الدّنْيَا حِينَ يَبْقَىَ ثُلُثُ اللّيْلِ الاَخِرُ، فَيَقُولُ: مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ وَمَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ وَمَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرُ لَهُ” (رواه البخاري)
হযতর আবু হোরাইরা রা. থেকে বর্নিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : আমাদের মহান প্রভু প্রতিরাতে নিচের আকাশে অবতরণ করেন, যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ বাকী থাকে। তিনি বলেন, কে আছ আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। কে আছ আমার কাছে চাও, আমি তাকে (যা চায় তাই) দেব। কে আছ আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি তাকে ক্ষমা করব।’ (বুখারী)
যে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে চায়,সে এমন মর্যাদাপূর্ণ সময়ে ঘুমিয়ে থাকতে পারে না। বিশ্ব জাহানের মালিক ও প্রভু যখন পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন তার বান্দাদের ডেকে ডেকে তাঁর কাছে চাইতে বলেন, তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলেন আর তিনি তাদের আশ্বস্ত করেন যে, তিনি বান্দার ডাকে সাড়া দেবেন, যা চায় তাই দেবেন, ক্ষমা করে দেবেন, তখন তাঁর কোন বান্দা কি ঘুমিয়ে থাকতে পারে?
রাহমান- এর বান্দারা এ সময়ে উঠবে। তাদের প্রভুর উদ্দেশ্যে দাঁড়াবে। সেজদাবনত হবে। তাঁকে ডাকবে। তিনি তাদের ডাকে সাড়া দেবেন। তাঁর কাছে দুনিয়া-আখিরাতের সকল ধরনের কল্যাণ চাইবে,তিনি তাদেরকে তা দেবেন। সকল ধরণের গুনাহ, ভুল-ত্রুটি থেকে ক্ষমা চাইবে। তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। রাহমান- এর বান্দা হঠাৎ করে কোন এক রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নয় বরং প্রতিরাতেই জাগবে। কেননা তার প্রভু তো প্রতিরাতেই নিচের আকাশে অবতরণ করেন আর ডাকেন কে আছো আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। কে আছো আমার কাছে চাও, আমি দেব। কে আছো আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি ক্ষমা করে দেব।
রাহমান-এর বান্দারা রাতে উঠে তাদের প্রভুর সামনে দাঁড়ায়। তাঁকে সিজদা করে। শুধু তাই নয়,তারা বলে,‘হে আমাদের রব-পালনকর্তা। আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তিকে সরিয়ে দাও।’
মুমিন আল্লাহর কাছে যতটা জান্নাত পেতে চায় তার চেয়ে অনেক বেশি চায় জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচতে। কুরআন মজীদে মুমিনকে জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য দোয়ার ভাষা সেখানো হয়েছে,কোথাও জান্নাত (বেহেশত) চাওয়ার