মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মক্কী জীবন

রাসূলুল্লাহর মাক্কী জীবন

রাসূলুল্লাহর মাক্কী জীবন

পূর্বে প্রকাশিতের পর 
প্রথম স্তরঃ

গোপন দাওয়াতঃ নবুওয়াতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হবার পর প্রথম সমস্যা ছিলোঃ এক আল্লাহর ইবাদত কবুল করে অসংখ্য মিথ্যা রবের অস্তিত্ব অস্বীকার করার দাওয়াত প্রথম কোন্ ধরনের লোকদের দেয়া যাবে? দেশ ও জাতির লোকদের তখন যে অবস্থা ছিলো, তার একটি মোটামুটি ধারণা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধরনের লোকদের সামনে তাদের মেজাজ, পছন্দ ও অভ্যাসের সম্পূর্ণ বিপরীত কোনো জিনিস পেশ করা বাস্তবিকই অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিলো। তাই যে সব লোকের সঙ্গে এতদিন মুহাম্মাদ (সা.) -এর খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলো এবং যারা তাঁর স্বভাব-প্রকৃতি ও নৈতিক-চরিত্র সম্পর্কে সরাসরি অবহিত ছিলেন, তাঁদেরকেই তিনি সর্বপ্রথম দাওয়াতের জন্যে মনোনীত করলেন। কারণ, এদের তাঁর (রাসূলের) সততা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে কোন আপত্তি ছিলো না এবং তিনি কোন কথা বললে তাকে সরাসরি অস্বীকার করা এঁদের পক্ষে সম্ভবপর ছিলো না। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন খাদীজা (রাঃ), আলী (রাঃ), জায়েদ (রাঃ), আবু বকর (রাঃ) প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ একেবারে সূচনাতেই তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাক্ষ্য দিয়ে দিলেন যে, আহ্বায়কের সত্যবাদিতা ও আন্তরিকতায় কোন সন্দেহ নেই। আবু বকর (রাঃ) রাসূল (সা.) -এর আন্দোলনের সৈনিক হওয়া মাত্রই নিজের প্রভাবাধীন লোকদের মধ্যে জোরে শোরে কাজ শুরু করে দিলেন। তিনি হযরত ওমর, ওসমান, যুবায়ের, আব্দুর রহমান বিন আওফ, সা‘দ বিন আবি ওয়াক্কাস, তালহা (রাঃ) প্রমুখসহ বেশ কিছু সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকে এ বিপ্লবী আন্দোলনের সদস্য বানিয়ে ফেললেন। অত্যন্ত সতর্কতা, গোপনীয়তা ও নীরবতার মধ্য দিয়ে তারা এ কাজের প্রসার ঘটাতে লাগলেন এবং মুসলমানদের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পেতে লাগলো।
কুরআনের প্রভাবঃ এ পর্যায়ে কুরআনের যে অংশগুলো নাযিল হয়েছিলো, তা ছিলো ইসলামের প্রথম স্তরের উপযোগী ছোট-খাটো বাক্য-সমন্বিত। এর ভাষা ছিলো অতীব প্রাঞ্জল, কবিত্বময় ও হৃদয়গ্রাহী। উপরোন্তু এতে এমন একটা সাহিত্যিক চমক ছিলো যে, শোনার সঙ্গে-সঙ্গেই তা শ্রোতার মনে প্রভাব বিস্তার করতো এবং এক একটি কথা তীরের ন্যায় বিদ্ধ হতো। এসব কথা যে শুনতো তার মনেই প্রভাব বিস্তার করতো এবং বারবার তার আবৃত্তি করার ইচ্ছা জাগতো। আল্লামা শিবলী নু’মানীর মতে হযরত আবু যার (রাঃ) ৬ষ্ঠ বা ৭ম নম্বরে মুসলমান হয়েছিলেন। তিনিও সেই সব ব্যক্তিদের অন্যতম, যারা অস্থিরতায় ভুগছিলেন এবং মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়ে নিছক আপন নির্মল স্বভাব ও বিবেকের তাড়নায় সত্যের সন্ধানে উদগ্রীব হয়েছিলেন। যেভাবেই হোক তিনিও রাসূল (সা.)এর খবর পেলেন। অতঃপর নিজের ভাইকে সঠিক তথ্য জানার জন্য পাঠালেন। তাঁর ভাই রাসূল (সা.)-এর সাথে সাক্ষাত করলেন, এবং কুরআন তেলাওয়াত শুনলেন এবং ফিরে গিয়ে ভাইকে বললেন, “আমি এই দাওয়াত দাতাকে দেখে এসেছি। লোকেরা তাকে ধর্মত্যাগী বলে থাকে। কিন্তু তিনি মহৎ চারিত্রিক গুণাবলী শিক্ষা দেন এবং এমন এক বিস্ময়ের বাণী শোনান, যা মারাসূলয় কবিতা থেকে একেবারেই অন্য রকম। তাঁর চালচলন তোমার অতি পছন্দনীয় মনে হবে।” এরপর তিনি নিজে এলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন। শুধু কি তাই? যে সমস্ত বড়-বড় লিডারগণ ইসলামের ঘোর বিরোধিতায় ছিলো সোচ্চার, তারাও গোপনে কুরআন তেলাওয়াত শুনতো।
আকীদা-বিশ্বাসের সংশোধনঃ কুরআনে কারীমের প্রথম দিকের সূরা গুলোতে তাওহীদ ও আখেরাতের তাৎপর্য বর্ণনা করা হচ্ছিলো। এ ব্যাপারে এমন সব প্রমাণাদি পেশ করা হচ্ছিলো, যা প্রতিটি শ্রোতার মনে বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছিলো। এসব দলীল-প্রমাণ শ্রোতাদের নিকটতম পরিবেশ থেকেই পেশ করা হচ্ছিলো। পরন্তু এসব কথা এমন ভঙ্গীতে পেশ করা হচ্ছিলো, যে সম্পর্কে শ্রোতারা পুরোপুরি অভ্যস্ত ও অবহিত ছিলো। তাদেরই ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিতে এসব কথা বোঝাবার চেষ্টা করা হচ্ছিলো। আকীদা-বিশ্বাসের যেসব ভ্রান্তি সম্পর্কে তারা ওয়াকিফহাল ছিলো, সেগুলো সম্পর্কেই আলোচনা করা হচ্ছিলো। এ কারণেই আল্লাহর এ কালাম শুনে কেউই প্রভাবিত না হয়ে পারছিলো না। আল্লাহর রাসূল প্রথমে একাকীই এই আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কিন্তু কুরআনের এ প্রাথমিক আয়াতসমূহ এ ব্যাপারে অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। ফলে গোপনে-গোপনে আন্দোলন অত্যন্ত দ্রুততার সাথে বিস্তার লাভ করতে থাকে। এ পর্যায়ে দাওয়াত প্রচারের জন্য তাওহীদ ও আখিরাতের দলীল-প্রমাণের সঙ্গে-সঙ্গে এই বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্যে খোদ মুহাম্মাদ (সা.)-কে কিভাবে আত্মপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এবং কি-কি পন্থা তাঁকে অবলম্বন করতে হবে, সে সম্পর্কেও তাঁকে সরাসরি শিক্ষাদান করা হচ্ছিলো।
গোপনে সালাতঃ এ পর্যন্ত সবকিছু গোপনে গোপনেই হচ্ছিলো। নেহাত বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য লোক ছাড়া বাইরের কারো কাছে যাতে কিছু ফাঁস না হয়ে যায়, সেজন্যে হামেশা সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছিলো। নামাজের সময় হলে মুহাম্মাদ (সা.) আশপাশের কোনো পাহাড়ের ঘাঁটিতে চলে যেতেন এবং সেখানে নামাজ আদায় করতেন। একবার তিনি হযরত আলী (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে কোনো এক জায়গায় নামাজ পড়ছিলেন। এমন সময় তাঁর চাচা আবুতালিব ঘটনাক্রমে সেখানে এসে হাযির হলেন। তিনি অনেকক্ষণ ধরে ইবাদতের এই নতুন পদ্ধতি তাজ্জবের সাথে লক্ষ্য করলেন। নামাজ শেষ হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কোন্ ধরনের দ্বীন?” জবাব দিলেন, “এটা ইবরাহীম (আঃ)-এর দ্বীন।” আবু তালিব বললেনঃ “বেশ, আমি যদিও এটা গ্রহণ করতে পারছি না, তবে তোমাকে পালন করার পুরো অনুমতি দিলাম। কেউ তোমার পথে বাধ সাধতে পারবে না।”
প্রথম যুগের মু‘মিনদের বৈশিষ্ট্যঃ এ যুগের বৈশিষ্ট্য ছিলো এই যে, এ সময়ে ইসলাম গ্রহণ ছিলো প্রকৃতপক্ষে জীবন নিয়ে বাজী খেলার নামান্তর। কাজেই এ যুগে যাঁরা সামনে অগ্রসর হয়ে ইসলামের দাওয়াত কবুল করেন, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই কিছু অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিলো, যার ভিত্তিতে তাঁরা এ বিপদ-সংকুল পথে অগ্রসর হবার সাহস পেয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো, এসব লোক আগে থেকেই মুশরিকী রসম-রেওয়াজ ও ইবাদত-বন্দেগীর প্রতি অনীহা এবং সত্যের জন্যে অনুসন্ধিৎসু ছিলেন। স্বভাব-প্রকৃতির দিক দিয়ে তাঁরা ছিলেন সৎ ও পুতঃপবিত্র চরিত্রের অধিকারী। গোপনীয়তা অবলম্বন করা সত্ত্বেও সত্যের সুবাস বাতাসের ওপর ভর করেই দিক থেকে দিগন্তে ছুটে যাচ্ছিলো। এ সময়ে রাসূল (সা.)-কে নানা রকমের কু-খেতাব দেয়াও শুরু হয়ে গিয়েছিলো। তথাপি পরিবেশ মোটামুটি শান্ত ও স্বাভাবিক ছিলো। লক্ষনীয় ব্যাপার হলো ইসলামী আন্দোলনের এই প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের মধ্যে একজনও এমন ছিলেন না, যিনি উচ্চতর জাতীয় ও ধর্মীয় পদে আসীন ছিলেন। এর ফলে তাঁরা সকল স্বার্থপরতার বন্ধন থেকে মুক্ত ছিলেন। ইতিহাসে এ ধরনের স্বাধীনচেতা যুবকরাই বড়-বড় পরিবর্তন সূচিত করার জন্য সম্মুখ কাতারে অবস্থান গ্রহণ করে থাকে। নেতা ও পদস্থ ব্যক্তিরা কেউ এ কাজে অবদান রাখেনি। গোপনীয় স্তরের এই ইসলামী আন্দোলনকে কুরাইশ নেতারা কোন গুরুত্ব মনে করেনি। কুরাইশরা আরো মনে করতো যে, লাত, মানাত ও উয্যার মত দেবতাদের আমরা যখন এত ভক্তি ও পূজা করি, তখন তারাই যাবতীয় ব্যাপারে হেফাজত করবে এবং গুটিকয়েক তাওহীদ পন্থীদের খতম করে দেবে।
দ্বিতীয় স্তরঃ
প্রকাশ্য দাওয়াত; প্রায় তিন বছর যাবত দাওয়াত ও প্রচারের কাজ এভাবে গোপনে গোপনে চলতে লাগলো। কিন্তু কতোদিন আর এমনিভাবে চলা যায়! যে সূর্যকে আপন রশ্মি দ্বারা সারা দুনিয়াকে আলোকময় করে তুলতে হবে, তাকে তো লোকচক্ষুর সামনে আত্মপ্রকাশ করতে হবেই। ইতিমধ্যেই লোকেরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আসতে শুরু করে। ফলে মক্কার সর্বত্র ইসলামের কথা ছড়িয়ে পড়ে এবং এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হতে থাকে। পরিস্থিতি চিরদিন একইভাবে থাকতে দেয়া আল্লাহর রীতি নয়। আল্লাহর বাণী, “আমি এ দিবসসমূহকে মানুষের মধ্যে পালাবদল করাই; এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাদেরকে আল্লাহ এরূপে প্রকাশ করেন।” (ইমরান-১৪০)। তিনি বাতিলের প্রতিরোধের জন্য সত্যকে সামনে নিয়ে আসেন। আল্লাহর বাণী; “আমি সত্য দ্বারা আঘাত হানি মিথ্যার উপর; ফলে ওটা মিথ্যাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয় এবং তৎক্ষণাৎ মিথ্যা উৎখাত হয়ে যায়।” (আম্বিয়া-১৮)। আল্লাহর এই চিরাচরিত রীতি অনুসারে আদেশ জারী হলোঃ “অতএব তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছো, প্রকাশ্যে প্রচার কর এবং মুশরিকেদের উপেক্ষা কর।” (হিজর-৯৪)। তিনি আরো বলেন, “তোমার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করে দাও এবং যারা তোমার অনুসরণ করে সেই সব মুমিনের প্রতি বিনয়ী হও। আর বলোঃ আমি প্রকাশ্য সতর্ককারী।” (শুআ‘রা-২১৪,২১৫)।
রাসূল (সাঃ) সমস্ত হিম্মত ও সাহস সঞ্চয় করে, নতুন সম্ভাব্য সংঘাতময় পরিস্থিতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে একদিন সাফা পর্বতের ওপর এসে দাঁড়িয়ে আরবের বিশেষ রীতি অনুযায়ী কুরাইশ জনতাকে বিশেষ সাংকেতিক ধ্বনি দিয়ে ডাক দিলে লোকেরা ছুটে এলো। সবাই রুদ্ধশ্বাসে কান পেতে রইল কী হয়েছে, জানার জন্য। রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলেনঃ ‘আমি যদি তোমাদের বলি, এ পাহাড়ের অপর পাশে হানাদার বাহিনী তোমাদের ওপর আক্রমণ চালাতে ছুটে আসছে, তাহলে তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে?’ সবাই সমবেত স্বরে বলে উঠলোঃ হ্যাঁ, কেন করবোনা? আমরা তোমাকে সব সময় সত্য কথাই বলতে দেখেছি এবং আমরা তোমাকে আল্ আমীন বলেই জানি। রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘তাহলে শোনো, আমি বলছি, তোমরা এক আল্লাহকে প্রভু ও উপাস্য মেনে নাও, আর মূর্তি-পূজা ছেড়ে দাও। নচেত তোমাদের ওপর কঠিন শাস্তি নেমে আসবে।’ যখনই তিনি তাদেরকে মহা-সত্যের দিকে আহবান জানালেন ঠিক তখন থেকেই তারা তাঁর মিশনকে একটা ভয়ংকর ও মারাত্মক বলে মনে করলো, তাঁর বিরুদ্ধে প্রচন্ডভাবে ক্ষেপে উঠলো। তাঁর চাচা আবু লাহাব কথাটা শোনা মাত্রই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললো, ‘ওরে হতভাগা তুই আজকের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যা। এই কথা বলার জন্যই কি আমাদের এখানে ডেকেছিলি?’ আবু লাহাবের সাথে অন্যরাও খুবই ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গেল। অথচ তারাই তাঁকে আল্ আমীন (বিশ্বস্ত) বলে স্বীকার করে নিয়ে ছিলো। তাঁর কাছে তাদের সম্পদ আমানত রাখতো এবং বিচার-ফয়সালার ভার তাঁর ওপর ন্যাস্ত করতো। যেই সততা নিষ্ঠার কারণে তাকে ভালো বাসতো সেই সত্য নীতি সমাজে প্রতিষ্ঠা করার কথা যখনই বলা হলো তখনই তারা তা বরদাশত করতে পারলো না মহাশত্রু মনে করলো এবং শত্রুতায় কোমর বেঁধে নামলো। বাতিলরা যে সব সময় সত্যের বিপক্ষে অবস্থান নিবে সে কথা আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলসহ (সাঃ) বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন পবিত্র কুরআনুল কারীমে। আল্লাহর বাণী, “তিনি সেই আল্লাহ যিনি তাঁর রাসূলকে হেদায়াত (কুরআন) এবং সত্য ধর্ম সহকারে প্রেরণ করেছেন, যেন ওকে সকল ধর্মের উপর বিজয়ী করে দেন, যদিও মুশরিকদের জ্বালা ধরে।” (তাওবা: ৩৩ ফাত্হ: ২৮ ছফ: ৯)। জাহেলিয়্যাতের যুগের মানুষগুলো না হয় রাসূল (সাঃ)-কে রাসূল হিসেবে মেনে নিতে চায়নি তাই তারা বিরোধিতা করেছে। কিন্তু আজ আমরা কি করছি? আমরাতো রাসূল (সাঃ)-কে মেনে নিয়েছি, বিশ্বাস করেছি, রাসূল প্রেমিক বলে দাবীও করি। অথচ রাসূল (সাঃ)-এর নীতি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক তা আমাদের ভালো লাগে না, বিরোধীতা করি, শত্রুতা পোষণ করি। অথচ এ কাজে আত্মনিয়োগ করা প্রতিটি মুসলমানের ওপর ফরজ। যে কারণে কাফের মুশরিকদের জ্বালা ধরে তা যদি আমাদের ও স্পর্শ করে তাহলে আমাদের অবস্থান কোথায়? আল্লাহর বাণী: “ঈমানের নিয়ামত একবার লাভ করার পর পুনরায় যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে, তাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত দান করবেন, এটা কেমন করে সম্ভব হতে পারে? অথচ তারা নিজেরা সাক্ষ দিয়েছে যে, রাসূল সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তাদের নিকট প্রকাশ্য নিদর্শনসমূহ এসেছিল, আল্লাহ অত্যাচারী সম্প্রদায়কে পথ-প্রদর্শন করেন না।” (ইমরান-৮৬)। যারা রাসূল (সাঃ)-এর নীতি সমাজে প্রতিষ্ঠার কাজে নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছেন তাদের সহযোগিতা না করে বরং কি ভাবে তাদের উৎখাত করা যায় সে চেষ্টা যারা করেন তাদের সাথে আর জাহেলিয়্যাতের সেই লোকদের সাথে পার্থক্য কোথায়? আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, দুনিয়ার এ জীবনে আল্লাহ মানুষকে কিছুটা কর্মের স্বাধীনতা দিয়েছেন বটে, কিন্তু আসলে দুনিয়ার জীবন একটা পরীক্ষাকাল ছাড়া আর কিছুই নয়। এ পরীক্ষার পর অবশ্যই মানুষকে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে এবং তিনি সমস্ত কাজ-কর্ম যাচাই করে পরীক্ষার সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে ফলাফল ঘোষণা করবেন।
রাসূল (সাঃ)-এর প্রথম ঘোষণা কোন মামুলী ব্যাপার ছিলো না। এর ফলে গোটা কুরাইশ এবং অন্যান্য গোত্রের ভেতর আগুন জ্বলে উঠলো এবং চারদিকে এ সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেলো। কয়েকদিন পর রাসূল (সাঃ) আলী (রাঃ)-কে একটি ভোজ সভার আয়োজন করতে বললেন। এতে গোটা আব্দুল মুত্তালিব খান্দানকে আমন্ত্রণ করা হলো। এ ভোজসভায় হামজাহ্, আবুতালিব, আব্বাস প্রমুখ সবাই শরীক হলেন। পানাহারের পর মুহাম্মদ (সাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি এমন একটি জিনিস নিয়ে এসেছি, যা দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের জন্যেই যথেষ্ট। এই বিরাট বোঝা উত্তোলনে কে আমার সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছেন?” এটা ছিলো অত্যন্ত কঠিন সময়। চারদিকে শুধু বিরোধিতার ঝান্ডা উত্তোলিত হচ্ছিলো। সুতরাং এ -বোঝা উত্তোলনে সহযোগিতা করার অর্থ ছিলো এই যে, শুধু দু’একটি খান্দান, গোত্র বা শহরের লোকদেরই নয়, বরং গোটা আরবের বিরোধিতার মুকাবিলা করার জন্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে প্রস্তুত হতে হবে। তাকে এজন্যেও তৈরী হতে হবে যে, এর বিনিময়ে শুধু তার আখিরাতের জিন্দেগী সফলকাম হবে এবং সে আপন মালিকের সন্তুষ্টি লাভ করতে পারবে। এছাড়া দূরব্যাপী দৃষ্টিনিক্ষেপ করেও আপাতত ফায়দা লাভের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিলো না। ফলে সমস্ত মজলিসের ওপর একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো। উঠে দাঁড়ালেন শুধু কিশোর আলী। তিনি বললেন, “আমার চোখে যদিও যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে, আমার হাঁটুদ্বয়ও অত্যন্ত পাতলা, বয়সেও আমি সবার ছোট, তবুও আমি আপনার সহযোগিতা করে যাবো।” মাত্র তেরো বছর বয়সের একটি বালক না বুঝে-শুনে এত বড় একটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলো। গোটা কুরাইশ খান্দানের পক্ষে এটা ছিলো এক বিস্ময়কর দৃশ্য। তারা অট্টহাসীতে ফেটে পড়লো। এবং তারা ভাবলো এসব একটা তামাশা, পাগলামী ছাড়া আর কিছু নয়।

Related Post