সফর সম্পর্কে ইসলাম

সফর সম্পর্কে ইসলাম

সফর সম্পর্কে ইসলাম

মানুষ পৃথিবীতে ব্যক্তিগত ও পেশাগত কর্মব্যস্ততা, পারিবারিক ও সামাজিক দায়দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হয়ে পড়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত, অবসাদগ্রস্থ। নানা দুঃখ-কষ্ট, মানসিক অশান্তি, কর্মের একঘেয়েমিপূর্ণ এ জীবন ক্ষণিকের জন্য হলেও খানিকটা বিশ্রাম, একটু প্রশানি-, কিছুটা তৃপ্তি পেতে চায়। চোখ যেন খুঁজে পেতে চায় একটি ভিন্ন জগৎ। যেখানে আছে প্রকৃতির অপরূপ সাজ। পাখপাখালির কলরব। মন ভোলানো, চোখ জুড়ানো, হৃদয় কাড়া মনোরম পরিবেশ। বিষয়টি আমরা অনুধাবন করি আর না-ই করি; আমাদের মন-মসি-ষ্ক ঠিকই জীবনের এ কর্মব্যস-তার মাঝে মুক্তবিহঙ্গের মতো দূরে কোথাও যেতে চায়। নিজ গণ্ডি পেরিয়ে দূরে কোথাও ঘুরতে বা বেড়াতে যাওয়া মোটেও দোষণীয় নয়। বিখ্যাত হাদিসগ্রন’ সুনান আবু দাউদে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মরুভূমির বিভিন্ন প্রানে- ভ্রমণে বের হতেন। সাহাবায়েকিরামও মরুভূমিসহ বিভিন্ন স’ান পরিদর্শনে বের হতে ভালোবাসতেন মর্মে বর্ণনা পাওয়া যায়।
ভ্রমণ বলতে যা বোঝায় : ভ্রমণ শব্দের আরবি প্রতিশব্দ হলো ‘রিহলাহ’ ও ‘সাইর’। রিহলাহ অর্থ ভ্রমণ, ফ্লাইট ইত্যাদি। যেমন বলা হয় : গাদান রিহলাতুনা ‘আগামীকাল আমাদের ভ্রমণ বা ফ্লাইট।’ আর ‘সাইর’ অর্থ সফর করা, সন্তান ত্যাগ করা, ভ্রমণ করা, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া ইত্যাদি। তবে আল কুরআনে ভ্রমণের প্রতিশব্দ ‘সাইর’ ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন : হে রাসূল! আপনি [মানুষকে] বলুন, তোমরা পৃথিবীতে ‘সাইর’ [ভ্রমণ] করে দেখ অত্যাচারীদের পরিণতি কেমন হয়েছে [সূরা নামল : ৬৯]। প্রফেসর উসমান খালেদ ইউরিশ বলেন : সতর্কতার সাথে মন’র ও নিবিড় গতিতে সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত সত্যের সন্ধানে গমন করা, তত্ত্ব তালাশ করা, পরিণতি বিবেচনায় রেখে কাজ করা, চিন্তা করা এবং পুণ্য কাজকর্ম দ্বারা করণীয় সম্পর্কে ভিত্তি স্থাপন করা ইত্যাদি শব্দেরই ব্যাখ্যা হচ্ছে ‘সাইর’ বা ভ্রমণ। ভ্রমণ করা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। শুধু মানুষই নয়, পৃথিবীর সব কিছুই ভ্রমণরত অবস’ায় আছে। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র সদা-সর্বদা পরিভ্রমণ করছে নিজ নিজ কক্ষপথে।
ভ্রমণের ইতিহাস : মানব সভ্যতার মতো ভ্রমণের ইতিহাসও অতিপ্রাচীন। আদম আলাইহিস্ সালাম থেকে শুরু করে অদ্যাবধি ভ্রমণের ধারা অব্যাহত রয়েছে। মূলত সৌর জগৎসহ পৃথিবীর সব কিছুই ভ্রমণ করছে। আল্লাহতায়ালা বলেন : সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে আবর্তন করে। এটা পরাক্রমশালী আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ। চন্দ্রের জন্য আমি বিভিন্ন কক্ষপথ নির্ধারণ করেছি। অবশেষে তা পুরনো খেজুর শাখার অনুরূপ হয়ে যায়। সূর্য নাগাল পেতে পারে না চন্দ্রের এবং রাত্রি অগ্রে চলে না দিনের। মূলত প্রত্যেকেই শূন্যলোকে সাঁতার কেটে চলেছে। [সূরা ইয়াসিন, আয়াত : ৩৮-৪০]
পৃথিবীর আদি মানব আদম আলাইহিস সালাম ও তাঁর অর্ধাঙ্গিনীকে সৃষ্টি করার পর তাঁদের জান্নাতে যাওয়া, জান্নাত থেকে বের হওয়া, পৃথিবীর বিভিন্ন স’ানে ঘোরাঘুরির পর আরাফাতের ময়দানে উভয়ের একত্র হওয়ার ঘটনা ভ্রমণ ইতিহাসের প্রাথমিক রূপ হিসেবে গণ্য। পৃথিবীর আদি থেকে অদ্যাবধি ইতিহাসের পাতায় অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিত, নবী-রাসূলের নাম পাওয়া যায়, যাঁরা পৃথিবীর নানা প্রান-র ভ্রমণ করে ভ্রমণেতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
মূসা আলাইহিস সালাম জ্ঞান অন্বেষণের জন্য একজন সালিহ বান্দার সাথে ভ্রমণে বের হয়েছিলেন। এমনকি আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনীতেও আমরা দেখতে পাই, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত নির্দেশে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে ইয়াসরিবে [মদিনায়] হিজরত করেন। অতঃপর তারই নির্দেশে তিনি ইসরা ও মিরাজে গমন করেন। জ্ঞান অন্বেষণের জন্য তিনি ভ্রমণের প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন : ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণে রাস-ায় বের হবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে যাওয়ার পথ সহজ করে দেবেন।’ তিনি আরো বলেন : ‘তোমরা জ্ঞান অন্বেষণে বের হয়ে পড়ো, যদিও তা সুদূর চীন দেশে হয়।’
ভ্রমণ সাহিত্য ও ভ্রমণ ইতিহাস একটি চমকপ্রদ বিষয়। এতে সাধারণত পৃথিবীর অজানা-অচেনা ভৌগোলিক পরিবেশ, মানুষ, সমাজ ও সভ্যতার জীবন- বর্ণনা ও চিত্র তুলে ধরা হয়। তাই এটি পাঠকের মানসপটে নাড়া দেয় দারুণভাবে। মুসলিমদের মধ্যে সুলায়মান সায়রাফী, ইবন বতুতা, আলবেরুনি, আরবের হিরোডটাস নামে খ্যাত আল মাসউদি বিখ্যাত পর্যটক ও ভ্রমণ ইতিহাসবিদ হিসেবে বিশ্বনন্দিত। আধুনিককালে ‘হাওলাল আলাম ফি মিয়াতাইনি ইয়াওম’ [বিশ্বব্যাপী দুই শ’ দিন] গ্রনে’র লেখক আনিস মানসুর, ‘ফি বিলাদি কিসরা’ [কিসরার দেশে] গ্রন’ রচয়িতা তিউনিসীয় সাহিত্যিক আবদুল ওয়াহিদ, ‘মুযাক্কারাতুল আকতার আশ শাকিকাহ’ [ভ্রাতৃপ্রতিম আরব অঞ্চলের ডায়েরি] গ্রনে’র লেখক প্রখ্যাত আরব সাহিত্যিক কামিল আল্ কিলানি ভ্রমণ সাহিত্য রচনা করে খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেছেন।
ভ্রমণের উপকারিতা : বনজঙ্গলে, ফুল বাগানে, পার্কে ও দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করা নিছক কোনো বিষয় নয়। ঐতিহাসিকভাবে জানা যায়, যুগে যুগে আলিম-উলামা, মুসলিম মনীষীগণ আত্মিক প্রশান্তি ও জ্ঞান অন্বেষণের জন্য বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন। ভ্রমণের বহু উপকারিতা রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপকারিতা হলো :

০১. আত্মার প্রশানি- দান ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন;

০২. দেশের বিভিন্ন প্রান-র ও স্থান সম্পর্কে ধারণা লাভ;

০৩. মানুষের নানামুখী স্বভাব-চরিত্রের সাথে পরিচিত হওয়া;

০৪. নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন ও যোগ্যতার বিকাশ সাধন;

০৫. মুসলিম ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক শক্তিশালীকরণ;

০৬. সন্তানাদি প্রতিপালনে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের অভিজ্ঞতা অর্জন;

০৭. সর্বোপরি সৃষ্টিজগৎ সম্পর্কে নানামুখী জ্ঞান অর্জন ইত্যাদি।
ভ্রমণে করণীয় : একজন মুসলিমের জন্য ভ্রমণকালীন বেশ কিছু করণীয় রয়েছে। কুরআন-হাদিসের আলোকে এসব করণীয় হলো :

০১. দোয়া পড়ে ভ্রমণে বের হওয়া।

০২. ভ্রমণসঙ্গী তিনের অধিক হলে পরামর্শের ভিত্তিতে একজনকে আমির বানিয়ে তাকে অনুসরণ করা।

০৩. সকাল-সন্ধ্যার দোয়াসহ অন্যান্য দোয়া কালাম যথাসময়ে যথাস’ানে পড়া।

০৪. দূরের ভ্রমণে সালাত কসর করা।

০৫. অন্যান্য ফরজ-ওয়াজিব, হুকুম-আহকাম পালন করা।

০৬. যথাযথ পর্দা মেনে চলা।

০৭. সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কর্মসূচি গ্রহণ করা।

০৮. ভ্রমণ বা দর্শনীয় স্থানের আইন-কানুন মেনে চলা ইত্যাদি।

ভ্রমণে নিষিদ্ধ : ভ্রমণকালে একজন মুসলিমকে বেশ কিছু বিষয়ে সতর্ক হতে হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে ভ্রমণের নিষিদ্ধ বিষয়গুলো হলো :

০১. অশালীন, কুরুচিপূর্ণ ও দৈহিক আকৃতি প্রকাশ পায় এমন পোশাক পরিহার করা।

০২. গাইরি মাহরাম [যার সাথে বিবাহ বৈধ] এর সাথে ভ্রমণ না করা।

০৩. কোনো কিছুর অপচয় না করা।

০৪. হারাম ও নিষিদ্ধ পর্যায়ে পড়ে এমন কথাবার্তা ও আচার-আচরণ পরিহার করা।

০৫. জীবজন’, গাছপালা, ফুল-ফল বিনষ্ট না করা ইত্যাদি।

পরিশেষে বলা যায়, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে ভ্রমণ সম্পর্কে তার সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা তুলে ধরেছে। ভ্রমণ করে সৃষ্টিরাজি অবলোকনের মাধ্যমে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুধাবনের শিক্ষা গ্রহণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। আল্লাহ বলেন : ‘তোমরা ভ্রমণ করে তাঁর (আল্লাহর) অভিনব সৃষ্টিরাজি অবলোকন করো। [সূরা আনকাবুত : ২০] অন্য দিকে ভ্রমণ করে কাফির-মুশরিকদের করুণ পরিণতির দৃশ্য দেখে সঠিক পথের সন্ধানী হতেও নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন : তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করে দেখ মিথ্যাচারীদের পরিণতি কেমন হয়েছে? [সূরা আল আনআম : ১১]

Related Post