শিরক মুক্ত ঈমান

আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ

আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ

পাপের মধ্যে সবচেয়ে বড় পাপ এবং জুলুমের মধ্যে সবচেয়ে বড় জুলুম হচ্ছে শিরক, যা ব্যক্তিমনের উদ্ভট ধারণা-কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। যার পেছনে কোনো প্রকার প্রামাণ্য আসমানি সনদ কিংবা বুদ্ধিভিত্তিক দলিল নেই। যারা এ অপরাধে অপরাধী, কস্মিনকালেও আল্লাহপাক তাদের প্রতি করুণা প্রদর্শন করবেন না, ক্ষমাও করবেন না। কেননা এটা আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয়ভাজন হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সা:-কে অনেক কড়া ভাষায় সম্বোধন করে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন তুমি যদি শিরক করো, তাহলে তোমার আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। (সূরা জুমার : ৬৫)।

শিরক একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ সমকক্ষ করা, মিলানো, সংমিশ্রণ করা, একত্রকরণ, অংশীদার, ভাগাভাগি, সমান করা, সম্পৃক্ত করা আর ইংরেজিতে বলা হয় ইত্যাদি। শিরক মানে বিশ্বপ্রভু আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার বা সমকক্ষ বানানো। এটা এমন সব বিশ্বাস, কাজ, কথা বা অভ্যাসকে বোঝায় যা দ্বারা মহান আল্লাহর রুবুবিয়াত, উলুহিয়াত এবং সিফাতে অন্য কারো অংশীদারিত্ব বা সমকক্ষতা প্রতীয়মান হয়। আল্লাহর রুবুবিয়াতে কাউকে শরিক বানানোর অর্থ লালন-পালন, সৃষ্টি, জীবন-জীবিকা, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদিতে অন্যকে অংশীদার করা। তাঁর উলুহিয়াত বৈশিষ্ট্যে কাউকে সমকক্ষ করার অর্থ সালাত, সাওম, কোরবানি, মান্নত প্রভৃতিতে অন্য কারো উপাস্য মেনে নেয়া। আর আল্লাহর সিফাতেকাউকে শরিক বানানোর অর্থ হচ্ছে, কোনো ব্যক্তির গায়েব জানা, নিজকে অমুখাপেক্ষী ভাবা, অভাবমুক্ত মনে করা প্রভৃতি।

ইমাম আজ্জাহাবি তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত আল-কাবায়ের (কবিরা গুনাহ) নামক গ্রন্থে লিখেছেন শিরক দুই প্রকার : (১) আকিদাগত শিরক অর্থা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা এবং তার ইবাদত করা,(২) লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে সৎ কাজ করা। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন : তোমরা ছোট শিরক থেকে দূরে থাকো। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন : ছোট শিরক কী? তিনি বললেন : রিয়া অর্থাৎ লোক দেখিয়ে সৎ কাজ করা। যেদিন আল্লাহ বান্দাদের কর্মফল দিবেন, সে দিন তাদেরকে বলবেন, যাদের দেখিয়ে দেখিয়ে তোমরা নেক কাজ করতে, তাদের কাছে চলে যাও। দেখো তারা তোমাদেরকে কী প্রতিদিন দেয়। (আহমাদ ও বায়হাকি)। ফজল ইবনে ইয়াজ বলেন : ‘লোকের ভয়ে খারাপ কাজ বর্জনকারী রিয়াকারী এবং মানুষকে খুশি করার জন্য ভালো কাজ করা শিরক। আর ইখলাস হচ্ছে এই উভয় রোগ থেকে মুক্ত থাকার নাম।’
মানব প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় সার্থকতা হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর সমীপে মাথা নত করা, অন্য কারো কাছে নয়। কিন্তু কেউ যখন আল্লাহকে ছেড়ে অন্য কারো কাছে মাথা নুইয়ে দেয় কিংবা বিশ্বাস করে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ ইবাদতের হকদার আছে, তখন সে মানবীয় সত্তা থেকে বহু দূরে অবস্থান করে। ফলে তার অবস্থা হয়ে যায় একটি জীবন্ত লাশের মতো। শয়তান তাকে অধঃপতনের গহিন সমুদ্রে ফেলে দেয়, সেখানে সে হাবুডুবু খেতে থাকে। তার উন্নত নেক আমল বরবাদ হয়ে যায়, ফলে তার সর্বশেষ ঠিকানা হয়ে যায় জাহান্নাম। আল্লাহ তায়ালা বলেন,নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন। এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম। (আল-মায়িদা : ৭২)।
যারা শিরক করে আরবিতে তাদেরকে মুশরিক বলা হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত তাদের করুণ পরিণতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন। যেমন : * তারা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে, যা তাদের অপকার করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। এটাই চরম বিভ্রান্তি যে, তারা এমন কিছুকে ডাকে, যার অপকার উপকারের আগে এসে পৌঁছে। কত নিকৃষ্ট এ বন্ধু, কত নিকৃষ্ট এ সঙ্গী। (সূরা হজ্জ : ১২-১৩)।

* যারা আল্লাহর সাথে অন্যকে ইলাহ মনে করে তাদের কাছে কোনো দলিল-প্রমাণ নেই। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না, যে তাঁর সাথে শরিক করল। এ ছাড়া তিনি যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করে দেন। (আল মুমিনুন : ১১৭)।

রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর প্রিয় উম্মতকে শিরকের ভয়াবহতা থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে বহু মূল্যবান বাণী রেখে গেছেন। তিনি বলেছেন :যে ব্যক্তি শিরকমুক্ত অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে যে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি শিরক করে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে সে জাহান্নামে যাবে। (বুখারি)। * যে ব্যক্তি লোক দেখিয়ে নামাজ পড়ল সে শিরক করল। আর যে ব্যক্তি লোক দেখিয়ে রোজা রাখল সেও শিরক করল। (মুসনাদে আহমাদ)।
মানুষ নানাবিধ কারণে শিরকে লিপ্ত হয়ে থাকে। কখনো কখনো অজ্ঞ মানুষেরা অসিলার ভুল ব্যাখ্যা করে থাকে। তারা মনে করে, আল্লাহর কাছে কিছু চাইতে হলে কারো মাধ্যমেই চাইতে হবে। ফলে তারা কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তির প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা দেখানোর ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত করে ফেলে। আর এ বাড়াবাড়ি ফল অনেক ক্ষেত্রে শিরকের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। কখনো কখনো অতি ভক্তি কিংবা অতি আবেগের বশীভূত হয়ে মানুষ মানুষের পায়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে,চুমুখায়,পায়ের ধুলা গায়ে মাখে যা সুস্পষ্ট শিরকের শামিল।

আমাদের দেশে প্রচলিত শিরকগুলোর মধ্যে পীরপূজা, মাজারপূজা, কবরপূজা, মাজারের পার্শ্ববর্তী গাছের শিকড়, ছাল-বাকল ইত্যাদিতে রোগ আরোগ্য হয় বলে বিশ্বাস, মাজার থেকে আনা সুতা, তাগা, দড়ি প্রভৃতি আরোগ্য দান করে, মাজার পুকুরের পানি, কুমির, কাছিম, গজার, কবুতর প্রভৃতিকে খাবার দিলে মনের আশা পূর্ণ হয়, মৃত ওলিরা জীবিতদের সাহায্য করতে পারেন, দুর্ঘটনা রোধের জন্য মাজারে টাকা দেয়া, নবী-ওলিরা গায়েব (অদৃশ্য) জানেন, নানাবিধ ফয়েজ-বরকত হাসিলের জন্য মাজারের গিলাপে চুমু খাওয়া, টিয়া পাখি কিংবা বানরের মাধ্যমে ভাগ্য গণনা করা, কোনো বুজুর্গ একই সময় অনেক স্থানে অবস্থান করতে পারা প্রভৃতি। এগুলো নিকৃষ্ট রুচি, অজ্ঞতা, মূর্খতা এবং বাড়াবাড়িরই নামান্তর।
মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ ও কল্যাণকর জীবনযাপনের মহৎ শক্তি হলো ঈমান। ঈমান এক অচলায়তন পর্বতের মতো, যা চির অবিচল সদা সমুন্নত, যা একটি দিগন্ত উজ্জ্বলকারী সূর্যশক্তি, যা জীবনের সব দিক ও আনাচ-কানাচে আলোকমণ্ডিত ও উজ্জ্বল করে দেয়। শিরক এমন একটি অন্ধকার জগ, যেখান থেকে আল্লাহর আক্রোশ আর গজবের হাওয়াই নির্গত হয়ে থাকে।

(সমাপ্ত)

Related Post