অস্ট্রেলিয়ার নওমুসলিম আবু বকর রুবিন বলেছেন: ‘আমার মুসলমান হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ার সময়। সেই বছর আমি অনেক সংকটের শিকার হয়েছিলাম। আমার বাবা-মা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় আমি তীব্র মানসিক চাপের শিকার হই। এইসব তিক্ত ঘটনার কারণে আমার মাথায় নানা প্রশ্ন জাগে। এসবের মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল খুবই মৌলিক প্রশ্ন। আর তা হলো, কেন আমরা পৃথিবীতে এসেছি এবং আমাদের জীবনের লক্ষ্য কী? আমার বাবা-মা আমাকে নাস্তিকে পরিণত করেছিল। সেই শৈশবেই তারা আমাকে বলতেন, স্রষ্টা ও পুনরুত্থান দিবস বলতে কিছু নেই। মৃত্যু পর আর কোনো জীবন নেই কিন্তু আমি সব সময়ই আমার অস্তিত্বের মধ্যে এক শূন্যতা অনুভব করতাম। আর তাই বাস্তবতা বা সত্য খুঁজে বেড়াতাম।’
সত্যকে জানার জন্য পড়াশুনার আগ্রহ থাকায় রুবিন খ্রিস্ট ধর্ম সম্পর্কে বহু বই পড়েন। কিন্তু তার মধ্যে সত্যের যে প্রচন্ড তৃষ্ণা জেগেছিল তার বিন্দুমাত্রও নিবারণ করতে পারেনি খ্রিস্ট ধর্ম। ফলে নানা প্রশ্নের উত্তর জানা তথা সত্যের দিশা পাওয়ার জন্য তার তৃষিত মন আরো বেশি পড়াশুনার সিদ্ধান্ত নেয়। আবুবকর এ প্রসঙ্গে বলেছেন: ‘আমি প্রথমেই খ্রিস্ট ধর্ম সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা শুরু করি। খ্রিস্ট ধর্মে আনুষ্ঠানিকভাবে দীক্ষা নেয়া বা খ্রিস্টীয় নামকরণ অনুষ্ঠানের গোসল পর্ব, পাদ্রি, ক্যাথলিক সম্প্রদায় ও খ্রিস্ট ধর্মের মূল নীতিমালা সম্পর্কে গবেষণা করতে থাকি। এইসব বিষয়ে যখনই গির্জার কাছে প্রশ্ন করেছি তখনই পাদ্রিরা বাইবেলের শরণাপন্ন না হয়েই মনগড়া ব্যাখ্যার আলোকে জবাব দিতেন। আর প্রত্যেক পাদ্রির ব্যাখ্যা হত ভিন্ন ধরনের।’
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক নাস্তিক রুবিনের গবেষণা কেবল খ্রিস্ট ধর্মের বিষয়েই সীমিত থাকেনি। অন্য ধর্মগুলো নিয়েও গবেষণার পদক্ষেপ নেন তিনি। রুবিন এ প্রসঙ্গে বলেছেন: ‘আমি খ্রিস্ট ধর্ম ছাড়াও ইহুদি ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ও হিন্দু ধর্ম নিয়ে গবেষণা শুরু করি। কিন্তু এইসব ধর্মকে আমার কাছে নিজের প্রত্যাশিত ধর্ম বলে মনে হয়নি। কারণ, এই ধর্মগুলো আমার অনেক প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারেনি। এ ছাড়াও এইসব ধর্মের নানা দোষ-ত্রুটি আমাকে এই ধর্মগুলোর প্রতি আকৃষ্ট করতে পারেনি।’ রুবিন আরো বলেছেন: ‘নানা ধর্ম নিয়ে গবেষণার পর যখন গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে আমি হতাশ ও ক্লান্ত হয়ে পড়ি তখন আমার এক বন্ধু আমার কাছে প্রশ্ন করে: এ পর্যন্ত কয়টি ধর্ম নিয়ে গবেষণা করেছো? আমি কয়েকটি ধর্ম সম্পর্কে আমার ব্যাপক গবেষণার অভিজ্ঞতার কথা তাকে জানাই। সে আমাকে প্রশ্ন করল: ইসলাম সম্পর্কেও কি গবেষণা করেছ?
তার এই প্রশ্নে আমি বিস্মিত ও বিরক্ত হয়ে বললাম: ইসলাম? না, আমি কখনও ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা করবো না; কারণ, মুসলমানরা হলো সন্ত্রাসী ও পাগল। আসলে ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর নেতিবাচক প্রচারণার কারণে এ ধর্মের বিষয়ে গবেষণা করার কথা কখনও কল্পনাও করিনি এবং বিষয়টি আমার জন্য ছিল অত্যন্ত কঠিন।’ অবশেষে ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা নিয়ে বন্ধুর প্রশ্নের পর এ ধর্ম নিয়ে গবেষণার ইচ্ছাও জেগে ওঠে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক নাস্তিক রুবিনের মধ্যে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “বন্ধুর সঙ্গে আলাপের পর ইসলাম সম্পর্কেও গবেষণার সিদ্ধান্ত নিলাম এ কারণে যে, আমি যা ভাবতাম এ ধর্ম সম্পর্কে তা প্রমাণ করা এর মাধ্যমেই সম্ভব হবে। ঠিক এ লক্ষ্যেই শহরের একটি মসজিদে ঢুকে পড়ি পায়ের জুতো না খুলেই। এ সময় এক ব্যক্তি নামায পড়ছিলেন ও সিজদারত অবস্থায় ছিলেন। আমি সরাসরি তার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। আমি তার নামাজ পড়ার দৃশ্য দেখতে লাগলাম। এ অবস্থায় মসজিদের এক আলেম আমার কাছে আসেন। সে সময় ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে অত্যন্ত নেতিবাচক ধারণা থাকায় আমি ভেবেছিলাম যে আজই হয়তো আমার জীবনের শেষ দিন। কিন্তু যখন দেখলাম মসজিদের আলেম আবু হামজাহ হাসিমুখে আমাকে স্বাগত জানাতে এলেন তখন সেইসব ধারণা অনেকাংশেই ম্লান হয়ে যায়।”
তিনি এ প্রসঙ্গে আরো বলেছেন: “আবু হামজাহ আমাকে তার কার্যালয়ে আমন্ত্রণ জানালেন। সেখানে আমি স্রষ্টা ও ইসলাম সম্পর্কে যখন নানা প্রশ্ন করছিলাম তখন তিনি পাদ্রিদের বিপরীতে পবিত্র কুরআন থেকে আমার প্রশ্নগুলোর জবাব দিচ্ছিলেন। তিনি যখন কুরআন পড়ছিলেন তখন মনে হলো যে তিনি যেন আমাকে সঠিক পথ দেখাচ্ছেন। তাই কুরআন ও এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে আরো বেশি জানতে আগ্রহী হলাম। আর তাই আবু হামজাহ’র কাছ থেকে কুরআনের একটি কপি ধার নেই।”
রুবিন অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে প্রত্যেক রাতে কুরআন অধ্যয়ন করতেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন: সেই রাতটি ছিল এক নিঝুম ও প্রশান্ত রাত। আমি পাঠ করছিলাম কুরআন। হঠাৎ কুরআন পাঠ বন্ধ করে দিয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বললাম: হে আল্লাহ্ আমি মুসলমান হওয়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছি। তোমার গ্রন্থ কুরআনে আমি বিশ্বাস এনেছি। কিন্তু আমার মনকে তৃপ্ত করার জন্য ও বিশ্বাসকে জোরদারের জন্য তোমার কাছে একটি নিদর্শন দেখতে চাচ্ছি।
এরপর চোখ বন্ধ করে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা কোনো নিদর্শন দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু কিছুই ঘটলো না। আবারও বললাম: কেবল একটি ক্ষুদ্র নিদর্শন দেখাও। এ কথা বলে আবারও চোখ বন্ধ করলাম। কিন্তু এবারও কিছু ঘটলো না। এরপর আকস্মিকভাবে আবারও কুরআন খুললাম এবং সূরা জাসিয়ার প্রথম দিকের কয়েকটি আয়াত চোখে পড়ল, যেখানে মহান আল্লাহ বলছেন:
إِنَّ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٍ لِّلْمُؤْمِنِينَ وَفِي خَلْقِكُمْ وَمَا يَبُثُّ مِن دَابَّةٍ آيَاتٌ لِّقَوْمٍ يُوقِنُونَ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَمَا أَنزَلَ اللَّهُ مِنَ السَّمَاءِ مِن رِّزْقٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ آيَاتٌ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ
“নিশ্চয়ই আকাশমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে মুমিনদের জন্যে বিপুল সংখ্যক নিদর্শন রয়েছে। আর তোমাদের সৃষ্টিতে এবং চারদিকে ছড়িয়ে রাখা জীব-জন্তুর সৃজনের মধ্যেও নিদর্শনাবলী রয়েছে বিশ্বাসীদের জন্য। দিন ও রাতের পরিবর্তনে, আল্লাহ্ আকাশ থেকে যে রিজিক বা বৃষ্টি বর্ষণ করেন, এরপর মৃত ভূমিকে তার মৃত্যুর পর আবারও জীবিত করেন, তাতে এবং বায়ু প্রবাহের পরিবর্তনে বুদ্ধিমানদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।” (জাসিয়া: ৩-৫)
অস্ট্রেলিয়ার নওমুসলিম রুবিন আরো বলেছেন, “এই আয়াত ছিল আমার জন্য একটি নিদর্শন। এ আয়াতের মাধ্যমে আমি বুঝতে পারি যে আকাশ ও জমিনের সব কিছুই এক আল্লাহর অস্তিত্বের এক একটি নিদর্শন। কুরআনের স্পষ্ট ও হৃদয়জুড়ানো বাণী আমাকে প্রশান্তি দিলো এবং আমি এভাবে অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাই। এভাবে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম যে, ইসলামের বিরুদ্ধে নেতিবাচক নানা প্রচারণা সত্য নয়, বরং ইসলাম পরিপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ ধর্ম যা মহান আল্লাহ মানুষকে সুপথ দেখানোর জন্য পাঠিয়েছেন।”
রুবিন ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণার পর অবশেষে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং মুসলমান হন। তিনি পবিত্র রমযানের প্রথম রাতে মসজিদে যান এবং সেখানে মুসলিম আলেম আবু হামজাহর কাছে কলেমা শাহাদাতাইন পাঠ করেন। এ সময় মসজিদে সমবেত মুসলিম ভাইয়েরা তাকবির বা আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে রুবিনকে অভ্যর্থনা জানান। এখন মুসলমানদের সম্পর্কে তার ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন।