দ্বীনি এলেম অর্জন করা সবার জন্য ফরজ

DSC00061

সমাজে নারী ও পুরুষ সকলের অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে। তাদের অধিকার ও দায়িত্ব-কর্তব্য সংরক্ষণ ও নিশ্চিত করতে ইসলাম দিয়েছে নিয়মনীতি ও আইন। আইনের ঊর্ধ্বে থেকে কারো কিছু করার অধিকার ইসলামে নেই। যারা ইসলামী আইনকে অমান্য করে চলবে তারা ইসলাম থেকে নিজেকে বাইরে নিক্ষেপ করবে। ইসলামের মধ্যে থেকে, ইসলামী বিধিবিধান মেনে একজন নারী অনেক কিছুই করতে পারে। তার জীবনের সব অধিকার সে ভোগ করতে পারে এবং ইসলামের অধিকারপ্রাপ্ত হয়ে কাজ করলে সব ক্ষেত্রে নারীরাও মর্যাদাবান হয়ে সমাজ ও জাতিকে অনেক কিছু দিতে পারে। অধিকার পেতে হলে অধিকার সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা দরকার। এ জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। নারী অধিকার ও দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান না থাকেল নারী কিভাবে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে! এ জন্য শিক্ষা অর্জন করা পুরুষের মতো প্রত্যেক নারীর জন্য অপরিহার্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘মূর্খরা কি জ্ঞানীদের সমক হতে পারে?’
যাদের ইলম-জ্ঞান নেই তারা মূর্খ, আর যাদের জ্ঞান আছে তারাই আলেম-জ্ঞানী। এ দুই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। জ্ঞানী ব্যক্তি তার কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে খবর রাখে, অন্যায় কর্ম করলে তার হৃদয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। মূর্খ ব্যক্তি অজ্ঞতার কারণে তার দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারে না। জাতির উন্নতি, অগ্রগতি, অবনতি নির্ভর করে তাদের সন্তান-সন্ততির শিক্ষার ওপর। আর ছেলেমেয়েদের শিক্ষা অধিকতর নির্ভর করে তাদের মায়েদের ওপর। মা যদি শিক্ষা,পরহেজগার, জ্ঞানী,চরিত্রবতী,বুদ্ধিমতী ও সচেতন হন;তাহলে তাদের সন্তানও ওইসব গুণে গুণী হতে পারবে। এ জন্য জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে নারীসমাজের শিক্ষার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,‘যারা চোখে দেখে আর যারা দেখে না তারা কখনো সমান নয়।’
যে চক্ষু জ্ঞানহীন মূর্খ,পড়তে পারে না; সে চক্ষু নিয়ে বিশ্ব চরাচরে বসবাসকারী ব্যক্তি সমাজে বোঝাস্বরূপ। সে যেন চোখ থাকতেও অন্ধ। অন্ধ-মূর্খ মানুষ অজ্ঞানতার অতল সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে থাকে। এ জন্য চুকে প্রস্ফুটিত করতে হবে। শিক্ষিত মেয়ে যে ঘরে প্রবেশ করবে, সে ঘর আলোকিত হবে এবং সে ঘরে যে সন্তান জন্ম নেবে, সেও শিক্ষিত হবে। মায়ের ছোঁয়া পেয়ে তার নৈতিক চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন হবে। ধর্মভীরু ও শিক্ষা মা-ই পারে সন্তানকে মিথ্যাবাদিতা, বেহায়াপনা, অরাজকতার ছোবল থেকে আগলে রাখতে; পারে অবৈধ অর্থ উপার্জন, অন্যের অধিকার হরণ ইত্যাদি থেকে বিরত রাখতে। মানুষ জন্ম নিয়েই সব কিছু জানে না ও করতে শেখে না। পিতামাতা ও সমাজ-পারিপার্শ্বিকতা থেকে ক্রমান্বয়ে মানুষ আপন পরিমণ্ডল সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে শেখে। পিতামাতা যদি ধর্মচিন্তাশীল ও খোদাভীরু হয় তবে তাদের সাহচর্যে সন্তানেরাও উন্নত চিন্তা ও চেতনার অধিকারী হয়ে থাকে। সমাজ-সামাজিকতা যদি ধর্মীয় অনুভূতিশীল ও সৎকর্মশীল মানুষের দ্বারা পরিচালিত হয়, সে সমাজে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ মানুষের আধিক্য হয়ে থাকে। জ্ঞানী মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘আমি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছি, যা তারা অজ্ঞাত ছিল।’
মানুষ জ্ঞানী বা শিক্ষিত হয়ে জন্ম নেয় না। আল্লাহ শিক্ষার পথ উন্মুক্ত করে দেন বলেই মানুষ শিখতে পারে। যদি ইলম না থাকত তবে আল্লাহ, নবী-রাসূল সা:, বেহেশত, দোজখ, হালাল, হারাম, পাপ, পুণ্য কোনো কিছুই মানুষ জানতে পারত না। বিশ্ব চরাচরে যে অসংখ্য সৃষ্টি এসবের কোনো ধারণাই মানুষ পেত না। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের সব কিছু সম্পর্কে জ্ঞান দান করেছেন। পৃথিবী, গ্রহ, নক্ষত্র মহাবিশ্ব সব কিছুর প্রতি তথ্য ও ইঙ্গিত ঐশী গ্রন্থে দেয়া হয়েছে। ইলম বা জ্ঞান অর্জন ছাড়া এসবের খবর জানা সম্ভব নয়। এ জন্য ইলম তথা শিক্ষা অর্জন করা মানুষের জন্য অপরিহার্য। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, প্রত্যেক নরনারীর জন্য ইলম বা জ্ঞান অর্জন করা ফরজ অবশ্য কর্তব্য। (বুখারি)।
ইসলামে পুরুষের মতো নারীর জন্যও শিক্ষা লাভ ফরজ করা হয়েছে। যেখানে পুরুষের শিক্ষার প্রসঙ্গ এসেছে, সেখানে নারীদের শিক্ষার কথাও বলা হয়েছে। নবী সা:-এর সহধর্মিণী হজরত আয়েশা রা: ছিলেন তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে বেশি শিক্ষিতা নারী। অনেক সাহাবায়ে কেরামও তাঁর কাছ থেকে ইসলামের নানা বিষয়ে শিক্ষা নিয়েছেন। অনেক শিক্ষা ও নির্দেশ তাঁর মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা:-এর অন্য স্ত্রী-কন্যা ও মুসলিম রমণীরা প্রয়োজনীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তখন একাডেমিক শিক্ষার প্রচলন না থাকলেও নারীরা প্রয়োজনীয় শিক্ষা ঘরোয়া পরিবেশে অর্জন করেছিলেন। ইসলামপূর্ব যুগে কন্যাসন্তানদের প্রতি আরবের মানুষের ব্যবহার অত্যন্ত কুৎসিত ও জঘন্য ছিল। তাদের আচরণ মনে হলে সভ্য সমাজ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠবে। মূর্খতা ও অজ্ঞতা তাদেরকে এতটা নিচে নামিয়ে ছিল যে, সামান্যতম মনুষ্য অনুভূতি তাদের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারত না। তাদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তাদের কাউকে যখন কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তাদের মুখমণ্ডল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে কিষ্ট হয়। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয়, তার গ্লানি হেতু সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্মগোপন করে। সে চিন্তা করে হীনতা সত্ত্বেও সে তাকে রেখে দেবে,না মাটিতে পুঁতে ফেলবে। সাবধান! তারা যে সিদ্ধান্ত নেয় তা কত নিকৃষ্ট।’ (সূরা নাহল : ৫৭-৫৯)।
এহেন নির্মম ও বর্বর জাতিকে ইসলাম সুসভ্য ও পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ জাতি হিসেবে গড়ে তুলেছিল। নারীর মর্যাদা ও গুরুত্বকে সমভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। আর এটা সম্ভব হয়েছিল ইলাহি জ্ঞানের আলো মানুষের হৃদয়ে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে। নারীসমাজ নিজেদেরকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে ইসলামের মহান শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরেছিল। তাই তাদের গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তানাদি পৃথিবীতে চোখ খুলেই আদর্শ ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন। তারাই পরবর্তীকালে বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে বিশ্বকে আদর্শের শিক্ষা দিয়েছেন। ইসলামের স্বর্ণযুগে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা সবাই মায়েদের আদর্শিক ধারার বলিষ্ঠ শিক্ষার গুণেই আজো স্মরণীয় হয়ে আছেন। এ জন্য নারীদেরকে আদর্শ নারী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।
অধুনা বিশ্বে পুরুষের পাশাপাশি নারীসমাজের চরম নৈতিক স্খলন ঘটেছে। অনেক নারীকে দেখা যায় দৈনন্দিন কর্ম সম্পর্কে তারা চরমভাবে বিপদগ্রস্ত। শিক্ষা ঈমান-আমল, সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে তারা যতটুকু না সময় দিয়ে থাকে তার চেয়ে ঢের বেশি সময় ও অর্থ ব্যয় করে থাকে রূপচর্চা, অশিক্ষা, অপকর্ম ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। এ জন্য ছেলেমেয়েদের আদর্শবান করে গড়ে তোলা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। বিয়েশাদির ব্যাপারেও আমাদেরকে এ দিকটা সর্বাগ্রে লক্ষ করা উচিত। রাসূলুল্লাহ সা: গুরুত্ব সহকারে আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন, ‘কেবল সুন্দর বলেই বিয়ে কোরো না। কেননা সৌন্দর্য নৈতিক অবয়ের কারণ হতে পারে। অথবা কেবল সম্পদের কারণে কাউকে বিয়ে কোরো না। কারণ সম্পদ থেকে অবাধ্যতার সৃষ্টি হতে পারে। বরং ধর্মের প্রতি কী রকম নিষ্ঠা আছে, অনুরাগ কেমন তার আলোকেই বিয়েশাদি হওয়া উত্তম।’ (ইবনে মাজা/১৮৫৯)।‘একজন পুরুষ মানুষকে শিক্ষা দেয়া মানে একজন ব্যক্তিকে শিক্ষিত করে তোলা; আর একজন মেয়েকে শিক্ষা দেয়া মানে একটি গোটা পরিবারকে শিক্ষিত করে তোলা।’
জাতির কল্যাণে নারীশিক্ষার প্রয়োজন। পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর অর্ধেকেরও বেশি নারী। আর এই অর্ধেক জনগণকে সুশিক্ষিত করতে না পারলে জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতি ও কল্যাণ আসতে পারে না। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে,সেই শুরু থেকেই নারীরা নিজেদেরকে কর্মঠ হিসেবে গড়ে তুলেছেন, তাদের উপযোগী বিভিন্ন কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। সে সময় তারা সেবিকা, শিক্ষিকা, রাঁধুনিসহ এজাতীয় নানাবিধ কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে পারলৌকিক মুক্তির জন্য তৈরি করবে, সবার কল্যাণে কাজ করবে, জীবনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে এটাই শিক্ষার উদ্দেশ্য।
শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, শিক্ষা উদ্দেশ্য মনুষত্বের বিকাশ করা, চাকরি বা শুধু জ্ঞান অর্জন নয়। জ্ঞান খুবই বড় জিনিস। যে জাতি জ্ঞানে যত উন্নত তাদের সম্মান ও ঐশ্বর্য তত উন্নত।’
জ্ঞান অর্জন ও শিক্ষা লাভের মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তোলার সাথে সাথে অন্যকে জানিয়ে দেয়ার মাধ্যমে দাওয়াতি কাজ করারও প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের সমাজে নারী প্রচারক বা লেখকের অনেক অভাব পরিলতি হয়। বিশেষ করে ধর্ম-জ্ঞানলব্ধ নারীর অপ্রতুলতা লক্ষ করা যায়। তাই নারীদেরকে ধর্মশিক্ষা, নারীসমাজের উন্নয়ন-অগ্রগতি ও চরিত্র গঠনের জন্য লেখালেখি ও দাওয়াতি কাজ করার উদ্যোগ নেয়া দরকার।
শিক্ষিত নারী একটি পরিবারকে বদলে দিতে পারে। কেবল পরিবার নয়, জাতির উন্নয়নেও নারীর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। নারী শিক্ষা ক্ষেত্রে উদাসীনতার সুযোগ নেই। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার ধনসম্পদ ও পরিবার-পরিজনদের মায়ায় পড়ে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ ভুলে না গিয়ে আমাদের নাজাতের উপায় তালাশ করা দরকার। আল্লাহর আদেশ পালনে দৃঢ়ভাবে কাজ করার জন্য ও পুরো সমাজকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তির জন্য পুরুষের সাথে সাথে নারীদেরকেও সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে আসুন আমরা দায়িত্ববোধের পরিচয় দিই। = সমাপ্ত=

Related Post