ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভে ফরজ ইবাদত হলো সিয়াম পালন করা। মহান আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসে সিয়াম পালনকে আমাদের উপর ফরজ করে দিয়েছেন এই জন্য যে,এই মাসে অবতীর্ণ হয়েছে পবিত্র আল-কুরআন যা বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়াত এবং নিদর্শন ও সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী বিধান হিসাবে।
প্রথমত সিয়াম সাধনায় আল্লাহর নির্দেশ পালন করা হয়। দ্বিতীয়,রোজা দ্বারা সংযমী হওয়া যায়। তৃতীয়,রোজা দ্বারা অতীতের গুনাহসমূহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। মুলত আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনের সর্বোত্তম পন্থা হলো সিয়াম সাধনা। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। সূরা বাকারা : ১৮৩
এই আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, সিয়াম সাধনার দ্বারা তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জিত হয়।
এই পবিত্র মাসকে পূর্ণভাবে আল্লাহর রহমত, বরকত ও নাজাত প্রাপ্তির জন্য আমাদের কিছু করণীয় আছে এবং সেই সাথে কিছু বর্জনীয় কার্যাবলী রয়েছে যা পরিত্যাগ করার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারবো। শুধুমাত্র পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে দিনের বেলায় বিরত থাকাই সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে রমজান মাসে সার্বক্ষণিক নিজের কু-প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে প্রকৃত তাকওয়া অর্জন করা সম্ভব। আমাদের ভুলে গেলে হবে না যে,সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়টুকু রোজার অন্তুর্ভূক্ত নয়;বরং দিন ও রাত্রি উভয় সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে সিয়াম সাধনার প্রকৃত আত্মতৃপ্তি লাভ করা সম্ভব।
সিয়াম সাধানার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি হালাল খাদ্য ও পানীয়কে আল্লাহর নির্দেশের কারণে বর্জন করে নিজ কু প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে। সুতরাং নিজ কু-প্রবৃত্তিকে দমন ও আত্মশুদ্ধির জন্যে যে আমল গুলি করতে হবে তা ধারাবাহিক বর্ণনা করা হলো –
১ – আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রহমত লাভের উদ্দেশ্যে সিয়াম সাধনা করা:
عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال إذا جاء رمضان فتحت أبواب الجنة وغلقت أبواب الناروسلسلت الشياطين (بخارى ومسلم)
হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন,আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন,যখন রমজান মাস আসে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। অপর বর্ণনায় রয়েছে বেহেশতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়,দোযখের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয় এবং শয়তানকে শৃংখলিত করা হয়।অপর বর্ণনায় আছে,রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়।)বুখারীও মুসলিম(
রমজান মাসে যেহেতু বেহেশতের ও রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় সেহেতু রোজা রেখে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর রহমতের আশা করব।
২- মুখ ও জিহ্বাকে সংযত রাখা
পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি নিজের মুখ ও জিহ্বাকে সংযত রাখতে হবে। মিথ্যা, অশ্লীল কথাবাতা, গালিগালাজ, গীবত, পরনিন্দা, অভিশাপ দেয়া ও চোগলখোরীসহ অন্যান্য অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। হাদিসে এসেছে-আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেছেন,যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কর্ম পরিত্যাগ করেনি,তার পানাহার ছেড়ে দেয়াতে আল্লাহর কোন কাজ নেয়।(মিশকাত : ১০৮৯,বুখারী
৩- নিয়মিত তারাবীহর নামাজ আদায় করা
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তারাবীহ পড়তে হবে। কেননা,যে ব্যক্তি রমজানে তারাবীহ নামাজ পড়বে তার অতীতের সগীরা গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। হাদিসে এসেছে-
কিন্তু তিনি এ বিষয়ে খুব তাকীদ করতেন না। বরং এরূপ বলতেন,যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে নামায কায়েম করবে তার পূর্ববর্তী (সগীরা) গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হবে। (মুসলিম)
৪- কুরআন তিলাওয়াত করা :
নফল ইবাদতের মধ্যে সর্বোত্তম ইবাদত হলো কুরআন তিলাওয়াত করা। যেমন হযরত নুমান বিন বাশির রা. হতে বর্ণিত নবী করীম সা. ইরশাদ করেনআমার উম্মতের সবচেয়ে উত্তম ইবাদত কুরআন তিলাওয়াত করা। (বায়হাকী,শুআবুল ঈমান :হা. ১৮৬৯),অন্য হাদিসে এসেছে,যে ব্যক্তি রমজান মাসে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি নফল কাজ করবে সে ঐ ব্যক্তির সমান হলো যে,অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করল। (মিশকাত :১৮৬৮) সুতরাং রমজান মাসে কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে আমরা অধিকতর সওয়াবের অধিকারী হবো।
৫- বেশি করে দান-সদকাহ করা– মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-
مَّثَلُ الَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنبُلَةٍ مِّئَةُ حَبَّةٍ وَاللّهُ يُضَاعِفُ لِمَن يَشَاء وَاللّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ (سورة البقرة 261)
যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে,তাদের উদাহরণ একটি বীজের মতো,যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আর আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা করেন (সওয়াবে) কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ অতি প্রাচুর্যময় (এবং) সর্বজ্ঞ। )সূরা বাকারাহ : ২৬১(
৬- নিজে ইফতার করার পাশাপাশি রোজাদারদের ইফতার করানো-
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত যায়েদ বিন খালেদ জুহানী রা. হতে বর্ণিত,রাসূল সা. বলেছেন,যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করালো তাকে রোজাদারের অনুরূপ সওয়াব দান করা হবে। কিন্তু রোজাদারের সওয়াবের কোন কমতি হবে না। (তিরমিযী : ৮০৭)
৭- মিসওয়াক করা :
হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, আব্দুল্লাহ বিন রবিআ রা. তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন,তিনি বলেন,আমি নবী করীম সা. কে রোজা অবস্থায় অসংখ্যবার মিসওয়াক করতে দেখেছি। (তিরমিযী: হা.৭২৫)
৮- শীঘ্রই ইফতারী করা
হাদিস শরীফে এসেছে –হযরত সাহল ইবনে সা’দ রা. বলেন,আল্লাহ রাসূল সা. বলেছেন,মানুষ কল্যানের সাথে থাকবে যতকাল তারা শীঘ্রই ইফতার করবে। (বুখারী ও মুসলিম )
অন্য হাদিসে আছে,হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত রাসূল সা. বলেছেন,আল্লাহ তা’আলা বলেন,আমার বান্দাদের মধ্যে আমার কাছে তারাই বেশি প্রিয় যারা শীঘ্রই ইফতারী করে। (তিরমিযী, মিশকাত : ১৮৯৬)
৯- ইফতারের পূর্বে ও ইফতারের সময় দোয়া করা
হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. যখন ইফতার করতেন নিম্নের দোয়াটি পড়তেন :
عَنْ أَنَسٍ ، قَالَ : كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ ” إِذَا أَفْطَرَ , يَقُولُ : اللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ ، وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ ، فَتَقَبَّلْ مِنِّي إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
হে আল্লাহ! আমি তোমার জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমার রিজিক দিয়ে ইফতার করছি। তুমি আমার এই রোজাকে কবুল কর। নিশ্চয় তুমি সর্বজ্ঞ,সর্বশ্রোতা। তাবারানী : ৮৪৫
১০- বেশি করে ইসতেগফার ও দোয়া করা
এই রমজান মাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত্রি হলো লাইলাতুল কদর। হাদিস মোতাবেক রমজানের শেষের দশদিন বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করার কথা বলা হয়েছে। এই জন্য যে মহান আল্লাহ দেখতে চান লাইলাতুল কদরের বরকত ও ফজিলত লাভের উদ্দেশ্যে তার কোন বান্দা বেশি ইবাদত করে।
রাসূল সা. এই শেষ দশকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন তা নিম্নোক্ত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন আমি রাসূল সা. কে লাইলাতুল কদরের কথা জিজ্ঞাসা করলাম, আজ কি দোয়া পাঠ করব? তিনি বললেন নিম্নের দোয়াটি পাঠ করবে : اللهم انك عفو تحب عفو فا عف عنى
হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই তুমি ক্ষমাশীল। তুমি ক্ষমাশীলতাকে ভালবাস। অতএব আমাকে ক্ষমা করো। (তিরমিযী : হা. ৩৫১৩, মুসনাদে আহমদ : ১/১৭১
১১- খেজুর অথবা পানি দিয়ে ইফতার করা
হযরত সালমান আমের রা. বলেন,রাসূল সা. বলেছেন,যখন তোমাদের কেউ ইফতার করে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে,কেননা এতে বরকত রয়েছে। যদি খেজুর না পায়,তবে যেন পানি দ্বারা ইফতার করে,এটি পবিত্রকারী।(আহমদ,তিরমিযী,আবু দাউদ,ইবনে মাজাহ,দারেমী)
১২- সেহরী খেয়ে রোজা রাখা
সেহেরী খাওয়া সুন্নত। সেহেরী খেয়ে রোজা রাখার মধ্যে বরকত নিহিত রয়েছে। হাদিস শরীফে এসেছে-
আনাস বিন মালেক রা. হতে বর্ণিত,রাসূল সা. বলেছেন- তোমরা সেহেরী খাবে। কেননা সেহরীতে বরকত রয়েছে।(বুখারী, মুসলিম)
১৩ – মসজিদে এতেকাফ করা
রমজানের শেষের দশদিনে এতেকাফ করা সুন্নত। পুরুষরা মসজিদে এবং স্ত্রীলোকেরা আপন ঘরে একটি স্থান ঘিরে নিয়ে তথায় এতেকাফ করবে। হাদিসে এসেছে-
হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত যে,নবী করীম সা. রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন,যাবৎ না আল্লাহ তাকে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং তাঁর পর তাঁর স্ত্রীগণও এতেকাফ করেছেন। (বুখারী ও মুসলিম)
১৪- বেশি বেশি করে নফল নামাজ আদায় করা
হাদিস মোতাবেক রমজান মাসে একটি নফল ইবাদত করলে একটি ফরজ ইবাদতের সমান মর্যাদা পাওয়া যায়। হাদিসে এসেছে,হযরত আলী রা. বলেন,আমাকে হযরত আবু বকর রা. বলেছেন আর তিনি সত্য বলেছেন তিনি বলেছেন আমি রাসূল সা.কে বলতে শুনেছি যে,কোন ব্যক্তি গুনাহ করবে অতঃপর ওঠে আবশ্যকীয় পবিত্রতা লাভ করবে এবং নফল নামাজ পড়বে; তৎপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। নিশ্চয় আল্লাহ তার গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। (তিরমিযী,ইবনে মাজাহ)
১৫- বেশি করে আল্লাহর জিকির ও তাসবীহ-তাহলীল করা
রমজান মাসে বেশি করে তাসবীহ পাঠ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্ঠা করতে হবে। মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন ,
وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُواْ فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُواْ أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُواْ اللّهَ فَاسْتَغْفَرُواْ لِذُنُوبِهِمْ وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ اللّهُ وَلَمْ يُصِرُّواْ عَلَى مَا فَعَلُواْ وَهُمْ يَعْلَمُونَ.
আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করে অথবা নিজেদের প্রতি যুলুম করে আল্লাহকে স্মরণ করে,অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে ?আর তারা যা করেছে,জেনে শুনে তা তারা বার বার করে না। (সূরা আল-ইমরান : ১৩৫)
১৬- রমজান মাসে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করা
রমজান মাসের শেষের দশদিনের বেজোড় রাত্রিতে লাইলাতুল কদরের জন্য বেশি করে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে এবং সারা বিশ্ববাসীর শান্তি, ক্ষমা ও স্থিতিশীলতার জন্য দোয়া করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,
لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ – লাইলাতুল কদর এক হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। (সূরা কদর : ৩)
১৭-রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করা :
রমজান মাসে এমন কিছু করা যাবে না যা শরীয়তপরিপন্থী। যেমন রোজাদারহীন ব্যক্তি রোজাদারদের সামনে পানাহার করা। সেই সাথে অশ্লীল ও অনৈতিক কার্যাবলী থেকে বিরত থাকতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন-
وَلاَ تَقْرَبُواْ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ
আর অশ্লীল কাজের নিকটবর্তী হবে নাতা থেকে যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে।( সূরা আন-আম : ১৫১)
পরিশেষে বলতে চাই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত ও সৎকর্মের মাধ্যমে এই রমজানের ফজিলত আমরা পূর্ণভাবে অর্জন করতে পারি। মহান আল্লাহ এই রমজান মাসে আমাদের উপর রহমত,রবকত ও মাগফেরাত প্রদান করুন এবং আমাদের জাহান্নাম থেকে নাজাত প্রদান করুন। আমিন।