নামাজের কাফফারা বলতে কুরআন ও হাদীসে কিছু আছে কি?

নামাজের কাফফারা বলতে কুরআন ও হাদীসে কিছু আছে কি

নামাজের কাফফারা বলতে কুরআন ও হাদীসে কিছু আছে কি

প্রশ্ন: আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ।
নামাজের কাফফারা বলতে কুরআন ও হাদীসে কিছু আছে কি? একটা কথা প্রচলন আছে মৃত ব্যক্তি জীবদ্দসায় যে সময়ে নামাজ পড়তে পারে নাই সেই সময় কালে প্রতি দিন ৬ ওয়াক্ত নামাজ ধরে প্রতি ওয়াক্ত ৫৫ টাকা হিসাবে কাফফারা নাকি দিতে হবে। বিষয়টি জানালে খুব খুশি হবো। আ্যড শরিফুল হক রতন মানিকগঞ্জ জজ কোর্ট।

উত্তর: ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়ারাকাতুহ। নিম্নে আপনার প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর প্রদান করা হলো।

রসূল (সাঃ) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন বান্দার নিকট থেকে তার আমলসমূহের মধ্যে যে আমলের হিসাব সর্বাগ্রে নেওয়া হবে, তা হল নামায। নামায ঠিক হলে সে পরিত্রাণ ও সফলতা লাভ করবে। নচেৎ (নামায ঠিক না হলে) ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং (হিসাবের সময়) ফরয নামাযে কোন কমতি দেখা গেলে আল্লাহ তাবারাকা অতাআলা ফিরিশ্‌তাদের উদ্দেশ্যে বলবেন, ‘দেখ, আমার বান্দার কোন নফল (নামায) আছে কি না।’ অতএব তার নফল নামায দ্বারা ফরয নামাযের ঘাটতি পূরণ করা হবে। অতঃপর আরো সকল আমলের হিসাব অনুরূপ গ্রহণ করা হবে।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৭৭০, তিরমিযী, সুনান ৩৩৭, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১১৭নং, সহিহ তারগিব ১/১৮৫)

পক্ষান্তরে যে ব্যক্তির নামায অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছুটে যায়, তার জন্য কাযা আছে। আল্লাহ বান্দার অন্তরের খবর রাখেন। তার মনে অবহেলা ও শৈথিল্য না থাকলে তিনি তার কাযা গ্রহণ করবেন। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, ‘(এই কাযা আদায় করা ছাড়া) এর জন্য আর অন্য কোন কাফফারা নেই।’ (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৬০৩নং)

পক্ষান্তরে কাযা আদায় করার সময় ও সুযোগ না পেলে কোন পাপ হয় না। (যেমন কাযা আদায় করার পূর্বে হঠাৎ ইন্তেকাল করলেন) সুতরাং এ কথা সুস্পষ্ট হয় যে, মরণের সময় অথবা পরে বেনামাযী অথবা কিছু নামায ত্যাগকারীর তরফ থেকে নামায-খন্ডনের উদ্দেশ্যে রাকআত হিসাব করে কাফফারা স্বরূপ কিছু দান-খয়রাত ইত্যাদি করা নিরর্থক ও নিষ্ফল। বরং এই উদ্দেশ্যে পাপ-খন্ডনের ঐ অনুষ্ঠান ও প্রথা এক বিদআত। (ইসলাহুল মাসাজিদ, আল্লামা আলবানীর টীকাসহ্‌ উর্দু তর্জমা মালেক, মুআত্তা ২৯৬ পৃ:, আহ্‌কামুল জানাইয, আলবানী ১৭৪, ২৭৫পৃ:, মু‘জামুল বিদা’ ১৬৪পৃ:) বলা বাহুল্য এমন পাপস্খলনের  রীতি তো অমুসলিমদের; যারা ইয়া বড় বড় পাপ করে কোন পানিতে ডুব দিলে অথবা কিছু অর্থ ব্যয় করলে নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে। যেহেতু নামাযের কাফফারা নেই, তাই পাঁচ ওয়াক্ত ফরযের স্থানে ছয় ওয়াক্ত হিসাব করারও অনর্থক।

বিষয়টি আরো পরিস্কার করা হচ্ছে:

বিনা ওজরে ইচ্ছাকৃত নামায ছেড়ে দিলে বা সুযোগ ও সময় থাকা সত্ত্বেও না পড়ে অন্য ওয়াক্ত এসে গেলে পাপ তো হবেই; পরন্তু সে নামাযের আর কাযা নেই। পড়লেও তা গ্রহণযোগ্য নয়। (কারণ এমন দৃষ্টান্ত, সাহাবায়ে কেরামগণ হতে প্রমাণিত নেই) বিনা ওজরে যথাসময়ে নামায না পড়ে অন্য সময়ে কাযা পড়ায় কোন লাভ নেই। বরং যে ব্যক্তি এমন করে ফেলেছে তার উচিৎ, বিশুদ্ধচিত্তে তওবা করা এবং তারপর যথাসময়ে নামায পড়ায় যত্নবান হওয়ার সাথে সাথে নফল নামায বেশী বেশী করে পড়া। (মুহাল্লা, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ ১/২৪১-২৪৩, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ৭৮পৃ:, ১নং টীকা, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৫/৩০৬, ১৫/৭৭, ১৬/১০৫, ২০/১৭৪, মিশকাত ৬০৩নংহাদীসের আলবানীর টীকা দ্র:)

কেউ অজ্ঞান থাকলে জ্ঞান ফিরার পূর্বের নামায কাযা পড়তে হবে না। কারণ, সে জ্ঞানহীন পাগলের পর্যায়ভুক্ত। আর পাগলের পাপ-পুণ্য কিছু নেই। (আবূ দাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৩২৮৭ নং, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২৬/১২৮, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ ১/২৪১, আলমুমতে‘, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উছাইমীন ২/১২৬)

ইবনে উমার (রাঃ) অজ্ঞান অবস্থায় কোন নামায ত্যাগ করলে তা আর কাযা পড়তেন না। (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ ১/২৪১) সুতরাং এখান থেকে এ কথা বলা যায়, যেসব লোক মৃত্যুর পূর্বে ভীষণ অসুস্থ থাকে, যার কারণে কথাও বলতে পারে না এবং নড়াচড়াও করতে পারে না, শুধু শ্বাসপ্রশ্বাস চালু থাকে। এমন রোগীকেও অচেতন ধরা হবে। তার নামাযের কাযা নেই।

পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, ইচ্ছাকৃত নামায ত্যাগ করলে সে নামাযের কাযা নেই। অতএব তওবার পর কাযা উমরী বলে শরীয়তে কোন নামায নেই। বিধায় তা বিদআত।

অবশ্য এই তওবাকারী ব্যক্তির উচিৎ, বেশী বেশী করে নফল নামায পড়া এবং অন্যান্য নফল ইবাদতও বেশী বেশী করে করা। (দারেমী, সুনান ২/৪২) তার জন্য ওয়াজেব এই যে, সে সর্বদা নামায ত্যাগ করার ঐ অবহেলাপূর্ণ পাপ ও ক্ষতির কথা মনে রেখে তার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে (নফল ইবাদতের মাধ্যমে) সদা সচেতন থাকবে। সম্ভবত: তার ঐ হারিয়ে দেওয়া দিনের কিছু ক্ষতিপূরণ অর্জন হয়ে যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ২/১৩৫)

 যদি কেউ মারা যায়, আর জিম্মায় কোন ফরয নামায কিংবা একাধিক ফরয নামায বাকি থাকে, সেই ক্ষেত্রে তার এই নামাযের কাজার বিধান ইসলামে নেই। কেননা ইবাদের বেলায় নিয়ম হলো, কোন প্রতিনিধির দ্বারা কোন ইবাদত আদায় করা জায়েয নেই। তবে হ্যাঁ শরীয়ত যেখানে প্রতিনিধির দ্বারা ইবাদত শুদ্ধ হওয়ার কথা প্রমাণিত আছে, একমাত্র সেই ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য হবে। যেমন হজ্জ বা মান্নাত রোযা।

ফরয নামায বিষয়ে প্রতিনিধি বা কাফফারা  দিয়ে আদায় হওয়ার বিষয়ে কোন প্রমাণ কুরআন বা হাদীসে বর্ণিত হয়নি। মুয়াত্তা ইমাম মালেক হাদীস গ্রন্থে আনাস বিন মালেক হতে হাদীস বর্ণিত হয়েছে; তিনি আব্দুল্লাহ বিন উমর হতে বর্ণনা করেন,

أنه لا يصوم أحد عن أحد، ولا يصلي أحد عن أحد

একজনের পক্ষ থেকে অন্য জন রোযা রাখলে আদায় হবে না, তেমনিভাবে একজনের পক্ষে অন্য জন নামায আদায় করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। যদিও ইবনে উমরের এই আছার হাদীসটি রোযার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় অন্য দলীলের কারণে কিন্তু নামাযের বেলায় অবশ্যই তা প্রযোজ্য, অর্থাৎ নামাযের বেলায় কোন প্রতিনিধিত্ব চলবে না।

এখন আসি আপনার প্রশ্নের উত্তরে, অর্থাৎ যার পিতা বা মাতা অথবা আত্মীয়-স্বজন মারা যায়, এমতাবস্থায় যে, তার কিছু নামায কাজা হয়ে গেছে। অসুস্থতার কারণে হতে পারে অথবা এমনি অলসতার কারণে হতে পারে। এই ক্ষেত্রে উলামাদের কথা হলো তার উপর কোন কাযা নামায নেই। কেননা পুরুষের নামায কখনই মাফ হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত তার হুঁশ-জ্ঞান ঠিক থাকে। এমন অসুস্থ যে তার হুঁশ-জ্ঞান নাই, তখন তার নামায মায়াফ। কেননা তখন তিনি মুকাল্লাফ বিশ শরা‘(শরীয়তের বিধান প্রযোজ্য) এর অন্তর্ভুক্ত নন। তার জন্য দোয়া, ইস্তেগফার করবে, তার কোন অসিয়ত থাকলে তা আদায় করা, তার বন্ধু-বান্ধবের আপ্যায়ন করা, আত্মীয়-স্বজনের খুঁজ নেওয়া। পিতা-মাতার জন্য সন্তানের প্রধান দায়িত্ব হলো, দোয়া করা, এবং সদকায়ে জারিয়া, বা ওয়াকফ জাতীয় দান করা। এই বিষয়ে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূলে কারীম (সা.) বলেন:

 

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ , أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، قَالَ : ” إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَمَلُهُ إِلا مِنْ ثَلاثٍ : صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ ” , أَخْرَجَهُ مُسْلِمٌ

 

আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী করীম (সাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, নবী (সাঃ) বলেন, “মানুষ যখন মারা যায়, তখন সমস্ত আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমলের দরজা বন্ধ হয়না।

(১) সাদকায়ে জারিয়া।

(২) যদি এমন সন্তান রেখে যায়, যে পিতার জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করবে।

(৩) যদি এমন দ্বীনি শিক্ষা রেখে যায়, যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়। [সহিহ মুসলিম: ৪৩১০]

Related Post