প্রশ্ন: কাঁচা পেঁয়াজ-রাসুন খেয়ে নাকি নামায পড়া যায় না? এই বিষয়ে হাদীস থেকে বিস্তারিত জানালে খুশি হবো। আশরাফুদ্দীন, (বাবুল) কায়রাওয়ান, কুয়েত
উত্তর: জী রাসূল (সা.) কাঁচা পেঁয়াজ-রসুন, এবং দুর্গন্ধ জাতীয় পানাহার করে মসজিদে যেতে নিষেধ করেছেন। যেমন হযরত জাবের (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল বলেছেন:
وعن جابر بنِ عبد الله رضي الله عنه عن النبيِّ [ قال: ((مَنْ أكلَ البصَلَ والثومَ والكُرّاث فلا يقربنَّ مسجدَنا؛ فإنَّ الملائكةَ تتَأذَّى مما يتأذَّى منه بنُو آدم)) أخرجَه مسلم،
যে ব্যক্তি পেঁয়াজ, রসুন খেল, সে যেন আমাদের মসজিদের নিকটে না আসে, কেননা আদম সন্তান যেসব বস্তু হতে কষ্ট পায়, তা হতে মালাইকা বা ফেরেশতাগণ কষ্ট পেয়ে থাকেন। (মুসলিম)
রাসূল (সা.) আরো বলেছেন: হযরত ইবনে উমার হতে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে:
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِي اللَّهم عَنْهمَا أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهم عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ فِي غَزْوَةِ خَيْبَرَ مَنْ أَكَلَ مِنْ هَذِهِ الشَّجَرَةِ يَعْنِي الثُّومَ فَلَا يَقْرَبَنَّ مَسْجِدَنَا
রাসূল (সা.) খায়বর যুদ্ধের সময় বললেন; যে ব্যক্তি এই গাছ তথা রসুন খাবে, সে যেন আমাদের মসজিদের কাছে না আসে। (বুখারী)
এই বিষয় আরো অনেক হাদীস রাসূল থেকে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং হাদীসের আলোকেই বুঝা গেল, যে, গন্ধযুক্ত খাবার খেয়ে নামাযে যাওয়া নিষেধ, কেননা এতে মুসল্লীদের কষ্ট হয়। আল্লাহ আমাদেরকে এমন খাবার খাওয়া হতে হেফাযত করুন।
প্রশ্ন: অনকে অসুস্থ, কিংবা বয়স্ক ব্যক্তি সরাসরি নামাযের সিজদা মাটিতে করতে অক্ষম, তারা কি বালিশ কিংবা উঁচু কোন বস্তুতে সিজদা করতে পারবে? এস. এম. জাকিরুল্লাহ, দোয়া, কুয়েত।
উত্তর: না, তারা বালিশের উপর সিজদা করতে পারেন না। কেননা হাদীসে এসেছে হযরত জাবের (রা.) বলেছেন:
عاد صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مريضاً، فرآه يصلي على وسادة فرمى بها، وقال : صلِّ على الأرض إن استطعت وإلا؛ فَأَوْمِ إيماءً، واجعل سجودك أخفض من ركوعك
রাসূল (সা.) কোন এক রুগ্ন ব্যক্তির খবরাখবর নিতে যান। ঠিক সে সময় তাকে বালিশের উপর নামাযের সিজদা করতে দেখে তা টেনে ফেলে দিয়ে বললেন, মাটির উপর সিজদা করতে সক্ষম হলে মাটির উপরই সিজদা করে নামায পড়বে। নতুবা এমনভাবে ইশরা করে নামায পড়বে, তাতে রুকুর ইশারা থেকে সিজদার ইশারায় মাথা অপেক্ষকৃত বেশি নিচু করবে। (বায়হাকী)
এ হাদীস থেকে বুঝাগেল, অসুস্থ ব্যক্তিরা বালিশ কিংবা কোন উঁচু বস্তুতে সিজদা না করে ইশরার মাধ্যমে সিজদা করবে।
প্রশ্ন: অনেককে দেখা যায়, সিজদায় গিয়ে কপাল চেপে ধরে, আবার অনেকে রোদে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে এই নিয়তে যে, এভাবে নামায পড়লে কপালে তাড়াতাড়ি সিজদার চিহ্ন পড়বে। এভাবে দাগ লাগানো বৈধ হবে কি? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।
উত্তর: না বৈধ হবে না। বিশেষ করে যদি নামাযীর মনে এমন চিন্তা থাকে যে, লোকে তার কপালে নামাযের দাগ দেখে শ্রদ্ধ বা সম্মান করবে এবং লোকে তাকে নামাযী বলবে। সহীহ হাদীসে রয়েছে:
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” مَنْ أَحْسَنَ الصَّلاةَ حَيْثُ يَرَاهُ النَّاسُ ، وَأَسَاءَ حِينَ يَخْلُو فَتِلْكَ اسْتِهَانَةٌ يَسْتَهِينُ بِهَا رَبَّهُ ” .
আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি অন্য মানুষের সম্মুখে ভালোভাবে নামায পড়ে, (খুশু-খুযু প্রকাশ করে থাকে ও ভালোভাবে রুকু ও সিজদা করে থাকে) আর যখন একাকী পড়ে তখন ভালোভাবে পড়ে না। সে আপন রব্বের সাথে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলো, এবং তামাশা করলো। (সুনানে কুবরা লিল বায়হাকী)
অনুরূপভাবে উমার বিন খাত্তাব বর্ণনা করেছেন- তিনি একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মসজিদে উপস্থিত হলে সেখানে তিনি দেখেন যে, মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) রাসূল (সা.) এর কবরের নিকট কাঁদছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: কেন কাঁদছো? মুয়াজ বিন জাবাল বললেন, আমি রাসূল (সা.)-এর কাছ থেকে একটি কথা শুনেছিলাম, ঐ কথাই আমাকে কাঁদাচ্ছে। তিনি বলছিলেন; সামান্যতম রিয়া (লোক দেখানো আমল) হলো শিরক।
শুধুমাত্র মূর্তির সামনে সিজদা করা ও মূর্তিকে অর্থ প্রদান করাই শিরক নয়, বরং অন্যকে সন্তুষ্ট করার জন্য বা অন্যকে দেখানোর জন্য এবং অন্যের চোখে নেক ও ভদ্র হওয়ার নিয়তে কেউ যদি অধিক থেকে অধিক বড় নেক আমলও করে তাহলে সে বাস্তবিক পক্ষে শিরক করে। এর কারণ হলো এই যে, সন্তুষ্টি শুধুমাত্র আল্লাহরই অধিকার আর সে এ অধিকার আল্লাহ ছাড়া অন্যকে দান করেছে।
প্রশ্ন: নামায না পড়লেই কি লোক কাফের হয়ে যায়? আমাদের মুসলিম সমাজে অনেক লোক দেখা যায় যে, তারা নামায পড়েন না, তাদের অবস্থা কি? হাদীসের আলোকে জানতে চাই। আসাদুর রহমান, আব্বাসিয়া কুয়েত
উত্তর: জী কোন ব্যক্তি যদি নামায ফরয হওয়ার কথা অস্বীকার করে তাহলে সত্যিই কাফের হয়ে যায়। যেমন রাসূল (সা.) বলেছেন:
عن بريدة [قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم إن العهد الذي بيننا وبينهم الصلاة فمن تركها فقد كفر
হযরত বুরাইদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন; নিশ্চয় আমাদের ও ইসলাম গ্রহণকারী সাধারণ লোকদের পরস্পরে নামাযের চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কাজেই যে লোক নামায ছেড়ে দিবে, সে যেন কুফরির পথ গ্রহণ করলো। (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনু মাযাহ)
অর্থাৎ যে, লোক নামায পড়ে না, সে ‘মুসলিম রূপে’ গণ্য নয়। যে নামায পড়- ছেড়ে দেয় না, সে মুসলমান। এই কারণে রাসূল (সা.) ইসলাম গ্রহণকারী লোকদের হতে নামায পড়ার ছেড়ে না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করতেন। নামায পড়াই ঈমানের ও মুসলমান হওয়ার বাস্তব প্রমাণ।
যদি কেউ অহঙ্কারবশতই নামায প্রত্যাখ্যান করে কিংবা নামাযকে ফরয মেনে না নেয়, তাহলে তার কাফের হয়ে যাওয়া অকাট্য ও অবধারিত। এরূপ ব্যক্তি মুসলিম সমাজ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার যোগ্য। অবশ্য শুধুমাত্র গাফলতির কারণে যদি কেউ নামায না পড়ে; কিন্তু তা ফরয হওয়ার প্রতি তার পূর্ণ বিশ্বাস অক্ষুণ্ন থাকে এবং মানে যে নামায ফরয, তাহলে এই ব্যক্তি ‘কাফের’ বলে গণ্য হবে না। তাকে তাওবা করে রীতিমত নামায পড়ার জন্য প্রস্তুত করা আবশ্যক।
প্রশ্ন: আমার এক ভাই এমন দ্রুত নামায আদায় করে যে, সে রুকুতে গেলে আমি মনে মনে রুকুর ছোট তাকবীর একবার বলতেই সে উঠে যায়। ঠিকমত না দাঁড়িয়ে হুট করে সিজদায় চলে যায়। এভাবে নামায কবুল হয় কি? আবু ইবরাহীম, হাওয়াল্লী, কুয়েত
উত্তর: না, এভাবে নামায মোটেও কবুল হয় না। এ বিষয়ে সহীহ হাদীস রয়েছে; হযরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করলো, রাসূল (সা.) তখন মসজিদের এক কোণে বসা ছিলেন। সে ব্যক্তি নামায পড়লো। পরে রাসূল (সা.) -এর কাছে এসে সালাম দিলো। রাসূল (সা.) সালামের জওয়াব দিয়ে বললেন, তুমি ফিরে যাও এবং আবার নামায পড়ো, কেননা তুমি নামায পড়নি। লোকটি এই কথা শুনে ফিরে গেলো এবং আবার নামায পড়লো। পরে ফিরে এসে আবার রাসূল (সা.)-কে সালাম দিলো। রাসূল (সা.) সালামের জওয়াব দিলেন এবং বললেন, তুমি আবার গিয়ে নামায পড়ে আসো। কেননা তুমি যেভাবে নামায পড়েছো, তা হয়নি। পরে তৃতীয় কিংবা চতুর্থবার লোকটি বললো, হে আল্লাহর রাসূল! কিভাবে নামায পড়তে হবে, তা আমাকে শিখিয়ে দিন। তখন রাসূল (সা.) নামায শিক্ষা প্রসঙ্গে বললেন: তুমি যখন নামাযের জন্য প্রস্তুতি নিবে, তখন প্রথমেই খুব ভালো ও পূর্ণমাত্রায় ওযু করবে। তারপর কিবলামুখী হয়ে দাঁড়াবে, এরপর আল্লাহু আকবার বলে হাত বেঁধে দাঁড়াবে। পরে নামাযে কুরআনের আয়াত যতটা তোমার পক্ষে পাঠ করা সম্ভব পাঠ করবে। তারপর রুকু দিবে- তাতে সম্পূর্ণ ধীরস্থির হয়ে থাকবে। তারপর মাথা তুলে একেবারে সমান হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। এরপর সিজদায় যাবে- সিজদায় স্থির হয়ে থাকবে। পরে মাথা তুলে উঠে ধীরস্থির হয়ে বসবে। পরে আবার সিজদায় যাবে। এবার সিজদায় স্থির হয়ে থাকবে। পরে উঠে বসবে। অপর বর্ণনায় বলা হয়েছে, অতঃপর মাথা তুলে উঠে একবারে সমান হয়ে দাঁড়াবে। এরপর নামাযের অন্যান্য সব কাজ অনুরূপ স্থির ও ধীরতাসহকারে সম্পন্ন করবে। (বুখারী ও মুসলিম)
লোকটি বারবার নামায পড়া সত্তে¡ বার বার রাসূল (সা.) তাকে বললেন, তুমি যাও আবার নামায পড়ো, কেননা তুমি নামায পড়নি। নামায পড়নি, এর অর্থ নামায যে রীতি-পদ্ধতি ও ভাবধারাসহকারে পড়তে হয়, তুমি সেভাবে নামায পড়নি। কাজেই তোমাকে আবার পড়তে হবে। বারবার পড়া সত্তে¡ও তার নামায হচ্ছে না কেন, তা লোকটি বুঝতে পারেনি। শেষ সময়ে এর আসল কারণ বুঝতে পেরে তিনি নিজেই রাসূল (সা.) এর নিকট নামায পড়ার সঠিক পদ্ধতি জানতে চাইলেন। সে অনুযায়ী রাসূল (সা.) তাকে নামায পড়ার নিয়ম ও পদ্ধতি সবিস্তারে বলে দিলেন। তিনি এ পর্যায়ে নামাযে যে বড় বড় কয়েকটি কাজের কথা বলেছেন- তা হচ্ছে: সূরা ফাতিহা ও অপর কিছু আয়াত, রুকু-সিজদা ও রুকু-সিজদায় পূর্ণ ধীরস্থিরতা পালন করা, রুকুর পর সোজা হয়ে দাঁড়ানো ও দুই সিজদার মাঝে ধীরস্থির হয়ে বসা। এ কাজগুলো রাসূল (সা.) এর শিখানো পদ্ধতি অনুযায়ী সম্পন্ন করা না হলে প্রকৃত নামায যথাযথভাবে আদায় হতে পারে না। নামায পড়ার এই পদ্ধতিই রাসূল (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন এবং এই পদ্ধতি অনুযায়ী সব মুসলমানের নামায পড়া কর্তব্য।
প্রশ্ন: এক ব্যক্তি নিয়মিত নামায পড়েন, কিন্তু তিনি সিগারেট পান করেন, এমন ব্যক্তির ইমামতিতে নামায পড়া জায়েয হবে কি? সাজ্জাদ হোসেন, কুয়েত সিটি।
উত্তর: সিগারেট পান করে এমন ব্যক্তির পেছনে নামায পড়া জায়েয হবে। তবে সে যদি মসজিদের নির্ধারিত ইমাম হন, তাহলে অতিসত্ত¡র একজন দ্বীনদার-পরহেজগার ইমাম নিয়োগ করা প্রয়োজন।
প্রশ্ন: কোন ইমাম সাহেব যদি ইচ্ছাকৃতভাবে দাড়ি না রাখেন, তাহলে তার পিছনে নামায সহীহ হবে কী? আব্দুল গফুর, সালমিয়া, কুয়েত
উত্তর: কোন ইমাম দাড়ি না রাখলেও তার পেছনে নামায সহীহ হবে। তবে এই ক্ষেত্রে বুখারীর প্রথম হাদীসটি উল্লেখযোগ্য। তা হচ্ছে:
إِنَّمَا الأَعْمَالُ بالنِّيَّاتِ
সমস্ত কাজই নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আপনাকে জানতে হবে ইমাম সাহেব কেন দাড়ি রাখেননি। ইমাম যদি দাড়ি রাখার হাদীস অমান্য করে এবং এমন বলে যে, দাড়ি না রাখা জায়েয, দাড়ি না রাখলে সুন্নাতের খেলাপ হবে না। এই অবস্থায় তার পেছনে নামায সহীহ হবে না। আর যদি সে ইমাম দাড়ির রাখার যাবতীয় হাদীস মেনে ও স্বীকার করে নেয়, এবং দাড়ি না রাখার তার ব্যক্তিগত দুর্বলতা অথবা অন্য কোন কারণ থাকে, তাহলে তার পেছনে নামায সহীহ হবে।
আরো উল্লেখ্য যে, যে ব্যক্তি দাড়ি রাখে না এমন লোককে ইমাম নিযুক্ত না করাই উচিত।