রামাদান আরবি শব্দ।আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, কঠোর সাধনা, আত্মসংযম ইত্যাদি। সাধারণত প্রভাতের সাদা আভাপ্রকাশের সময় (সুবহে সাদিক) থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার ও যাবতীয়ইন্দ্রিয় তৃপ্তি, অন্যায়-অপরাধ, পাপ কাজ থেকে বিরত থাকার কঠোর সাধনাকে সাওম বা রোজাবলা হয়।
মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘রমজানের মাস, যে মাসেকুরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক এবং সত্য ও মিথ্যারপার্থক্যকারী এক নির্ভুল মানদণ্ড। অতএব, তোমাদের মধ্যে যারাই এ মাসের সাক্ষাৎ পাবেতারা যেন অবশ্যই সিয়াম পালন করে ।হজরত সালমান ফারসি রা: বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: শাবান মাসের শেষ দিকে আমাদেরউদ্দেশে খুতবা দিলেন। তিনি বললেন, ‘হে মানব সকল! তোমাদের কাছে এক সুমহান মাসউপস্থিত। এটি একটি অতি বরকতময় মাস, যে মাসে একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়েওউত্তম। এ মাসে রোজা রাখা আল্লাহ্ তোমাদের ওপর ফরজ করে দিয়েছেন এবং রাতের নামাজকেনফল করেছেন। যে এ মাসে একটি নফল কাজ করল সে যেন অন্য মাসে একটি ফরজের সমান আমল করল, আর যে এ মাসে একটি ফরজ কাজ করল সে অন্য মাসে ৭০টি ফরজের সমান কাজ করল। এটি হচ্ছেঅন্যদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার মাস। আর এ মাসে ঈমানদারদের রিজিক বাড়িয়ে দেয়া হয়।
কোনো রোজাদারকে যে কেউ কোনো কিছু দিয়ে ইফতার করাবে তা তার জন্য মাগফিরাতের কারণ হবেএবং দোজখ থেকে বাঁচার উপায় হবে। আর ওই ব্যক্তি রোজাদারের সমান সওয়াব লাভ করবে,যদিওরোজাদারের সওয়াবে কোনো কমতি হবে না। এ বিষয়ে এক সাহাবি, নবী সা:-কে বললেন, ‘হেআল্লাহর রাসূল সা: আমাদের অনেকেরই রোজাদারকে কোনো কিছু দিয়েই ইফতার করানোর সাধ্যনেই।’তখন রাসূল সা: বললেন, ‘আল্লাহ্ তাদেরও এই পুরস্কার দেবেন যারা একটু দুধ, একটিখেজুর অথবা শুধু পানি দিয়ে রোজাদারকে ইফতার করাবেন। আর যে রোজাদারকে পূর্ণতৃপ্তিসহকারে আহার করাবে আল্লাহ তাকে হাউজে কাওসার থেকে পানি পান করাবেন, যাজান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত তার থেকে তৃষ্ণা দূর করেদেবেকুরআন নাজিল হওয়ার এ মাসের প্রথম ১০ দিন রহমত, মধ্য ১০ দিন মাগফিরাত এবং শেষ ১০ দিনজাহান্নাম থেকে মুক্তির দিন। এ মাসে যে কেউ তার গোলামের কাজকে সহজ করে দেবে আল্লাহতাকে মাফ করে দেবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন ।তিরমিজি।উল্লিখিত কুরআনের আয়াত এবং হাদিসের আলোকে আমাদের শুধু রমজান মাস নয়, সারা জীবন চলাউচিত। রমজান কুরআন নাজিলের মাস। কুরআনের উৎসবের মাস। এ মাসে কুরআনের পূর্ববর্তীনাজিলকৃত সব অংশ রাসূল সা: জিবরিল আ:’কে পড়ে শোনাতেন। আমরা কি এ মাসে পুরো কুরআনপড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি?কুরআনের শিক্ষা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে বাস্তবায়নেরকী কী পদক্ষেপ আমরা এ মাসে নিয়েছি?রমজান মাসে নফল কাজগুলোর জন্য ফরজের সমান বরকতের ওয়াদা করা হয়েছে। আর প্রতিটি ফরজেরজন্য সত্তর গুণ সওয়াব। কতটুকু নফল ইবাদত করার পরিকল্পনা আমরা গ্রহণ করেছি? ফরজগুলোকে যথার্থ আন্তরিকতাসহকারে আদায়ের কতটুকু উদ্যোগ আমাদের রয়েছে? রমজানেশয়তানকে আবদ্ধ করে রাখা হয়। কিন্তু আমরা কি নিজেদের শয়তানি প্ররোচনা থেকে মুক্তকরতে পেরেছি? এই রমজানেও কি আমরা শয়তানি কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হই না? রহমত বরকত মাগফিরাতের এ মাসে আমরা কি আমাদের প্রাত্যহিক প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রেসংযম অবলম্বন করতে পেরেছি? প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যয় এবং ভোগ-বিলাসের ইচ্ছা কি আমরা দমনকরতে পেরেছি? রমজান সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও অংশীদারিত্বের মাস। আমরা কি এ বিষয়গুলোঅনুধাবন করার চেষ্টা করেছি? আমরা কি আমাদের চার পাশের অভাবগ্রস্ত, সুবিধাবঞ্চিত, অসহায়, ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর কথা ভেবেছি? তাদের জন্য সাধ্যমতো কিছু করার পরিকল্পনাকি আমাদের মাথায় এসেছে? অভাবী, ক্ষুধার্ত এবং দরিদ্র অনেক আত্মীয়স্বজন যারা আমাদেররয়েছেন, তাদের কি আমাদের সম্পদে অংশীদারিত্বের কথা আমরা ভেবেছি?দুনিয়াব্যাপীআমাদের যে অসংখ্য মুসলিম ভাইবোন বিপদকিষ্ট জীবনযাপন করছেন, সেহরি ও ইফতারের জন্যযাদের কোনো খাবার হয়তো জুটবে না, শান্তিতে রাত জেগে নফল ইবাদত করার মতো নিরাপত্তাযাদের নেই, তাদের জন্য সহানুভূতি ও সহমর্মিতা জানানোর কার্যকর কোনো পন্থার কথা কিআমরা ভেবেছি?
কুরআন নাজিলের এ মাসে আমরা কি অপ্রয়োজনীয় ও বাজে কাজে সময় ব্যয় করা ছাড়তে পেরেছি?অথবা আমরা কি এসব অর্থহীন কাজ থেকে বিরত থাকতে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি? রমজান মাস মিথ্যা-ফাসেকি ও ঝগড়া থেকে বিরত থাকার মাস। আমরা কি মিথ্যা বলা ছাড়তেপেরেছি? ফাসেকি আমল ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া থেকে বাঁচার জন্য কোনো সত্যিকারন্যায়ানুগ পন্থা অনুসরণের পরিকল্পনা কি আমরা করেছি?
এ মাসে অশ্লীলতা থেকে কতটুকু দূরে আমরা সরতে পেরেছি? আমরা কি রমজানের দিনে এবং রাতেটেলিভিশনের পর্দা থেকে আমাদের চোখ সরাতে পেরেছি? কুরআন, হাদিস ও বিভিন্ন ইসলামিবইপুস্তক পড়া, যা আমাদের সত্য ও সুন্দর জীবনের চাবিকাঠি, তা বাদ দিয়ে এখনো কি আমরাটেলিভিশন-ভিডিওতে ঢালিউড, বলিউড ও হলিউড সিনেমা-নাটক দেখতে আগ্রহী নই? আমাদেরক্যাসেট ও সিডি মোবাইলে এখনো কি ওই সব গান বাজে না, যা অশ্লীলতা মুক্ত নয়?
প্রিয় ঈমানদার ভাই ও বোনেরা, আসুন, এই রমজানে উপরিউক্ত প্রশ্নগুলোর আলোকে আমরাআমাদের জীবনকে আলোচনা-পর্যালোচনা করে দেখি ।
প্রতি বছর রমজান আমাদের কাছে আসে তাকওয়া অর্জনে সাহায্য করতে। আমাদের জীবন তোরমজানের কল্যাণে ভরে ওঠা উচিত মুত্তাকিদের গুণাবলিতে। কত রমজান হয়তো আমরা পার করেদিয়েছি। কিন্তু তাকওয়া কি সত্যিই আমরা অর্জন করতে পেরেছি? বছরের প্রতিটি মাসই তোআমরা হেলা-ফেলায় কাটিয়ে দেই। আসুন এই রমজানের মাসকে তার পরিপূর্ণ গুরুত্বসহকারেপালন করি, যাতে আমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারি। আমাদের রমজানের দিনগুলো যদি বছরেরঅন্য দিনগুলো থেকে ভিন্নতর না হয়,তবে আমরা সুস্পষ্ট ক্ষতিতে নিমজ্জিত হবো। একটাহাদিসের অংশ বিশেষের অর্থ হলো ‘যে রমজান মাস পেল এবং তার জীবনের সব গুনাহ মাফকরিয়ে নিতে পারল না, সে ধ্বংস হোক।’আমাদের তো এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তেরসদ্ব্যবহার করতে হবে, যাতে আমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারি, যা আমাদের আল্লাহরসন্তুষ্টি অর্জন করতে সাহায্য করবে। টিভি-সিনেমা দেখে, গান শুনে এবং হালকাগল্পগুজবে সময় ব্যয় না করে আমাদের গঠনমূলক দ্বীনইসলামের কাজে সময় ব্যয় করতে হবে ।মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাজিলের এ মাসে আমাদের বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত, জিকির ও দানকরা অন্য মাসের চেয়ে সত্তর গুণ বেশি নেকের আমল। আমাদের নামাজে এবং অন্যান্য ইবাদতেআরো অনেক বেশি আন্তরিকতা ও নিষ্ঠাবোধ থাকতে হবে। সাথে সাথে অভ্যস্ত হতে হবেআত্মবিচারে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান এবং নিষ্ঠা ওআত্মবিচারসহকারে রমজানের রোজা পালন করে,আল্লাহ্ তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করেদেবেন।’ (বুখারি-মুসলিম) তাই প্রত্যেকটি ইবাদতেই আমাদের আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান হতে হবে।
রোজা সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেছেন, ‘বনি আদমের প্রতিটি আমল তার নিজেরজন্য, রোজা ছাড়া। রোজা আমার জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দেবো।’ (বুখারি)ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী ঈমানদান মুসলমান ভাই-বোনেরা, আসুন,রমজানের রোজা পালনেরপাশাপাশি আমাদের ব্যক্তিজীবনের আত্মশুদ্ধি করি। মহান আল্লাহর কাছে আমাদেরভুলত্রুটির ক্ষমা চেয়ে সত্য ও সুন্দর জীবনের পথে এগিয়ে চলি।