পূর্বের পর্ব পাঠ করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
শেষ পর্ব
কাল্পনিক কারামত
অনেক মানুষই মুজিযা আর কারামতের পার্থক্য জানে না। মুজিযা আর কারামত কি তা বুঝে না। মুজিযা হল এমন অলৌকিক বিষয় যা নবীদের থেকে প্রকাশ পায়। আর কারামত হল এমন অলৌকিক বিষয় যা আল্লাহ তা’আলার প্রিয় বান্দাদের থেকে প্রকাশ পায়। মুজিযা প্রকাশের শর্ত হল নবী বা রাসূল হওয়া। আর কারামত প্রকাশের শর্ত হল নেককার ও মুত্তাকী হওয়া। অতএব যদি কোন বিদআতী পীর-ফকির বা শিরকে লিপ্ত ব্যক্তিদের থেকে অলৌকিক কিছু প্রকাশ পায় সেটা মুজিযাও নয়, কারামতও নয়। সেটা হল দাজ্জালী ধোঁকাবাজি বা প্রতারণা।
অনেক অজ্ঞ লোক ধারণা করে থাকে মুজিযা বা কারামত, সাধনা বা চেষ্টা-প্রচেষ্টা করে অর্জন করা যায়, বা মানুষ ইচ্ছা করলেই তা করতে পারে। তাই এ সকল অজ্ঞ লোকেরা ধারণা করে অলী আউলিয়াগণ ইচ্ছা করলে কারামতের মাধ্যমে অনেক কিছু ঘটাতে পারেন, বিপদ থেকে মানুষকে উদ্ধার করতে পারেন। কিন্তু আসল ব্যাপার হল, কারামত কোন ব্যক্তির ইচ্ছাধীন নয়। এটি একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছাধীন। মানুষ ইচ্ছা করলে কখনো কারামত সংঘটিত করতে পারে না, সে যত বড় অলী বা পীর হোক না কেন।
কোন বিবেকমান মানুষ বিশ্বাস করে না যে, একজন মানুষের প্রাণ চলে যাওয়ার পর তার কিছু করার ক্ষমতা থাকে। আবার যদি সে কবরে চলে যায় তাহলে কিভাবে সে কিছু করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করে?
এ ধরনের কথা তারাই বিশ্বাস করতে পারে অজ্ঞতার ক্ষেত্রে যাদের কোন নজীর নেই। অলী তো দূরের কথা কোন নবীর কবরও পূজা করা জায়েয নেই। নবীর কবরতো পরের কথা, জীবিত থাকা কালে কোন নবীর ইবাদত করা, বা তাকে দেবতা জ্ঞান করে পূজা করা যায় না। এটা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা’আলা বলেন : কোন মানুষের জন্য সংগত নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, হিকমত ও নবুওয়াত দান করার পর সে মানুষকে বলবে, তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমার ইবাদতকারী হয়ে যাও। বরং সে বলবে, তোমরা রব্বানী (আল্লাহ ভক্ত) হও। যেহেতু তোমরা কিতাব শিক্ষা দিতে এবং তা অধ্যয়ন করতে। আর তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ করেন না যে, তোমরা ফেরেশতা ও নবীদেরকে প্রভূ রূপে গ্রহণ কর। তোমরা মুসলিম হওয়ার পর তিনি কি তোমাদেরকে কুফরীর নির্দেশ দেবেন? (সূরাহ আলে ইমরান: ৭৯-৮০)
মুশরিকদের অবস্থা : অতীত ও বর্তমান
যারা কবর-মাযার পূজা করে তারা বলে থাকে যে, মুশরিকরা মূর্তি পূজা করত। আমরাতো মূর্তি পূজা করি না। আমরা আমাদের পীর দরবেশদের মাজার জিয়ারত করি। এগুলোর ইবাদত বা পূজা করি না। তাদের অসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ-প্রার্থনা করি যেন আল্লাহ তাদের সম্মানের দিকে তাকিয়ে আমাদের দুআ-প্রার্থনা কবুল করেন। এটাতো কোন ইবাদত নয়। এদের উদ্দেশ্যে আমরা বলব: মৃত ব্যক্তির কাছে সাহায্য ও বরকত কামনা করা সত্যিকারার্থে তার কাছে দুআ করার শামিল। যেমন ইসলামপূর্ব জাহেলী যুগে পৌত্তলিকরা মূর্তির কাছে দুআ-প্রার্থনা করত। তাই জাহেলী যুগের মূর্তি পূজা আর বর্তমান যুগের কবর পূজার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এ দুটো কাজই লক্ষ্য উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে এক ও অভিন্ন। যখন জাহেলী যুগের মুশরিকদের বলা হল তোমরা কেন মূর্তিগুলোর ইবাদত করো? তারাতো কিছু করার ক্ষমতা রাখে না। তখন তারা ইবাদতের বিষয়টি অস্বীকার করত এবং বলত: আমরা তো তাদের ইবাদত করি না, তবে এ জন্য যে তারা আমাদের আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে। (সূরাহ যুমার: ৩)
এমনিভাবে আমাদের সমাজের কবরপূজারীরাও বলে থাকে যে, আমরা তো কবরে শায়িত অলীর ইবাদত করি না। তার কাছে দুআ করি না। আমাদের উদ্দেশ্য শুধু এই যে, তারা আল্লাহর কাছে প্রিয়। তাদের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ অর্জন করা যাবে। এ সকল অলীগণকে আমরা আমাদের ও আল্লাহ তা’আলার মধ্যে মাধ্যম মনে করে থাকি।
কাজেই পরিণতির দিক দিয়ে জাহেলী যুগের মুশরিকদের মূর্তি পূজা আর বর্তমান যুগের মুসলমানদের কবর পূজা এক ও অভিন্ন। দুটো একই ধরনের শিরক।
মুহাব্বাত ভালোবাসার ক্ষেত্রে শিরক
অন্তরের একাগ্র ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আল্লাহ ব্যতীত আর কোন সৃষ্টি পেতে পারে না। এই নির্ভেজাল শ্রদ্ধাপূর্ণ ভালোবাসা হল একটি ইবাদত। যারা মনে করে আমরা এই কবরের অলী ও বুযুর্গদের অত্যাধিক ভালোবাসি, তাদের শ্রদ্ধা করি, তাদের সম্মান করি তাহলে এটিও একটি শিরক। আর এই মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কারণেই তারা অলী-বুযুর্গদের কবরে মানত করে, কবর প্রদক্ষিণ করে, কবর সজ্জিত করে, কবরে ওরস অনুষ্ঠান করে। কবরবাসীর কাছে তারা সাহায্য চায়, উদ্ধার কামনা করে। যদি কবরওয়ালার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত সম্মান ও ভালোবাসা না থাকতো, তাহলে তারা এগুলোর কিছুই করত না। আর এ ধরনের ভালোবাসা শুধু আল্লাহ তা’আলার জন্যই নিবেদন করতে হয়। আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য নিবেদন করা শিরক।
আল্লাহ তাআলা বলেন: আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, আল্লাহকে ভালবাসার মত তাদেরকে ভালবাসে। আর যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহর জন্য ভালবাসায় দৃঢ়তর। (সূরাহ আল বাকারা: ১৬৫)
দৃঢ়তর, সত্যিকার ও সার্বক্ষণিক ভালোবাসা একমাত্র আল্লাহ তা’আলার প্রাপ্য। এটা অন্যকে নিবেদন করলে শিরক হয়ে যাবে। মুশরিক পৌত্তলিকরা তাদের দেব-দেবীর জন্য এ রকম ভালোবাসা পোষণ করে থাকে।
আল্লাহ মানুষের খুবই কাছে। মানুষ আল্লাহর কাছে তার প্রার্থনা পৌছে দিতে মাধ্যম বা অসীলা খোঁজে! কিন্তু কেন? আল্লাহ তা’আলা কি মানুষ থেকে অনেক দূরে? আর মাজারে শায়িত সে সকল পীর-অলীগণ মানুষের কাছে কি আল্লাহর চেয়েও নিকটে? কখনো নয়। একজন মানুষ যখন প্রার্থনা করে তখন সকলের আগেই তারা সরাসরি আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়। আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা নিজে বলছেন: আর যখন আমার বান্দাগণ তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, আমি তো নিশ্চয় নিকটবর্তী। আমি প্রার্থনাকারীর ডাকে সাড়া দেই, যখন সে আমাকে ডাকে। সুতরাং তারা যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান আনে। আশা করা যায় তারা সঠিক পথে চলবে। (সূরাহ বাকারা: ১৮৬)
মানুষ সরাসরি আল্লাহ তাআলার কাছে তার সকল প্রার্থনা নিবেদন করবে কোন মাধ্যম ব্যতীত। এটাই ইসলামের একটি বৈশিষ্ট্য ও মহান শিক্ষা। আল্লাহ তা’আলার কাছে দুআ-প্রার্থনায় কোন মাধ্যম গ্রহণ করার দরকার নেই মোটেই।
দুআ-প্রার্থনায় মাধ্যম বা অসীলা গ্রহণ একটি বিজাতীয় বিষয়। হিন্দু, বৌদ্ধ খৃষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মের লোকেরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে মূর্তি, পাদ্রী ও ধর্মযাজকদের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। এ দিকের বিবেচনায় এটি একটি কুফরী সংস্কৃতি, যা কোন মুসলমান অনুসরণ করতে পারে না।
দুআ-প্রার্থনায় আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য সৎকর্মসমূহকে অসীলা হিসাবে নেয়া যায়। তেমনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নামসমূহ অসীলা হিসাবে নেয়ার জন্য আল-কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: আর আল্লাহর জন্যই রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেসব নামের মাধ্যমে ডাক। আর তাদেরকে বর্জন কর যারা তাঁর নামে বিকৃতি ঘটায়। তারা যা করত অচিরেই তাদেরকে তার প্রতিফল দেয়া হবে। (সূরাহ আল আরাফ: ১৮০)
বর্তমানে আমরা আরো যা দেখছি তা হলো: রাজনৈতিকভাবে কোন অনুষ্ঠানকে সামনে নিয়ে বিভিন্ন নেতাদের মাযারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়, মাযার যিয়ারত করা হয়। যা রীতিমত গরীবের অর্থ হরণ করার শামিল। যে দেশের সাধারণ লোকজন এখনো দারিদ্র সীমার নীচে বরবাস করছে, সেই দেশের সরকার কীভাবে অর্থ অপচয় করে? ভাবতে অবাক লাগে!
সর্বশেষে বলতে চাই, যারা এ ধরনের অন্যায় অসীলা গ্রহণের মাধ্যমে শিরকে লিপ্ত হচ্ছেন তারা এর থেকে ফিরে আসুন। আমাদের দায়িত্ব কেবল সত্য বিষয়টি আপনাদের কাছে পৌঁছে দেয়া। এ সকল অসীলা নিঃসন্দেহে শিরক। আর শিরক এমন এক মহাপাপ যা আল্লাহ কখনো ক্ষমা করবেন না। যে এ শিরকে লিপ্ত হবে জাহান্নামই হবে তার ঠিকানা। আল্লাহ তা’আলা বলেন: নিশ্চয় যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার উপর অবশ্যই আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার ঠিকানা আগুন। আর যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই। (সূরাহ মায়েদা: ৭২)
তাই আমাদের জন্য একান্ত কর্তব্য হল, আমাদের সকল ইবাদত-বন্দেগী, দুআ-প্রার্থনা নির্ভেজালভাবে একমাত্র এক আল্লাহ তা’আলার জন্য নিবেদন করা। তিনি যা করতে বলেছেন আমরা তাই করবো। নিজেরা কিছু উদ্ভাবন করবো না। তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের যেভাবে প্রার্থনা করতে শিখিয়েছেন আমরা সেভাবেই প্রার্থনা করবো। তিনি যেভাবে অসীলা গ্রহণ অনুমোদন করেছেন, আমরা সেভাবে অসীলা গ্রহণ করবো। এর ব্যতিক্রম হলে আমরা ইসলাম থেকে দূরে চলে যাবো। কাজেই সর্বক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য হবে কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুসরণ করা। যদি আমরা এভাবে চলতে পারি তবে দুনিয়াতে কল্যাণ আর আখেরাতে চিরন্তন সুখ ও সফলতা লাভ করতে পারবো। অন্যথা, উভয় জগতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবো। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে শিরক থেকে হেফাজত করুন। আ-মীন ॥