পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ধৈর্যের পরই মানুষের প্রাপ্তি আসে। কঠিন ত্যাগ ও পরীক্ষার মাধ্যমে এ প্রাপ্তির স্বাদ পাওয়া যায়। যেকোনো ভালো কিছু পেতে হলে সাময়িক কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। তাহলে ভালো কিছু আশা করা যায়। লেখায় যে প্রাপ্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সে প্রাপ্তি হলো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। বর্তমান হলো দুনিয়ার ভালো-মন্দ, আর ভবিষ্যৎ হলো মৃত্যুর পর। একজন মানুষের দুনিয়ার ভালো-মন্দ হলো এক থেকে এক শ’ বছর অথবা তার চেয়ে কিছু বেশি সময়। আর পরপারের ভালো-মন্দ হলো হাজার হাজার বছর, যার কোনো সুনির্দিষ্ট সীমারেখা নেই।
পৃথিবীতে আজ যারা ইসলাম প্রচার করছেন, তাদের বেশির ভাগই নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত হচ্ছেন। নির্যাতনের কারণ হলো বেশির ভাগ মানুষ যারা পৃথিবীর স্রষ্টা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পাঠানো কিতাব অনুসরণ করে, তাদের জীবন গড়তে রাজি নন। এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের মানুষ রয়েছে। কিছু মানুষ আল্লাহর কিতাব বিশ্বাস করেন, কিন্তু তারা এ কিতাবের কথাগুলো মানেন না। কিতাবে কী বলা হয়েছে তাও গবেষণা করতে চান না। দ্বিতীয় প্রকারের মানুষ হলো তারা এই কিতাব বিশ্বাস করেন না। এই দুই অংশের মানুষই ইসলাম ধর্ম প্রচারকারীদের ওপর নির্যাতন চালায়। নির্যাতনকারীর সংখ্যা ধর্ম প্রচারকারীর তুলনায় অনেক বেশি। তাই নির্যাতনকারীরা অনেক বেশি সুযোগ পাচ্ছেন নির্যাতন করতে। এ ক্ষেত্রে যারা আল্লাহ ও তাঁর কিতাবের ওপর বিশ্বাস করেন, তাদেরও কিছু লোক দুনিয়াবি ভোগবিলাসের মোহে পড়ে যারা কিতাব বিশ্বাস করেন না তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। ফলে ত্রিমুখী নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে ইসলাম প্রচারকারীরা।
অতীতের ইতিহাস থেকে জানা যায়, পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত যারাই আল্লাহর বাণী প্রচার করেছেন, তারাই ত্যাগ স্বীকার এবং নির্যাতিত হয়েছেন। নির্যাতনের মাত্রা খুবই ভয়ঙ্কর ছিল। যে কথা গভীরভাবে অনুধাবন করলে শরীর শিউরে ওঠে।
পবিত্র আল কুরআন ও হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায়, চৌদ্দ শ’ বছর আগে যখন পৃথিবীতে শাসক শ্রেণীর মানুষেরা সাধারণ মানুষের ওপর অনাচার, অত্যাচার, ব্যভিচার, হত্যা, জুলুম, নির্যাতন করছিল, তখন মহান আল্লাহ মানবতার শান্তির জন্য হজরত মুহাম্মদ সা:কে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন জিব্রাঈল আ:-এর মাধ্যমে মুহাম্মদ সা:-কে ইসলাম প্রচারের জন্য নির্দেশনা দিতেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যে এই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা ও মালিক তা মুহাম্মদ সা: প্রচার করতে লাগলেন। শাসক শ্রেণীর লোকেদের মানুষের ওপর অত্যাচার নির্যাতন করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান তিনি। জুলুমবাজরা রাসূল সা:-এর কথা বিশ্বাস করলেন না; বরং তারা ক্ষিপ্ত হয়ে রাসূল সা:-কে হত্যা করার যড়যন্ত্র করেন। যখন রাসূল সা: দাওয়াত দিতে তায়েফ গেলেন তখন তায়েফের ইসলামবিরোধীরা তাঁকে পাথর নিক্ষেপ করে তাঁর শরীর রক্তাক্ত করে দেয়। একপর্যায়ে তিনি বেহুঁশ হয়ে যান। বেহুঁশের পর আবার যখন হুঁশ আসে, তখন তাকে ধাক্কা মারতে মারতে সামনের দিকে নিয়ে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় আবার তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়েন। এভাবে তিনি তিনবার বেহুঁশ হন।
ওহুদের যুদ্ধে সাহাবিদের নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন মুহাম্মদ সা:। সেখানে ইসলামবিরোধীদের আঘাতে তাঁর দন্ত মোবারক শহীদ হয়। তীরের আঘাতে মাথা থেকে অঝর ধারায় রক্ত প্রবাহিত হয়। এ সময় তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এভাবে তিনি একের পর এক নির্যাতনের শিকার হন। একই সময়ে ইসলাম প্রচারের অপরাধে সাহাবি হজরত তালহা নির্যাতনের শিকার হন। তার পিঠে ইসলামবিরোধীরা ৮০টি তীর বিদ্ধ করে।
হজরত বেলালকে রশি দিয়ে উটের পায়ে বেঁধে টানতে থাকে। উট যখন হয়রান হয়ে যায়, তখন উটের পা থেকে রশি খুলে উত্তপ্ত মরুভূমিতে চিৎ করে শুইয়ে লোহার রড দিয়ে চতুর্দিক থেকে পেটাতে থাকে। হজরত খব্বাবকে জ্বলন্ত আগুনের কয়লার ওপরে শুইয়ে দিয়েছিল। খাব্বাবের গায়ের মাংস শরীর থেকে খসে পড়ে। শরীরের ভেতর গর্ত হয়ে যায়। হজরত আম্মার, খুবায়েব, সুমাইয়াকে বিভিন্ন কায়দায় নির্যাতন করা হয়েছিল।
ইমাম আবু হানিফাকে আট বছর কারাবন্দী করে রাখা হয়েছিল। আবু হানিফার মাকে ধরে এনে মায়ের সামনে তাকে পেটানো হতো। ইমাম মালেককে ২৮ দিন দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছিল। তার হাত ফুলে এমন অবস্থা হয়েছিল যে, তিনি কিছু ছুঁতেও পারছিলেন না।
এভাবে অসংখ্য সাহাবিকে অমানবিকভাবে চরম নির্যাতন করা হয়েছিল। মুহাম্মদ সা:-এর আগেও যারা ইসলাম প্রচার করেছিলেন, তাদেরও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এমনকি নবীরাও একই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে একাধিক পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন।বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও একটু ভিন্ন রূপরেখায় ইসলাম প্রচারকারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। একেক দেশে একেক ধরনের কৌশল অবলম্বন করে তাদের নির্যাতন করা হচ্ছে। কাউকে প্রকাশ্যে গুলি করে, কাউকে মিথ্যা সাক্ষীর মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। এসব অন্যায়-অত্যাচারের কঠিন পথকে ধৈর্য সহকারে মোকাবেলা করার চেষ্টা করতে হবে এবং ইমানকে মজবুত রাখতে হবে।
(সমাপ্ত)