পূর্বের পর্ব পাঠ করতে এখানে ক্লিক করুন
হুদায়বিয়ার ঘটনা
পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত কা‘বা ছিল ইসলামের মূল কেন্দ্র। রাসূল (সা.) সহ মুসলমানগণ ইসলামের ইসলামের এই কেন্দ্রস্থল থেকে হিজরত করার ছয়টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। হজ্জ পালন করা ইসলামের মৌলিক স্তম্ভ হওয়া সত্ত্বেও তারা তা থেকে বঞ্চিত। এ কারণে মুসলমানদের অন্তর ব্যথিত ব্যাকুল।
এমতাবস্থায় একদিন রাসূল (সা.) স্বপ্নে দেখলেন, তিনি তাঁর সাথীদের নিয়ে পবিত্র মক্কায় গিয়ে ওমরা আদায় করছেন। নবীর স্বপ্ন নিছক স্বপ্ন বা কল্পনা নয়। বরং তা এক প্রকার ওহী। যা আল্লাহ তা‘আলা সূরা আল ফাত্হ এর সাতাশ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করেছেন। এভাবে “প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তাঁর রসূলকে সত্য স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আল্লাহ চাহেন তো তোমরা অবশ্যই মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে মস্তকমুন্ডিত অবস্থায় এবং কেশ কর্তিত অবস্থায়। তোমরা কাউকে ভয় করবে না। অতঃপর তিনি জানেন যা তোমরা জান না। এছাড়াও তিনি দিয়েছেন তোমাদেরকে একটি আসন্ন বিজয়।” এ কারণেই তা বাস্তবায়নে রাসূল (সা.)-এর জন্য জরুরি ছিল। কিন্তু কুরাইশরা তা আদৌ করতে দেবে কিনা সেটাই হলো সমস্যা। বাস্তবেও তারা ৬ বছর যাবত মুসলমানদের জন্য উমরা হজ্জের জন্য মক্কার কাছেও যেতে দেয়নি। এমতাবস্থায় রাসূল (সা.)-কে একটি কাফেলাসহ বিনা বাঁধায় যেতে দিবে তা কল্পনাও করা যায় না। তবে নবীর পদমর্যাদা এই যে, তাঁর রব্ব তাঁকে যে নির্দেশই দান করেন তা তিনি বিনা দ্বিধায় বাস্তবায়ন করেন। তাই রাসূল (সা.) তাঁর স্বপ্নের কথা দ্বিধাহীন চিত্তে সাহাবীদের সামনে উপস্থাপন করলেন এবং উমরার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। এ অবস্থায় যারা প্রকৃত ঈমানের বলে বলিয়ান তাদের সমন্বয়ে ১৪শ সাহাবী যে কোন মূল্যে তারা উমরার জন্য প্রস্তুত হলেন।
৬ষ্ঠ হিজরীর ‘যুলকা‘দা’ মাসে প্রথম দিকে এ পবিত্র কাফেলা মদীনা থেকে যাত্রা করলো। যুল হুলাইফাতে পৌঁছে সবাই উমরার জন্য ইহরাম বাঁধলেন। কুরবানীর জন্য ৭০টি উট সাথে নিলেন। আরবের প্রথা অনুযায়ী আত্মরক্ষার্থে একখানা তরবারি সাথে নিলেন। এ ভাবে তাদের এ কাফেলা লাব্বায়িক ধ্বনী তুলে বায়তুল্লাহ অভিমুখে যাত্রা করলেন।
এ দিকে রাসূল (সা.) তাঁর দূরদর্শিতার ফলে সন্দেহ হয়েছিলো যে, কুরাইশগণ নির্বিঘেœ বায়তুল্লাহ প্রবেশ করতে নাও দিতে পারে। আর এ আশঙ্কায় তিনি কুরাইশদের অভিপ্রায় জানার জন্য আগে ভাগেই বনী কা‘ব গোত্রের এক ব্যক্তিকে গুপ্তচর হিসেবে পাঠিয়েছিলেন, সেই এই মর্মে সংবাদ নিয়ে এলো যে, কুরাইশ সমস্ত গোত্রকে একত্রিত করে মুহাম্মাদকে বায়তুল্লাহ প্রবেশে বাঁধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনকি তারা মক্কার বাইরে সৈন্য সমাবেশ করতে শুরু করেছে। এবং মুকাবালার জন্য সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে আছে।
কুরাইশদের সঙ্গে আলোচনা
এ খবর পাওয়া মাত্র রাসূল (সা.) রাস্তা পরিবর্তন করলেন এবং ভীষণ কষ্ট স্বীকার করে অত্যন্ত দুর্গম একটি পথ ধরে হারাম শরীফের একেবারে প্রান্ত সীমায় অবস্থিত হুদায়বিয়ায় শিবির স্থাপন করলেন। এখানকার খুজআ গোত্রের প্রধান বুদায়েল রাসূলের নিকট আসলে তিনি তাকে বললেন, আমরা কোন ধরণের যুদ্ধ বিগ্রহের জন্য আসিনি। কেবল মাত্র বায়তুল্লাহর যেয়ারত ও তাওয়াফের জন্য এসেছি। কুরায়েশদের নিকট বুদায়েল যখন এ কথা জানালো, তখন তারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। এ অবস্থায় বুদায়েল কুরায়েশদেরকে বললো, আমরা এ অন্যায় কাজে সহযোগিতার জন্য মিত্রতা করিনি। এরপর কুরায়েশদের মধ্যে অন্যতম চিন্তাশীল ব্যক্তি ওরওয়া বললো, আমি গিয়ে মুহাম্মাদের সঙ্গে আলাচনা করবো। ওরওয়া রাসূলের খেদমতে হাজির হলো কিন্তু মীমাংশা হলো না। এরপর কুরায়েশদের পক্ষে মাসউদ সাকাফী এসে রাসূলকে ভালো-মন্দ সবদিক বুঝিয়ে তাকে মক্কায় প্রবেশ না করার পরামর্শ দিলো।
দূতের আসা-যাওয়া ও আলাপ-আলোচনা চলাকালীন সময়ে গোপনে রাসূল (সা.)-এর সেনা শিবিরে আকস্মিক হামলা চালিয়ে সাহাবীদের উত্তেজিত করা এবং যুদ্ধের অজুহাত হিসেবে কাজে লাগানো যায়, তাদের দ্বারা এমন কোন কাজ করানোর জন্য কুরায়েশরা বারবার চেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু সাহাবায়ে কেরামের ধৈর্য ও সংযম এবং রাসূল (সা.)-এর বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি তাদের সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। তারা মুসলমানদের বিপক্ষে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল পাঠিয়ে ঝটিকা আক্রমণের চেষ্টা করতো। কিন্তু প্রতিবারই তারা সাহাবীদের হাতে বন্দী হলে রাসূল (সা.) তাদের ক্ষমা করে মুক্ত করে দিতেন। এভাবে কুরাইশরা তাদের প্রতিটি দূর্তামী ও অপকৌশল ব্যর্থতার পর্যবসিত হতে থাকে। অবশেষে রাসূল (সা.) নিজের পক্ষ থেকে উসমান (রা.)-কে নিজের দূত হিসেবে মক্কায় পাঠান, এবং তার মাধ্যমে কুরায়েশদের নেতাদের জানিয়ে দেন, যে, আমরা যুদ্ধের জন্য নয়, বরং বায়তুল্লাহ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কুরবানীর পশু সঙ্গে নিয়ে এসেছি। কাজ সমাধা হলেই আমরা মদীনায় ফিরে যাবো। উসমান (রা.) মক্কায় গেলেন, কিন্তু কা‘বা যেয়ারতের জন্য মুসলমানদের সুযোগ দিতে মোটেও রাজী হলো না। উল্টো হযরত উসমানকে তারা আটক করে রাখলো।
বাইয়াতে রেদওয়ান
পূর্বের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, ইসলামের বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম করে তারা কোন নীতি-নৈতিকতার ধার ধারেনা। তাদের অন্যতম মূল হাতিয়ার হলো মিথ্যার আশ্রয় নেয়া,মিথ্যা প্রপাগা ন্ডা করা,পেশি শক্তির মাধ্যমে জেল-জুলুম,নির্যাতন,হত্যা ও অরাজকতা সৃষ্টিকরে ইসলাম পন্থীদের ওপর দোষারোপ করা। ইদানিংকালে তাদের সাথে যোগ হয়েছে ইহুদীদের দ্বারা প্রভাবিত এক শ্রেণীর ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা। তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন ও সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার টুকুও হরণ করে নেয়। এমতাবস্থায় ইসলাম তাদের বিরুদ্বে পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োজনে প্রতিরোধের বিধান রেখেছে। অন্যথায় ইসলামপন্থীদের আত্মরক্ষার মাধ্যমে মানবতার কল্যাণে ইসলামের অগ্রযাত্রার কাজ পরিচালনা করা আরো কঠিন হয়ে যেত। আল্লাহর বাণী,“যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে;কারণ,তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে;নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম।” (সূরা হাজ্জ-৩৯)। যার বাস্তবতা আমরা হুদায়বিয়ার ঘটনায় দেখতে পাই। নানা অজুহাত দেখিয়ে ওমরা পালনে বাধা দেয়া, যুদ্ধ নিষিদ্ধ মাসে গোপনে আক্রমণ করে মুসলমানদের ওপর দোষ চাপানোর পরিকল্পনা করা, শান্তির প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া রাসূল সা:এর দূত হযরত ওসমান (রা:) কে বন্দী করে হত্যার সংবাদ প্রচার করা।
ইবনে ইসহাক বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর আমাকে জানিয়েছেন যে,রাসূলুল্লাহ সা: যে মুহূর্তে শুনলেন যে,ওসমান রা:নিহত হয়েছেন, সে মুহূর্তেই বললেন,“ কুরাইশদের বিরুদ্ধে ওসমান হত্যার বদলা না নেয়া পর্যন্ত মদীনায় ফিরে যাওয়া হবেনা”। একথা বলেই তিনি একটি বাবলা গাছের নীচে বসে পড়লেন। তিনি সাহাবীদের কাছ থেকে এই মর্মে শপথ গ্রহণ করলেন:“ঘটনা সত্য হলে আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো,তবু লড়াই থেকে পিছু হটবো না”। তিনি নিজের এক হাতকে ওসমানের হাত বলে আখ্যায়িত করে তাঁঁর ওপর নিজের পক্ষ থেকে অন্য হাত রেখে বললেন,“অংগীকার কর”। মুসলমানগণ আন্তরিকতার সাথে শাহাদাতের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে কুরাইশদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য শপথ গ্রহণ করেন। এই শপথের নাম হচ্ছে ‘বাইয়াতে রিদওয়ান’। সত্যের সৈনিকদের জীবনে এরূপ অনেক মুহূর্ত আসে যা তাদেরকে দুর্বলতার পরিবর্তে ঈমানী শক্তি আরো বৃদ্ধি করে দেয়। কুরাইশরা দেখলো মুহাম্মাদ সা:এর সাথীরা তাঁর হাতের ইশারায় জীবন দিতেও প্রস্তুত। রাসূল সা:বললেন,“আজকের দিন তোমরা সারা দুনিয়ার মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ”। মুসলমানদের ঈমানী জযবা ও দীনকে বিজয় করার জন্য প্রয়োজনে তারা শহীদ হবেন কিন্তু বাতেলের কাছে নতি স্বীকার করবেন না বলে যে মনোবল দেখালেন সে জন্যে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেন। আল্লাহর বাণী, আল্লাহ মু‘মিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন যখন তারা বৃক্ষতলে তোমার নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেছেন,তিনি তাদের অন্তরে যা ছিল তা অবগত হলেন তাই তাদেরকে তিনি দান করলেন প্রশান্তি এবং তাদেরকে বিনিময় দিলেন আসন্ন বিজয়”। সুরা ফাত্হ – ১৮। এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সুসংবাদ দান করেছেন যে, যারা এ ভয়ংকর পরিস্থিতিতে জীবন বিলিয়ে দিতে সামান্য দ্বিধা করেনি এবং রাসূলের হাতে হাত দিয়ে জীবন উৎসর্গ করার জন্য শপথ করে ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছেন তিনি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। চৌদ্দশো মুসলমানের আমরণ লড়াইয়ের প্রতিজ্ঞার খবর পেয়ে কুরাইশরা হযরত ওসমান রা:কে ফেরত দিলো এবং সন্ধি করতে সম্মত হলো।
হযরাত ওসমান রা:ফিরে আসলেন এবং কুরাইশদের পক্ষ থেকে সন্ধির বিষয় আলোচনা করার জন্য সুহাইল ইবনে আমরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলও রাসূল সা:এর নিকট পৌঁছলো। নবী সা:এবং তাঁর সাথীদের আদৌ মক্কায় প্রবেশ করতে দিবে না-কুরাইশরা তাদের এ জিদ ও একগুয়েমী পরিতাগ করলো। তবে নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য তারা বললো যে মুসলমানরা এ বছর ফিরে যাবেন এবং আগামী বছর আসতে পারবেন। সন্ধিপত্র লেখার জন্য হযরত আলী রা:কে ডাকা হলো। চুক্তির শুরুতে যখন রাসূল সা: “বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম” লেখার নির্দেশ দিলেন, তখন সুহাইল বললো,“রহমান রাহীম” আবার কি? আমাদের নিয়মানুযায়ী “বিছমিকা আল্লাহুম্মা” (হে আল্লাহ তোমার নামে) লেখা হোক। রাসূল সা:এ দাবী মেনে নিলেন। এরপর বললেন, লেখ,“নিম্নলিখিত চুক্তি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ ও সুহাইল বিন আমরের মধ্যে সম্পাদিত হলো”। সুহাইল বললো, যদি আপনাকে আল্লাহর রাসূল মানতাম,তাহলে আপনার সাথে যুদ্ধ করতাম নাকি? আপনি শুধু নিজের নাম ও নিজের বাপের নাম লিখান। এসব কথায় সাহাবীদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। আলী রা: এটা কিছুতেই মানতে রাজী হলেন না। রাসূল সা:নিজের হাতে ঐ কথাটা কেটে তার পরিবর্তে ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’ লেখালেন। সুহাইলের এসব ধৃষ্টতা দেখে সাহাবীরা উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু রাসূল সা: এর কারণে সংযম প্রদর্শন করলেন।
সন্ধির ফলাফল
সন্ধি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর রাসূল সা: সাহাবীদেরকে কুরবানী করে মাথার চুল কামিয়ে ফেলতে আদেশ দিলেন। কিন্তু অস্থিরতা,দু:খবেদনার কারণে কেউ নড়া-চড়া করলোনা। পরপর তিনবার নির্দেশ দিলেন তাতেও কাজ হলোনা। এ থেকে সহজেই বুঝা যায় যে, তারা কতটা মানসিক কষ্টে ছিলেন। মানবীয় তৎপরতার ক্ষেত্রে কত বিচিত্র রকমের পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে,তা এ ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়। রাসূল সা: মর্মাহত হয়ে নিজ তাবুতে ফিরে উম্মুল মু‘মিনিন হযরত উম্মে সালামা রা:র কাছে ঘটনা খুলে বললেন। উম্মে সালামা রা: তাঁকে সান্ত¦না দিয়ে বললেন: চুক্তির শর্ত পালনে তারা মর্মাহত। আপনি বাইরে গিয়ে নিজের কুরবানী করে মাথার চুল মুন্ডন করুন। দেখবেন তাদের মনে যতই ব্যাথা থাকুক তারা আপনার আনুগত্য না করে পারবেনা। উম্মে সালামা রা:এর পরামর্শে রাসূল সা: তাই করলেন। সাথে সাথে সমস্ত সাহাবীগণ তাঁকে অনুসরন করলেন এবং আনুগত্যের বাস্তব উদাহরণ পেশ করলেন। চুক্তি স্বাক্ষরের পর হুদায়বিয়ায় তিন দিন অবস্থানের পর তিনি মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। মক্কা ও মদীনার মাঝখানে আসতেই এই সন্ধি চুক্তিকে স্পষ্ট বিজয় অভিহিত করে আল্লাহ তা‘য়ালা সূরা আল্ ফাতাহ নাযিল করেন। “নিশ্চয়ই ( হে রাসূল) আমি তোমাকে দান করেছি সুস্পষ্ট বিজয়”। তখনকার সময় এ বিজয় অস্পষ্ট মনে হলেও পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ বলে দেয় যে, সত্যিকারেই হুদায়বিয়ার সন্ধি ছিলো স্পষ্ট বিজয়। ইসলামী আন্দোলনে দীর্ঘ সংগ্রামী পথ পরিক্রমায় মুহাম্মাদ সা:কে কোরাইশরা তেমন মূল্যায়নই করেনী। এই সন্ধির মাধ্যমে তারা প্রথম বারের মতো মুহাম্মাদ সা:কে একজন অপরাজেয় শক্তিরূপে স্বীকার করে নিলো। এর ফলে কোরেশদের মনে ক্ষতের সৃষ্টি হলো এবং তাদের মধ্যে বিবেধ দেখা দিলো।
এতদিন ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের ধারক-বাহক মুহাম্মাদ সা: ও তাঁর কর্মী বাহিনীর ব্যাপারে জনগণের মধ্যে বিরুপ মনোভাব সৃষ্টির জন্য কোরেশরা নানা ধরনের মিথ্যা প্রপাগান্ডা ও কুৎসা রটনা করে আসছিলো। ফলে মানুষেরা দূর থেকে সে প্রপাগান্ডায় প্রভাবিত হয়ে তাদের চরম শত্রু মনে করতো। এখন এ চুক্তির ফলে জনসাধারন মুসলমানদের সাথে অবাধে মেলা-মেশার সুযোগ পেল। ইসলামী সংগঠনের লোকদের অতি নিকট থেকে দেখার ও জানার সুযোগ আসলো। যাদের বিরুদ্ধে ক্রোধ ও বিদ্বেষ পুঞ্জীভূত হয়েছিলো, তাদেরকে তারা নৈতিক চরিত্র,আচার-ব্যাবহার ও স্বভাব চরিত্রের দিক দিয়ে আপন লোকদের চেয়েও বেশী উন্নতমানের দেখতে পেল। তারা আরো দেখতে পেল,ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে তারা এতদিন যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষন করে আসছে,কিন্তু তা সত্ত্বেও কোরেশদের প্রতি মুসলমানদের মনে কোন ঘৃনা বা শত্রুতা নেই। বরং তাদের যা কিছু ঘৃনা তা শুধু তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস ও মানবতা বিবর্জিত আচার-পদ্ধতির বিরুদ্ধে। ইসলামী কর্মীরা যা কিছু বলে তার প্রতিটি কথা সহানুভূতি ও মানব কল্যাণে পরিপূর্ণ। এতো রক্তপাত সত্ত্বেও তারা বিরুদ্ধবাদীদের সাথে সহানুভূতি ও সদাচারণের বেলায় কোন ত্রুটি করেনা। এর ফলে ইসলাম বিদ্ধেষীরা কতখানি ভ্রান্তধারনা ও অমানবিক কার্যকলাপে নিমজ্জিত ছিলো,তা তারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারলো। তারা আরো অবলোকন করতে পারলো যে, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের আধ্যাত্মিক,মানসিক,নৈতিক,বৈষয়িক ও জ্ঞানগত উন্নতির বিষয়। চুক্তির ফলে অবাধে মেলা-মেশার সুযোগে ইসলামের অন্তর্নিহিত বিষয় যতই জানতে লাগলো ততই জনসাধারণ ইসলামের ছায়াতলে সমবেত হতে লাগলো। সন্ধির মাত্র দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে এতো লোক ইসলাম গ্রহণ করলো যে, ইতিপূর্বে কখনো তা ঘটেনী। এ সময় বিখ্যাত সেনাপতি খালিদ বিন অলীদ ও আমর বিন আস (রা:) ইসলাম গ্রহণ করলে মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি পেল। ফলে ইসলাম ব্যাপকভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। সন্ধির পূর্বে যেখানে চৌদ্দশত সাহাবী নিয়ে ওমরায় রওয়ানা দিয়েছিলেন-মাত্র দু‘বছর পর মক্কা অভিযানের সময় সে সংখ্যা দশ হাজারের বেশী অতিক্রম করেছিলো। মূলত: ফলাফলে দিক থেকে হুদায়বিয়ার সন্ধি সত্যিকারে একটা মহা বিজয় হিসেবেই পরিগণিত হলো। নানা শংকা ও জটিলতার অবসান করে কোরেশদেরকে সন্ধিতে বাধ্য করা এবং চুক্তির পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মাধ্যমে রাসূল সা: এর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও নেতাসূলভ প্রজ্ঞারই পরিচয় বহন করে। কাজেই হুদায়বিয়ার সন্ধি থেকে মুসলমানরা কিয়ামতের আগ পর্যন্ত শিক্ষা নিতে থাকবে।