প্রশ্নোত্তর

কুরআন ও সুন্নাহ

আপনি যা জানতে চেয়েছেন

 প্রশ্ন: আচ্ছালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ আমি একটা বিষয় জানতে চাই, বর্তমান যে আল হাদীস বা সালাফি এদের উৎপত্তি কোথা থেকে আর রাসুল (সা.) যে ইসলাম রেখে গেছে তার আদলে এখন কোন ইসলামি দল পৃথিবীতে আছে কিনা আল হুদার মাধ্যমে জানাবেন। ধন্যবাদ ॥ রাশেদ ওয়াফরা
 উত্তর: আহলে হাদীস, বা আহল-ই-হাদীস ফার্সি শব্দ, বা আসহাবুল হাদীস (আরবি: Ahl al-hadith; أهل الحديث) অথবা (Ashab al-hadith; أصحاب الحديث) যার শব্দিক অর্থ হল, হাদীসের অনুসারী। পারিভাষিক অর্থঃ কুরআন এবং ছহীহ হাদীসের নিরপেক্ষ অনুসারী। বিশিষ্ট আলেমগণ বলে থাকেন, যেহেতু, হাদীসের মধ্যে আসছে; কুরআন কে উৎকৃষ্ট বাণী বলা হয়েছে (রিয়াযুস স্বলিহীন ১ম খন্ড হা/১৭০), আর হাদীসের শব্দিক অর্থ বাণী, যেহেতু রাসূল (সা.)-এর বাণী হচ্ছে হাদীস, তাই সব মিলিয়ে আহলে হাদীস বা আসহাবুল হাদীস অর্থ কুরআন এবং ছহীহ হাদীসের অনুসারী। পূর্ববর্তী আলেমদের অভিমত, এরা হল মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার এমন একটি দল যারা কুরআন এবং হাদীসের অনুসরণে সকল মাযহাবের চেয়ে এগিয়ে। এর নিজস্ব অনুসারীরা একে আহলে হাদীস (আহল আল-হাদীস) বা সালাফি মতবাদ বলে ডাকলেও, অনেকেই একে ওয়াহাবি আন্দোলনের একটি প্রকরণ বলে দাবি করে এর অনুসারীদের ওয়াহাবি নামে চিহ্নিত করেন।
তারা প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের ইমাম, ইমাম আবু হানিফা (রহঃ), ইমাম মালিক (রহঃ), ইমাম শাফেঈ (রহঃ), ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) সহ সকল মুজতাহিদগণের ফতোয়াকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে, তবে কোনো একটি নির্দিষ্ট মাযহাব বা ইমামের মতকে এককভাবে অনুসরণ করেন না।
তাদের আরো বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, তারা কুরআন এবং ছহীহ হাদীসকে সর্ব প্রথম অনুসরণ করেন, তারপরে অস্পষ্ট বিষয়গুলিতে ইমামগণ অর্থাৎ মুজতাহিদদের ফতোয়া পর্যালোচনা করে গ্রহণ করেন। তারা বা আহলে হাদীস আলেমগণ হাদীস শাস্ত্রের বিভিন্ন পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে হাদীসের সনদ যাচাই বাছাইয়ের পর সহীহ, দূর্বল, জাল এভাবে হাদীসের  শ্রেণি বিভাগ করেন। ১৪০০ বছর পূর্বে মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সাহাবি (রা.) গণ যেভাবে ইসলাম পালন করেছেন, বুঝছেন, বিশ্বাস করেছেন সেই মূলেই মুসলিম উম্মাহকে দলাদলি, বিভিন্ন মতবাদ ছেড়ে ফিরে যাওয়ার দাওয়াত দেয়।
বিভিন্ন ইতিহাসবিদগণের তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে আহলে হাদীসগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
উপমহাদেশে বর্তমানে আহলে হাদীসদের দুটি সংগঠনকে দেখতে পাওয়া যায়, যারা ধর্ম প্রচারের কাজ করে থাকে। একটি “জমিয়তে আহলে হাদীস”, যা ১৯৪৮ সালে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমীর পুরষ্কার প্রাপ্ত প্রথম সাহিত্যিক আল্লামা আব্দুল্লাহেল কাফী আল কোরায়েসীর মাধ্যমে এবং অন্য সংগঠনটি হল “আহলে হাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ”, যা ১৯৯৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রতিষ্ঠা করেন ।
আহলে হাদীসদের অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য হল তাঁরা শির্ক এবং বিদ’আতের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার মাধ্যমে সমাজের কুসংস্কার দূরীকরণে ভূমিকা রাখে।
আর রাসূল (সা.) যে ইসলাম রেখে গেছেন, সেই ইসলামের অনুসারী পৃথিবীতে রয়েছে, তবে সঠিকভাবে অনুসরণকারীর সংখ্যা খুবই কম। অনেকেই দাবী করেন যে, আমরাই রাসূলের অনুসারী, যেমন যারা শুধু পীর-মুরীদির পদ্ধতিতে ইসলাহে নাফস বা আত্মশুদ্ধির কাজ করেন, তারাও বলেন, আমরা রাসূলের অনুসারী, আবার যারা শুধু দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে ব্যস্ত তারাও বলেন, আমরাই একমাত্র রাসূলের রেখে যাওয়া পদ্ধতিতে বহাল রয়েছি। আবার যারা দারস ও তাদরীস শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে নিয়োজিত তারাও বলেন, যে আমরাও রাসূলের রেখে যাওয়া ইসলামের উপর আছি। মূল কথা হলো: ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। পৃথিবীতে যত বিভাগ রয়েছে যাবতীয় বিভাগে ইসলামের দিক নির্দেশনা আলোচিত হয়েছে, রাসূল (সা.)ও ব্যক্তি জীবনে সর্ব বিষয়ে বাস্তবায়ন করে গেছেন। অর্থাৎ আত্মশুদ্ধি, দাওয়াত ও তাবলীগ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিসহ ব্যক্তি জীবন হতে রাজনৈতিক জীবনের পর্যায়ের সব বিষয়ে রাসূলের অবদান রয়েছে। এখনও পৃথিবীতে যারা রাসূলের সবদিক নিয়ে কাজ করেন, তারাই একমাত্র রাসূলের রেখে যাওয়া ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন। আর যারা একটি নির্দিষ্ট বিভাগ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন, তারা আংশিক ইসলামের উপর আছেন।
প্রশ্নঃ  এশা নামাযের সময় মসজিদে প্রবেশ করে মনে পড়ল, মাগরিবের নামায পড়া হয়নি। এদিকে মসজিদে এশার জামায়াত চলছে, এখন আমি কী করবো? এশার জামায়াতে শরীক হবো নাকি একাকী মাগরিব পড়ে নিয়ে জামায়াতে শরকী হবো। এখন আমার করণীয় কি বিস্তারিত জানাবেন?  মুহাম্মাদ আফসার উদ্দিন
উত্তরঃ মসজিদে প্রবেশ করে যদি দেখেন যে, এশার নামাযের জামায়াত দাঁড়িয়ে গেছে। তখন মাগরিব ছালাতের নিয়ত করে এশার জামায়াতে শরীক হয়ে যাবেন। ইমাম তৃতীয় রাকায়াত শেষে চতুর্থ রাকাআতের জন্য দণ্ডায়মান হলে- বসে পড়বেন এবং পূর্ণ তাশাহহুদ পড়ে সালাম না ফিরিয়ে ইমামের অপেক্ষা করবেন।  সেই ক্ষেত্রে আপনি দুয়ায়ে মাছূরার স্থানে বিভিন্ন দোয়া পড়তে থাকবেন। তারপর ইমাম সাহেবের সাথে সালাম ফিরাবেন। অথবা একাকী সালাম ফিরিয়েও ইমামের অবশিষ্ট নামাযে এশার নিয়তে শামিল হলেও কোন অসুবিধা নেই। ইমামের সাথে নিয়তের ভিন্নতা হলে কোন অসুবিধা নেই। বিদ্বানদের মধ্যে এব্যাপারে মতভেদ থাকলেও এটিই বিশুদ্ধ মত। আর যদি একাকী মাগরিব নামায আদায় করে এশার জামাতে শামিল হন, তাতেও কোন অসুবিধা নেই। (ফতোওয়া আরকানুল ইসলাম: সালাত অধ্যায়: ২০৮ নম্বর উত্তর)
প্রশ্ন: তাকবীরে তাহরীমা আল্লাহু আকবার বলে হাত কোথায় বাঁধবো? সীনার উপর নাকি নাভির নিচে, না নাভি ও সীনার মাঝামাঝি? দলীলসহ বিস্তারিত জানাবেন। আব্দুস সামাদ, মাহবূলা, কুয়েত।
 উত্তর:  সহীহ হাদীসের আলোকে হাত কোথায় বাধতে হবেঃ
ঈমাম আবু হানিফার মতে নাভির নিচে হাত বাধা সুন্নাত। ইমাম শাফেঈর মতে নাভীর উপরে বুকের নিচে হাত রাখা সুন্নাত এবং এটাই তার বিশুদ্বতম মত। ইমাম মালীকের মতে হাত না বেধে ছেড়ে দেয়া সুন্নাত। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের মতে নাভীর উপরে বা নিচে যে কোন এক জায়গায় রাখলে সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। সালাফী বা আহলে হাদীসের মত অনুযায়ী বুকের উপরে হাত বাধা সুন্নাত।
হাত বাধা সংক্রান্ত হাদীসগুলিঃ
হাত কোথায় বাধতে হবে সুস্পষ্টভাবে কোন হাদিস বুখারী-মুসলিমে নেই। যা আছে তা হল কোন হাতের উপরে কোন হাত রাখতে হবে কতখানি রখতে হবে। হাদিসগুলি দেখে নেই তাহলে আমাদের বুঝতে সুবিধা হবে।

عن ابي حازم عن سهل بن سعد ] قال كان ناس يومرون ان يضع الرجل اليد اليمني علي ذراعه اليسري في الصلاة قال ابو حازم لا أعلمه ألا ينمي ذلك الي النبي [
হযরত সাহল ইবনে সাদ রা. বলেন, লোকদেরকে আদেশ করা হত, পুরুষ যেন নামাযে ডান হাত বাম বাহুর উপর রাখে।’-সহীহ বুখারী ১/১০৪
হযরত হুলব আতত্বয়ী (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের ইমাম হতেন এবং তাঁর ডান হাত দিয়ে বাম হাত ধরতেন।
كان رسول الله [ يؤمنا فيأخذ شماله بيمينه. رواه الترمذي وقال : حديث حسن
জামে তিরমিযী ১/৩৪; ইবনে মাজাহ ৫৯
উক্ত হাদীছে ডান হাতকে বাম যিরার উপর রাখতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু হাত কোথায় রাখবে, নাভির উপরে না নাভীর নিচে, সে সম্পর্কে উক্ত হাদীসে কিছু বলা হয়নি। এখন আমাদের বুঝা দরকার যে আরবীতে “যিরা” শব্দের অর্থ কি? কনুই থেকে মধ্যমা আঙুল পর্যন্ত অংশকে আরবিতে যিরা বলা হয়। (মিছবাহুল লুগাত, মুজামুল ওয়াসিত, আল মুনযিদ)।  সে হিসাবে উক্ত হাদীসটি কোনভাবেই নাভীর নিচে ডান হাতকে বাম হাতের কব্জির উপর রাখা হাদীস বিরোধী নয়, কেননা কব্জি নিংসন্দেহে “যিরা” এর অন্তর্ভুক্ত। তবে যেহেতু উক্ত হাদীসে স্পষ্ট করে হাত কোথায় রাখা উচিত তা বলা হয়নি, সে জন্য আমাদেরকে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট হাদীস এবং সাহাবায়ে কেরাম এর আমল দেখতে হবে।
সাহল বিন সাদ (রা.) এর হাদীসের ব্যাপারে বুখারী শরীফের বিখ্যাত ভাষ্যকার হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন-
“বাহুর কোন জায়গায় রাখতেন সেটা এই হাদীসে অস্পষ্ট। আবূ দাউদ ও নাসাঈ বর্ণিত ওয়াইল (রা.) এর হাদীসে বলা হয়েছে- ‘অতঃপর তিনি তাঁর ডান হাত বাম হাতের তালুর পিঠ, কব্জি ও বাহুর উপর রাখলেন।’ ইবনে খুজাইমা (রহ.) প্রমুখ এটিকে সহীহ বলেছেন। সালাত অধ্যায়ের শেষে দিকে হযরত আলী রাযিঃ এর অনুরূপ আছার (হাদীস) এর উল্লেখ আসছে।” (ফতহুল বারী২/২৭৫)।
ইমাম আবু হানীফা (রহ.) যে হাদীসটি দিয়ে নাভীর নিচে হাত বাধার কথা বলেছেন; তা হলো-
رواه أبو داود وأحمد وغيرهما، عن عليٍّ ] قال: إن من السنة في الصلاة وضع الأكف على الأكف تحت السرة

হাদীসটিকে হাদীস বিষারদগণ যঈফ বলেছেন। আবার বুকের উপরে হাত রাখার হাদীসও পাওয়া যায়, যা বর্ণনা করেছেন ওয়ায়েল ইবনে হুজর (রা.)।

وائل بن حجر ] قال: صليت مع رسول اللّه  [  فوضع يده اليمنى على يده اليسرى على صدره. أخرجه ابن خزيمة في صحيحه.
মোট কথা হলো; নামাযে হাত বাধা সুন্নাত। আপনি চাইলে বুকের উপরও বাধতে পারেন আবার নাভীর নিচেও বাধতে পারেন, আবার চাইলে এই দুয়ের মাঝামাঝিও বাধতে পারেন। এখানে বিষয়টিতে প্রশস্ততা রয়েছে। তবে বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের ওলামাদের মতে নাভীর ও বুকের মাঝামাঝি হাত বাধাই উত্তম। কেননা হযরত আলী হতে অন্য একটি বর্ণনায় নাভীর উপরেও হাত বাধার কথা পাওয়া যায়। ইমাম আহমদেও একটি মত হলো, মুসল্লি চাইলে বুক ও নাভীর মাঝামাঝি হাত বাধতে পারবে। হাদীছটিতে সামান্য দুর্বলতা থাকলেও এক্ষেত্রে বর্ণিত অন্যান্য হাদীছের তুলনায় এটিই সর্বাধিক শক্তিশালী।
সুতরাং যেখানে আমলের করার ক্ষেত্রে শিথিলতা রয়েছে, সেখানে কাউকে বাধ্য না করে, ছেড়ে দেওয়াই উত্তম। নাভীর নিচে হাত বাধলে নামায হবে না, কিংবা যারা বুকের উপরে বাধেন, তাদের হাত টেনে নিচে নামিয়ে দেওয়া ঠিক না। আল্লাহ আমাদেরকে সুন্দরভাবে সঠিক আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন

Related Post