প্রশ্ন: আচ্ছালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। জনাব: ইসলামী আইনে বিয়ে করা কি ফরজ, ওয়াজিব না সুন্নত। কুরআন ও হাদীস আলোকে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলবেন? পরবর্তী আল হুদায় প্রশ্নসহ উত্তর বিস্তারিত জানালে উপকৃত হতাম। মুহাম্মাদ আলী, ফাওয়ানিয়া, কুয়েত।
উত্তর: ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। ইসলামে বিয়ের গুরুত্ব অপরিসীম, পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এ বিষয়ে রয়েছে বিষদ বর্ণনা। সাধারণত বিয়েকে ইসলাম উৎসাহিত করে তথাপি অবস্থা ও পারিপার্শ্বিকতার উপর ভিত্তি করে এটি কোন কোন ব্যক্তির জন্য ফরজ হয়, কারো জন্য ওয়াজিব আবার কারো সুন্নাত, কারো জন্য মুস্তাহাব, কারো জন্য শুধুই হালাল এমনকি কারো কারো জন্য হারামও হয়ে থাকে। এই নীতি মুসলমান নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। রাসূল (সা.) বিয়ে করার জন্য উৎসাহ প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন, হে যুবকেরা! তোমাদের মধ্যে যে সামর্থ্য রাখে বিয়ে করবার, সে যেন বিয়ে করে। কেননা এটা দৃষ্টিকে নত রাখা ও গোপনাঙ্গসমূহের হেফাযতের জন্য সবচাইতে কার্যকর। আর যে তা পারবে না, সে যেন সাওম বা রোযা পালন করে, কেননা এটা তার জন্য ঢাল স্বরূপ”। [সহীহ বুখারী ৫০৬৫, সহীহ মুসলিম ১৪০০]
ব্যক্তি হিসেবে বিয়ে কয়েক প্রকার। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো:
ফরয বিয়ে
যদি সামর্থ থাকার সাথে সাথে চাহিদা এতো বেশি থাকে যে, বিয়ে না করলে হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে বিয়ে করা ফরয।من الفعل الحرام النظر المحروم والاستمناء بالكف অর্থঃ কু-দৃষ্টি ও হস্তমৈথুন হারাম কাজের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ বিয়ে না করলে হস্তমৈথুন বা ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেই ক্ষেত্রে বিয়ে করা ফরয।
ওয়াজিব বিয়ে
যখন বিয়ে প্রয়োজন তথা দেহ-মনে তার চাহিদা থাকে। তার এই পরিমাণ সামর্থ থাকে যে প্রতিদিনের খরচ প্রতিদিন উপার্জন করে খেতে পারে। তখন বিয়ে করা ওয়াজিব। বিয়ে থেকে বিরত থাকলে গুণাহগার হবে।
সুন্নাত বিয়ে
যদি বিয়ের চাহিদা না থাকে কিন্তু স্ত্রীর অধিকার আদায়ের সামর্থ রাখে তবে বিয়ে করা সুন্নত। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন, বিয়ে আমার সুন্নাত, যে আমার সুন্নাত ত্যাগ করলো, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। (বুখারী: ৫০৬৩ ও মুসলিম:১৪০১)
নিষিদ্ধ বিয়ে
যদি কারো আশঙ্কা হয় সে স্ত্রীর অধিকার আদায় করতে পারবে না। চাই তা দৈহিক হোক বা আর্থিক হোক। তার জন্য বিয়ে করা নিষিদ্ধ। অথবা যার অধীনে ৪জন স্ত্রী বর্তমান রয়েছে, তার জন্য পঞ্চম বিয়ে করা হারাম।
মতভেদপূর্ণ বিয়ে
যদি চাহিদা ও প্রয়োজন থাকে কিন্তু সামর্থ না থাকে তাহলে তার বিয়ের ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। অধমের মতে ওয়াজিবের মতটিই অগ্রগণ্য। সামর্থ কষ্ট-শ্রম ও ঋণ করার দ্বারা অর্জন হয়। যদি সে তা আদায় করার পরিপূর্ণ ইচ্ছা রাখে। আদায়ের চেষ্টাও করে। যদি সে আদায় করতে না পারে তবে আশা করা যায় আল্লাহ তার ঋণদাতাকে রাজি করিয়ে দিবেন। কেননা দ্বীনের সংরক্ষণের জন্য ঋণ করেছিলো। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় কাজের জন্য ঋণ করা নাজায়েয। বরং ভরণ-পোষণ ও মহর আদায় করার জন্য-যদি তা নগদ প্রদান করতে হয়- ঋণ করতে পারবে। আর যদি অর্থের ব্যবস্থা করতে অপারগ হয়, তাহলে রোযা রেখে তার যৌন চাহিদা দমন করবে। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন: বিয়ের সামর্থ না থাকলে রোযা থাকবে, এতে যৌন চাহিদা হ্রাস পায়। [ইসলাহে ইনকিলাব, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২৯ থেকে ৪০।]
প্রশ্ন: মৃত ব্যক্তির জানাযার সময়, তাকে কী ইমাম সাহেবের সামনে রাখা হবে নাকি সাইটে রাখা হবে? আর লাশ দাফন করার পর সবাই মিলে যে, দোয়া করা হয়, কবর সামনে নিয়ে দোয়া করবো নাকি কিবলার দিকে দোয়া করবো? বিস্তারিত জানাবেন। আব্দুস সামাদ, মাহবূলা, কুয়েত।
উত্তর: মানুষ বড় হোক অথবা ছোট হোক ইমাম পুরুষের মাথা বরাবর এবং মহিলার মাঝামাঝি স্থানে দাঁড়াবেন। এটি ইমাম শাফেঈর মত। অতএব, মৃত ব্যক্তি ছোট বালক হলেও ইমাম তার মাথার কাছে দাঁড়াবেন। অনুরূপভাবে ছোট বালিকা হলেও তার মাঝ বরাবর দাঁড়াবেন। (বুখারী:১৩৩১ মুসলিম: ৯৬৪)
এই দিকে ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদও (সাহেবাইন) ইমাম শাফেঈর মত বলেন মৃত ব্যক্তি পুরুষ হলে ইমাম মাথা বরাবর দাঁড়াবে। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) একজন পুরুষের জানাযার নামায পড়ালেন, তিনি তখন লোকটি মাথা বরাবর দাঁড়িয়েছেন। অতঃপর একজন মহিলার নামায পড়ালেন, রাসূল (সা.) মাঝামাঝি দাঁড়ালেন। (তিরমিযী হাদীস হাসান)
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন: ইমাম সাহেব নারী-পুরুষ উভয়ের মাঝামাঝি দাাঁড়াবেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ হতে এমনটি বর্ণিত হয়েছে। আর ইমাম মালেক (রহ.) বলেন পুরুষের বেলায় মাঝামাঝি দাঁড়াবে, আর নারীর বেলায় কাঁধ বরারব দাঁড়াবে।
প্রশ্ন: নামাযের কোন একটি শর্ত (যেমন পানি সংগ্রহ) পূর্ণ করতে গিয়ে যদি নামাযের সময় পার হয়ে যায় তবে তার বিধান কি? মুহাম্মাদ আনিছুর রহমান, সাবাহ আন নাসের, কুয়েত
উত্তর: বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, কোনভাবেই নামাযের নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত করা বৈধ নয়। কোন লোক যদি সময় পার হয়ে যাওয়ার ভয় করে, তবে যে অবস্থাতেই থাকুক নামায আদায় করে নিবে। যদিও একটু পর উক্ত শর্ত পূর্ণ করা সম্ভব হয়। কেননা আল্লাহ্ বলেন,
إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا
“নিশ্চয় নির্দিষ্ট সময়ে নামায আদায় করা মুমিনদের উপর ফরয করা হয়েছে।” (সূরা নিসা- ১০৩)
অনুরূপভাবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতিটি নামাযের সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং ঐ সময়ে আদায় করাটাই ওয়াজিব। কেননা শর্ত পূর্ণ করার জন্য অপেক্ষা করা যদি বৈধ হত, তবে তায়াম্মুমের কোন প্রয়োজন ছিল না। সময় পার হওয়ার পর পানি সংগ্রহ করা সম্ভব। সুতরাং দীর্ঘ সময়ের জন্য নামাযকে দেরী করা বা অল্প সময়ের জন্য দেরী করার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। উভয় অবস্থায় নামাযের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। তাই যে অবস্থাতেই থাক না কেন সময়ের মধ্যেই (তায়াম্মুম করে হলেও) নামায আদায় করে নিবে। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া এমত পোষণ করেছেন।
প্রশ্ন: জনাব আচ্ছালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু। আমার প্রশ্ন সুন্নাত নামায শুধু সূরা ফাতেহা দিয়া পড়া যাবে কিনা?
বিস্তারিত জানিয়ে ধন্য করবেন। জাযাকাল্লাহু খাইরান। ইমরান গাজী, কুয়েত।
উত্তর: যে কোন নামাযে সূরা ফাতেহার পর অন্য সূরা মেলানোর বিধান হলো; যদিও কেউ কেউ ওয়াজিব বলেছেন। কিন্তু বিশুদ্ধ মত হলো, সূরা ফাতেহার পরে অন্য সূরা মেলানো সুন্নাত। চাই নামায যে প্রকারের (ফরয, সুন্নাত, নফল, ওয়াজিব ইত্যাদি) হোক না কেন। সুতরাং কেউ যদি শুধু ফাতেহা দিয়ে নামায আদায় করে, তাহলে তার নামায হয়ে যাবে। তবে উত্তম হলো, সূরা ফাতেহার পরে অণ্য একটি সূরা মিলিয়ে পড়া। কেননা রাসূল (সা.) সর্বদা সূরা মিলিয়ে পড়েছেন। (ইবনে কুদামা ও মারকাজুল ফতোয়া: ১২৪১৪৭-৩৭৮৭৭)
প্রশ্নঃ রাত জাগার কারণে সূর্য উঠার পর নামায আদায় করলে কবূল হবে কি? অন্যান্য নামায সে সময়মতই আদায় করে। সেগুলোর বিধান কি? মনজুর আলম, জেলিব আল শোয়োখ, কুয়েত
উত্তরঃ ইচ্ছাকৃতভাবে সময় পার করে সূর্য উঠার পর ফজর নামায আদায় করলে তা কবূল হবে না। কেননা রাত না জেগে আগেভাগে নিদ্রা গেলে সময়মত উক্ত নামায আদায় করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল। সুতরাং বিনা ওযরে সময় অতিবাহিত করে নামায আদায় করলে উক্ত নামায কবূল হবে না। কেননা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ
مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
“যে ব্যক্তি এমন আমল করল, যার পক্ষে আমাদের কোন নির্দেশ নেই, তবে উহা প্রত্যাখ্যাত।” (মুসলিম)
আর যে ব্যক্তি বিনা ওযরে সময় অতিবাহিত করে নামায আদায় করে, সে তো এমন আমল করল, যার অনুমতি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল দেননি। সুতরাং উহা প্রত্যাখ্যাত।
কিন্তু সে বলতে পারে আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম। আর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ
مَنْ نَسِيَ صَلَاةً أَوْ نَامَ عَنْهَا فَكَفَّارَتُهَا أَنْ يُصَلِّيَهَا إِذَا ذَكَرَهَا
“যে ব্যক্তি নামায আদায় করতে ভুলে যায় অথবা নামায না পড়ে ঘুমিয়ে থাকে, তার কাফ্ফারা হচ্ছে যখনই স্মরণ হবে তখনই সে উহা আদায় করে নিবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
আমরা তাকে বলব, যখন কিনা তার জন্য সম্ভব ছিল যে, সময় মত জাগার জন্য আগেভাগে ঘুমিয়ে পড়বে বা এলার্ম ঘড়ি প্রস্তুত করবে বা কাউকে অনুরোধ করবে তাকে জাগিয়ে দেয়ার জন্য। তখন এগুলো না করে সময় অতিবাহিত করে ঘুমের ওজুহাত খাড়া করা, ইচ্ছাকৃতভাবে নামায পরিত্যাগ করারই অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। সুতরাং পরবর্তীতে আদায় করলে উহা কবূল হবে না। আর অন্যান্য নামায সময়মত আদায় করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে।
এ উপলক্ষ্যে আমি কিছু নসীহত করতে চাইঃ মুসলিম ব্যক্তির উপর আবশ্যক হচ্ছে, এমনভাবে আল্লাহ্র ইবাদত করা, যেভাবে করলে তিনি তার উপর সন্তুষ্ট হবেন। এ দুনিয়ায় তাকে তো সৃষ্টি করা হয়েছে কেবল মাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্য। কেউ জানেনা কখন তার মৃত্যু ঘণ্টা বেজে উঠবে। তাকে পাড়ি জমাতে হবে পরপারের জগতে। যেখানে হিসাব-নিকাশের সম্মুখীন হবে। তখন আমলই হবে একমাত্র তার সহযোগী। মৃত্যুর পর আমল করার আর কোন অবকাশ থাকবে না। রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
“যখন মানুষ মৃত্যু বরণ করে, তিনটি আমল ব্যতীত তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। ছাদকায়ে জারিয়া, উপকারী বিদ্যা, সৎ সন্তান যে তার জন্য দু‘আ করবে।” (মুসলিম: ১৬৩১)