কুরআন শব্দের অর্থ: পাঠ করা, যা পাঠ করা হয়। আর পরিভাষায়-আল্লাহ তা‘আলা জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে মানব জাতির হেদায়াত হিসাবে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তার নাম আল কুরআন।
আল-কুরআন কি?
এ প্রশ্নের জবাব স্বয়ং কুরআনই দিয়েছে। কুরআনের ভাষায়– إِنَّهُ لَقُرْآنٌ كَرِيمٌ فِي كِتَابٍ مَّكْنُونٍ
‘নিঃসন্দেহ এটি তো এক সম্মানিত কুরআন,এক সুরক্ষিত গ্রন্থে। [সূরা ওয়াকিয়া : ৭৭-৭৮]
অন্যত্র বলা হয়েছে: وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيزٌ ‘নিশ্চয়ই এটি এক অপরাজেয় কিতাব।’ [সূরা হামীম আস-সাজদা : ৪১]
قَدْ جَاءَكُم مِّنَ اللَّـهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে এক আলোকবর্তিকা এবং এক উন্মুক্ত কিতাব।’ [সূরা মায়িদা : ১৫]
অন্যত্র বলা হয়েছে: تِلْكَ آيَاتُ الْكِتَابِ الْحَكِيمِ‘এগুলো বিজ্ঞানময় কিতাবের আয়াত।’[সূরা লুকমান : ২]
কুরআন শিক্ষা করা সহজ
যদিও এর ভাষা আরবী কিন্তু যারা কুরআন শিখতে চায় তাদের জন্য কুরআনকে আল্লাহ সহজ করে নাযিল করেছেন।
পবিত্র কুরআন শুধু তেলাওয়াত করে খতম করার জন্য অবতীর্ণ হয়নি। বরং আল্লাহ এই কুরআন অবতীর্ণ করেছেন, যেন তা নিয়ে গবেষণা করে বাস্তবে আমল করা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
قال سبحانه: كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ ﴿٢٩﴾
এটি একটি বরকতময় কিতাব,যা আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসূহ লক্ষ্য করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন তা অনুধাবন করে। (সূরা সাদ: ২৯)
এই আয়াত হতে আমরা নিম্নের বিষয়গুলো জানতে পারলাম:
১। এটি আল্লাহর কিতাব যা তিনি অবতীর্ণ করেছেন।
২। এটি বরকতপূর্ণ কিতাব, আর বরকত তখনই অর্জন হবে যখন তদানুযায়ী আমল করা হবে।
৩। বরকত বলা হয় সেই অতিরিক্ত বস্তুকে যা আমরা চোখে দেখি না, কিন্তু অনুভব করতে পারি।
৪। বরকতের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে,“কল্যাণ ও সৌভাগ্য বৃদ্ধি।”কুরআন মজীদকে বরকত সম্পন্ন কিতাব বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, এটি মানুষের জন্য একটি অত্যন্ত উপকারী কিতাব। এ কিতাবটি তার জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য সর্বোত্তম বিধান দান করে। এর বিধান মেনে চলায় মানুষের লাভই হয় কেবল, কোনো প্রকার ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
আয়াতের দ্বিতীয় শেষ অংশ: لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ
অর্থাৎ: যাতে মানুষ এর আয়াতসূহ লক্ষ্য করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন তা অনুধাবন করে।
কুরআন দুটি উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ করা হয়েছে
১। চিন্তা ও গবেষণা করা
২। উপদেশ গ্রহণ করা
সম্মানিত হাজেরীন! চিন্তা ও গবেষণার অর্থ হলো:
- আমরা বার বার তেলাওয়াত করবো, যেভাবে বিজ্ঞান শাস্ত্র, গণিত শাস্ত্র পড়ে থাকি, খবরের কাগজের মত না।
- গবেষণার পূর্বে কিতাবের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে, যে এটি বিজ্ঞানপূর্ণ কিতাব, আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা হয়েছে।
- গবেষণা করলে কুরআন নাযিলের মর্ম অনুধাবন হয়।
উপদেশ গ্রহণ করার অর্থ
১।কুরআনে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।
২।বিধানাবলীকে জীবন পরিচালনার পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করা।
গবেষণার পূর্বে কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্ক বোঝা দরকার।এখানে ৪টি বিষয় লক্ষণীয়
- কুরআন আমাদেরকে সরাসরি বলছে,
- কুরআন আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বলছে,
- কুরআন মীমাংসা করার কথা বলে,
- কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্কটা বুঝতে হবে।
সরাসরি বলতে বুঝায়
যখনই আমরা কুরআন তেলাওয়াত কিংবা শ্রবণ করি, আমরা বলে থাকি এটি আল্লাহর কিতাব। এর অর্থ হলো, যে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সরাসরি সম্বোধন করছেন। যখন আমরা এ কথা বুঝলাম যে, আল্লাহ আমাদেরকেই বলছেন। আমাদের এটাও মনে রাখা দরকার যে, আল্লাহ দেখছেন, তার বান্দা কুরআন শুনে কি করে? অর্থাৎ কুরআন শোনে আমল করে কি না?
- ব্যক্তিগতগত বলতে বুঝায়
আমরা যে আয়াত তেলাওয়াত করি কিংবা শ্রবণ করি, তখন এই অনুভূতি নিয়ে তেলাওয়াত করা বা শোনা দরকার যে, এই আয়াতটি আমার জন্য। এমন না যে, এই আয়াত কাফেরদের জন্য, অমুক আয়াত মুনাফিকদের জন্য, অমুক আয়াত মদীনাবাসীর জন্য, আর অমুক আয়াত মক্কাবাসীর জন্য। বরং এভাবে গবেষণা করতে হবে যে, এই আয়াতে আমার জন্য কি শিক্ষা রয়েছে, আমি এখান থেকে কিভাবে হেদায়াত পেতে পারি।
- মীমাংসিত বলতে বুঝায়
প্রতিটি খাদ্যে বা দানায়, খাদকের নাম লেখা রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি যে, সবকিছুই ভাগ্যলিপিতে লিখা রয়েছে। তাহলে বলতে পারি, যে প্রতি আয়াতে তেলাওয়াতকারী ও শ্রবণকারীর নাম লিখা রয়েছে।
- সম্পর্ক বলতে বুঝায়
কুরআন আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যখনই কুরআন পড়া হয় বা শ্রবণ করা হয়, তখনই আমাদেরকে কোন না কোন দিক দির্দেশনা দিয়ে থাকে। কেননা আল্লাহর উপদেশ অনর্থক হতে পারে না। আমাদের চিন্তা ভাবনা করা দরকার যে, হে আল্লাহ আজ আমাকে এই আয়াত কেন শোনালেন?
গবেষণার জন্য ৪টি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত
১। মনোযোগ
২। বুঝা
৩। চিন্তা-ভাবনা
৪। অনুভূতি-বোধ
মনোযোগ: চোখ, কান, শরীর, মন, মগজ সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কুরআন বুঝার জন্য মনোযোগী করতে হবে।
পুরো আয়াত যদিও বুঝে না আসে, তবুও মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে, যতটুকু বুঝে আসে তা আমল করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে।
বুঝা: কুরআন বুঝে না আসলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গীকার করতে হবে, আজ থেকে কুরআন বুঝে পড়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখবো।
চিন্তা-ভাবনা: যখনই কোন নিদর্শনের আলোচনা বা ঐতিহাসিক বিষয় আসে, সেখানে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।
অনুভূতি-বোধ: যেখানে পুরস্কারের আলোচনা হয়, সেখানে ভালোভাবে অনুভূতিসহ পড়বে, জান্নাতের আলোচনার স্থানে আগ্রহ বাড়িয়ে দিবে, আর জাহান্নামের আলোচনা আসলে, ভয় অনুভব করবে।
গবেষণা ও উপদেশ গ্রহণের নিয়ম
দোয়া: কুরআনের প্রতিটি আয়াত আমাদের কাছ থেকে কিছু চায়। সেটি পূর্ণ করার জন্য দোয়া দিয়ে আরম্ভ করা উচিৎ। অর্থাৎ প্রতিটি আয়াত আমলের জন্য নাযিল করা হয়েছে, চাই তা অন্তরের আমল হোক বা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের আমল হোক। সুতরাং প্রতিটি কাজের সূচান দোয়া দিয়ে করতে হবে।
ইহতেসাব: দোয়ার আলোকে বিগত দিনগুলোর আত্মসমালোচনা করা উচিত। শুধু দোয়া যথেষ্ট না। তাই দোয়ার সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টাও করতে হবে। যেমন আপনার ছেলে ১০ শ্রেণীতে পড়ে, কিন্তু পাস করতে পারছে না। এই ক্ষেত্রে ছেলেকে স্কুলে যেতে হবে, নিয়মিত পাঠ করতে হবে, ইত্যাদি।
পরিকল্পনা: আগামী দিন আপনি কি করবেন সেই বিষয়ে পরিকল্পনা করা দরকার। যদি সফলতার প্লান না করেন, তাহলে ব্যর্থতার প্লান করা হবে। যেমন আপনি খানা খাওয়ার প্লান না করলে, না খেয়ে থাকার প্লান করা হলো।
তাবলীগ: রাসূল (সা.) বলেছেন: بلغوا عني و لو آية একটি আয়াত জানা থাকলে তা পৌঁছে দাও।
গবেষণার উপর কয়েকটি আয়াত
أَفَلا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا [محمد:24]
তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ ۚ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِندِ غَيْرِ اللهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا ﴿٨٢﴾
এরা কি লক্ষ্য করে না কোরআনের প্রতি? পক্ষান্তরে এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অপর কারও পক্ষ থেকে হত, তবে এতো অবশ্যই বহু বৈপরিত্য দেখতে পেত। (সূরা নিসা:৮২)
أَفَلَمْ يَدَّبَّرُوا الْقَوْلَ أَمْ جَاءَهُم مَّا لَمْ يَأْتِ آبَاءَهُمُ الْأَوَّلِينَ ﴿٦٨﴾
অতএব তারা কি এই কালাম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে না? না তাদের কাছে এমন কিছু এসেছে, যা তাদের পিতৃপুরুষদের কাছে আসেনি? (সূরা মুমিনূন: ৬৮)
وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَـٰذَا الْقُرْآنَ مَهْجُورًا ﴿٣٠﴾
রসূল বললেনঃ হে আমার পালনকর্তা, আমার সম্প্রদায় এই কোরআনকে প্রলাপ সাব্যস্ত করেছে। (সূরা ফুরকান: ৩০)
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِّكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَىٰ لِلْمُسْلِمِينَ – النحل : ﴿٨٩﴾
আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নাযিল করেছি যেটি এমন যে তা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্যে সুসংবাদ। (সূরা নাহল: ৮৯)
কুরআন গবেষণার উপর হাদীস
عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَنْ سَلَكَ طَرِيْقًا يَلْتَمِسُ فِيْهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهُ بِهِ طَرِيْقًا اِلَى الْجَنَّةِ، وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِىْ بَيْتٍ مِنْ بُيُوْتِ اللهِ يَتْلُوْنَ كِتَابَ اللهِ وَيَتَدَارَسُوْنَهُ بَيْنَهُمْ اِلَا نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِيْنَةُ وَغَشِيْيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيْمَنْ عِنْدَهُ وَمَنْ بَطَّاَبِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ (مسلم–ابو داود–ترمذى)
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করার উদ্দেশ্যে পথ চলবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দিবেন। আর যখন কোন একদল লোক আল্লাহর ঘরে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে এবং তার উপর শিক্ষামূলক আলাপ-আলোচনা করে, তখন তাদের উপর (আল্লাহর পক্ষ থেকে) এক মহাপ্রশান্তি অবতীর্ণ হয় এবং আল্লাহর রহমত তাদেরকে আবৃত করে রাখে। আর ফেরেশতাদের মজলিসে তাদের সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করেন। আর যার আমল তাকে পিছন দিকে টানবে, বংশ গৌরব তাকে আগে বাড়াতে পারবে না। (অর্থাৎ ইলম হাসিল করার উদ্দেশ্য হল ইলম অনুসারে আমল করা। সুতরাং যে আমল করবে না তার ইলম কিংবা বংশ মর্যাদা তাকে আল্লাহর নিকট পৌঁছাতে পারবে না।) (মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী)
কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব
১. কুরআন শিক্ষা ফরয :
প্রত্যেক মুসলিমকে কুরআন পড়া জানতে হবে। যে নিজেকে মুসলিম হিসাবে দাবী করবে তাকে অবশ্যই কুরআন শিক্ষা করতে হবে। কুরআন শিক্ষা করা এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, আল্লাহ তা‘আলা কুরআন শিক্ষা করা ফরয করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ ﴾ [العلق: ١]
অর্থ: ‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ [সূরা আলাক : ১]।
কুরআন শিক্ষায় কোন প্রকার অবহেলা করা যাবে না। উম্মাতকে কুরআন শিক্ষার নির্দেশ দিয়ে ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, «تَعَلَّمُوا الْقُرْآنَ ، وَاتْلُوهُ»
অর্থ:‘তোমরা কুরআন শিক্ষা কর এবং তিলাওয়াত কর’ [মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবাহ:৮৫৭২]।
২. সালাত আদায়ের জন্য কুরআন শিক্ষা:
আল্লাহ তা‘আলা ঈমানদার বান্দাহদের উপর প্রতিদিন পাচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। কুরআন তেলাওয়াত ছাড়া সালাত আদায় হয় না। সালাত আদায় করার জন্যও কুরআন শিখতে হবে। কুরআনে বলা হয়েছে, ﴿ فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ﴾ [المزمل: ٢٠]
অর্থ: ‘অতএব তোমরা কুরআন থেকে যতটুকু সহজ ততটুকু পড়’[সূরা আল-মুযযাম্মিল: ২০]।
এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ».
অর্থ: ‘যে ব্যক্তি সূরা ফাতেহা পড়ে না তার সালাতই হয় না’। [সহীহ বুখারী:৭৫৬]
৩. কুরআন প্রচারের জন্য শিক্ষা করা :
কুরআন মাজীদে কুরআন প্রচারের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সে নির্দেশের আলোকে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম কুরআন প্রচার-প্রসারে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছেন। যে ব্যক্তি কুরআন পড়তে জানে না,সে কীভাবে তা প্রচার করবে? সুতরাং কুরআন প্রচার-প্রসারে ভূমিকা পালন করার জন্য তা শিক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন। কুরআনে বলা হয়েছে, ﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغْ مَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ ﴾ [المائدة: ٦٧]
অর্থ: হে রাসূল, তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দাও [সূরা মায়িদাহ : ৬৭]।
৪. কুরআন শিক্ষা অন্তরের প্রশান্তি :
মানব জীবনে অর্থ বা অন্যান্য কারণে জাগতিক তৃপ্তি আসলেও প্রকৃত তৃপ্তি ও শান্তি কুরআন শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। এজন্য কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللَّـهِ ۗ أَلَا بِذِكْرِ اللَّـهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ ﴾ [الرعد: ٢٨]
অর্থ:‘যারা ঈমান আনে,বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে। জেনে রাখ,আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়’ [সূরা আর-রা‘দ:২৮]।
৫. হেদায়াত লাভের জন্য কুরআন শিক্ষা :
কুরআনের মাধ্যমেই হেদায়াতের সন্ধান পাওয়া যাবে। সেজন্য কুরআন থেকে হেদায়াত পাবার জন্য কুরআন শিক্ষা করতে হবে । কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ إِنَّ هَـٰذَا الْقُرْآنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ ﴾ [الاسراء: ٩]
অর্থ: ‘নিশ্চয় এ কুরআন এমন পথ-প্রদর্শন করে,যা সর্বাধিক সরল ও সঠিক’।[সূরা বনি-ইসরাঈল:০৯]
৬. জান্নাতে যাওয়ার জন্য কুরআন শিক্ষা:
প্রত্যেক মুমিনের সর্বোচ্চ কামনা হলো জান্নাতে যাওয়া। তাই জান্নাতে যাওয়ার জন্য কুরআন শিক্ষা করতে হবে। হাদিসে এসেছে,
«اَلصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَقُولُ الصِّيَامُ أَيْ رَبِّ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ وَيَقُولُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ قَالَ فَيُشَفَّعَانِ»
অর্থ: সিয়াম ও কুরআন কিয়ামাতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে হে আমার রব, আমি দিনের বেলায় তাকে (এ সিয়াম পালনকারীকে) পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবূল কর। অনুরূপভাবে কুরআন বলবে, হে আমার রব,আমাকে অধ্যয়নরত থাকায় রাতের ঘুম থেকে আমি তাকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবূল কর। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবূল করা হবে [মুসনাদ আহমাদ: ৬৬২৬]।
কুরআন শিক্ষা না করার পরিণতি
১. রাসূলের অভিযোগ পেশ :
কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিতে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মাতের জন্য শাফায়াত চাইবেন। কিন্তু যারা কুরআন শিক্ষা করেনি, কুরআনের যেসব হক রয়েছে তা আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ পেশ করবেন। কুরআনে এসেছে :
﴿ وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَـٰذَا الْقُرْآنَ مَهْجُورًا﴾ [الفرقان: ٣٠]
অর্থ: ‘আর রাসূল বলবেন,হে আমার রব,নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে’ [সূরা আল-ফুরকান-৩০]
ইবন কাসীর বলেন, কুরআন না পড়া, তা অনুসারে আমল না করা, তা থেকে হেদায়াত গ্রহণ না করা, এ সবই কুরআন পরিত্যাগ করার শামিল।
২. কিয়ামতে অন্ধ হয়ে উঠবে :
যে কুরআন শিখা থেকে থেকে বিমুখ হয়ে থাকল, সে কতইনা দুর্ভাগা! আলকুরআনে এসেছে,
﴿ وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَىٰ ﴿١٢٤﴾ قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَىٰ وَقَدْ كُنتُ بَصِيرًا ﴿١٢٥﴾ قَالَ كَذَٰلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا ۖ وَكَذَٰلِكَ الْيَوْمَ تُنسَىٰ ﴾ [طه: ١٢٤، ١٢٦]
আর যে আমার যিক্র (কুরআন) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, নিশচয় তার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি কিয়ামতের দিন তাকে অন্ধ অবস্থয় উঠাবো। সে বলবে, হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন ? অথচ আমিতো ছিলাম দৃষ্টিশক্তিসম্পন্নণ? তিনি বলবেন, অনুরুপভাবে তোমার নিকট আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, অত:পর তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল’ [সূরা তাহা-১২৪-১২৬]।
৩.মূক, বধির অবস্থায় ঊঠবে:
সবচেয়ে বড় হেদায়েত আল-কুরআন প্রত্যাখ্যানকারীদের কবর হবে সংকীর্ণ, যার দরুন তাদের দেহের পাঁজরগুলো বাঁকা হয়ে যাবে। অবশেষে কিয়ামতের দিন মূক ও বধির হয়ে উঠবে । আলকুরআনে এসেছে :
وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَىٰ وُجُوهِهِمْ عُمْيًا وَبُكْمًا وَصُمًّا مَّأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ ۖ كُلَّمَا خَبَتْ زِدْنَاهُمْ سَعِيرًا [الاسراء:
আমি কিয়ামতের দিন তাদেরকে সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায়, অন্ধ অবস্থায়, মূক অবস্থায়, বধির অবস্থায়। তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম। যখন জাহান্নামের আগুন নির্বাপিত হওয়ার উপক্রম হবে আমি তখন তাদের জন্য অগ্নি আরও বাড়িয়ে দেব। [সূরা বনি-ঈসরাইল:৯৭]
৪. গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত :
কুরআন শিক্ষা না করা গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শামিল। কুরআনে এসেছে,
أُولَـٰئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ ۚ أُولَـٰئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ ﴾ [الاعراف: ﴿١٧٩]
অর্থ: ‘এরা চতুস্পদ জন্তুর ন্যায় বরং এরা তাদের চেয়েও আরো অধম ও নিকৃষ্ট এরাই হলো গাফেল’ [সূরা আরাফ-১৭৯] ।
৫. কুরআন বিপক্ষের দলীল হিসাবে আসবে :
কুরআন শিক্ষা থেকে বিরত থাকার কারণে কুরআন তার বিপক্ষের দলিল হিসাবে উপস্থিত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন : «وَالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ»
অর্থ: কুরআন তোমার পক্ষে কিংবা বিপক্ষের দলীল। [সহীহ মুসলিম: ৩২৮ ]
৬. জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে :
জাহান্নামের মত ভয়াবহ কঠিন জায়গা আর নেই। কুরআন শিক্ষা না করার কারণে জাহান্নামে যেতে হবে। নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
الْقُرْآنُ شَافِعٌ مُشَفَّعٌ وَمَا حِلٌ مُصَدَّقٌ، مَنْ جَعَلَهُ إِمَامَهُ قَادَهُ إِلَى الْجَنَّةِ، وَمَنْ جَعَلَهُ خَلْفَ ظَهْرِهِ سَاقَهُ إِلَى النَّارِ
কুরআন সুপারিশকারী এবং তাঁর সুপারিশ গ্রহণযোগ্য। সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআনকে সামনে রেখে তাঁর অনুসরণ করবে, কুরআন তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি একে নিজ পশ্চাতে রেখে দিবে, কুরআন তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে [সহীহ ইবনে হিববান : ১২৪]।
৭. আখেরাতে জবাবদিহি করতে হবে:
কুরআন শিক্ষায় যথাযথ ভূমিকা পালন না করলে এ বিষয়ে আখেরাতে জবাবদিহি করতে হবে। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿ وَإِنَّهُ لَذِكْرٌ لَّكَ وَلِقَوْمِكَ ۖ وَسَوْفَ تُسْأَلُونَ ﴾ [الزخرف: ٤٤]
অর্থ: নিশ্চয় এ কুরআন তোমার জন্য এবং তোমার কওমের জন্য উপদেশ। আর অচিরেই তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে। [সূরা যুখরুফ : ৪৪]
কুরআন শিক্ষায় করণীয়
১. ভাল শিক্ষকের কাছে পড়া:
যিনি সহীহভাবে কুরআন পড়তে পারেন তার নিকটই কুরআন শিক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে যে শিক্ষকের কুরআন শিক্ষার বিষয়ে প্রশিক্ষণ আছে তার কাছে পড়লে আরো ভাল হয়।
২. নিয়মিত পড়া :
সহীহভাবে কুরআন শিক্ষার জন্য নিয়মিত সময় দেয়া দরকার। যদিও কম সময় হয়। প্রতিদিন শেখার মধ্যে থাকলে সহীহভাবে কুরআন শিক্ষা সহজ হবে এবং যা শেখা হবে তা আয়ত্ত্বে থাকবে।
৩. মশক করা :
কোন যোগ্য শিক্ষকের কাছে মশক করলে পড়ার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। মশক হলো- শিক্ষক পড়বে তারপর সেভাবে ছাত্রও পড়বে। এ ছাড়া বিভিন্ন সিডির মাধ্যমেও মশক করা যায়। এক্ষেত্রে বিশ্ববিখ্যাত ক্বারী মুহাম্মাদ সিদ্দিক মানশাওয়াভীর কুরআন প্রশিক্ষণ সিডির সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।
৪. পরিবার পরিজন ও সন্তানদের শিক্ষা দেয়া:
প্রত্যেক মুসলিমকে তার পরিবার পরিজন ও সন্তানদের কুরআন শিক্ষা দেয়া অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। কুরআনে এসেছে,
﴿ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا ﴾ [التحريم: ٦]
অর্থ:‘হে ইমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও’ [সূরা তাহরীম-৬]।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,
«عَلَيْكُم بِالْقُرْآنِ ، فَتَعَلَّمُوْهُ وَعَلِّمُوْهُ أَبْنَائَكُمْ ، فَإِنَّكُمْ عَنْهٌ تُسْأَلُوْنَ ، وَبِهِ تُجْزَوْنَ»
অর্থর্: কুরআনের বিষয়ে তোমাদের উপর অবশ্য পালনীয় এই যে, কুরআন শিক্ষা করা এবং তোমাদের সন্তানদের কুরআন শিক্ষা দেয়া। কেননা এ বিষয়ে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে এবং তার প্রতিদানও দেয়া হবে। [শরহে সহীহ বুখারী, ইবন বাত্তাল : ৪৬]
৫. ফযীলাতপূর্ণ সূরাগুলো বেশী বেশী তেলাওয়াত করা :
ফযীলতপূর্ণ সূরাগুলো ভালোভাবে শিক্ষা করা এবং সেগুলো বেশি বেশি তিলাওয়াত করা। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
«أَيَعْجِزُ أَحَدُكُمْ أَنْ يَقْرَأَ فِى لَيْلَةٍ ثُلُثَ الْقُرْآنِ. قَالُوا :وَكَيْفَ يَقْرَأُ ثُلُثَ الْقُرْآنِ قَالَ : (قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ) يَعْدِلُ ثُلُثَ الْقُرْآنِ.»
‘তোমাদের কেউ কি রাত্রিকালে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াতে অক্ষম? তারা বললেন, কুরআনের এক তৃতীয়াংশ কিভাবে পড়া পড়বে তিনি বললেন, (সূরা ইখলাস) কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল্য’ [সহীহ বুখারী: ৫০১৫] ।
অতএব যেসব সূরা ও আয়াত সম্পর্কে অধিক ফযীলত ও বেশি নেকীর কথা বর্ণিত হয়েছে এবং যেগুলো ভালোভাবে শেখা ও বেশি বেশি পড়া দরকার তার মধ্যে রয়েছে, শুক্রবার ফজর নামাজে সূরা আলিফ-লাম-সিজদাহ পড়া, ঘুমানোর আগে সূরা মুলক এবং ফরয নামাজের পর সূরা নাস, সূরা ফালাক ও আয়াতুল কুরসী পড়া। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে কুরআন শিক্ষার তাওফীক দিন। আমীন।