মদিনায় হিজরত করার এক বছর আগে রাসূল (সা:) এর মিরাজ সংঘটিত হয়। রাসূল (সা:) এর ভয়ানক কষ্ট ও উৎপীড়নের দিনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে মিরাজে নিয়ে মানব জাতিকে পুনঃ মূল্যায়ন করেছিলেন। মিরাজের মাধ্যমে আল্লাহ একথা বুঝিয়ে দিয়েছেন, সম্মানিত ফেরেশতাদের সীমা যতটুকু মানব সন্তানের সীমা তারও অধিক। আল্লাহ যখন মানুষ সৃষ্টির ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন; জিন জাতিকে নিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা হেতু ফেরেশতারা তখন এ কথায় সায় দেয়নি। আল্লাহ প্রথম মানব, আদম (আ:)-কে জ্ঞানের মাধ্যমে বড় করে, ফেরেশতাদের চেয়েও বেশি মর্যাদা দিয়েছিলেন। মিরাজের মাধ্যমে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল (সা:)-কে আরশে আজিমে নিয়ে মানব জাতিকে সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করলেন। মহানবী (সা:)-এর কাছে জিবরাঈল (আ:) সাক্ষাৎ হয়েছিল প্রায় চব্বিশ হাজার বার (ভিন্নমত ও আছে)।এই চব্বিশ হাজার বারের মধ্যে ছয় হাজারের অধিক আয়াতের পবিত্র কুরআনও অবতীর্ণ হয়েছিল। জিবরাঈল (আ:) রাসূল (সা:)-কে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, অধ্যবসায়সহ সকল বিষয়ে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেছেন। জিবরাঈল (আ:) এর নিরবচ্ছিন্ন ও সার্বক্ষণিক তদারকির পরও এমন কিছু কথা ও ঘোষণা আল্লাহ বাকী রেখেছিলেন, যা তিনি তাঁর প্রিয়তম রাসূল (সা:)-কে একান্ত একাকীত্বে এবং সাক্ষাতে বলার প্রয়োজন মনে করেছিলেন।
রাসূল (সা:)-কে অচিরেই একটি ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্র চালাবার বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, উপযোগী কর্মপন্থা ও কিছু নীতিমালা শিক্ষা দেবার জন্য; আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূল (সা:)-কে মিরাজে নিয়ে ১৪টি মৌললিক বিষয়ের উপর সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও তাগাদা দিয়েছিলেন। সেই ১৪টি শিক্ষা নিয়েই আজকের বক্তব্য। সূরা বনী ইসরাইলের ২৩ থেকে ৩৭ নং আয়াত পর্যন্ত সে কথাগুলো ধারাবাহিক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে…
১. “তোমার রব ফায়সালা করেছেন; তোমরা কারো ইবাদত করো না, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া” অর্থাৎ যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেখানে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো আইন মানা যাবে না, কারো মতবাদ গ্রহণ করা যাবে না। রাষ্ট্রের সমস্ত আইনের উৎস হবেন একমাত্র আল্লাহ এবং সমগ্র বিশ্বের তিনিই মালিক ও প্রতিভূ। সকল প্রকার সার্বভৌমত্বের মালিক তিনি ব্যতীত অন্য কেউ স্বীকৃত হবেনা। সমাজ ও রাষ্ট্রে শুধু তাঁরই একক কর্তৃত্ব চলবে।
২. “পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার কর। যদি তোমাদের কাছে তাদের কোনও একজন কিংবা উভয় বৃদ্ধ অবস্থায় থাকে, তাহলে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে ‘উহ্’ শব্দ পর্যন্ত বল না এবং তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিয়ো না বরং তাদের সাথে মর্যাদা সহকারে কথা বল। আর দয়া ও কোমলতা সহকারে তাদের সামনে বিনর্ম থাক এবং দোয়া করতে থাক এই বলে: ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি তাদের প্রতি দয়া কর সেভাবে: যেভাবে তারা দয়া, মায়া, মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন”।
এই কথার দ্বারা পিতা মাতাকে পরিপূর্ণ সম্মান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিশুর প্রতি প্রতিটি পিতা-মাতা যতটুকু যত্ন ও নিরাপত্তা দেন; অবিকল প্রতিটি সন্তানকেও পিতা-মাতার বৃদ্ধাবস্থায় সেভাবে যত্নশীল হতে বলেছেন। ইসলামী শরীয়ত পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যের ব্যাপারে নিম্নলিখিত নীতিমালা ঘোষণা করেছে:
– পিতা-মাতা অভাবী হলে, সন্তান তাদের অভাব দূর করতে সহযোগিতা করবে।
– তাদের সেবা যত্নের প্রয়োজন হলে, সন্তান সেটা করতে বাধ্য থাকবে।
– তাদের যদি বাসস্থান ও পোশাক না থাকে, সন্তান সেটার ব্যবস্থা করবে।
– সন্তানের যত জরুরী কাজ থাকুক, পিতা মাতার আহবানকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের সামনে হাজির হতে হবে।
– সন্তান ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় পিতা-মাতার কাছে ভদ্র-ন¤্র থাকতে বাধ্য, কোন অবস্থাতেই কর্কশ বাক্য গ্রহণীয় নয়।
– যেকোনো কারণই ঘটুক না কেন, পিতা-মাতার সাথে বেয়াদবি করা যাবেনা।
– তাদের সাথে পথ চলতে সন্তান আগে যেতে পারবে না, অপ্রয়োজনে ডানে কিংবা বামেও চলতে পারবেনা।
– সন্তান নিজে যা পছন্দ করবে, পিতা-মাতাকেও তা দিবে; আবার তাদের অপছন্দকে সন্তান পরিত্যাগ করবে।
– পিতা মাতার জন্য সন্তানকে সার্বক্ষণিক দোয়া করতে হবে এবং এই দোয়া পুরো জীবন অব্যাহত রাখতে হবে।
– সন্তান তাদের আদেশ পালনে বাধ্য, আল্লাহর বিরুদ্ধে হলে পরিত্যাগ করবে; তারপরও অবাধ্য হওয়া যাবেনা।
৩. “আত্মীয়কে আত্মীয়ের অধিকার দিয়ে দাও; মিসকিন ও মুসাফিরকে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দাও এবং অপব্যয় করো না।” অর্থাৎ কোন নাগরিক স্বীয় রোজগার এবং অর্থ-সম্পদ শুধুমাত্র নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে নেবে না। নিজের প্রয়োজন পূরণ করার সাথে সাথে আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী এবং অভাবী মানুষদেরকে তার আয় থেকে তাদেরকে অধিকার দিতে হবে। সচ্ছল ব্যক্তি অসচ্ছলকে, ধনী ব্যক্তি গরীবকে সহযোগিতা করবে। এই সহযোগিতা তাদের প্রতি কোন মেহেরবাণী নয়, বরং নিজের সম্পদের উপর অন্যের যে হক আছে তা স্বীকার করেই করতে হবে। যদি মুসাফির হাজির হয়, কমপক্ষে তিন দিন যাতে তিনি দামী মেহমান হিসেবে সমাদৃত হন সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
৪. “যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই, আর শয়তান তার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ”। অপব্যয়ী মানুষের হৃদয় থেকে গরীব, দুঃখীদের জন্য ভালবাসা ও সহানুভূতি বিদায় নেয়। ধীরে ধীরে তাকে অহংকারের চরিত্রে গ্রাস করে। এটা যখন তার অভ্যাসে পরিণত হয়, তখন আত্ম অহঙ্কারের জ্বালায় সে আর মিতব্যয়ী হতে পারেনা। স্বীয় অভ্যাসই তার জন্য পতনের কারণ হয়। এক সময় অপব্যয়ে অভ্যস্ত ব্যক্তির পরিবারের সবাই একাজে নিয়মিত হয়ে পড়ে। ফলে ধনে পূর্ণ ভাণ্ডার, শূন্য হতেও বেশি সময় লাগেনা। এটি শয়তানের প্ররোচনায় হয়, অথচ শয়তান একজন প্রকাশ্য দুশমন।
৫. “যদি তাদের থেকে (অর্থাৎ অভাবী, আত্মীয়-স্বজন, মিসকিন ও মুসাফির) তোমাকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয় এজন্য যে, এখনো তুমি প্রত্যাশিত রহমতের সন্ধান করে ফিরছ, তাহলে তাদেরকে নরম ভাবে জবাব দাও।” অর্থাৎ নিজের চরম অভাব অনটনের দিনে যখন, সাহায্যের আশায় প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি চলছে; তখন কেউ যদি সাহায্যের আশায় তার দিকে হাত বাড়ায়। সে যাতে বিনয় ও ভদ্রতার সাথে তাকে ফিরিয়ে দেয়। কখনও গোস্বা হয়ে, গালমন্দ বা কর্কশ কণ্ঠে ফিরিয়ে না দেয়। সম্মানী মানুষ অভাবী হলে, তার সাহায্য চাওয়ার ঘটনা প্রকাশ না করা। এটা নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা-কটাক্ষ না করে, তাঁকে অনুধাবন করার মত বুঝিয়ে ইজ্জতের সাথে ফিরিয়ে যেন ফিরিয়ে দেয়।
৬. “নিজের হাত গলায় বেঁধে রেখো না এবং তাকে একেবারে খোলাও ছেড়ে দিয়ো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও অক্ষম হয়ে যাবে”। হাতকে গলায় বাঁধা মানে কৃপণতার নীতি অবলম্বন করা। আর হাতকে ছেড়ে দিয়ো না মানে, দু’হাতে দান করে নিজেকে একেবারে খালি রিক্ত করে ফেলা। আল্লাহ এই দুই নীতির কোনটাই গ্রহণ করেতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ ব্যাখ্যায় বলছেন: কৃপণ ব্যক্তি জন সমাজে এবং আল্লার কাছে নিন্দিত হবে। হাত খোলা ব্যক্তি দুনিয়া চালাতে অক্ষম হয়ে পড়বে এবং স্বীয় বংশধর অন্যের মুখাপেক্ষী হবে। তার অর্থ এই নয় যে, ব্যক্তি তার সাধ্যের ভিতর থেকে দান খয়রাত বন্ধ রাখবে। কেননা রাসূল (সা:) বলেছেন: কৃপণ এবাদত কারীর চেয়ে মূর্খ দানশীল ব্যক্তি অনেক উত্তম।
৭. “দারিদ্রের আশঙ্কায় নিজেদের সন্তান হত্যা করো না। আমি তাদেরকেও রিজিক দেবো এবং তোমাদেরকেও। তাদেরকে হত্যা করা একটি মহাপাপ”। দারিদ্র্যতার আশঙ্কায় যেন, গর্ভস্থ সন্তান হত্যা না করা হয়। আবার দারিদ্র্যতার আশঙ্কায় যেন সন্তান নেওয়া থেকে ইচ্ছাকৃত বিরত না থাকে। এখানে কোন পদ্ধতি ব্যবহার করে সন্তান আসার পথ বন্ধ করা হল, সেটা মূল বিষয় নয়। মূল কথাটি হল, মনে প্রাণে দারিদ্র্যতার ভয়ে অধিক সন্তান আসার পথ বন্ধ করতে চেয়েছিল কিনা; মূলত এটি নিয়তের উপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। দারিদ্র্যতার ভয়ে সন্তান না নেবার নিয়ত করে যদি বন্ধ্যা নারীও বিয়ে করা হয়, তাহলে তাকে এই অন্যায়ের মুখোমুখি হতে হবে। ইসলাম এটাকে গোপন হত্যা বলা বলে চিত্রিত করেছে। এক্ষেত্রে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিশ্চিত করেছেন, সন্তানের জন্য তিনি তার প্রাপ্য রিজিক দেবেন। আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, এর বিনিময়ে বোনাস হিসেবে পিতা-মাতার রিজিকও প্রশস্ত করে দেবেন।
৮. “ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না, ওটা অত্যন্ত খারাপ কাজ এবং খুবই জঘন্য পথ”। এখানে ব্যভিচার করার প্রশ্ন তো আসেনি, বলা হয়েছে তার ধারে কাছেও যেওনা। ব্যভিচার শুরু হতে কিছু ধাপ পার হতে হয় এবং এতে নারী পুরুষ দুই জনের সম্মতির প্রয়োজন পড়ে। সেই ধাপগুলো হল যৌন সুড়সুড়িমূলক গান, সাহিত্য ও অশ্লীল নাটকে নিজেকে নিয়োজিত করা। নারী পুরুষের খোলামেলা অনুষ্ঠানে একসাথে হাসি-ঠাট্টা, মশকারীর পরিবেশ তৈরি করা। পাশাপাশি বসিয়ে নারী-পুরুষের ক্লাসের ব্যবস্থা করিয়ে ফ্রি স্টাইলে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করা ইত্যাদি। অর্থাৎ এমন পরিবেশ থেকে দূরে থাকা, যে পরিবেশে গেলে একজন পরপুরুষ ও একজন পরনারী নিজেদের মনের কথা, অভিব্যক্তি, দুর্বলতা, পছন্দ, অপছন্দ ইত্যাদি সম্পর্কে আন্দাজ অনুমান করতে পারে। পরিনামে সেই তথ্যের সুযোগ ধরে একে অপরের প্রতি দুর্বল হবার কারণ ঘটবে। শয়তান এই সুযোগ কাজে লাগায়; নিজের স্ত্রীকে অনেক দোষে ভরপুর একজন মহিলা বলে মনে হবে, আর হাস্য-তামাসায় লিপ্ত পরনারীকে সকল গুণে গুণান্বিত বলে মনে হবে। স্বামী-স্ত্রী একত্রে থাকে বলে তাদের দোষ-গুণ গুলো দু’জনের কাছে প্রকাশিত থাকে। আর সে সমস্ত নারী পুরুষ কোন উপলক্ষে কোথাও একত্রিত হয়, সেখানে শুধু তাদের গুণ গুলো প্রকাশিত হয়; দোষগুলো প্রকাশিত হয়না বা ভুলেও দোষের আচরণ করেনা। ফলে তাদের প্রতি আকর্ষণ বেশি থাকে। তাই আল্লাহ ব্যভিচার তৈরি হবার যত উপকরণ আছে সেখান থেকেও দূরে থাকতে বলেছেন, কেননা মানবিক দুর্বলতায় আচ্ছন্ন মানুষ ঐ স্থান থেকে জিতে আসতে পারেনা।
৯. “আল্লাহ যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন, সত্য ব্যতিরেকে তাকে হত্যা কর না। আর যে ব্যক্তি মজলুম অবস্থায় নিহত হয়েছে তার অভিভাবককে আমি কিসাস দাবী করার অধিকার দান করেছি। কাজেই হত্যার ব্যাপারে তার সীমা অতিক্রম করা উচিত নয়, তাকে সাহায্য করা হবে”। আল্লার নির্ধারিত সীমার বাহিরে হত্যাকা- ঘটানো যাবে না। হত্যাকাণ্ডের জন্য কিসাসের ব্যবস্থা আছে, তবে যার থেকে কিসাস নেওয়া হবে, কিসাসের সাথে সাথে জেল, জরিমানা, অপমান করাকে সীমা লঙ্ঘন বলেছেন। ইসলামী শরীয়ত বৈধ হত্যার জন্য নিম্নলিখিত নীতিমালা দিয়েছে।
এক, জেনে বুঝে হত্যাকারী থেকে কিসাস নেওয়া।
দুই, আল্লাহর সত্য দ্বীনের পথে গায়ে পড়ে বাধাদান কারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।
তিন, ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা উৎখাত করার প্রচেষ্টাকারীদের শাস্তি দেওয়া।
চার, বিবাহিত পুরুষ ও নারীকে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার শাস্তি স্বরূপ।
পাঁচ, মুরতাদের শাস্তি স্বরূপ কিসাস দেওয়া।
১০. “ইয়াতীমের সম্পত্তির ধারে কাছে যেয়ো না, তবে হ্যাঁ সদুপায়ে, যে পর্যন্ত না সে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে যায়”। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আদেশ। ইয়াতীম যখন ছোট থাকে, তখন তার সম্পত্তি সম্পর্কে কোন জ্ঞান থাকেনা, ফলে অন্যরা নিজেদের ইচ্ছামত ব্যবহার করার সুযোগ পায়। ইয়াতীম নিজেও জানেনা তার সম্পত্তি কে ব্যবহার করছে, সম্পত্তি দিয়ে উপকারই বা কি। অতঃপর ইয়াতীম যখন বড় হয়; তখন কেউ তাকে না জানালে, তার জানার সুযোগ থাকেনা তার হক, আমানত হিসেবে কার কাছে কি সম্পদ আছে। ইয়াতীমের এই দুর্বলতার সুযোগে যিনি সেগুলো দীর্ঘ বছর ব্যবহার করেন, একপর্যায়ে সেগুলোর প্রতি তার মায়া বসে যায়। বাহিরের মানুষ জন সেগুলো তার সম্পদ বলে মনে করে। একপর্যায়ে ব্যবহারকারীর সন্তানেরাও ইয়াতীমের আমানতকে নিজেদের সম্পদ ভাবতে থাকে। এটি অন্যের সম্পদ তারা ভাবতেও চায়না, পরিণামে ব্যবহারকারী ব্যক্তি দুনিয়ার লোভে ইয়াতীমের সম্পদ ফেরত না দিয়ে নিজের দখলে রেখে দেন। এটি একটি চরম পরীক্ষা, দায়িত্বগত মুছিবতে না পড়া পর্যন্ত এই দায়িত্ব থেকে দূরে থাকা উচিত।
১১. “প্রতিশ্রুতি পালন করো, অবশ্যই প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে”। প্রতিশ্রুতির বেলায় কেয়ামতের দিন বেশি করে ধরা হবে। গরীব মানুষ প্রতিশ্রুতি দিয়ে, ভঙ্গ করলে তাকে দুনিয়ার প্রতি ঘাটে ঘাটে জবাবদিহি করতে হয়। গরীবের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত নিস্তার থাকেনা কেননা তার পিছনে শাসনযন্ত্র ব্যবহার করা যায়। তবে ধনী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা প্রতিশ্রুতি দিলে তার জবাবদিহিতা থাকেনা। গরীবের পক্ষে ক্ষমতা শীলদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করার সাহস থাকেনা। অধিকন্তু সমাজের ক্ষমতাশালীরা প্রতিশ্রুতিকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। সাধারণ মানুষের একটি সুন্দর পরিকল্পনাকে ক্ষমতাশালীরা প্রতিশ্রুতির অস্ত্র দিয়ে ল-ভ- করে দেয়। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা কখনও প্রতিশ্রুতিকে একটি লোভনীয় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে অসৎ ব্যক্তিবর্গ, অসৎ উদ্দেশ্যে সাধনে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবার বেলায় সর্বদা অগ্রগামী থাকে।
১২. “মেপে দেবার সময় পরিমাপ পাত্র ভরে দাও এবং ওজন করে দেবার সময় সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওজন কর। এটিই ভালো পদ্ধতি এবং পরিণামের দিক দিয়ে এটিই উত্তম”। ওজনে কম দেবার কারণে আল্লাহ একটি জাতিতে ধ্বংস করে দিয়েছেন। পাত্রে পরিমাপ করা জিনিষ পুরো পাত্র ভরে দিতে হবে। যেমন, তরল পরিমাপ করার মত পাত্র একজন গরীবের ঘরেও থাকে। বাটি, ঘটি, নারিকেলের খোল ইত্যাদি দিয়ে মোটামুটি ধারনা করা যায় জিনিষ কতটুকু কম-বেশি পেয়েছে। অন্যদিকে আল্লাহ ওজনের ক্ষেত্রে সঠিক দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করতে বলেছেন। দাঁড়িপাল্লা এবং বাটখারার ত্রুটি সাধারণের পক্ষে ধরা সম্ভব নয়। নিজের চোখের সামনে মাপা এক কেজি গোশত কিনে, ঘরে গিয়ে মাপলে হয় পৌনে এক কেজি! এ সমস্ত জালিয়াতি দাঁড়িপাল্লা এবং বাটখারার সাহায্যে করা হয়। তাই আল্লাহ এক্ষেত্রে পরিমাপ যন্ত্র সঠিক করার কথা বলেছেন। কেয়ামতের দিন ওজনে কম দেয়া ব্যক্তির চরম অপমান ও জিল্লতী হবে।
১৩. “এমন কোনও জিনিসের পেছনে লেগে যেয়ো না যে সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই। নিশ্চিতভাবেই চোখ, কান ও দিল সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে”। ধারনা, অনুমান, সন্দেহ করে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবেনা। ধারনা নির্ভর কোন বিষয়ে মন্তব্য করতে নিষেধ করা হয়েছে। এতে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, গীবত হয়, চোগলখোরি বেড়ে যায়। আরেক কথায়: যার যে কাজ তাকে দিয়ে সে কাজ করাতে হবে, প্রত্যেকের কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। যিনি যে কাজে দক্ষ তাকে সে কাজের সুযোগ না দেওয়ার নাম জুলুম; আবার যিনি যে কাজের উপযুক্ত নয় তাকে সেটার দায়িত্ব দেবার নামও জুলুম। আল্লাহ এক মানুষকে, এক যোগ্যতা দিয়ে দুনিয়াতে পাঠান। তার যোগ্যতা দক্ষতা দুনিয়া বাসীর প্রয়োজন বলেই তাকে সমসাময়িক সময়ে পাঠানো হয়। এতে যথোপযুক্ত ব্যক্তির যোগ্যতা দক্ষতা ব্যবহার না হলে সমাজে বিপর্যয় নিশ্চিত হয়; জনগণ সঠিক সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত থাকে, ইসলামে যা এক প্রকার জুলুম।
১৪. “জমিনের উপর দম্ভভরে চলা ফেরা কর না; তুমি না জমিনকে চিরে ফেলতে পারবে, না পাহাড়ের উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারবে”। অর্থাৎ ভূ-পৃষ্টে এমনভাবে চলাফেরা করা যাবে না কিংবা এমন ভাষায় কথা বলা যাবে না যার দ্বারা গর্ব-অহঙ্কার প্রকাশ পায়। আচরণে অন্যকে তুচ্ছ, তাচ্ছিল্য, কটাক্ষ, অবহেলা, খোঁটা দেওয়ার মাধ্যমে গর্ব-অহঙ্কারের প্রকাশ ঘটে। মানুষ যতই বড় হোক না কেন, সে মাটিকে না পদানত করতে পারবে না কখনও পাহাড়ের মত উঁচু সম্মানের অধিকারী হতেও পারবে না। মূলত: সকল প্রকার গর্ব অহঙ্কার শুধুমাত্র আল্লার জন্যই নির্ধারিত।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, আল্লাহর কাছে তার গর্ব, অহঙ্কার, বীরত্ব, শৌর্য, বীর্যের কোন মর্যাদা নাই। মানুষের মত শ্রেষ্ঠ জীবের প্রতিটি সকাল শুরু হয়, তার নিজের মল নিজের হাতে পরিষ্কারের মাধ্যমে। এই ধরনের অপদস্থ মূলক নিয়ম মানব ব্যতীত আল্লাহ আর কারও জন্য রাখেনি। মেথর হয়ে নিজের মল নিজের হাতে পরিষ্কার করে, যে মানুষকে প্রতিটি সকালের শুভ কাজ শুরু করতে হয়; সেই মানুষের জন্য ক্ষমতার বাহাদূরী শোভনীয় নয়। মিরাজের শিক্ষার প্রত্যেকটি কথাই সমাজের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব শীলদের জন্য বেশি প্রযোজ্য। অসহায় মানুষেরা এই ১৪ টি শর্তের বাহিরে গেলে সমাজের কর্তৃত্ববান মানুষেরা তাদের বিচারক সাজে। তবে সমাজ পরিচালনায় যারা ভূমিকা রাখে তাদেরকে প্রশ্ন করার কেউ থাকেনা। প্রশ্ন ও প্রতিবাদ কারীর সংখ্যা রাষ্ট্রে বেশি হলে, সে সমাজ ভালভাবে চলে, সঠিক নিয়মে হাটে। প্রতিবাদ কারীর সংখ্যা কম হলে, সে সমাজ শাসকের মন, মর্জি, খেয়াল, খুশি মত চলে। ফলে সেখানে আল্লাহর গজবের উপযোগী নীতি চালু হয়। তখনই আল্লাহর গজবে একটি সমৃদ্ধশালী জাতি এক নিমিষে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। আল্লাহ বলেছেন, “যখন আমি কোন জনবসতিকে ধ্বংস করার সংকল্প করি তখন তার সমৃদ্ধিশালী লোকদেরকে নির্দেশ দিয়ে থাকি, ফলে তারা সেখানে নাফরমানী করতে থাকে আর তখন আযাবের ফায়সালা সেই জনবসতির ওপর বলবত হয়ে যায় এবং আমি সেই জনবসতিকে ধ্বংস করে দেই”। সূরা বনী ইসরাইল-১৬