‘এটা দিয়েই তোমরা আমার কাফন বানাবে। বদরের যুদ্ধে এ যুব্বাটা পরেই কাফিরতের বিরুদ্ধে লড়েছিলাম। আমার ইচ্ছে আল্লাহর দরবারে এটা নিয়েই আমি উপস্থিত হই’। মৃত্যুর আগে হযরত সাদ (রা.) বহু সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও একটি পুরানো পশমী জুব্বা দেখিয়ে উপরিউক্ত অছিয়ত করে যান।
তাঁর নাম সা’দ। ডাকনাম আবূ ইসহাক। পরবর্তীতে তিনি সা’দ ইবন আবী ওয়াকক্কাস নামে পরিচিত হন। আব্বার নাম আবূ ওয়াক্কাস মালেক। মায়ের নাম হামনা। তাঁর বংশ তালিকা এ রকম- সা’দ ইবন মালেক, ইবনে ওয়াহব, ইবন আবদে মোনাফ, ইবন যোহর, ইবন নযর, ইবন কেনানা আল কারশী আযযোহারী। এ তথ্য মতে তিনি যোহরী গোত্রের লোক ছিলেন। রাসূল (সা.)-এর মাতা আমিনাও এ যোহরী গোত্রের ছিলেন। এদিক দিয়ে হরযত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাসূল (সা.)-এর মাতুল ছিলেন। অবশ্য রাসূল (সা.) বহু বারই একথা উল্লেখ করেছেন যে, ‘সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা.) আত্মীয়তার দিক দিয়ে আমার মামা হন’।
সা’দ (রা.) মাত্র ১৭ বছর বয়সে ইসলাম কবূল করেন। প্রথম খলীফা হযরত সিদ্দীকে আকবরের দাওয়াত পেয়ে সা’দ (রা.) রাসূল (সা.) নিকট হাজির হন এবং ইসলাম কবূল করেন। প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি একজন। তিনি নিজেকে তৃতীয় মুসলমান বলে দাবী করেছেন। তবে ঐতিহাসিকভাবে যেটা সত্য তা হলো তিনি ৭ম অথবা ৮ম ইসলাম গ্রহণকারী মুসলমান। যাহোক তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন এ সংবাদ তাঁর মায়ের কানে পৌঁছানো মাত্র তাঁর মা হামনা খুব হৈ-চৈ ও কান্নাকাটি শুরু করে দেন। এমনকি তিনি ঘোষণা দেন ‘সা’দ যতক্ষণ মুহাম্মদের রিসালাতের অস্বীকৃতি ঘোষণা না দেবে ততক্ষণ আমি কিছু খাবোনা, কিছু পান করবো না, রৌদ্র থেকে বাঁচার জন্য ছায়াতেও আসবো না। মার আনুগত্যের হুকুম তো আল্লাহও দিয়েছেন। আমার কথা না শুনলে অবাধ্য বলে বিবেচিত হবে এবং মার সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকবে না’।
মাতৃভক্ত সা’দ তাঁর মায়ের এহেন ঘোষণায় খুব অস্থির হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি রাসূল (সা.)-এর খেদমতে হাযির হয়ে সব ঘটনা খুলে বললেন। রাসূল (সা.) জবাব দেওয়ার পূর্বেই আল্লাহ রব্বুল আলামীন সূরা আনকাবুতের ৮৯ নং আয়াতটি নাযিল করেন, ‘আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতামাতার প্রতি ভালো ব্যবহার করতে। তবে তারা যদি তোমার ওপর বল প্রয়োগ করে, আমার সাথে এমন কিছু শরীক করতে বলে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তুমি তাদের আদেশ অমান্য করো’।
এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর সা’দ (রা.)-এর চিত্ত চাঞ্চল্য কমে এলো। তিনি তাঁর মাকে বার বার বুঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁর মা কোন কথাই শুনলেন না- তিন দিন তিনি তার সিদ্ধান্তের ওপরে অটল থাকার পর সা’দ (রা.) বাধ্য হয়ে তাঁর মাকে জানিয়ে দিলেন, ‘মা তোমার মতো হাজারো মা যদি আমার ইসলাম ত্যাগ করার জন্য জিদ ধরে পানাহার ছেড়ে দেয় এবং মৃত্যুবরণ করে, তবুও যে সত্য দ্বীনকে বুঝে শুনে গ্রহণ করেছি, তা ত্যাগ করা সম্ভব নয়’। এ সত্য কথাগুলো শুনার পর সা’দ (রা)-এর মায়ের মন ক্রমান্বয়ে ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং এক পর্যায়ে তিনি মুসলমান হন। সা’দের পিতা আবী ওয়াক্কাসও মুসলমান হয়ে ছিলেন।
ইসলামের প্রথম যুগে যাঁরা ইসলাম কবুল করেছিলেন তাঁরা প্রথম প্রথম গোপনে ইসলাম পালন করতেন। নবুয়াতের তৃতীয় বছরে সুলাইম গোত্রের নওমুসলিম আমর ইবন আব্বাস শিয়াবে আবূ তালিবের এক কোনে সালাত আদায় করছিলেন। কিন্তু কোরাইশরা এ দৃশ্য দেখে ফেলে এবং তাঁর প্রতি পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। এহেন পরিস্থিতিতে হযরত সা’দসহ দু’একজন মুসলমানও এগিয়ে আসেন ও তাদের আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানান। কথা কাটাকাটি হতে হতে একপর্যায়ে তা হাতাহাতিতে রূপ নেয়। এ সময় হযরত সা’দ (রা.) পাশে পড়ে থাকা উটের এক খণ্ড হাড় তুলে নিয়ে একজন কাফিরকে মনমত পিটুনী দেন। এতে লোকটির শরীর তো রক্তাক্ত হয়ই, সাথে সাথে মাথাও যায় ফেটে। সত্যি বলতে কি এটাই ছিলো ইসলামের জন্য প্রথম রক্তপাত, যা হযরত সা’দ (সা.)-এর হাতেই ঘটেছিলো।
কোরাইশদের অত্যাচারে মক্কায় টিকতে না পেরে মুসলমানরা মদীনায় হিজরত করা শুরু করলে প্রথম মদীনায় পৌঁছান মুসয়াব ইবন উমাইর ও ইবন উম্মে মাকতূম (রা.)। এরপর চারজনের একটি ক্ষুদ্র কাফেলা মদীনায় গমন করে। এদের মধ্যে ছিলেন সা’দ (রা.)। এ ব্যাপারে হযরত বারা ইবন আযিব (রা.) বলেন, ‘সর্ব প্রথম আমাদের নিকট আগমন করেন মুসয়াব ইবন উমাইর ও ইবন উম্মে মাকতুম (রা.)। এ দু’ব্যক্তি মদীনাবাসীদের কুরআন শিক্ষা দিতেন। অতপর বিলাল, সা’দ ও আমার বিন ইয়াসির (রা.) আগমন করেন’। অন্য এক বর্ণনা মতে জানা যায় যে সা’দ (রা.) এর সাথে তাঁর ভাই উমাইরও হিজরত করেন। জানা যায় তাঁরা মদীনায় এসে পূর্বেই মদীনায় অবস্থানকারী তাঁদের অন্য এক ভাই উতবা ইবন আবী ওয়াক্কাসের বাড়িতে উঠেন এবং সেখানেই অবস্থান করেন। উমাইর (রা.) প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম একজন।
মুসলমানগণ মদীনায় হিজরত করার পরও কোরাইশদের আক্রমণের আশঙ্কা থেকে দূরে থাকতে পারলেন না। বরং সর্বদা তাদেরকে সচেতন থাকতে হতো কখন তারা আক্রমণ করে বসে। সে জন্য রাসূল (সা.) কোরাইশদের গতি বিধি লক্ষ্য রাখতে হযরত আবদ ইবনুল হারেসের নেতৃত্বে ষাট থেকে আশি জন অশ্বারোহী প্রেরণ করেন। এ দলে হযরত সা’দ (রা.) ছিলেন। এক পর্যায়ে তারা যখন হেযাযের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় গিয়ে পৌঁছায় তখন একদল কোরাইশ বংশীয় মুশরিকের দেখা পান। যেহেতু মুসলমানরা শুধু অবস্থা জানার জন্য ঘুরে ফিরছিলেন তাই কোন যুদ্ধ হলো না। কিন্তু হযরত সা’দ (রা.) উত্তেজিত হয়ে মুশরিকদের লক্ষ্য করে তীর চালনা করেন। এ তীরই আল্লাহর রাস্তায় চালানো সর্বপ্রথম তীর, যা সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাসের হাত হতে চালানো হয়েছিলো।
স্বয়ং রাসূলের (সা.) নেতৃত্বে হিজরী দ্বিতীয় সনের রবিউসসানী মাসে কোরাইশদের গতি বিধি লক্ষ্য রাখতে দুশো সাহাবীর একটি দল মদীনা থেকে বের হন। এ দলের পতাকাবাহী ছিলেন হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা.)। এবার বাওয়াত নামক স্থানে ছোট ধরনের একটি সংঘর্ষ হয়।
রাসূল (সা.) বদর যুদ্ধে দু’একদিন আগে কুরাইশদের অবস্থা জানার জন্য যে ক্ষুদ্র দলটি প্রেরণ করেন হযরত সা’দ (রা.) তাঁদের মধ্যে ছিলেন। দলটি ক্ষুদ্র হলেও এরা কুরাইশদের দু’জন চরকে গ্রেফতার করে রাসূল (সা.)-এর কাছে আনেন। রাসূল (সা.) গুপ্তচরদ্বয়ের নিকট হতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেন।
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ হচ্ছে বদরের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে হযরত সা’দ (রা.) ও তাঁর ভাই হযরত উমাইর (রা.) অসম্ভব সাহসিকতার সাথে লড়াই করেন। হযরত উমাইর (রা.) এ যুদ্ধে শহীদ হন। হযরত সা’দ (রা.) সরদার সাঈদ ইবনুল আসকে হত্যা করেন। সাঈদের একটি চমৎকার তরবারি ছিলো, যা হযরত সা’দ (রা)-এর পছন্দ হয়। যুদ্ধের পর তরবারি খানা তিনি রাসূল (সা.)-এর নিকট আনেন এবং নিজে পাওয়ার আকাঙ্খা পেশ করেন। কিন্তু তখনও গণিমতের মাল সম্পর্কে আল্লাহর কোন নির্দেশ না আসাতে সা’দকে বিমুখ হতে হয়। হযরত সা’দ (রা.) ফিরে যেতে যেতে সূর আনফাল নাযিল হয়। সাথেসাথে রাসূল (সা.) সা’দকে ডেকে বললেন, ‘তোমার তলোয়ার নিয়ে যাও’।
ওহুদের যুদ্ধের সেই বিভিষীকাময় পরিস্থিতিতে যে সমস্ত সৈনিক সাহাবা নবীজীকে হেফাজত করার জন্য তাঁকে ঘিরে ব্যূহ রচনা করেছিলেন, নিজেদের জানকে বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন, হযরত সা’দ (রা.) ছিলেন তাঁদেরই একজন। এ ব্যাপারে তিনি নিজেই বলেছেন।
‘ওহুদের দিন রাসূল (সা.) তাঁর তূণীর আমার সামনে ছড়িয়ে দিলেন এবং বললেন, ‘তীর মারো! আরও মারো। আমার মা বাবা তোমার প্রতি কুরবান হোক’।
ওহুদের যুদ্ধে সা’দ (রা.)-এর ভাই হযরত উমাইর শহীদ হলেও অপর ভাই পাপিষ্ঠ উতবার ছুড়ে দেওয়া পাথরের আঘাতেই মহানবীর মুখমণ্ডল আহত হয়। এমন কি দাঁত শহীদ হয়। তারপর থেকে সা’দ (রা.) প্রায়ই বলতেন, ‘কাফিরদের অন্য কাউকে হত্যার এত প্রবল আকাঙ্ক্ষা আমার ছিল না, যেমন ছিলো উতবার ব্যাপারে। কিন্তু যখন আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনলাম, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলের (সা.) চেহারা রক্ত রঞ্জিত করেছে, তার ওপর আল্লাহর গজব আপতিত হবে, তখন তার হত্যার আকাঙ্খা আমার নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং অন্তরে প্রশান্তি নেমে আসে’।
ওহুদের যুদ্ধের ঐ বিপদের মধ্যেও একটি দৃশ্য দেখে রাসূল (সা.) হেসেছিলেন। জনৈক মুশরিক বীরবিক্রমে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছিলো। এক সময়ে রাসূল (সা.) সা’দ (রা.) কে পাল্টা আক্রমণের হুকুম দিলেন, কিন্তু এ সময়ে একটি অকেজো তীর ছাড়া সা’দের নিকট আর কিছুই ছিলো না। অগত্যা ঐ তীর দিয়েই সা’দ (রা.) মুশরিককে আক্রমণ করলেন। সা’দ (রা)-এর নিশানা ছিল অব্যর্থ। তীরটি মুশরিক সৈনিকটির কপালে বিদ্ধ হতেই সে ভীষণভাবে দিশেহারা হয়ে উলঙ্গ অবস্থায় নিচে পড়ে গেলো। এ অবস্থা দেখে রাসূল (সা.) হেসেছিলেন।
বদর যুদ্ধ থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত সব যুদ্ধ গুলোতেই অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে সা’দ (রা.) অংশ গ্রহণ করেন। মক্কা বিজয়ের পর হুনাইন, তায়েফ ও তাবুকের যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন।
হযরত সা’দ (রা.) নিজের জীবনের চেয়ে নবী (সা.)-এর ভালমন্দের প্রতি গুরুত্ব দিতেন বেশি। খন্দকের যুদ্ধের সময় সালা পর্বতের উপত্যকার এক তাবুতে রাসূল (সা.) অবস্থান করছিলেন। কোন এক রাতে ভীষণ ঠাণ্ডা পড়তে থাকে, এমন সময় রাসূল (সা.) অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে? উত্তর এলো, ‘সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস’। কি ব্যাপার! কেনো এসেছো? বললেন, ‘সা’দের হাজার জীবন অপেক্ষা আল্লাহর রাসূল (সা.) হচ্ছেন তার প্রিয়তম। এ অন্ধকার ঠাণ্ডা রাতে আপনার ব্যাপারে আমার ভয় হলো। তাই পাহারার জন্য হাজির হয়েছি’। রাসূল (সা.) বললেন, সা’দ আমার চোখ খোলা ছিলো। আমি আশা করছিলাম আজ যদি কোন নেক্কার বান্দা আমার হিফাজত করতো’।
রাসূল (সা.) বিভিন্ন সময়ে হযরত সা’দ (রা)-এর জন্য দোয়া করেছেন। বিদায় হজ্বের সময়ে তিনি দারুণ ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি জীবনের আশঙ্কা করছিলেন। এমতাবস্থায় রাসূল (সা.) একদিন তাঁর কপালে, বুকে ও পেটে হাত বুলিয়ে এ দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি সা’দকে শিফা দান করুন, তাঁর হিজরতকে পূর্ণতা দান করুন’। অর্থাৎ হিজরতের স্থান মদীনাতেই তাঁর মৃত্যু দান করুন। আবূ ওবাইদা ও মুসান্নার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী পারস্যের কিসরা বাহিনীকে পরাজিত করে ইরাক দখল করে নিলে কিসরা বাহিনী মহাবীর রুস্তমের নেতৃত্বে পুনরায় একত্রিত হয়ে মুসলমানদের ওপর আঘাত হানার প্রস্তুতি নেয়। হযরত ওমর (রা.) এ সংবাদ পেয়ে নিজেই মুসান্নাকে সাহায্যের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন কিন্তু মজলিসে শূরা খলীফার সিদ্ধান্ত অনুমোদন না করায় সর্বসম্মতিক্রমে হযরত সা’দ (রা.) কে সেনাপতি করে পাঠান হয়। সা’দ (রা)-এর রণকৌশল এত নিপূণ ছিলো যে, এ যুদ্ধে বিশাল পারস্য বাহিনী সর্বদিক থেকে ভীষণভাবে নাকানী চুবানী খায় এবং মুসলিম বাহিনীর কাছে পরাস্ত হয়।
মুসলিম বাহিনী যখন পারস্য বাহিনীকে এক এক করে পরাস্ত করছিলো তখন সা’দ (রা)-এর নিকট খবর আসলো শাহানশাহ ইয়াজদিগিরদ রাজধানী থেকে মূল্যবান সমস্ত সম্পদ সরিয়ে নিচ্ছেন। এ সংবাদে দেরী না করে সা’দ (রা.) মাদায়েনের দিকে রওনা হলেন। কিন্তু ইরানীরা পূর্বেই দজলা নদীর পুলটি ধ্বংস করে দিয়েছিলো। এখানে এসে মুসলিম বাহিনী থমকে দাঁড়ালো। এ সময়ে সা’দ (রা.) সৈন্য বাহিনীর উদ্দেশ্যে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। ভাষণ শেষ করেই তিনি নিজের ঘোড়াসহ উত্তাল দজলা মাঝে নেমে পড়েন, দেখাদেখি মুসলিম বাহিনীও তাঁর অনুসরণ করে। তাঁরা নদী পার হয়ে ওপারে উঠলে- ইরানী বাহিনী এ দৃশ্য দেখে ভয়ে চিৎকার করতে লাগলো, ‘দৈত্য আসছে, দানব আসছে, পালাও পালাও’।
সা’দবাহিনীর এ আকস্মিক আক্রমণে বাদশাহ সমস্ত ধন সম্পদ ফেলে হালওয়ানে পালিয়ে গেলো। সা’দ (রা.) রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে আল্লাহর শোকর আদায় করার উদ্দেশ্যে আট রাকাত সালাতুল ফাতহ আদায় করলেন। ঐদিন ছিলো শুক্রবার, তাই সা’দ (রা.) বললেন, ‘আজ এ প্রাসাদেই জুম’আর সালাত আদায় করা হবে’। সেই অনুযায়ী মিম্বর তৈরী করে সত্যি সত্যিই জুম’আর সালাত অনুষ্ঠিত হয়। এটাই পারস্যের মাটিতে প্রথম জুম’আর সালাত। পরবর্তীতে হযরত সা’দ (রা.) পারস্যের মাটিতে প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি কুফার গভর্ণরও হয়েছিলেন।
হযরত ওসমান যখন বিদ্রোহীদের দ্বারা আক্রান্ত হন তখন সা’দই (রা.) তাঁকে রক্ষার জন্য সর্ব প্রথম এগিয়ে আসেন। হযরত ওসমান (রা.) শহীদ হওয়ার পর যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় সা’দ (রা.) নিজেকে তা থেকে দূরে রাখেন। তিনি সিফফিন ও জংগে জামাল কোনো যুদ্ধেই অংশ গ্রহণ করেননি। আসলে তিনি ছিলেন অসম্ভব শান্তিপ্রিয় মানুষ। এমন কি একবার তিনি তাঁর পুত্রকে আসতে দেখে বললেন আল্লাহ এ অশ্বারোহীর অনিষ্ট থেকে আমাকে রক্ষা করুন। ছেলে যখন এসে বললো, ‘আপনি উট ও ছাগলের মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন, অথচ এদিকে লোকেরা রাষ্ট্রীয় ঝগড়ায় লিপ্ত’। সা’দ (রা.) পুত্র উমার (রা.)-এর বুকে হাত রেখে বললেন, ‘চুপ করো, আমি রাসূলকে (সা.) বলতে শুনেছি, আল্লাহ ভালবাসেন নির্জনবাসী, মুত্তাকী এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় যে মানুষের রাগাবিরাগের পরোয়া করে না তাকে’।
পঁচাশি বছর বয়সে মদীনা থেকে দশমাইল দূরবর্তী আকীক উপত্যকায় তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালটা ছিল হিজরী ৫৫ সন। মদীনার সে সময়কার গভর্নর মারওয়ান তাঁর নামাযে জানাজা পড়ান। মৃত্যুকালে হযরত সা’দ (রা)-এর অছিয়ত মুতাবেক বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকালীন পরিহিত পুরানো জুব্বাটি দিয়েই তাঁর কাফন তৈরী করা হয়। যা প্রথমেই উল্লেখ করেছি।
হযরত সা’দ (রা)-এর নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস এতো গভীর ছিলোযে, মৃত্যুকালীন সময়ে তাঁর পুত্র মুসয়াবের চোখে পানি দেখে তিনি বললেন, ‘আমার জন্য কেঁদোনা। আল্লাহ কক্ষণো আমাকে শাস্তি দেবেন না, আমি জান্নাতবাসী। আল্লাহ মু’মিনদেরকে তাদের সৎকাজের প্রতিদান দেবেন এবং কাফিরদের সৎকাজের বিনিময়ে তাদের শাস্তি লাঘবন করবেন’।
হযরত সা’দ (রা.) অত্যন্ত মর্যাদাবান একজন সাহাবা ছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদাসহ অন্যান্যা সাহাবারাও তাকে অত্যন্ত সমীহ করে চলতেন। একবার একটি হাদীসের ব্যাপারে হযরত ওমর (রা.)-এর ছেলে হযরত আবদুল্লাহ তাঁর আব্বার কাছে জানতে চাইলে, পিতা ওমর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন হাদীসটি হযরত সা’দ (রা.) বর্ণনা করেছেন কি না, আবদুল্লাহ (রা.) বললেন, ‘হা’। তখন ওমর (রা.) বললেন, ‘সা’দ যখন তোমাদের নিকট কোন হাদীস বর্ণনা করেন তখন সে সম্পর্কে কারো কাছে কিছু জিজ্ঞেস করবে না’।
বিলাল (রা.)-এর অনুপস্থিতিতে তিন বার হযরত সা’দ (রা.) আযান দেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। এমনকি রাসূল (সা.) নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘বিলালকে আমার সাথে না দেখলে তুমি আযান দেবে’।
প্রভূত সম্পদের মালিক হযরত সা’দ (রা.) অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। অবশ্য প্রথম জীবনে তিনি দরিদ্র লোক ছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমরা রাসূল (সা.)-এর সাথে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতাম, অথচ তখন গাছের পাতা ছাড়া আমাদের খাওয়ার কিছুই থাকতো না। গাছের পাতা খাওয়ার ফলে আমাদের বিষ্ঠা হতো উট ছাগলের বিষ্ঠার মতো’। কাব্য সাহিত্যের প্রতি হযরত সা’দ (রা)-এর প্রচণ্ড আকর্ষণ ছিলো। তিনি কবিতা রচনা করেছেন বলেও প্রমাণ মিলে। প্রাচীন বই পত্রে তাঁর কিছু কবিতা সংকলিত পাওয়া যায়।
এ অসম্ভব প্রতিভাধর ঈমানদার বুজর্গ সাহাবী ছিলেন ঐ সৌভাগ্যবান দশজন সাহাবীর একজন যাঁরা জীবিত থাকতেই বেহেশতের খোশ খবর পেয়েছিলেন।