Main Menu

রমযান কুরআন নাযিলের মাস

রমযান কুরআন নাযিলের মাস

রমযান কুরআন নাযিলের মাস

এ মাসের সম্মান ও ফযীলত অপরিসীম। আর এ মাসের সম্মান বৃদ্ধির মূল কারণ হলো, এ মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে,  এই কুরআনের কারণেই রমযান মাসের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মর্মে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন:

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدىً لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَان 

রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। (সূরা বাকারা: ১৮৫)

পবিত্র কুরআন শুধু তেলাওয়াত করে খতম করার জন্য অবতীর্ণ হয়নি। বরং আল্লাহ এই কুরআন অবতীর্ণ করেছেন, যেন তা নিয়ে গবেষণা করে বাস্তবে আমল করা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

قال سبحانه: كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَ‌كٌ لِّيَدَّبَّرُ‌وا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ‌ أُولُو الْأَلْبَابِ ﴿٢٩

এটি একটি বরকতময় কিতাব,যা আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসূহ লক্ষ্য করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন তা অনুধাবন করে। (সূরা সাদ: ২৯)

এই আয়াত হতে আমরা নিম্নের বিষয়গুলো জানতে পারলাম:

১। এটি আল্লাহর কিতাব যা তিনি অবতীর্ণ করেছেন। *

২। এটি বরকতপূর্ণ কিতাব, আর বরকত তখনই অর্জন হবে যখন তদানুযায়ী আমল করা হবে।

৩। বরকত বলা হয় সেই অতিরিক্ত বস্তুকে যা আমরা চোখে দেখি না, কিন্তু অনুভব করতে পারি।

৪। বরকতের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে,“কল্যাণ ও সৌভাগ্য বৃদ্ধি।”কুরআন মজীদকে বরকত সম্পন্ন কিতাব বলার অর্থ হচ্ছে এই যে,এটি মানুষের জন্য একটি অত্যন্ত উপকারী কিতাব। এ কিতাবটি তার জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য সর্বোত্তম বিধান দান করে। এর বিধান মেনে চলায় মানুষের লাভই হয় কেবল,কোনো প্রকার ক্ষতির আশঙ্কা নেই।

আয়াতের দ্বিতীয় শেষ অংশ:

لِّيَدَّبَّرُ‌وا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ‌ أُولُو الْأَلْبَابِ

অর্থাৎ: যাতে মানুষ এর আয়াতসূহ লক্ষ্য করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন তা অনুধাবন করে।

কুরআন দুটি উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ করা হয়েছে

১। চিন্তা ও গবেষণা করা

২। উপদেশ গ্রহণ করা

সম্মানিত হাজেরীন! চিন্তা ও গবেষণার অর্থ হলো:

  • আমরা বার বার তেলাওয়াত করবো, যেভাবে বিজ্ঞান শাস্ত্র, গণিত শাস্ত্র পড়ে থাকি, খবরের কাগজের মত না।
  • গবেষণার পূর্বে কিতাবের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে, যে এটি বিজ্ঞানপূর্ণ কিতাব, আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা হয়েছে।
  • গবেষণা করলে কুরআন নাযিলের মর্ম অনুধাবন হয়।

উপদেশ গ্রহণ করার অর্থ

১।কুরআনে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।

২।বিধানাবলীকে জীবন পরিচালনার পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করা।

গবেষণার পূর্বে কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্ক বোঝা দরকারএখানে ৪টি বিষয় লক্ষণীয়

  • কুরআন আমাদেরকে সরাসরি বলছে,
  • কুরআন আমাকে ব্যক্তিগত বলছে,
  • কুরআন মীমাংসা করার কথা বলে,
  • কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্কটা বুঝতে হবে।

  সরাসরি বলতে বুঝায়

যখনই আমরা কুরআন তেলাওয়াত কিংবা শ্রবণ করি, আমরা বলে থাকি এটি আল্লাহর কিতাব। এর অর্থ হলো, যে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সরাসরি সম্বোধন করছেন। যখন আমরা এ কথা বুঝলাম যে, আল্লাহ আমাদেরকেই বলছেন। আমাদের এটাও মনে রাখা দরকার যে, আল্লাহ দেখছেন, তার বান্দা কুরআন শুনে কি করে? অর্থাৎ কুরআন শোনে আমল করে কি না?

  • ব্যক্তিগতগত বলতে বুঝায়

আমরা যে আয়াত তেলাওয়াত করি কিংবা শ্রবণ করি,তখন এই অনুভূতি নিয়ে তেলাওয়াত করা বা শোনা দরকার,যে এই আয়াতটি আমার জন্য। এমন না যে,এই আয়াত কাফেরদের জন্য,অমুক আয়াত মুনাফিকদের জন্য, অমুক আয়াত মদীনাবাসীর জন্য, আর অমুক আয়াত মক্কাবাসীর জন্য। বরং এভাবে গবেষণা করতে হবে যে, এই আয়াতে আমার জন্য কি শিক্ষা রয়েছে, আমি এখান থেকে কিভাবে হেদায়াত পেতে পারি।

  • মীমাংসিত বলতে বুঝায়

প্রতিটি খাদ্যে বা দানায়, খাদকের নাম লেখা রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি যে, সবকিছুই ভাগ্যলিপিতে লিখা রয়েছে। তাহলে বলতে পারি, যে প্রতি আয়াতে তেলাওয়াতকারী ও শ্রবণকারীর নাম লিখা রয়েছে।

  • সম্পর্ক বলতে বুঝায়

কুরআন আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যখনই কুরআন পড়া হয় বা শ্রবণ করা হয়, তখনই আমাদেরকে কোন না কোন দিক দির্দেশনা দিয়ে থাকে। কেননা আল্লাহর উপদেশ অনর্থক হতে পারে না। আমাদের চিন্তা ভাবনা করা দরকার যে, হে আল্লাহ আজ আমাকে এই আয়াত কেন শোনালেন?

গবেষণার জন্য ৪টি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত

১। মনোযোগ

২। বুঝা

৩। চিন্তা-ভাবনা

৪। অনুভূতি-বোধ

মনোযোগ: চোখ, কান, শরীর, মন, মগজ সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কুরআন বুঝার জন্য মনোযোগী করতে হবে।

পুরো আয়াত যদিও বুঝে না আসে, তবুও মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে, যতটুকু বুঝে আসে তা আমল করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে।

বুঝা: কুরআন বুঝে না আসলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গীকার করতে হবে, আজ থেকে কুরআন বুঝে পড়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখবো।

চিন্তা-ভাবনা: যখনই কোন নিদর্শনের আলোচনা বা ঐতিহাসিক বিষয় আসে, সেখানে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।

অনুভূতি-বোধ: যেখানে পুরস্কারের আলোচনা হয়, সেখানে ভালোভাবে অনুভূতিসহ পড়বে, জান্নাতের আলোচনার স্থানে আগ্রহ বাড়িয়ে দিবে, আর জাহান্নামের আলোচনা আসলে, ভয় অনুভব করবে।

গবেষণা ও উপদেশ গ্রহণের নিয়ম

দোয়া: কুরআনের প্রতিটি আয়াত আমাদের কাছ থেকে কিছু চায়। সেটি পূর্ণ করার জন্য দোয়া দিয়ে আরম্ভ করা উচিৎ। অর্থাৎ প্রতিটি আয়াত আমলের জন্য নাযিল করা হয়েছে, চাই তা অন্তরের আমল হোক বা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের আমল হোক। সুতরাং প্রতিটি কাজের সূচান দোয়া দিয়ে করতে হবে।

ইহতেসাব: দোয়ার আলোকে বিগত দিনগুলোর আত্মসমালোচনা করা উচিত। শুধু দোয়া যথেষ্ট না। তাই দোয়ার সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টাও করতে হবে। যেমন আপনার ছেলে ১০ শ্রেণীতে পড়ে, কিন্তু পাস করতে পারছে না। এই ক্ষেত্রে ছেলেকে স্কুলে যেতে হবে, নিয়মিত পাঠ করতে হবে, ইত্যাদি।

পরিকল্পনা : আগামী দিন আপনি কি করবেন সেই বিষয়ে পরিকল্পনা করা দরকার। যদি সফলতার প্লান না করেন, তাহলে ব্যর্থতার প্লান করা হবে। যেমন আপনি খানা খাওয়ার প্লান না করলে, না খেয়ে থাকার প্লান করা হলো।

তাবলীগ: রাসূল (সা.) বলেছেন:  بلغوا عني و لو آية একটি আয়াত জানা থাকলে তা পৌঁছে দাও।

গবেষণার উপর কয়েকটি আয়াত

أَفَلا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا  [محمد:24]

তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?

أَفَلَا يَتَدَبَّرُ‌ونَ الْقُرْ‌آنَ ۚ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِندِ غَيْرِ‌ اللهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرً‌ا ﴿٨٢

এরা কি লক্ষ্য করে না কোরআনের প্রতি? পক্ষান্তরে এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অপর কারও পক্ষ থেকে হত, তবে এতো অবশ্যই বহু বৈপরিত্য দেখতে পেত। (সূরা নিসা:৮২)

أَفَلَمْ يَدَّبَّرُ‌وا الْقَوْلَ أَمْ جَاءَهُم مَّا لَمْ يَأْتِ آبَاءَهُمُ الْأَوَّلِينَ ﴿٦٨

অতএব তারা কি এই কালাম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে না? না তাদের কাছে এমন কিছু এসেছে, যা তাদের পিতৃপুরুষদের কাছে আসেনি? (সূরা মুমিনূন: ৬৮)

وَقَالَ الرَّ‌سُولُ يَا رَ‌بِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَـٰذَا الْقُرْ‌آنَ مَهْجُورً‌ا ﴿٣٠

রসূল বললেনঃ হে আমার পালনকর্তা, আমার সম্প্রদায় এই কোরআনকে প্রলাপ সাব্যস্ত করেছে। (সূরা ফুরকান: ৩০)

وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِّكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَ‌حْمَةً وَبُشْرَ‌ىٰ لِلْمُسْلِمِينَ  – النحل : ﴿٨٩﴾

আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নাযিল করেছি যেটি এমন যে তা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্যে সুসংবাদ। (সূরা নাহল: ৮৯)

কুরআন গবেষণার উপর হাদীস

عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ ] قَالَ، قَالَ رَسُوْلُ اللهِ [ : مَنْ سَلَكَ طَرِيْقًا يَلْتَمِسُ فِيْهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهُ بِهِ طَرِيْقًا اِلَى الْجَنَّةِ، وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِىْ بَيْتٍ مِنْ بُيُوْتِ اللهِ يَتْلُوْنَ كِتَابَ اللهِ وَيَتَدَارَسُوْنَهُ بَيْنَهُمْ اِلَا نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِيْنَةُ وَغَشِيْيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيْمَنْ عِنْدَهُ وَمَنْ بَطَّاَبِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ  (مسلم-ابو داود-ترمذى)

হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করার উদ্দেশ্যে পথ চলবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দিবেন। আর যখন কোন একদল লোক আল্লাহর ঘরে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে এবং তার উপর শিক্ষামূলক আলাপ-আলোচনা করে, তখন তাদের উপর (আল্লাহর পক্ষ থেকে) এক মহাপ্রশান্তি অবতীর্ণ হয় এবং আল্লাহর রহমত তাদেরকে আবৃত করে রাখে। আর ফেরেশতাদের মজলিসে তাদের সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করেন। আর যার আমল তাকে পিছন দিকে টানবে, বংশ গৌরব তাকে আগে বাড়াতে পারবে না। (অর্থাৎ ইলম হাসিল করার উদ্দেশ্য হল ইলম অনুসারে আমল করা। সুতরাং যে আমল করবে না তার ইলম কিংবা বংশ মর্যাদা তাকে আল্লাহর নিকট পৌঁছাতে পারবে না।) (মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী)

আরো একটি হাদীস:

عَنْ أَبِيْ ذَرٍّ ] قَالَ: “صَلَّى رَسُوْلُ اللهِ ﷺ لَيْلَةً فَقَرَأَ بَآيَةٍ حَتَّى أَصْبَحَ يَرْكَعُ بِهَا وَيَسْجُدُ بِهَا: إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ ۖ وَإِن تَغْفِرْ‌ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ * المائدة ﴿١١٨﴾

فَهَذَا صَلَّى رَسُوْلُ اللهِ ﷺ يُقَدِّمُ التَّدَبُّرَ عَلَى كَثْرَةِ التِّلَاوَةِ، فَيَقْرَأُ آيَةً وَاحِدَةً فَقَطْ فِيْ لَيْلَةِ كَامِلَةٍ

হযরত আবু যর (রা.) হতে বর্ণিত,রাসূল (সা.) একদা রাতে নামায পড়লেন,একটি আয়াত পড়ে পড়েই রাত পার করলেন,এবং রুকু সিজদা করে নামায শেষ করলেন,আয়াতটি হলো:

إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ ۖ وَإِن تَغْفِرْ‌ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ﴿١١٨﴾

যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন,তবে তারা আপনার দাস এবং যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে আপনিই পরাক্রান্ত,মহাবিজ্ঞ। (সূরা মায়েদা:১১৮)

একটি আয়াত বারবার পড়ার মানে হলো, তিনি আয়াতটি নিয়ে গবেষণা করেছেন,ও পরকালের কথা ভেবেছেন।

عن ابن مسعود ] قَالَ: ” كَانَ الرَّجُلُ مِنَّا إِذَا تَعَلَّمَ عَشْرَ آياتٍ لَمْ يُجَاوِزْهُنَّ حَتَّى يَعْرِفَ مَعَانِيَهُنَّ وَالْعَمَلَ بهِنَّ

হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) বলেন; আমাদের মধ্য হতে কেউ ১০টি আয়াত শিখার পর অর্থ বোঝা ও বাস্তবে আমল করা ছাড়া সামনে বাড়তাম না।

সম্মানিত মুসাল্লিয়ানে কেরাম! পৃথিবীতে একমাত্র নির্ভেজাল ও সন্দেহমুক্ত কিতাব হল ‘আল-কুরআন’। পবিত্র  এই কুরআন নাযিল করা হয় রমযান মাসে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ البقرة

‘রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হেদায়াত স্বরূপ এবং হেদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ঐ মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। {সূরা  বাকারা, আয়াত-১৮৫}

 উল্লেখিত আয়াতে কুরআন নাযিলের মাস হিসেবে রমযান মাসের পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে এবং সেই সাথে পবিত্র কুরআনের পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে তিনভাবে।

 এক. আল কুরআন মানুষের জন্য হেদায়াত স্বরূপ।

 দুই. আল কুরআন হেদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী সম্বলিত।

 তিন. আল কুরআন সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী।

একই সাথে কুরআন নাযিলের মাস রমযান মাসে সিয়াম পালন করার বিধানও প্রদান করা হয়েছে।
উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা যে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত তা হল, রমযান মাস হল পবিত্র কুরআন নাযিলের মাস এবং যে এই মাস পাবে, তার উপর সিয়াম পালন করা ফরয।

রমযান মাসে কুরআন নাযিলের কারণ:

আল কুরআন যেহেতু আল্লাহর বাণী, সে কারণেই মহান আল্লাহ তাঁর বাণী স্বীয় বান্দার উপর অবতীর্ণ করার জন্য এমন একটি সময় নির্বাচন করেছেন, যে সময়ে বান্দা সিয়াম পালনে রত থাকবে। তাই, রমযান মাসে নাযিল করা হয়েছে আল কুরআন, আর আল কুরআনের খাতিরেই রমযান মাসে ফরয করা হয়েছে সিয়াম।

রমযান মাস ব্যাপী তারাবীহ-এর সালাতে কুরআনুল কারীম খতম করার বিধানও প্রমাণ করে যে, আল কুরআনের সঙ্গে সিয়াম পালনের কি গভীর সম্পর্ক। আর এ কথা বাস্তব সত্য যে, বৎসরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় পবিত্র রমযান মাসে কুরআন তেলাওয়াতকারীর সংখ্যা ও তেলাওয়াতের পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে যায়।

এর অন্যতম আরেকটি কারণ হল, রমযানে মানুষ তুলনামূলকভাবে গুনাহমুক্ত থাকে। আর মানুষ যখন গুনাহমুক্ত থাকে, তখন আল কুরআন তাকে আকর্ষণ করে। সে কারণেই নাবালেগ অবস্থায় মানুষের জন্য শুদ্ধভাবে কুরআনুল কারীম এর তালীম গ্রহণ করা এবং হিফজ করা বা হাফেজ হওয়া সহজ হয়। কেননা, মানুষ নাবালেগ অবস্থায় গুনাহের হিসাবমুক্ত থাকে। আর নবীগণ যেহেতু একেবারেই গুনাহমুক্ত, নিষ্পাপ, সে কারণেই নবীগের উপর মহান আল্লাহর কিতাব সরাসরি অবতীর্ণ করা হয়। এখানে গুনাহমুক্ত থাকাটা একটা মৌলিক বিষয়।

 আলকুরআন হল মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি: হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন-

 عَنْ عُثْمَانَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ

‘তোমাদের মাঝে ঐ ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে কুরআন শেখে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।’ {বুখারী শরীফ, হাদীস-৪৬৩৯} এই হাদীসের আলোকে শ্রেষ্ঠ মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত।

এক. যারা কুরআন শেখে।

দুই. যারা অপরকে কুরআন শিক্ষা দেয়।

এই দুই ভাগের বাইরে তথা কুরআনের শিক্ষা সংশ্লিষ্টতা ছাড়া শ্রেষ্ঠত্বের ভিন্ন কোন পথ নেই।

কুআনের প্রতি হরুফে ১০ নেকি:

হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন-

عن عبد الله بن مسعود قال قال رسول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ (أخرجه الترمذي)

 ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের একটি হরফ পাঠ করল, এতে সে একটি নেকি প্রাপ্ত হল এবং উক্ত একটি নেকি দশটি নেকির সমতুল্য হবে। রাসূল (সা.) আরো বলেন, আমি বলছি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ।’ {তিরমিযী শরীফ, হাদীস-২৮৩৫}

অর্থাৎ উদ্দেশ্য এই যে, অন্যান্য আমলের বেলায় যেমন পুরো আমলকে একটি বলে গণ্য করা হয়, কুরআনুল কারীমের বেলায় তেমনটি নয়। বরং এখানে আমলের অংশ বিশেষকেও পূর্ণ আমল বলে গণ্য করা হয়। এই জন্য প্রতিটি হরফের পরিবর্তে একটি করে নেকি হবে। আর প্রতিটি নেকির বিনিময়ে দশটি করে নেকি পাওয়া যাবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, কুরআনুল কারীম বুঝে পাঠ করলেও যেমন নেকি হয়, অনুরূপভাবে না বুঝে পড়লেও নেকি হয়। তবে বুঝে বুঝে পাঠ করলে অবশ্যই নেকি বেশি হবে এবং কুরআনের হক আদায় হবে। আর বুঝে পাঠ করে এর উপর আমল করলে নেকি আরো বেশি হবে। কেননা, আলিফ-লাম-মীম এগুলোর অর্থ কারো জানা নেই। তদুপরি এর প্রতিটি হরফে দশটি করে নেকি হয়।

কুরআনের উপর আমলকারীর পিতা-মাতাকে নূরের মুকুট পড়ানো হবে, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন-

عَنْ سَهْلِ بْنِ مُعَاذٍ الْجُهَنِيِّ عَنْ أَبِيهِ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ وَعَمِلَ بِمَا فِيهِ أُلْبِسَ وَالِدَاهُ تَاجًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ضَوْءُهُ أَحْسَنُ مِنْ ضَوْءِ الشَّمْسِ فِي بُيُوتِ الدُّنْيَا لَوْ كَانَتْ فِيكُمْ فَمَا ظَنُّكُمْ بِالَّذِي عَمِلَ بِهَذَا؟  رَوَاهُ أَبُو دَاوُد، وَالْحَاكِمُ وَقَالَ: صَحِيحُ الْإِسْنَادِ.

 ‘যে ব্যক্তি কুরআন কারীম পড়ে এবং উহার উপর আমল করে, তার মাতা-পিতাকে কেয়ামতের দিন এমন একটি (নূরের) টুপি পরানো হবে, যার জ্যোতি দুনিয়ার সূর্যের জ্যোতি অপেক্ষা অধিক হবে।’ {আবু দাউদ শরীফ, হাদীস-১২৪১}

কুরআনের ধারক-বাহক আল্লাহর পরিবার:

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : ” إِنَّ لِلَّهِ تَعَالَى أَهْلِينَ مِنَ النَّاسِ ، قِيلَ : مَنْ هُمْ يَا رَسُولَ اللَّهِ ؟ ، قَالَ : أَهْلُ الْقُرْآنِ ، هُمْ أَهْلُ اللَّهِ وَخَاصَّتُهُ ”  (صحيح الجامع2165(

আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত: রাসূল (সা.) বলেছেন: লোক হতে আল্লাহর কিছু লোক আল্লাহর পরিবারের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের পরিচয় কি? রাসূল (রা.) বললেন, কুরআনের ধারক-বাহকগণই আল্লাহর পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।

কুরআন কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو رضي الله عنهما أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ، يَقُولُ الصِّيَامُ : أَيْ رَبِّ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ وَيَقُولُ الْقُرْآنُ : مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ قَالَ : فَيُشَفَّعَانِ ) . صححه الألباني في “صحيح الجامع” (7329(.

রোযা ও কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে রব! আমি তাকে খাদ্য ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, (অর্থাৎ না ঘুমিয়ে সে তেলাওয়াত করেছে) অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতঃপর তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৬৬২৬; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস : ২০৮০;

কুরআনের উপর আমলকারীগণ জান্নাতের উঁচু স্থানে বাস করবেন:

عن عبد الله بن عمرو رضي الله عنهما قال: يُقَالُ لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ اقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ في الدُّنْيَا فإِنَّ مَنْزِلَكَ عِنْدَ آخِرِ آيةٍ تَقْرَؤُهَا». سنن أبي داود حسن صحيحصحيح الجامع8122(

 

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.)-সূত্রে বর্ণিত: রাসূল (সা.) বলেন: কুরআনের সাহেবকে বলা হবে, তুমি কুরআন পড়, আর উচ্চ আসন গ্রহণ কর। যেভাবে তুমি দুনিয়াতে তারতীলের সাথে পাঠ করেছিলে। কেননা তোমার আসন তো সেখানে হবে, যেখানে তোমার পাঠ শেষ হবে। (সহীহ আল জামে)

দুঃখজনক হলেও সত্য:

অধিকাংশ মুসলমানের ঘরে কুরআন তেলাওয়াত হয় না। কুরআনের কোন শিক্ষা পরিবারে নেই। বৈষয়িক উন্নতির জন্য জাগতিক পড়া-শোনায় আমরা এতটাই ব্যস্ত যে, মহান আল্লাহর কালাম কুরআনুল কারীম শেখার সময়ও আমাদের নেই। আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে স্কুল-কলেজে ভাল রেজাল্ট করানোর জন্য আমরা মরিয়া হয়ে উঠি। অথচ কুরআন শিক্ষা দেয়া, নামায-কালাম, পাক-নাপাকী ইত্যাদি শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে আমরা চরমভাবে উদাসিন। যার পরিণতিতে ছেলে-মেয়েরা আজ পিতা-মাতার অবাধ্য। নেশা, মারা-মারি, যেনা-ব্যভিচার, জুয়া, খুন-খারাবী ইত্যাদি জঘণ্য কাজে তারা জড়িয়ে পড়ছে।

তাই আসুন! পবিত্র রমযানুল মুবারকে কুরআনুল কারীম এর জন্য সময়টাকে আমরা উৎসর্গ করে দেই। যারা কুরআন পড়তে শেখেননি, তাদের উচিত পবিত্র এই রমযান মাসে কুরআন শরীফ শিখে নেয়া। মহান আল্লাহ কুরআন শেখাকে সহজ করেছেন। তিনি বলেন-

 وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ

 ‘অবশ্য অবশ্যই আমি কুরআনকে সহজ করেছি উপদেশ গ্রহণের জন্য। অতএব কোন উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি?’ {সূরা কামার, ২২}

মাহে রমযান এর মত পুতঃপবিত্র একটি মাসে আমাদের সকল ব্যস্ততা ফেলে রেখে কুরআনুল কারীম এর তেলাওয়াত, তাফসীর অধ্যায়ন, মুখস্তকরণ তথা কুরআন কেন্দ্রিক সময় কাটানো উচিত। অন্য সময়ের চাইতে কুরআন অধ্যয়নের জন্য রমযান মাসই হল শ্রেষ্ঠ উপযোগী একটি মাস। কেননা, কুরআন অবতীর্ণের মাস হল মাহে রমযান

Related Post