মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন আল্লাহর রাসূল। তিনি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। মানবজাতির সর্বোত্তম আদর্শ হিসেবে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে দুনিয়ায় প্রেরণ করেন। তিনি সব ক্ষেত্রে ছিলেন মানুষের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। শিশু-কিশোরদের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যধিক স্নেহপ্রবণ ও যত্নশীল। তিনি নিজের পুত্র-কন্যাদের যেমন আদর করতেন, অন্য শিশুদেরও তেমনি ভালোবাসতেন। শিশু-কিশোরদের প্রতি তিনি উত্তম আচরণ করতেন।
মহানবী সা: তিন পুত্রসন-ান ও চার কন্যাসন্তানের জনক ছিলেন। তাঁর প্রথম স্ত্রী উম্মুল মুমিনিন খাদিজাতুল কোবরা রা:-এর গর্ভে দুই পুত্র ও চার কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। পুত্র কাসিম রা: এবং আবদুল্লাহ রা: যথাক্রমে ‘তাইয়েব’ ও ‘তাহের’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁরা উভয়েই শৈশবস’ায় ইনে-কাল করেন। চার কন্যা জয়নব রা:, রুকাইয়া রা:, উম্মে কুলসুম রা: এবং ফাতিমা রা: তাঁরাও অধিক বয়স পর্যন- জীবিত ছিলেন না। কন্যাদের মধ্যে একমাত্র ফাতিমা রা: দুই পুত্রসন-ানের জন্ম দেন। তাঁরা রাসূলুল্লাহ সা:-এর অতি আদরের নাতি- ইমাম হাসান ও ইমাম হুসেইন রা:।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর তৃতীয় পুত্রের নাম ইবরাহিম রা:। তিনি মহানবী সা:-এর মিসরীয় স্ত্রী হজরত মারিয়া কিবতিয়া রা:-এর গর্ভজাত। তিনিও শৈশবকালে ইন্তেকাল করেন।
রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর চার কন্যাকে যথাযথভাবে লালন পালন করে উপযুক্ত বিয়ে-শাদীর ব্যবস’া করেন। স্ত্রীদের কাছে তিনি যেমন ছিলেন আদর্শ স্বামী, সন-ানসন-তির কাছেও তেমনি তিনি ছিলেন আদর্শ পিতা। অপত্য স্নেহ-মমতা, আদর-যত্ন ও সহৃদয়তাপূর্ণ আচার-আচরণ এবং সাহচর্যের কারণে তিনি তাঁর সন-ানসন-তির কাছে ছিলেন একান- স্নেহবৎসল, দরদি পিতা। শুধু নিজের ছেলেমেয়েই নয়, সাধারণভাবে সব শিশুর প্রতিই ছিল তাঁর ঐকানি-ক মমত্ববোধ। শিশুদের তিনি খুব আদর করতেন এবং অনেক সময় তাদের সাথে বিভিন্ন খেলাধুলায় শরিক হয়ে তাদের মাতিয়ে রাখতেন। শিশুরাও তাঁর মধুর সাহচর্য পেয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠত।
শিশুদের প্রতি মহানবী সা:-এর মধুর আচার-আচরণ যেমন ছিল মনোমুগ্ধকর, তেমনি তা সবার জন্য শিক্ষণীয় ও অনুরণীয়। শিশু-কিশোরদের প্রতি তাঁর আচার-আচরণ কিরূপ ছিল, তা দু-একটি ঘটনার উল্লেখ করলেই সুস্পষ্ট হবে।
একবার আবিসিনিয়া থেকে একদল সাহাবা মদিনায় তশরিফ আনলেন। তাঁদের সাথে তাঁদের পরিবার-পরিজন ও ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও ছিল। মহানবী সা: সমাগত ছেলেমেয়েদের সাথে একেবারে মিশে গেলেন। তাদের সাথে খেলাধুলা করলেন, এমনকি তাদের ভাষায় কথা বলারও চেষ্টা করলেন। এভাবে ছোট শিশু-কিশোরদের নানা আদর-যত্ন ও মিষ্টি কথাবার্তায় তিনি তাদের মন জয় করলেন।
মহানবী সা: যখন কোনো জিহাদের ময়দান থেকে ফেরত আসতেন, তখন মদিনার আপামর জনসাধারণ ও ছোট ছেলেমেয়েরা তাঁকে সাদর সম্ভাষণ জানানোর জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে আসত। মহানবী সা: তাদের সাদর-সম্ভাষণের জবাব দিতেন অত্যন- মার্জিত ও আন্তরিকতার সাথে। ভিড়ের মধ্য থেকে তিনি বিশেষভাবে ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে চলে যেতেন এবং তাদেরকে গভীর দরদ দিয়ে আদর করতেন। পালাক্রমে তাদের সবাইকে নিজের উটের পেছনে চড়িয়ে নিয়ে বেড়াতেন। ছেলেমেয়েরা এতে খুব আনন্দবোধ করত। মহানবীর সাথে তাঁর উটের সওয়ারি হতে পেরে তারা নিজেদের অনেক সম্মানী বোধ করত।
একদিন মহানবী সা: মসজিদের মিম্বরে খুতবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় দেখতে পেলেন, তাঁর দৌহিত্রদ্বয়- হাসান রা: ও হুসেইন রা: দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে তাঁদের পা পিছলে যাওয়ার উপক্রম। সাথে সাথে তিনি খুতবা বন্ধ করে মিম্বর থেকে নেমে গিয়ে দু’হাত বাড়িয়ে শিশু দু’টিকে সযত্নে কোলে তুলে নিয়ে তাঁদেরকে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করলেন। তারপর আবার মিম্বরে উঠে খুতবা দিতে লাগলেন।
অন্য আরেক দিনের ঘটনা। শিশু হাসান রা: ও হুসেইন রা: সিজদারত অবস’ায় নানার পিঠের ওপর সওয়ার হলেন। তাঁরা তাঁর পিঠ থেকে না নামা পর্যন- তিনি সিজদা থেকে উঠলেন না। ফলে সিজদা দীর্ঘায়িত হলো। নামাজ শেষে মুক্তাদিগণ জিজ্ঞাসা করলেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি আজ সিজদা বেশ দীর্ঘায়িত করলেন।’ তিনি জবাব দিলেন : আমার আওলাদগণ (নাতিদ্বয়) আমাকে সওয়ারি বানিয়েছে। তাই তাঁদের তাড়াতাড়ি নামিয়ে দেয়াটা আমার পছন্দ হয়নি।
মহানবী সা: কখনো নামায পড়া অবস’ায় শিশুদের কান্নার আওয়াজ শুনলে নামাজ সংক্ষিপ্ত করতেন। এ সম্পর্কে তাঁর একটি বিখ্যাত হাদিস : আমি নামাজ পড়তে শুরু করলে মন চায় দীর্ঘ করে নামাজ পড়ি। তারপর কোনো শিশুর কান্নার শব্দ ভেসে আসে কানে, তখন নামাজ সংক্ষিপ্ত করে ফেলি। কেননা লম্বা করে নামাজ পড়ে শিশুদের মায়েদের কষ্টে ফেলে দিই এটা আমি চাই না। (বুখারি শরিফ : আবু কাতাদাহ রা:)।
উল্লেখ্য, রাসূল সা:-এর জামানায় প্রাপ্তবয়স্কা সব নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পুরুষদের সথে মসজিদে জামাতের সাথে আদায় করতেন। মহানবী সা:-এর ইমামতিতে মহিলারা মসজিদের একপাশে ভিন্ন কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন। এভাবে ঈদের জামাতেও তারা শরিক হতেন।
মহানবী সা: মদিনায় হিজরত করার পর আনাস বিন মালিক রা:-কে তাঁর খাদিম হিসেবে গ্রহণ করেন। আনাস রা: তখন ছিলেন একজন কিশোর বালক। তিনি মহানবী সা:-এর ইনে-কাল পর্যন- দীর্ঘ দশ বছর তাঁর খেদমতে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি সব সময় মহানবীর খিদমত করার জন্য উদগ্রীব থাকতেন। তাঁর সাথে যুদ্ধক্ষেত্রেও গমন করেছেন। এ দীর্ঘ দশ বছরকাল একজন কিশোর বালকের প্রতি মহানবীর আচার-আচরণ কত সুন্দর ও অনন্যসাধারণ ছিল, তা হজরত আনাসের বিবরণ থেকে জানা যায়। আনাস রা: বলেন, আল্লাহর কসম, আমি তাঁর যতটা খেদমত করেছি, তিনি তাঁর চেয়ে অনেক বেশি আমার খেদমত করেছেন এবং দীর্ঘ দশ বছরে তিনি আমার কোনো কথা বা আচরণে কখনো বিরক্তি প্রকাশ করেননি। তিনি সর্বদাই ছিলেন আমার প্রতি অতিশয় সদয়।
হজরত আনাস বিন মালিক রা:-এর ছোট ভাই উমাইরকেও মহানবী সা: অত্যন- স্নেহ করতেন। উমাইরের একটি পোষা বুলবুল ছানা ছিল। একদিন বুলবুল ছানাটি মারা গেলে উমাইর স্বভাবতই খুব দুঃখভারাক্রান- হয়। এ খবর পেয়ে মহানবী সা: উমাইরকে সান-্বনা দেয়ার জন্য তার বাড়িতে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখেন, বালক উমাইরের ম্লান মুখে বিষণ্নতার ছাপ। কাছে গিয়ে তিনি উমাইরকে আদর করলেন। তারপর তার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য কবিতার ভাষায় বললেন :
‘ইয়া উমাইর
মা ফাআলান নুগাইর।’
অর্থাৎ, ‘হে উমাইর, তোমাকে যে
ফাঁকি দিলো নুগাইর (বুলবুল)।’
মহানবী সা:-এর মুখে এ ছোট দুই লাইনের কবিতা শুনে সাথে সাথে কিশোর উমাইরের বিষণ্ন মুখটি প্রসন্ন হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
রাসূল সা.-এর পালিত পুত্র যায়েদের বাপ-চাচা তাকে ফেরত নিতে আসলে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা সত্ত্বেও তিনি বাপ-চাচার সাথে যাননি। বরং পিতাকে উদ্দেশ্য করে যায়েদ বলেছিলেন, ‘আব্বাজান, আমি মহান ব্যক্তির অনন্য গুণাবলি সম্পর্কে অবগত, তাঁর সান্নিধ্যের বিনিময়ে দুনিয়ায় অন্য কোন সান্নিধ্য আমার কাম্য নয়।’
মহানবী সা: প্রায়ই শিশুদের কোলে-কাঁখে নিয়ে আদর করতেন, নানা মিষ্টি কথা বলে, চুমু খেয়ে তাদেরকে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করতেন। শিশুরাও তাঁর সান্নিধ্য পেয়ে অন্য সব কিছু ভুলে যেত। এমন প্রাণবন- ছিল শিশু-কিশোরদের প্রতি মহানবীর আচরণ।
শিশুদের লালন-পালন, পরিচর্যা ও গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মহানবী সা:-এর সযত্ন প্রয়াস ছিল অনুকরণীয়। তিনি বড়দের জন্য শিশুর জগৎকে বেহেশতের নিকটবর্তী একটি মনোরম উদ্যান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শিশুদের তিনি তুলনা করেছেন বেহেশতের বর্ণাঢ্য প্রজাপতির সাথে। প্রজাপতি তার রঙ-বেরঙের পাখনা মেলে যেমন মনের আনন্দে উড়ে বেড়ায়, ফুলে ফুলে মধুর সুগন্ধ খুঁজে বেড়ায়, শিশুরাও তেমনি বড়দের জন্য প্রজাপতির মতোই আনন্দ-চঞ্চল। প্রজাপতির সাথে শিশুদের এ তুলনা থেকে মহানবী সা: তাদেরকে কতটা সুন্দর ও আদরনীয় গণ্য করতেন তা বোঝা যায়।
শিশুদের সুন্দর জীবন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মহানবীর সা:-এর বাণী : ‘ছেলেমেয়েরা সাত বছর বয়সে পদার্পণ করলে তাদেরকে নামাজ পড়ার তাগিদ দাও। তারা দশ বছর বয়সে পদার্পণ করার পরেও যদি নামাজ না পড়ে, তাহলে তাদের নামাজ পড়তে বাধ্য কর এবং ছেলে ও মেয়েকে (ওই সময় থেকে) আলাদা বিছানায় শয়নের ব্যবস’া কর।’ (আবু দাউদ শরিফ : হজরত আমর বিন শুয়াইব রা: তিনি তাঁর পিতা থেকে এবং তাঁর পিতা তাঁর পিতা থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন)।
মহানবী সা: শিশু-কিশোরদের কতটা আদর-স্নেহ করতেন এবং তাদের কল্যাণ ও তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে বিকশিত করার লক্ষ্যে কতটা উদগ্রীব ছিলেন নিম্নোক্ত দু’টি হাদিস থেকে তা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায়। তিনি বলেন : ‘ওই ব্যক্তি আমার উম্মতের অন-র্ভুক্ত নয়, যে ছোট ছেলেমেয়েদের প্রতি সদয় নয়।’ দ্বিতীয় হাদিসটি আরো তাৎপর্যপূর্ণ। মহানবী সা: বলেন : ‘ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে এমন আচরণ কর যাতে তাদের মধ্যে আত্মসম্মান বোধ সৃষ্টি হয়।’
শিশুরাই মানবজাতির ভবিষ্যৎ। তাই তাদের আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমাদের সর্বতোভাবে সচেষ্ট থাকা একান- প্রয়োজন। এখানে ‘আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন’ শব্দটি অতিশয় তাৎপর্যপূর্ণ ও ব্যাপক অর্থবহ। এর দ্বারা শিশুর প্রকৃত মেধা ও অন-র্নিহিত সম্ভাবনার যথাযথ বিকাশও অন-র্ভুক্ত। মহানবী সা: শুধু উপদেশ দিয়েই ক্ষান- হতেন না, তিনি তাঁর কাজ ও আচরণের দ্বারা বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটাতেন। মহানবী সা: বলেছেন : ‘যারা ছোটদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে না এবং বড়দের সম্মান করে না তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (আবু দাউদ)।
কী মহান ব্যক্তিত্ব ও অতুলনীয় মহত্তম আদর্শ! জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন- মহানবী সা:-এর সব কথা, কাজ ও আচরণের সব পুঙ্খানুপঙ্খ বিবরণ নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত। ব্যক্তিগত জীবন থেকে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় তথা আন-র্জাতিক পর্যায় পর্যন- তাঁর সুমহান ব্যক্তিত্বের মধ্যে এতটুকু কালিমার চিহ্নমাত্র নেই। সব পর্যায়ে তিনি চিরকালীন মানবজাতির অতুলনীয় সর্বোত্তম আদর্শ। মানবজাতির ইতিহাসে তিনি সমুজ্জ্বল সূর্যের মতো প্রদীপ্ত। পূর্ণ চন্দ্রের মতো আলোকোদ্ভাসিত, সরোবরের মতো শান-স্নিগ্ধ, শিশির ফোঁটার মতো পবিত্র, ফুলের মতো পেলব, আর সৌরভপূর্ণ তাঁর অনন্য চির মহিমান্বিত জীবন। সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য তিনি মহান স্রষ্টার অশেষ রহমত ও অপরিসীম নিয়ামত। সমগ্র মানবজাতির জন্য তিনি চির সমুজ্জ্বল সর্বোত্তম আদর্শ। স্রষ্টা স্বয়ং তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করেন। তাই আমরাও পরম শ্রদ্ধাপ্লুত চিত্তে পড়ি : সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
==0==