Main Menu

রাসূল (সা.)-এর রাষ্ট্র পরিচালনায় মৌল নীতিমালা

রাসূল (সা.)-এর রাষ্ট্র পরিচালনায় মৌল নীতিমালা

রাসূল (সা.)-এর রাষ্ট্র পরিচালনায় মৌল নীতিমালা

মানুষের জন্য রাষ্ট্র হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। এটি এমন একটি রাজনৈতিক কাঠামোর নাম যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোন ভূখন্ডের অধিবাসীরা তাদের আর্থ সামাজিক জীবনের যাবতীয় বিষয় পরিচালনা করে। পাশা-পাশি ভূখন্ডকে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেয়। এর আওতায় শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ সাধন, আইন ও প্রশাসন ইত্যাদি বিষয় নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্র করে থাকে। সৃষ্টির আদিকাল থেকে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আল্লাহ তা‘য়ালা নবী-রাসূলদের মাধ্যমে পরিচালনা করেছেন ও শিক্ষা দিয়েছেন। সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক মদীনায় একটি কল্যাণময় ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। আর এ মর্মে কুরআনে কারীমে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালার বাণী,
“(হে নবী) আমি সত্য ও সঠিকভাবে তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, তা পূর্ববর্তী সমস্ত কিতাবের সত্যতা প্রতিপন্ন করে এবং তার সংরক্ষণ করে। সুতরাং আল্লাহ যা কিছু নাযিল করেছেন, সে অনুযায়ী লোকদের মধ্যে তুমি বিচার ফয়সালা করো। আর যে সত্য তোমার কাছে এসেছে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না।” (সূরা মায়েদা: ৪৮) কুরআনে কারীমে আল্লাহ তা‘য়ালা ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার নীতিমালা পেশ করেছেন। রাসূল (সা.)আল- কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী মদীনায় হিজরতের পর সেখানে স্বাধীন ও উন্মুক্ত পরিবেশে যে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেন তা- ই পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ও কল্যাণময় রাষ্ট্র। রাসূল (সা.) প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি লাভ করে। ধর্ম ও রাষ্ট্রের সহাবস্থানে ইসলাম একটি সার্বজনীন ধর্ম ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিণত হয়। এক দশকের কম সময়ের মধ্যেই মদীনার এ রাষ্ট্র জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ব্যাপক সফলতা বয়ে আনে। অহীর মাধ্যমে রাসূল (সা.) এ রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যক্রম দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেন। যা আজও বিশ্ববাসীর কাছে এক অনুসরণযোগ্য রাষ্ট্র ব্যবস্থার মডেল হয়ে আছে এবং কিয়ামতের আগ পর্যন্ত থাকবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় রাসূল (সা.) যে সকল মৌল নীতিমালা গ্রহণ করেন তার থেকে অন্যতম কতিপয় নীতিমালা উল্লোখ করা হলো:
সার্বভৌমত্ব (তাওহীদ): তাওহীদ মানে আল্লাহর একত্ববাদ ও সার্বভৌমত্ব। এটি আল্লাহর সাথে মানুষের এবং মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের বিধি-বিধানসমূহ বর্ণনা করে। ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের প্রধান মূলনীতি হলো এ বিশ্ব আল্লাহর এবং সৃষ্টিও তাঁরই। আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান মেনে তাঁরই চির অনুগত হয়ে জীবন যাপনের মধ্যেই মানুষের যথার্থ কল্যাণ নিহিত রয়েছে। সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘য়ালা এবং বিধানদাতাও তিনিই। তিনি সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। এর মূল কথা হলো, বিশ্ব সাম্রাজ্য আল্লাহর। তিনিই এ বিশ্বের সার্বভৌম শাসক। কোন ব্যক্তি, বংশ, শ্রেণী, জাতি এমনকি গোটা মানবজাতিরও সার্বভৌমত্বের বিন্দুমাত্র অধিকার নেই। আইন প্রণয়ন এবং নির্দেশ দানের অধিকার কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট। এই রাষ্ট্রের প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে, এখানে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে। এ বিশ্বাস ও কর্মের ভিতর রয়েছে ঈমানের প্রাণশক্তি। প্রতিটি কাজ আল্লহর বিধান অনুযায়ী, আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় এবং একান্তই আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যেই করতে হবে। তিনি ছাড়া অন্য কোন মানবীয় ও অমানবীয় শক্তির পক্ষ থেকে নির্দেশ বা ফয়সালা দান করার অধিকার কারো নেই। পৃথিবীতে তাঁর এ সার্বভৌমত্ব প্রয়োগের জন্য তিনি নিজেই মানুষকে প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে প্রতিনিধি বানাবেন যেমনিভাবে তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদেরকে বানিয়েছিলেন।” (সূরা নূর: ৫৫) রাসূল (সা.) এ সার্বভৌমত্বের উপর ভিত্তি করে মদীনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি এ রাষ্ট্রে আইন, শাসন, সমাজ, ব্যক্তি, রাজনীতি, অর্থনীতি,সামরিক ও বেসামরিকসহ সকল সেক্টরে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে দশ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এ সার্বভৌমত্বের বাইরে কোন নাগরিক অবস্থান করতে পারেনি। তিনি রাষ্ট্রের জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আল্লাহ তায়ালা রিযকদাতা, সকল ক্ষমতার মূল উৎস। কেবলমাত্র তাঁর সার্বভৌমত্বেই নিহিত রয়েছে মানুষের মুক্তি, শান্তি ও প্রগতি। মানুষ মানুষের দাস হতে পারে না, কারো গোলামী ও করতে পারে না। দাসত্ব ও গোলামী কেবল আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। আল্লাহ তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রয়োগকারী হিসেবে তাঁর প্রতিনিধি বা খলীফা নিযুক্ত করেছেন। আর আল্লাহই হলেন এই প্রতিনিধির নিয়ামক শক্তি। তাই কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রনায়ক নিজেদের খেয়াল-খুশিমত আইন প্রণয়ন করার অধিকার রাখে না। রাসূল (সা.) আল্লাহর এ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ব মানবতাকে গোলামীর শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে মানব জীবনে আইনের শাসন, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা এবং বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ পৃথিবীকে উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। অহীর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এ রাষ্ট্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ আইনের চোখে যেমন সমান বলে বিবেচিত হয়েছিল, তেমনি তাদের অধিকার পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

শরীয়াহ:
‘শরীয়াহ’ আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ দ্বীন, জীবন পদ্ধতি, ধর্ম, জীবনাচার, নিয়মনীতি ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় শরীয়াহ হচ্ছে, ‘মহান আল্লাহ তা‘য়ালা জীবন ও জগৎ পরিচালনার জন্য মহানবী (সা.)-এর মাধ্যমে স্বীয় বান্দাহদেরকে যে সার্বিক হুকুম ও বিধান প্রদান করেছেন তাই হলো শরীয়াহ। ইসলামী শরীয়াহ একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতীর জন্য আর কোন বিধান নাযিল হবে না বিধায় তিনি এ বিধানকে মানুষের জন্য পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। আর এ বিধানের সকল স্তরে মডেল বা নমুনা হলেন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)। এ ব্যাপারে তিনি যা বলেছেন, যা করেছেন এবং যা সমর্থন করেছেন তা-ই হলো এ বিধানের অনুসারীদের একমাত্র অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ। তিনি শরীয়াতের এমন কোন বিধান রেখে যাননি যা পরবর্তীতে উম্মাতের মধ্যে কাউকে তা পূর্ণ করতে হবে। পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য একমাত্র সমাধান হলো ইসলামী শরীয়াহ। ইসলামী শরীয়াতের প্রথম উৎস হচ্ছে আল কুরআন এবং দ্বিতীয় উৎস সুন্নাহ।
আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী, “তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে (কুরআনকে) তার অনুসরণ কর, তাকে (কুরআনকে) ছেড়ে অন্য কোন মিত্র বা আওলিয়ার অনুসরণ করো না।” (সূরা আ‘রাফ: ৩) তিনি আরো বলেন, “এটিই (এ কুরআনের অনুসরণই) আমার (আল্লাহর) সরল-সহজ পথ। সুতরাং তোমরা এ পথেরই অনুসরণ করে চল, এটা ছাড়া অন্য কোন পথে চলো না। চললে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর (আল্লাহর) পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। তিনি এ নির্দেশ দিয়েছেন যেন তোমরা সাবধান হও”। (সূরা আনআম: ১৫৩)
পবিত্র কুরআনের পর দ্বিতীয় অনুসরণের বিষয় হচ্ছে রাসূল (সা.) এর সুন্নাহ বা হাদীস। কারণ তিনিই হলেন কুরআনের সকল বিষয়ের একমাত্র আদর্শ। আল্লাহ তা‘য়ালা মানব জাতিকে তার অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লহ তা‘য়ালার বাণী, “তোমরা ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর প্রেরিত উম্মী নবীর প্রতি, যে নিজেই আল্লাহ এবং তাঁর সকল বাণীকে মেনে চলে। তোমরা তারই অনুসরণ করো যাতে সঠিক পথের সন্ধান লাভ করতে পার।” (সূরা আ‘রাফ: ১৫৮)
ইসলামী শরীয়াহ ছাড়া কারো পক্ষে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামী জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। এতে ব্যক্তি মানুষের যাবতীয় সমস্যার যেমন সমাধান রয়েছে, তেমনি রয়েছে সামাজিক-সামষ্টিক মানুষের সমস্যাবলীর সঠিক ও সুষ্ঠ সমাধান। কুরআন সুস্পষ্টভাবে বিশ্বাসীদের প্রতি আহবান জানায়, ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী তাদের মধ্যে তোমরা ফায়সালা করো।” (সূরা মায়েদা: ৪৯) ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী যারা বিচার -ফায়সালা করে না কুরআন তাদেরকে কাফের, যালেম ও ফাসেক আখ্যায়িত করে নিন্দা করেছে যা সূরা মায়েদা ৪৪, ৪৫, ৪৭ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। শরীয়াহর আইনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে ইসলাম ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে নয় বরং সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে সরকারের প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা করেছে। ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্র ও সরকারের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য ও অনস্বীকার্য। রাসূল (সা.) রাষ্ট্র পরিচালনায় আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়াহ অনুসরণ করেছেন। ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার প্রদত্ত কোন আইন, পদ্ধতি, বিধি-বিধান, সিদ্ধান্ত, পর্যালোচনা ও আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক ও বৈধভাবে জনগণের উপর প্রয়োগযোগ্য হতে পারে না যদি না তা আল্লাহ প্রদত্ত ও মহানবী (সা.) প্রদর্শিত আইনের সাথে সামঞ্জস্যশীল হয়।
পরামর্শ সভা / মজলিশে শূরা:
ইসলাম যে নৈতিক চরিত্রের শিক্ষা দেয় পরামর্শ তার অনিবার্য দাবী এবং তা এড়িয়ে চলা কখনই মুসলমানদের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। আর অকল্যাণকর কোন কাজে ইসলাম কখনো অনুমতি দিতে পারে না। পবিত্র কুরআনুল কারীমে (৪২ নম্বর সূরা) এ ব্যাপারে ‘শূরা’ (পরামর্শ) নামে একটি সূরার নাম করণ করা হয়েছে। ইসলামী জীবন পদ্ধতিতে সমাজের ছোট বড় প্রতিটি ব্যাপারেই পরামর্শের নীতি কার্যকর হোক তা চায়। পারিবারিক ব্যাপার হলে সে ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী পরামর্শ করে কাজ করবে। ছেলে-মেয়ে বড় হলে তাদেরকেও পরামর্শে শরীক করবে। খান্দান বা গোষ্ঠীর ব্যাপার হলে সে ক্ষেত্রে গোষ্ঠির সমস্ত বুদ্ধিমান ও বয়োপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ করতে হবে। যদি কাজটি একাধিক ব্যক্তির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় হয়। আর গোটা জাতির ব্যাপার হলে তা পরিচালনার জন্য সবার মতামতের ভিত্তিতে তাদের নেতা নিযুক্ত হবে। সে ততক্ষণ পর্যন্ত নেতা থাকবে যতক্ষণ জাতি তাকে নেতা বানিয়ে রাখতে চায়।
কোন ঈমানদার ব্যক্তি জোরপূর্বক যেমন জাতির ঘাড়ে চেপে বসার চেষ্টা করতে পারেনা, ঠিক তেমনি জবরদস্তি করে মানুষের সম্মতি ও আদায় করতে পারেনা। তাকে পরামর্শ দানের জন্য মানুষ স্বাধীন ইচ্ছানুসারে নিজেদের মনোনীত প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে। রাসূল (সা.) তাঁর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী সম্পাদনের পূর্বে সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে নিতেন।
মহানবী (সা.) স্বয়ং শাসক ছিলেন। তিনি সরাসরি আল্লাহর নির্দেশ লাভ করতেন। তিনি কারো সাথে পরামর্শ করতে বাধ্য ছিলেন না। কিন্তু তাঁকে যেহেতু পরবর্তীকালে শাসকদের জন্য নমুনা হতে হবে তাই তাঁর মাধ্যমে পারস্পরিক পরামর্শ গ্রহণের ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কুরআনুল কারীমে রাসূল (সা.)- কে পরামর্শের ভিত্তিতে কার্যনির্বাহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রে পরামর্শ গ্রহণ পদ্ধতি অপরিহার্য করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ, “মুসলমানদের কার্যাবলী পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পাদিত হতে হবে।” (সূরা শূরা: ৩৮) কুরআনের এ নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাসূল (সা.) রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মজলিসুস শূরা বা পরামর্শ সভা গঠন করেন। আর এ পরামর্শ সভা গঠন করতে হবে উম্মতের মধ্যে প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিগণের সমন্বয়। যে কোন লোক এ পরামর্শ সভার সদস্য হতে পারবে না। তাতে সমূহ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে। আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী, “হে মুহাম্মাদ! যদি তুমি দুনিয়ায় বসবাসকারী অধিকাংশ লোকের কথায় চলো তাহলে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে।” (সূরা আনআ‘ম: ১১৬) অর্থাৎ পৃথিবীতে অধিকাংশ লোক এমন রয়েছে যে, আপনি যদি তাদের কথা শুনেন তবে তারা আপনাকে বিপথগামী করে দেবে। কেননা তাদের আকীদাহ, বিশ্বাস, স্বার্থপরতা ও মতবাদ ভিন্ন। কাজেই নেতাকে পরামর্শ দানের জন্য এমন সব লোক নিয়োগ করতে হবে যাদের প্রতি জনগণের শুধু আস্থা থাকলেই চলবেনা, তাদেরকে হতে হবে পূর্ণ আমানতদার। যারা পরামর্শের লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করবে যেমন, নেতার ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষা, চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে, অর্থ দ্বারা প্রলুব্দ করে, মিথ্যা ও চক্রান্তের সাহায্যে বা মানুষকে বিভ্রান্ত করে পরামর্শের স্থানটি দখল করা যাবে না। যারা এমনটি করে তাদেরকে দিয়ে জনগণের কাঙ্খিত সফলতা আশা করা যায়না। পরামর্শদাতাগণ নিজেদের জ্ঞান, ঈমান ও বিবেক অনুসারে মানুষের বৃহত্তর কল্যাণে পরার্শ দান করবে এবং মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতে হবে। কোন প্রকার লোভ-লালসা বা কোন দলাদলির মারপ্যাঁচ থাকতে পারবে না। তাহলে নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করবে এবং সেটা হবে খেয়ানতের শামীল। এই পরামর্শ পরিষদ স্বেচ্ছাচারী, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নয়, বরং অবশ্যই তাদেরকে দ্বীনের বিধি-বিধানের দ্বারা সীমাবদ্ধ থেকে কাজ করতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্রে শাসক ও পরামর্শ সভার সদস্যগণ স্বেচ্ছাচারী কিংবা স্বৈরচারী হবে না বরং তথায় পরামর্শভিত্তিক শাসন পরিচালিত হতে হবে।
শূরা গঠনে রাসূল (সা.) এর কৌশল
মজলিসে শূরা গঠনে রাসূল (সা.) এর কৌশল ছিলো এই যে, তিনি মুহাজির ও আনসারদের থেকে বিজ্ঞ সাহাবীদেরকে পরামর্শ সভার সদস্য করেছিলেন। রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ, প্রশাসনিক কাঠামোর রূপরেখা দান, শাসন প্রণালী প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ শূরা নির্ণয় করত। রাসূল (সা.) রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর অনুসারী সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করতেন। তবে আল্লাহ তা‘য়ালার পক্ষ থেকে নাযিল করা সংবিধান কুরআনে কারীমে তাকে যে ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে তার প্রেক্ষিতে তিনি যে কোন বিষয় পরামর্শ গ্রহণ বা বর্জন করার এখতিয়ার রাখতেন। তিনি সাহবীদের সঙ্গে পরামর্শ করার পর যে মতটি অধিক সঠিক ও কল্যাণকর মনে করেছেন সেটিই গ্রহণ করেছেন। যেমন, হযরত সালমান ফারসির পরামর্শে খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খনন এবং তায়েফে অভিযান চলাকালে অবরুদ্ধ শত্রুদের বিরুদ্ধে মিনজানিক ব্যবহার করা সংক্রান্ত পরমর্শ রাসূল (সা.) গ্রহণ করেছেন। সম্প্রদায়গত স্বার্থ, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ক প্রশ্নে প্রতিনিয়ত পরামর্শ সভা চলত। কখনো কখনো পরামর্শদাতাদের পরামর্শ শুনেছেন কিন্তু সুদূর প্রসারী চিন্তা-ভাবনা ও সময়োপযোগী কৌশল অবলম্বন করে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেননি। যেমন, হুদায়বিয়ার সন্ধির ব্যাপারে সমস্ত সাহাবী মক্কার কাফিরদের সাথে সন্ধি করার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি সন্ধি করেছেন এবং তা কার্যকর করলেন। আর সে সন্ধিই পরবর্তীকালে প্রকাশ্য বিজয় নিয়ে আসে। অনুরূপভাবে উসামা বিন যায়েদ (রা.) কে সেনাপতি বানানোর বিরুদ্ধে বড় বড় সাহবীগণ মতামত দেন। কিন্তু রাসূল (সা.) এ বিষয়ে তাদের বিরোধিতা পরোয়া না করে হযরত উসামা (রা.)-কে নিজ হাতে পতাকা দিয়ে বললেন, “তুমি রওয়ানা হয়ে যাবে সেখানে, যেখানে তোমার পিতা শহীদ হয়েছেন এবং সে স্থানের লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। আমি তোমাকে এ বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ নিযুক্ত করলাম।” এসব ঘটনা থেকে পরামর্শ গ্রহণের ব্যাপারে নবী কারীম (সা.) এর নীতির সন্ধান মিলে যে, নেতা পরামর্শ চাইবেন সংশ্লিষ্ট লোকেরাও পরামর্শ দিবে, কিন্তু তার নিকট যে পরামর্শ অধিক সঠিক ও কল্যাণকর মনে হবে তা তিনি গ্রহণ করবেন। রাসূল (সা.)-এর এতটা দূরদর্শিতা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ ছিলো যে, আপনি আপনার রাষ্ট্রের সব কার্যাবলীর ক্ষেত্রে আপনার লোকজনের সাথে পরামর্শ করে কার্য সম্পাদন অব্যাহত রাখুন। কারণ, মুসলিম সমাজের কার্যাবলীল উপর কারও একক কর্তৃত্ব নেই। শূরার সদস্যগণের দায়িত্ব কোন বিষয় নিজস্ব স্বাধীন মতামত পেশ করা আর শাসকের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হচ্ছে শূরার থেকে পরামর্শ নেয়া। শূরা শুধুমাত্র জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণের অংশগ্রহণই নিশ্চিত করে না-একই সাথে তা স্বৈরাচারী শাসন প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে। স্বেচ্ছাচারী হবার পথ রুদ্ধ করে দেয়। ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সরকার শুধুমাত্র আইনের মাধ্যমেই শাসনকার্য পরিচালনা করবে না, একই সাথে জনগণের আশা-আকাংখা ও ইচ্ছা পুরণে সিদ্ধান্তসমূহ পরামর্শের ভিত্তিতে গ্রহণ করবে এবং তা বাস্তবায়ন করবে। পরামর্শের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তে আল্লাহ তায়ালার রহমত থাকে।
রাসূল (সা.) অহী দ্বারা সরাসরি নির্ভুল জ্ঞান লাভ করতেন এবং ঐ জ্ঞানের আলোকে তাঁর কার্যাবলী পরিপূর্ণভাবেই নির্ভুল সম্পাদিত হতো। তিনি অন্যের কোন পরামর্শ গ্রহণের মুখাপেক্ষী ছিলেন না, তবুও বিষয়টির গুরুত্বের কারণে তিনিই সর্বাধিক পরামর্শ গ্রহণ করতেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়শা (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর চেয়ে অধিক পরামর্শ করতে আর কাউকে দেখিনি। অহী ও রাসূলের অবর্তমানে জ্ঞানের স্বল্পতার জন্য পরামর্শ করা অতীব জরুরী। কেননা আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবীতে আর কোন নবী ও রাসূল আসবে না। কোন বিষয় সঠিক কি বেঠিক তা জানানোর জন্যও আর জিব্রীল (আ.) এ পৃথিবীতে অবতরণ করবে না। আমরা মানুষ, আমাদের রয়েছে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। এ অবস্থায় একটি ভালো সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য পারস্পরিক আলোচনা পর্যালোচনা, পরামর্শ দেওয়া-নেয়া ও মত বিনিময় করা একান্ত জরুরী। সকলে মিলে পরামর্শ করে কাজ করলে অনেক জটিল ও কঠিন বিষয়ও সহজে আঞ্জাম দেয়া সম্ভব। পারস্পরিক পরামর্শ দুনিয়ার জীবনে কল্যাণ ও সৌভাগ্যের উৎস। রাসূল (সা.) এর বাণী, “দুনিয়ার জীবনের সুখ-সমৃদ্ধি ও কল্যাণ তিন জিনিসের সমন্বয় পাওয়া সম্ভব। তন্মধ্যে পারস্পরিক পরামর্শ হলো অন্যতম। এ প্রসঙ্গে হাদীসের ভাষ্য হচ্ছে, “ যখন তোমাদের নেতারা হবেন সর্বোপরি ভালো মানুষ, ধনীরা হবেন সর্বোচ্চ দানশীল এবং তোমাদের সামগ্রিক কার্যক্রম চলবে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে, তখন তোমাদের জন্য মাটির উপরিভাগ নিচের ভাগ থেকে উত্তম হবে। অর্থাৎ দুনিয়ার জীবন তোমাদের জন্য কল্যাণকর ও সুখময় হবে।

Related Post