Main Menu

মর্মান্তিক এপ্রিলফুল

মর্মান্তিক-এপ্রিলফুল

মর্মান্তিক-এপ্রিলফুল

প্রাক কথাঃ   ইসলামের সুমহান সৌন্দর্য বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল রাসূল (সাঃ)এর যুগ থেকেই। কালের পরিক্রমায় সে আলো ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের মাটিতেও। উমাইয়া সালতানাতের বীর সেনাপতি মূসা বিন নুসায়ের এবং তারেক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে স্পেনের মাটিতে তৎকালীন রাজা রডারিকের পরাজয় বরণ করার মধ্যদিয়ে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীর শেষের দিকে । তখন থেকে ১ এপ্রিল ১৪৯২ সালের আগ পর্যন্ত প্রায় আটশত বছর ধরে মুসলমানদের স্বর্ণযুগ ছিল স্পেনে । জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, চিকিৎসা, রাজনীতি, স্থাপত্য-কলা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সে সময় স্পেন নিজেই ছিল স্পেনের উদাহরণ। মুসলমানদের উন্নয়নের এমন গতিধারা খ্রিস্টানরা মোটেও মেনে নিতে পারেনি,শুরু হলো ষড়যন্ত্রের জাল বুনা। মুসলমানদের আভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টি করে সাজানো বাগানকে তছনছ করার নীল নকশা আঁকলো গ্রানাডার রাজা ফার্ডিন্যান্ড! তার সাথে যুক্ত হলো পর্তুগীজ রাণী ঈসাবেলা। যা সব শেষে মর্মান্তিক এপ্রিল ফুলে পর্যবশিত হয়। আলোচ্য প্রবন্ধে খ্রিস্টানদের চাতুরতার শিকার সরল মুসলিমদের শেষ পরিণতির ভয়াল চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে জাতির জাগরণে ক্ষুদ্র প্রয়াস পাব বলে বিশ্বাস করি।

এপ্রিল ফুলের বিশ্লেষণঃ  ঈসায়ী সনের চতুর্থ মাস এপ্রিল (April) , ফুল শব্দটি ইংরেজি (Fool) যার অর্থ বোকা। সুতরাং এপ্রিল ফুল মানে এপ্রিলের বোকা। খ্রিস্টান রাজা ফার্ডিন্যান্ড এর ফাঁকি বুঝতে না পেরে মুসলমানরা নগরীর প্রধান ফটক খুলে দিয়ে নগরীর মসজিদসমূহে এবং সমুদ্রের জাহাজে নিরস্ত্র আশ্রয় নিয়ে বোকামীর পরিচয় দেয় বলে তাদেরকে নিয়ে খ্রিস্টানরা উপহাস ছলে বলে থাকে Oh Muslims “ How much fool you” ? ওহে মুসলমানেরা তোমরা কত বোকা!

মুসলমানদের বীরত্বঃ   মুসলমানরা আরবকে কেন্দ্র করে এক সময় গোটা বিশ্ব শাসন করত। তৎকালে মূসা বিন নুসায়ের এবং তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে মুসলমানরা ইউরোপের স্পেন পর্যন্ত জয় করেছিল এবং সেখানের গ্রানাডা রাজ্যের অন্তর্গত কর্ডোবা নগরীতে তাদের জ্ঞানের স্বর্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। তখন থেকে সমগ্র বিশ্বের সচেতন লোকজন সেখানে জ্ঞানার্জনের জন্য ছুটে যেত। অষ্টম শতাব্দীর শেষ লগ্ন থেকে ১৪৯২ ঈসায়ী সালের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রায় আটশত বছর এই কর্ডোবা নগরীতেই মুসলমানেরা তাদের শৌর্য বীর্য ও বীরত্বের স্মৃতি ফুটিয়ে তুলেছিল অতি সুনিপুনভাবে।

জ্ঞানের ভান্ডার কর্ডোবাঃ  স্পেনের গ্রানাডা রাজ্যের কর্ডোবা নগরী ছিল তৎকালীন জ্ঞানের ভুবন। জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি সাধনের মাধ্যমেই মুসলমানরা বিশ্বকে জয় করতে পেরেছিল। আর এই জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলমানরা এত অধিক উন্নতি সাধন করেছিল  যার ফলশ্রুতিতে চীন, জাপান, বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানী, ইটালি ও রাশিয়াসহ আরো অনকে পরাশক্তির চক্ষুশীল হয় মুসলমানরা, শুরু হয় ছিদ্রাম্বেষণ। মুসলমানদেরকে পরাভূত করার লোমহর্ষক সিন্ধান্তে খ্রিস্টানরা মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে ঐক্যমত গড়ে তুলে। মুসলমানদের উন্নয়নের গতিধারা দেখে দিশেহারা হয় বিধর্মীরা । সকলেই মুসলমানদের জ্ঞান ভান্ডার কর্ডোবাকে নাস্তানাবুদ করার সিদ্ধান্তে অটল।

ভোগবিলাসের পরিণতিঃ প্রযুক্তিগত সকল জ্ঞান ছিল মুসলমানদের হাতে। মুসলমানরা চিকিৎসাবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, গণিত, ভূগোল ও শিল্পবিদ্যাসহ অসংখ্য জ্ঞানের ধারক ও বাহক ফলভোগকারী ছিল। ঠিক যখন মুসলমানরা তাদের ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে পড়ে তখন বিজাতিরা তাদের ওপর উড়ে এসে জুড়ে বসে এবং সকল পরাশক্তি মিলে মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ে আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব কলহ। রাসূল (সা.) এর যুগে যেমন মুনাফিক সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুল মুসলমানদের কাতারে থেকে মুসলমানদেরই ক্ষতি সাধন করত, তেমনি আবু দাউদ নামক এক গাদ্দার স্পেনের কর্ডোবার শেষ সুলতান আবুল হাসানের ছত্রছায়ায় থেকে খ্রিস্টান রাজা ফার্ডিন্যান্ডের কর্ডোবা ধ্বংসের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখলো! তার সাথে যোগদিল রাজ্যের আরও কিছু ক্ষমতা লোভী ব্যক্তি বর্গ। সে হত্যাযজ্ঞের মিশনকে পাকাপোক্ত করতে পার্শ্বর্বতী দেশ পর্তুগীজের রাণী ঈসাবেলার সাথে হাত মিলায় ফার্ডিন্যাণ্ড এবং উভয়ে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়। এর পর ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করা হলো সমগ্র স্পেন জুড়ে। মুসলিম নেতৃবৃন্দেও অন্তঃকোন্দলে যখন এমনিতেই অবস্থা শোচনীয় ঠিক তখনই ফার্ডিন্যাণ্ড-ঈসাবেলার সম্মিলিত বাহিনী আক্রমণ করে মুসলমানদের ওপর। ইতিহাস সাক্ষী যে, তখন মুসলমানদের রক্তে স্পেনের অলিতে গলিতে যেন খুনের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। নেতৃত্বহীন মুসলমানরা যখন জীবন বাঁচানোর জন্য দিশেহারা , ঠিক তখনই সুযোগ বুঝে গ্রানাডা রাজ্যের রাজা ফার্ডিন্যাণ্ড মিথ্যা আশ্বাস দেয় মুসলমানদের, এই কর্ডোবা নগরীর মুসলিম সম্প্রদায়ের যারা দীর্ঘদিন অবরোধে আটকা পড়েছে তারা যদি নগরীর প্রধান ফটক খুলে দিয়ে মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নেয় তাহলে তাদের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু রক্ষণা-বেক্ষণের দায়িত্ব নিবেন স্বয়ং রাজা ফার্ডিন্যাণ্ড, আর যারা সমুদ্রের জাহাজে আশ্রয় নিবে তাদেরকে আফ্রিকার অন্যান্য মুসলিম দেশসমূহে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সরল বিশ্বাসী মুসলমানরা সেদিন রাজার ছলনাময়ী প্রস্তাবে রাজি হয়ে না বুঝে বোকার মত নগরীর প্রধান ফটক খুলে দেয় এবং বাড়ী ঘর ছেড়ে সকলে গ্রানাডার রাজ্যের কর্ডোবা নগরীর সবচেয়ে বিরাট মসজিদসহ অন্যান্য মসজিদে অবস্থান গ্রহণ করে। ইহাতে শত্রুরা ঝোঁপ বুঝে কোপ মারে। শত্রু বাহিনী বিশ্বাস ঘাতকতা করে মসিজদের দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে বাহিরে তালা ঝুলিয়ে দেয়। তারপর ভিতরে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে সরল বিশ্বাসী মুসলিম নর-নারীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং বাকীদের জাহাজ থেকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে হত্যাকরে পৈশাচিকতার অট্ট হাসিতে মেতে উঠে। এই ঘটনায় প্রায় ৭ লক্ষ মুসলিম নর-নারী নিহত হয়। এই মর্মান্তিক হত্যা কান্ডের ফলে সমস্ত কর্ডোবা নগরী মুসলমানদের লাশে এক বিশাল ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়।

১ এপ্রিল সম্পর্কে অজ্ঞতাঃ খ্রিস্টানরা এই এপ্রিল ফুলকে উল্লাসের দিন হিসেবে গণণা করে, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কালের বিবর্তনে তা মুসলমানদের ঘরেও প্রবেশ করেছে। আজকের বিশ্বেও অসংখ্য মুসলমান ও এপ্রিলের সেই বিষাদময় ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ। যার কারণে ইহাকে কেন্দ্র করে মুসলমানরা ও আজ আনন্দ উল্লাস করে বিভিন্ন উৎসব উতযাপনের মাধ্যমে দিবসটিকে পালন করে।

এপ্রিল ফুল থেকে শিক্ষণীয়ঃ তাই বলছি মুসলমানদের উচিত ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখা। কেননা এজঘন্য হাসি তামাশা মুসলমানদের জন্য নয়। বরং মুসলিম মিল্লাতের জন্য এটা একটা শোক বিহবল দিন।

শিক্ষা ধ্বংসের ভয়াল পরিণতিঃ ইংরেজ দার্শনিক “নেপোলিয়ান” বলেছিলেন-কোন জাতিকে ধ্বংস করতে হলে সে জাতির শিক্ষা ধ্বংস করাই যথেষ্ট। তার সূত্র ধরে ইউরোপ মহাদেশের গ্রানাডা রাজ্যের রাজা ফার্ডিন্যাণ্ড ও তার স্ত্রী প্রতাপশালী পর্তুগীজ রাণী ঈসাবেলার সম্মলিতি বাহিনী তৎকালীন জ্ঞান বিজ্ঞানের রাজধানী স্পেনের কর্ডোবা নগরীর উপর ১৪৬৯ সালে অতর্কিত হামলা চালায় এবং সেখানের মুসলিম বিজ্ঞানী ও পন্ডিতদেরকে ধরে নিয়ে তাদের জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল গ্রন্থ সমূহসহ জাহাজ থেকে ভূ-মধ্য সাগরে ফেলে দেয়। মুসলমানদের জ্ঞান ভাণ্ডারে তথা গ্রন্থাগারে এত অধিক পরিমাণ বই ছিল যেগুলো ভূ-মধ্য  সাগরে ফেলার কারণে সেই সাগরের পানি কালো রং ধারণ করেছিল ( কারণ তখন বই পুস্তক লিপিবদ্ধ হতো লিক্যুইড জাতীয় কালি দিয়ে) । এমনিতেই জিব্রাল্টার প্রণালীতে গেলে দেখা যায় ভূ-মধ্য সাগরের পানির রং কালো বর্ণের , মনে হয় যেন সে পানি মুসলমানদের জ্ঞান ভান্ডার ধ্বংসের সাক্ষী আজও বহন করছে।

ধ্বংসের দিন তারিখঃ ১৪৬৯ সালের ৩রা জানুয়ারী মোতাবেক ৮৯৭ হিজরী ২রা রবিউল আউয়াল যুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘ ৩২ বছর যুদ্ধ করার পর মুসলমানরা সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে টিকে থাকতে না পেরে কর্ডোবা নগরীর প্রধান ফটক বন্ধ করে দিয়ে ভিতের আশ্রয় নেয় এবং সম্মিলিত বাহিনী উক্ত নগরী অবরোধ করে। দীর্ঘ সময় অবরোধের পর ১৪৯২ সালের ১লা এপ্রিল রাজা কার্ডিন্যাণ্ডের মিথ্যা আশ্বাসে নগরীর ফটক খুলে দেয়। এতে খ্রীষ্টানরা মুসলমানদের সকল জ্ঞান ভান্ডার সহ ৭ লক্ষাধিক মুসলমান ধ্বংস করে দেয়।

খ্রীস্টান রাজার ফাঁকি ও সফলতাঃ  যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতিতে মুসলমানরা নগরীর ফটক বন্ধ করে দিয়ে ভিতরে থেকে সংঘবদ্ধ হয়ে খ্রিস্টানদের হামলার পাল্টা জবাব দিচ্ছে। ইতোমধ্যে নগরীর বাহিরে যেতে না পেরে ভিতরে খাদ্য সংকটে অবলা নারী শিশু আর্তনাদ করছে অপরদিকে খ্রিস্টান রাজার মিথ্যা আশ্বাসে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ছেড়ে সকল জনতা মসজিদে এবং সমুদ্রে জাহাজে আশ্রয় নিলে বিশ্বাস ঘাতক রাজা ও তার বাহিনী মসজিদের বাহিরে  তালাবদ্ধ করে ভিতরে অগ্নি সংযোগ করে মুসলমানদেরকে পুড়িয়ে মারে এবং জাহাজে আশ্রিতদের অন্য মুসলিম দেশে পাঠানোর কথা বলে ভূ-মধ্য সাগরের মাঝখানে ডুবিয়ে মারে , এতে সমূলে বিনাশ হয়ে যায় গোটা জাতি। এটা মুসলমান জনগণের জন্য চরম বিষাদময় দিন। কোন কোন স্থানে মুসলমানরা উহাকে ইসলামী শোক দিবস হিসাবে পালন করেন। থেমে নেই সেই ষড়যন্ত্র, ফিলিস্তিন ইরাক আফগান আরাকান আন্দামান মিন্দানাও সিরিয়ায় যার ধারাবাহিকতা আজও চলছে। আমাদেরকে ইহুদী নাসারাসহ সকল নাস্তিক্যবাদী মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।

পরিশিষ্টঃ    মুসলমানরা বীরের জাতি, বীর দর্পে কাজ করে যাওয়াই তাদের আসল কাজ। ইতিহাস চর্বিত চর্বনে পাওয়া যায় যে, এই মুসলমানরা তাদের আদর্শ দিয়ে বিশ্ব জয় করেছিল। ফলে ধুলার তখতে বসেও অর্ধ পৃথিবী শাসন করতে পেড়েছে । আর যখনই তারা তাদের আদর্শ বচ্যিুত হয়েছে তখনই তাদেরকে অশান্তির কোপানলে ধুকে ধুকে মরতে হয়েছে। তাদের ওপর চেপে বসেছে অন্য জাতির আধিপত্য। দিকে বিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে জুলুম নিপীড়নের দাবানল এবং অমানিশার অন্ধকারে হারিয়ে গেছে সকল বোধশক্তি। এপ্রিল ফুল তারই একটি জ্বলন্ত প্রমাণ । মুসলমান একটি মিশনারী জাতি। তারা স্বাধীনচেতা অগ্নিপুরুষ। তারা মাথানত করতে জানে না। তাদের উচিত নিজেদের আদর্শ নিয়ে পথ চলা। তাই মুসলমানদের প্রতি সবিনয় অনুরোধ মসজিদে আবদ্ধ থেকে নয় বরং জ্ঞানের পাহাড় অর্জন করার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে পুনরায় জয় করতে হবে। তাই প্রয়োজন সকলে সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করা। কেননা একটি প্রবাদ আছে- “Unity is strength” একতাই বল।

লিখিছেন: জসিম বিন আখতার

 

Related Post