কুফরের তাৎপর্য
যে মানুষের কথা উপরে বলা হলো, তার মুকাবিলায় রয়েছে আর এক শ্রেনীর মানুষ। সে মুসলিম হয়েই পয়দা হয়েছে এবং না জেনে, না বুঝে জীবনভর মুসলিম হয়েই থেকেছে। কিন্তু নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সে আল্লাহকে চেনেনি এবং নিজের নির্বাচন ক্ষমতার সীমানার মধ্যে সে আল্লাহর আনুগত্য করতে অস্বীকার করেছে। এ ধরনের লোক হচ্ছে কাফের। ‘কুফর’ শব্দটির আসল অর্থ হচ্ছে কোন কিছু ঢেকে রাখা বা গোপন করা। এ ধরনের লোকে ‘কাফের’ (গোপনকারী) বলা হয়, কারণ সে তার আপন স্বভাবের উপর ফেলেছে অজ্ঞতার পন্দা। সে পয়দা হয়েছে ইসলামী স্বভাব নিয়ে। তার সারা দেহ ও দেহের প্রতিটি অংগ কাজ করে যাচ্ছে ইসলামী স্বভাবেরই উপর তার পারিপার্শ্বিক সারা দুনিয়ার এবং তার নিজের সহজাত প্রকৃতি সরে গেছে তার দৃষ্টি থেকে। সে এ প্রকৃতির বিপরীত চিন্তা করেছে। তার বিপরীতমুখী হয়ে চলবার চেষ্টা করেছে।
এখন বুঝা গেল, যে মানুষ কাফের, সে কত বড় বিভ্রান্তিতে ডুবে আছে।
কুফরের অনিষ্টকারিতা
কুফর’ হচ্ছে এক ধরনের মূর্খতা, বরং কুফরই হচ্ছে আসল মূর্খতা। মানুষ আল্লাহকে না চিনে অজ্ঞ হয়ে থাকলে তার চায়ে বড় মূর্খতা আর কি হতে পারে? এক ব্যক্তি দিন-রাত দেখেছে, সৃষ্টির এত বড় বিরাট কারখানা চলেছে, অথচ সে জানে না, কে এ কারখানার স্রষ্টা ও চালক। কে সে কারিগর, যিনি কয়লা, লোহা, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম ও আরো কয়েকটি পদার্থ মিলিয়ে অস্তিত্বে এনেছেন মানুষের মত অসংখ্য অতুলনীয় সৃষ্টিকে? মানুষ দুনিয়ার চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে পাচ্ছে এমন সব বস্তু ও কার্যকলাপ, যার ভিতরে রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিতবিদ্যা, রসায়ন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অপূর্ব পূর্ণতার নিদর্শন; কিন্তু সে জানে না, অসাধারণ সীমাহীন জ্ঞান- বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ কোন্ সে সত্তা চালিয়ে যাচ্ছেন সৃস্টির এসব কার্যকলাপ। ভাবা দরকার যে মানুষ জ্ঞানের প্রাথমিক স্তরের খবরও জানে না, কি করে তার দৃষ্টির সামনে উম্মুক্ত হবে সত্যিকার জ্ঞানের তোরণদ্বার? যতই চিন্তা-ভাবনা করুক, যতই অনুসন্ধান করুক, সে কোন দিকেই পাবে না সরল- সঠিক নির্ভরযোগ্য পথ, কেননা তার প্রচেষ্টার প্রারম্ভ ও সমাপ্তি সব স্তরেই দেখা যাবে অজ্ঞতার অন্ধকার।
কুফর একটি যুলুম, বরং সবচেয়ে বড় যুলুমই হচ্ছে এ কুফর। যুলুম কাকে বলে? যুলুম হচ্ছে কোন জিনিস থেকে তার সহজাত প্রকৃতির খেলাপ কাজ যবরদস্তি করে আদায় করে নেয়া? আগেই জানা গেছে যে, দুনিয়ায় যত জিনিস রয়েছে, সবাই আল্লাহর ফরমানের অনুসারী এবং তাদের সহজাত প্রকৃতি (ফিতরাত) হচ্ছে ‘ইসলাম’ অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের আনুগত্য। মানুষের দেহ ও তার প্রত্যেকটি অংশ এ প্রকৃতির উপর জন্ম নিয়েছে। অবশ্যি আল্লাহ এসব জিনিসকে পরিচালনা করবার কিছুটা স্বাধীনতা মানুষকে দিয়েছেন, কিন্তু প্রত্যেকটি জিনিসের সহজাত প্রকৃতির দাবী হচ্ছে এই যে, আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে যেন কাজে লাগানো হয়। কিন্তু যে ব্যক্তি ‘কুফর’ করছে সে তাকে লাগাচ্ছে তার প্রকৃতি বিরোধী কাজে। সে নিজের দিলের মধ্যে অপরের শ্রেষ্ঠত্ব, প্রেম ও ভীতি পোষণ করছে অথচ তার দিলের প্রকৃতি দাবী করছে যে, সে তার মধ্যে একমাত্র আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রেম ও ভীতি পোষণ করবে। সে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আর দুনিয়ায় তার আধিপত্যের অধীন সব জিনিসকে কাজে লাগাচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছা বিরোধী উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, অথচ তাদের প্রকৃতির দাবী হচ্ছে তাদের কাছ থেকে আল্লাহর বিধান মুতাবিক কাজ আদায় করা। এমনি করে যে লোক জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রত্যেকটি জিনিসের উপর এমন কি, নিজের অস্তিত্বের উপর ক্রমাগত যুলুম করে যাচ্ছে, তার চেয়ে বড় যালেম আর কে হতে পারে?
‘কুফর’ কেবল যুলুমই নয়, বিদ্রোহ, অকৃতজ্ঞতা ও নেমকহারামিও বটে। ভেবে দেখা যাক, মানুষের আপন বলতে কি জিনিস আছে। নিজের মস্তিষ্ক সে নিজেই পয়দা করে নিয়েছে না আল্লাহ পয়দা করেছেন? নিজের দিল, চোখ, জিভ, হাত-পা, আর সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবকিছুর স্রষ্টা মানুষ না আল্লাহ? তার চারপাশে যত জিনিস রয়েছে, তার স্রষ্টা মানুষ না আল্লাহ এসব জিনিস মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ও কার্যকরী করে তৈরী করা এবং মানুষকে তা কাজে লাগাবার শক্তি দান করা কি মানুষের নিজের না আল্লাহর কাজ? সকলেই বলবে, আল্লাহরই এসব জিনিস, তিনিই এগুলো পয়দা করেছেন, তিনিই সব কিছুর মালিক এবং আল্লাহর দান হিসেবেই মানুষ আধিপত্য লাভ করেছে এসব জিনিসের উপর। আসল ব্যাপার যখন এই, তখন যে লোক আল্লাহর দেয়া মস্তিষ্ক থেকে আল্লাহরই ইচ্ছার বিপরীত চিন্তা করার সুবিধা আদায় করে নেয়, তার চেয়ে বড় বিদ্রোহী আর কে? আল্লাহ তাকে চোখ, জিভ, হাত-পা, এবং আরো কত জিনিস দান করেছেন, তা সবকিছুই সে ব্যবহার করেছে আল্লাহর পছন্দ ও ইচ্ছা বিরোধী কাজে। যদি কোন ভৃত্ব তার মনিবের নেমক খেয়ে তার বিশ্বাসের প্রতিকূল কাজ করে যায়, তবে তাকে সকলেই বলবে নেমকহারাম। কোন সরকারী অফিসার যদি সরকারের দেয়া ক্ষমতা সরকারের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে থাকে, তাকে বলা হবে বিদ্রোহী। যদি কোন ব্যক্তি তার উপকারী বন্ধুর সাথে প্রতারণা করে সকলেই বিনা দ্বিধায় তাকে বলবে অকৃতজ্ঞ। কিন্তু মানুষের সাথে মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা ও অকৃতজ্ঞতার বাস্তবতা কতখানি? মানুষ মানুষকে আহার দিচ্ছে কোত্থেকে? সে তো আল্লাহরই দেয়া আহার। সরকার তার কর্মচারীদেরকে যে ক্ষমতা অর্পণ করে, সে ক্ষমতা এলো কোত্থেকে? আল্লাহই তো তাকে রাজ্য পরিচালনার শক্তি দিয়েছেন। কোন উপকারী ব্যক্তি অপরের উপকার করছে কোত্থেকে? সবকিছুই তো আল্লাহর দান। মানুষের উপর সবচেয়ে বড় হক বাপ-মার অন্তরে সন্তান বাৎসল্য উৎসারিত করেছেন কে? মায়ের বুকে স্তন দান করেছেন কে? বাপের অন্তরে কে এমন মনোভাব সঞ্চার করেছেন, যার ফলে তিনি নিজের কঠিন মেহনতের ধন সানন্দে একটা নিষ্ক্রিয় মাংসপিন্ডের জন্য লুটিয়ে দিচ্ছেন এবং তার লালন-পালন ও শিক্ষার জন্য নিজের সময়, অর্থ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কুরবান করে দিচ্ছেন? যে আল্লাহ মানুষের আসল কল্যাণকারী, প্রকৃত বাদশাহ, সবার বড় পরওয়ারদিগার, মানুষ যদি তার প্রতি অবিশ্বাস পোষণ করে, তাকে আল্লাহ বলে না মানে, তার দাসত্ব অস্বীকার করে, আর তার আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার চেয়ে গুরুতর বিদ্রোহ, অকৃতজ্ঞতা ও নেমকহারামী আর কি হতে পারে।
কখনো মনে করা যেতে পারে না যে, কুফরি করে মানুষ আল্লাহর কোন অনিষ্ট করতে পারছে। যে বাদশাহর সাম্রাজ্য এত বিপুল-বিরাট যে, বৃহত্তম দূরবীন লাগয়েও আমরা আজো স্থির করতে পারিনি কোথায় তার শুরু আর কোথায় শেষ। যে বাদশাহ এমন প্রবল প্রতাপশালী যে, তার ইশারায় আমাদের এ পৃথিবী, সূর্য, মঙ্গলগ্রহ এবং আরো কোটি কোটি গ্রহ-উপগ্রহ বলের মতো চক্রাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যে বাদশাহ এমন অফুরন্ত সম্পদশালী যে, সারা সৃষ্টির আধিপত্যে কেউ তার অংশীদার নেই, যে বাদশাহ এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল যে, সবকিছুই তার মুখাপেক্ষী অথচ তিনি কারুর মুখাপেক্ষী নন, মানুষের এমন কি অস্তিত্ব আছে যে তাকে মেনে বা না মেনে সেই বাদশাহর কোন অনিষ্ট করবে? কুফর ও বিদ্রোহের পথ ধরে মানুষ তার কোন ক্ষতি করতে পারে না, বরং নিজেই নিজের ধ্বংসের পথ খোলাসা করে।
কুফর ও নাফরমানীর অবশ্যম্ভাবী ফল হচ্ছে এই যে, এর ফলে মানুষ চিরকালের জন্য ব্যর্থ ও হতাশ হয়ে যায়। এ ধরনের লোক জ্ঞানের সহজ পথ কখনো পাবে না, কারণ যে জ্ঞান আপন ¯্রষ্টাকে জানে না, তার পক্ষে আর কোন জিনিসের সত্যিকার পরিচয় লাভ অসম্ভব। তার বুদ্ধি সর্বদা চালিত হয় বাঁকা পথ ধরে, কারণ সে তার ¯্রষ্টার পরিচয় লাভ করতে গিয়ে ভুল করে, আর কোন জিনিসকেও সে বুঝতে পারে না নির্ভুলভাবে। নিজের জীবনের প্রত্যেকটি কার্যকলাপে তার ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা অবধারিত। তার নীতিবোধ, তার কৃষ্টি, তার সমাজ ব্যবস্থা, তার জীবিকা অর্জন পদ্ধতি, তার শাসন-পরিচালনা ব্যবস্থা ও রাজনীতি, এক কথায় তার জীবনের সর্ববিধ কার্যকলাপ বিকৃতির পথে চালিত হতে বাধ্য। দুনিয়ার বুকে সে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, খুন-খারাবি করবে, অপরের অধিকার হরণ করবে, অত্যাচার উৎপীড়ন করবে। বদখেয়াল, অন্যায়- অনাচার ও দুষ্কৃতি দিয়ে তার নিজের জীবনকেই করে তুলবে তিক্ত-বিস্বাদ। তারপর এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে সে যখন আখেরাতের দুনিয়ায় পৌঁছবে, তখন জীবনভর যেসব জিনিসের উপর সে যুলুম করে এসেছে, তারা তার বিরুদ্ধে নালিশ করবে। তার মস্তিষ্ক, তার দিল, তার চোখ, তার কান, তার হাত-পা এক কথায় তার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর আদালতে অভিযোগ করে বলবেঃ এ আল্লাহদ্রোহী যালেম তার বিদ্রোহের পথে জবরদস্তি করে আমাদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিয়েছে। যে দুনিয়ার বুকে সে নাফরমানীর সাথে চলেছে ও হারাম পথে রোযগার করে হারামের পথে ব্যয় করেছে, অবাধ্যতার ভিতর দিয়ে যেসব জিনিস সে জবরদখল করেছে, যেসব জিনিস সে তার বিদ্রোহের পথে কাজে লাগিয়েছে, তার সবকিছুই ফরিয়াদী হয়ে হাযির হবে তার সামনে এবং প্রকৃত ন্যায় বিচারক আল্লাহ সেদিন মযলুমদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিকারে বিদ্রোহীকে দিবেন অপমানকর শাস্তি। চলবে…)