“তোমাকে বিয়ে দিয়েছি। বিক্রি তো করিনি-সবার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। মানিয়ে চলার চেষ্টা করবে। তবে একান্তই যদি কেউ তোমাকে বুঝতে না চায় তো Sacrifice । তোমাকে জীবন বাজি রেখে সংসার করতে হবে না। অবশ্য দাম্পত্য জীবনের সুখ শান্তি নির্ভর করে Sacrifice and compromise এর উপর।
আমি যখনই কারো বিয়ের কথা শুনি কিংবা বিয়ের দাওয়াত পাই তখনই আমার আব্বার ঐ কথাটি মনে পড়ে। যা আব্বা আমাকে বলেছিলেন ১৯৭৯ সালের ১৬ই জানুয়ারী। আমার বিয়ের পরের দিন।
কথাটা আব্বা আমাকে যে ভাবে বলেছিলেন ঠিক সেই ভাবেই ‘নূর’ কে বলেছিলাম। নুর হাসি মুখে খুশি মনে বলেছিলেন “ঠিক আছে এসো সেভাবেই চলি।”
আলহামদুলিল্লাহ। আমরা সে ভাবেই চলেছি। এতো গুলো বছর একসাথে আছি। কারো বিরুদ্ধে আমাদের কারো নালিশ নেই। পরস্পরের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ আমাদের সংসার। আর এই ভালোবাসা সংক্রামিত হয়েছে আমাদের সন্তানদের মধ্যে পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে। এই Sacrifice and compromise শুধু দাম্পত্য জীবনেই না জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজন। জীবন চলার পথে পরস্পরের প্রতি যতো অসন্তোষ, যতো অভিযোগ এই দুটি জিনিষের অভাব থেকেই সবকিছুর উৎপত্তি। নিজের শান্তির জন্য নিজের স্বার্থে এই দু’টি গুণ আমাদের অর্জন করা দরকার। এই গুণটির নামই কুরআনের পরিভাষায় ‘ইহসান’। যা একজন মুসলিমের সর্বোত্তম গুণ। যে গুণ একজন মুসলিম কে পূর্ণ মুসলিম হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।
আল্লাহপাক আমাদের দোয়া শিখিয়েছেন-“রব্বানা আত্বিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাঁও ওয়া ফিল আখিরতে হাসানাহ। ওয়া কিনা আযাবান্নার।” হে আমাদের রব আমাদের দুনিয়ায় শান্তি দাও এবং আখেরাতেও শান্তি দাও। আর জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।”
এই দুনিয়ার শান্তি সম্পূর্ন ভাবে নির্ভর করে এই Sacrifice and compromise এর উপর। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার শান্তি পাবে সেই আখেরাতের শান্তি পাবে এবং জাহান্নামের আগুন থেকে নিস্কৃতি পাবে। কারন দুনিয়ার শান্তি পেতে হলে যে আমল করতে হয় সেই আমল করাই আল্লাহ বারিতায়ালার নির্দেশ। যার মাধ্যমে সে পাবে জাহান্নাম থেকে নিস্কৃতি এবং আখেরাতের পরিপূর্ন শান্তি।
একবার রাসুল (সঃ) বললেন,“এক্ষুনি একজন জান্নাতি লোক আসবে” উপস্থিত সাহাবী সবাই অপেক্ষায় থাকলেন-কে আসে? একটু পরেই এক ব্যক্তি এলেন যাকে সবাই চেনে। এই ভাবে পরপর তিনদিন রাসুল (সঃ) ঘোষণা দিলেন একটু পরেই একজন জান্নাতি লোক আসবে আর এই তিন দিনই সেই একই ব্যক্তি এলেন। এক অল্প বয়স্ক সাহাবী কৌতুহলি হলেন ঐ জান্নাতি ঘোষনা প্রাপ্ত ব্যক্তি কি আমল করে তা জানার জন্য। তিনি তিনদিন তিন রাত তার সাহচার্যে থাকার পরও এমন কোনো আমল ঐ ব্যক্তির মধ্যে খুজে পেলেন না যা তাদের থেকে ঐ ব্যক্তিকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। অতঃপর কৌতুহলি সাহাবী ঐ ব্যক্তিকে সব জানালেন এবং তার আমল জানতে চাইলেন। জান্নাতি ঘোষনা প্রাপ্ত ব্যক্তি জানালেন “অন্যান্য কাজ তোমরা যা করো আমি তার চেয়ে বেশি কিছু করিনা তবে আমার দিন রাত-সকাল সন্ধ্যা অতিবাহিত হয় এমন ভাবে যে কারো উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই। কৌতুহলি সাহাবি বললেন “ তাহলে এই আমলই আপনাকে জান্নাতে পোঁছে দিয়েছে।”
এই যে আমল-এই আমলের নাম ঝধপৎরভরপব। আমাদের যাপিত জীবনে যতো অসন্তোষ আর অশান্তি তা সব সময় বড় কোনো বিষয় নিয়ে নয়। ছোট ছোট ব্যপারে ছাড় দিতে পারিনা বলেই অশান্তিতে ভুগি। দুনিয়ার শান্তি পাই না,তাহলে কি করে আখেরাতের শান্তি পাব? পরিপূর্ন মুসলিম হতে হলে ঈমান এলেম ও আমলের সাথে আরও তিনটি গুন আমাদের একান্ত প্রয়োজন। তা হলো-
১. ছাড় দেওয়ার মনোভাব
২. সমঝোতার মনোভাব
৩. পারস্পারিক ভালোবাসা।
ব্যাস এই তিনটি গুনই যথেষ্ট। যদিও তৃতীয় গুনটি থেকেই অপর দু’টি গুণের উৎপত্তি। মূল কথা হলো ভালোবাসাই ইসলাম। ভালোবাসাই শান্তি-সন্মান। আখেরাতের মুক্তি ও জান্নাত। রাসুল (সঃ) বলেছেন “তোমরা ততক্ষন জান্নাতে যেতে পারবে না যতক্ষন না তোমরা হবে মুমীন। তোমরা ততক্ষন মুমীন হতে পারবে না যতক্ষন না তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসতে পারবে।”
অতএব পারস্পারিক ভালোবাসা হলো মুমীন হওয়ার পূর্ব শর্ত। আর এই ভালোবাসা উত্তোরত্তর বৃদ্ধির জন্য রাসুল (সঃ) দুটি আমল করতে বলেছেন।
১.“অধিক পরিমাণে সালামের প্রচলন করো” এবং
২.“যাকে ভালোবাসো তাকে ভালোবাসার কথাটা জানাও।”
এই ভালোবাসার কথাটা জানানো যে কতো জরুরী তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। ঈমানের যেমন তিনটি পর্যায়
*অন্তরে বিশ্বাস রাখা
* মুখে স্বীকার করা
* আর কার্যে তার প্রমাণ দেওয়া।
ভালোবাসা ঈমানেরই আর এক নাম। ভালোবাসাও অন্তরে জাগতে হবে মুখে স্বীকার করতে হবে- তারপর কাজে তার প্রমান দিতে হবে। তাই তো ঈমান আনতে হলে মুখে কালেমা শাহাদাত উচ্চারণ করতে হয়। মুখে উচ্চারণ না করলে তার ঈমান কে গ্রহণ করাই হয় না। তাই ভালোবাসার কালেমাও মুখে উচ্চারণ করা জরুরী। আর ভালোবাসা এমন এক মুলধন তা উচ্চারণের মাধ্যমে বিলি করলে লাভসহ ফিরে আসবেই।
এমন অনেক পরিবার আছে যাদের মধ্যে ভালোবাসার খুবই অভাব। এমন অনেক দম্পতি পাওয়া যায় ৩০/৪০ বছর সংসার করার পরও তারা ভালোবাসার নাগাল পায়নি। তাহলে কি করে তাদের ছাড় (Sacrifice) দেওয়ার মনোভাব আসবে? আর সমঝোতার (compromise) তো প্রশ্নই আসেনা।
একবার এক সাধারন বৈঠকে আমার বক্তব্য শেষে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম “কারো কিছু প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।” এক বয়স্কা মহিলা বললেন,“আপা আমার স্বামী মারা গ্যাছে এক বছর হলো। তার জন্য তো আমার দোয়া করা উচিত। কিন্তু আমার যে দোয়া আসেনা। আমি এখন কি করবো?”
বুঝতে না পেরে আমি জিজ্ঞেস করলাম “ দোয়া আসেনা মানে?”
মহিলা বললেন,“আমার স্বামী এমন কোনো খারাপ কাজ নেই যা সে করেনি। মদ জুয়া খারাপ মেয়েদের কাছে যাওয়া কিছুই বাদ দেয়নি। এখন দোয়ার জন্য হাত তুলে “আল্লাহ তাকে ভালো রেখো কিংবা মাফ করে দাও” একথা বলা হয় না। মুখে আসে এখন মজা বোঝ। দুনিয়াতে থাকতে তো বিশ্বাস হয় নাই।
আপা আমি জানি তার জন্য ভালো দোয়া করা উচিত কিন্তু দোয়া যে আসেনা এখন কি করব আমি?”
একটু চুপ করে থেকে বললাম,“আচ্ছা আপনার স্বামী কেমন খারাপ ছিলো বলেন তো- কোনো বেগানা পুরুষকে আপনার ঘরে দিয়ে তাকে নিয়ে রাত কাটাতে বলেছে? মহিলা আঁতকে উঠলেন-“ছি!ছি! না না ওসব করেনি। বরং আমাকে কোনো পুরুষের সাথে কথা বলতেই দিত না। আমি একটু জোরে কথা বললে আমাকে বকত।” আবার বললাম “আপনাকে নামাজ পড়তে নিষেধ করেছে?”
মহিলা বললেন “না আপা সে আমাকে নামাজ পড়তে কোনোদিন নিষেধ করেনি। কোনো কোনো দিন আমার নামাজ একটু দেরী হলে বরং বকাঝকা করতো।”
বললাম “আপনার খাওয়া পরা কিভাবে চলে? থাকেন কোথায়?”
মহিলা বললেন, “থাকি স্বামীর বাড়িতেই জমি ক্ষেত আছে। ফল ফসল ভালোই পাই। তাছাড়া আমার স্বামী সরকারী চাকুরী করত। পঁচিশ’শ টাকা পেনশন পাই। আমার থাকা খাওয়ার অসুবিধা নেই আল্লাহর রহমতে।
বললাম “তাহলে ভাবেনতো স্বামীর বাড়ীতে থাকেন তার জমির ফল ফসল খান। তার চাকুরীর পেনশন ভোগ করেন। তার উপর সে আপনার এতটুকু ক্ষতি করেনি। দুনিয়ারও না আখেরাতেরও না। সে যা করেছে তা নিজের সর্বনাশ। সে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছে। তার জন্য তো দোয়া আরো বেশী করে করবেন। বলবেন “হে আল্লাহ, এই মানুষটাকে তুমি মাফ করো। সে আমার বড় উপকার করেছে। এখনও তার শ্রমের ফসল আমি খাই পরি। সে না বুঝে নিজের বড় সর্বনাশ করেছে। নিজের উপর জুলুম করেছে। তাকে তুমি মাফ করো প্রভু। তার কিছু ভালো কাজ থাকলে সে কথা উল্লেখ করে আল্লাহর কাছে দোয় করেন। তার বাড়িতে আছেন। তার জমির ফসল খান। তার শ্রমের বেতন এখনও পান আর তার জন্য দোয়া না করলে আপনার মতো বেঈমান আরতো দেখিনা।”
মহিলা এইবার কেঁদে ফেললেন ঝর ঝর করে।
অনেক দিন পরে আবার দেখা হলো সেই মহিলার সাথে বললাম “স্বামীর জন্য দোয়া কি আসে?”
* “আসে আপা। আপনি ঠিকই বলেছেন। মানুষটা আমার সাথে কোনোদিন খারাপ ব্যবহার করেনি। যা করেছে নিজের সর্বনাশই করেছে। আল্লাহ যেনো তাকে মাফ করে দেন। আপনি বলার আগে তার উপর আমার কোনো ভালোবাসাই ছিলনা। আপারে এখন মানুষটার উপর আমার কি যে মহব্বত পয়দা হয়েছে। সব সময় মনে হয় মহান আল্লাহ যদি তার সব গুনাহ মাফ করে দিতেন।”
এমনি জীবিত মৃত সবার প্রতি যদি আমাদের মহব্বত সৃষ্টি হতো তাহলেই আমরা ক্ষমা করতে পারতাম। ছাড় দিতে পারতাম। সমঝোতায় আসতে পারতাম। দুনিয়ায় শান্তিতে থাকতে পারতাম।
তবে স্মরণ রাখতে হবে সব কিছু হয় যেনো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। কারন আমার নামাজ আমার কুরবানী আমার জীবন আমার মরন সবই তো আমার রবের জন্য। তাইতো রাসুল (সঃ) বলেন “যে দিন আল্লাহর আরশের ছায়া ব্যতিত আর কোনো ছায়া থাকবে না সেই দিন ঐ দুই ব্যক্তিকে আল্লাহ তার আরশের ছায়ার নিচে জায়গা দেবেন যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পরস্পরকে ভালোবেসেছিলো।”
১৯৮৯ সাল পর্যন্ত নওগাঁ জিলায় কোনো মহিলা রুকন ছিল না। ৮৯ সালের ডিসেম্বরের ২৩/২৪ তারিখে শপথ হয় আমার আর রোকেয়া বেগম আপার। তার কয়েকদিন পরেই মনে হয় ৩০শে ডিসেম্বর শপথ হয় গুলশান আরা আপার। এরপর ৯৩/৯৪ সালের মধ্যে ১৩/১৪ জন রুকন হয়ে যায়। বর্তমানে রুকন সংখ্যা ৪৪/৪৫ জন। যা হোক সেই ১৩/১৪ জন রুকন বোনের মধ্যে গুলশান আরা আপার সাথে আমার খাতিরটা যেনো একটু বেশীই ছিল। আমি তখন থাকতাম সাপাহার উপজিলায়। নওগাঁ জিলা শহর থেকে অনেক দুরে। ত্রয়মাসিক রুকন সন্মেলনে নওগাঁ আসতাম। গুলশান আরার বাসায় অবশ্যই একবার যেতাম। আর গুলশান আরাও আমাকে খুব ভালোবাসতো। একবার সম্মেলনে যেয়ে দেখি গুলশান আরা আসেনি। মনটা খারাপ হয়ে গ্যালো। আসেনি ক্যান গুলশান আরা? নওগাঁর এক আপাকে জিজ্ঞেস করলাম। সেই আপা বললেন,“গুলশানআরা আর আগের মতো নেই। সে রুকন বৈঠকেও আসে নি। সাপ্তাহিক বৈঠকেও ঠিক মতো হাজির হয় না।” (চলবে…)