আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম?

আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম 1

আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম 1

পর্বে প্রকাশিতের পর

১৬তম পর্ব

বাংলাদেশ স্বাধীনতার আন্দোলন

বলাবাহুল্য, এটা ছিল একান্তরূপেই একটা রাজনৈতিক বিষয়। অবশ্য রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধানও চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। তবে অনেকের ধারণায় রাজনৈতিকভাবেই এই ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব ছিল।

কিন্তু তা না করে ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর’মতো হঠাৎ সেখানে ইসলামকে টেনে আনা হলো এবং সকল অন্যায় ও সকল ব্যর্থতাকে ইসলামের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হলো।

অর্থাৎ দেশবাসী বিশেষ করে তরুণ ও যুব সমাজকে একথাই বুঝানো হলো যে, যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক চক্রটি মুসলমান বলে পরিচিত এবং যেহেতু ইসলামের নামেই তারা এসব ঘৃণ্য কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে, অতএব এসব কিছুর জন্যেই ইসলামী সর্বোত্মকভাবে দায়ী।

আর যেহেতু ইসলামই এইসব কিছুর জন্যে সর্বোত্মকভাবে দায়ী, অতএব ইসলাম যে বুর্জোয়াদের শোষণের হাতিয়ার, সে কথা খুলে বলার অপেক্ষা রাখে না। এমতাবস্থায় এ দেশের মাটি থেকে ইসলামকে উৎখাত না করা পর্যন্ত কোনক্রমেই এ দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হতে পারে না।

এর পরবর্তী অবস্থা কত ভয়াবহ এবং বেদনাদায়ক হয়েছিল সে কথা প্রায় সকলেরই জানা রয়েছে। সুতরাং নতুন করে লিখার প্রয়োজন হয় না।

অথচ ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান রয়েছে এমন ব্যক্তিরাও যে,ইসলাম এবং একমাত্র ইসলামই বুর্জোয়া-অ-বুর্জোয়া নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল প্রকার কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’অর্থাৎ ‘আল্লাহ ব্যতীত আর কোন প্রভূ বা উপাস্য নেই’এই পবিত্র এবং বিপ্লবী কলেমা এবং ‘মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি’এ যুগান্তকারী ঘোষণার মাধ্যমে ইসলাম আল্লাহ এবং মানুষ উভয়ের মধ্যে গড়ে ওঠা এবং গড়ে তোলা যাবতীয় মধ্যস্থ- অন্য কথায় ছোট বড় সকল প্রকারের কল্পিত শক্তি, সত্তা ও বিষয়কে নির্মূল করত বিশ্বের বুকে একমাত্র আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, প্রভূত্ব এবং সার্বভৌমত্বের প্রতিষ্ঠা করার কঠোর ও সুমহান দায়িত্ব মুসলমানদের উপরে অর্পণ করেছে।

এমতাবস্থায় যারা ইসলামকে ‘বুর্জোয়াদের শোষণের হাতিয়ার’এবং ‘স্বাধীনতার শত্রু’বলে আখ্যায়িত করে তাদের সম্পর্কে কোন মন্তব্য না করাকেই আমরা নিরাপদ বলে মনে করি।

পৃথিবীর ইতিহাসের সাথে সামান্যতম পরিচয় রয়েছে এমন ব্যক্তিরাও একথা জানেন যে, বুর্জোয়া মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরাই আবহমানকাল যাবত রক্ত, বর্ণ, বংশ গোত্র, ভৌগোলিক সীমারেখা, ভাষা, পেশা, সামাজিক মর্যাদা, অর্থ-বিত্ত, শিক্ষা-দীক্ষা প্রভৃতিকে জাতীয়তার ভিত্তি হিসাবে ব্যবহার করত মানুষে মানুষে ভেদ বৈষম্যের অলংঘ্য প্রাচীন সৃষ্টি করেছে এবং এইভাবে ‘অখন্ড মানবতাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করত নানা দল-উপদলের সৃষ্টি ও পারস্পরিক ঘৃণা-বিদ্বেষের আগুনে জ্বালিয়ে নিজেদের প্রভূত্ব-প্রধান্য ও শাসন শোষণকে অব্যাহত ও নিরঙ্কুশ করেছে।

তাদের এই জঘন্য কাজের পরিণামে যখনই পারস্পরিক ঘৃণা-বিদ্বেষ, সংঘাত সংঘর্ষ এবং শোষণ-নির্যাতনের মানবতা পযর্দুস্ত এবং দিশেহারা হয়ে উঠেছে, সেই সঙ্কট-সন্ধিক্ষণে মুসলমান এবং একমাত্র ইসলামই এক মহান আদর্শের ভিত্তিতে ভেদ-বৈষম্যের সকল বাধা ও সকল প্রাচীর চুর্ণ-বিচুর্ণ করত ভাষা-পেশা-গোত্রবর্ণ প্রভৃতি নির্বিশেষে সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত করেছে। প্রাণঘাতি শত্রুকেও ভাই-এর মর্যাদা দিয়ে বুকে টেনে নিয়েছে।

আদর্শকে ভিত্তি করা ছাড়া নানা রং, নানা ভাষা, নানা পেশা ও নানা স্বার্থে বিভক্ত-বিচ্ছিন্ন মানস সমাজকে ঐক্যবদ্ধ, সুসংহত এবং মানবতা বোধ সম্পন্ন করে গড়ে তোলার বিকল্প কোন পথই যে আর নেই, কোন স্থীর-প্রাজ্ঞ এবং চিন্তাশীল ব্যক্তিই সেকথা অস্বীকার করতে পারেন না।

অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলনের সময় এই মহা-সত্য অস্বীকার করত দেশবাসীর বিশেষ করে দেশের উদীয়মান তরুণ ও যুব সমাজকে একথাই বুঝানো হয়েছিল যে, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখাই হলো আমাদের জাতীয়তার মূল ভিত্তি। অর্থাৎ আমরা বিশ্বের এক কোণায় নির্দিষ্ট এতটুকু স্থানের মধ্যে গোটা মানব জাতি হতে বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র একটি জাতি।

যেহেতু পৃথিবীর অন্য সকল ধর্ম শুধু ধর্মই। নিছক অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে পারলৌকিক কল্যাণ অর্জনই সে সবের মূল লক্ষ্য। সুতরাং ইহ-জীবেনর কাজ কারবারের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক থাকার কথা ওসব ধর্মের অনুসারীরা স্বীকার ও বিশ্বাস করেন না।

পক্ষান্তরে ইসলাম শুধু ধর্মই নয়- পরিপূর্ণ জীবন বিধানও। বলাবাহুল্য, জীবন-বিধানকে জীবনে বাস্তবায়িত করার উপরেই তার সার্থকতা নির্ভর করে। আর তা বাস্তবায়িত করতে হয় ইহ-জীকেবনই। কেননা, জীবন-বিধানকে জীবনের পরপারে বা পারলৌকিক জীবনে বাস্তবায়নের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।

ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এই বাস্তবায়িত করার সুফল শুধু ইহজীবন নয় পরজীবন পর্যন্ত ও পরিব্যাপ্ত। অন্য কথায় ইসলামের দৃষ্টিতে ইহ-জীবনই পারলৌকিক জীবনের ভিত্তিভূমি বা কর্মক্ষেত্র। অর্থাৎ ইহ-জীবনকে সুন্দর ও সফল করে গড়ার উপরেই পারলৌকিক জীবনের সাফল্য বা কল্যাণ ও মঙ্গল একান্তরূপে নির্ভরশীল। আর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই যে জীবনবিধানকে বাস্তায়িত করা সহজ ও সম্ভব সেকথা খুলে বলার কোনো প্রয়োজন হয় না।

যেহেতু পৃথিবীর অন্যান্য ধর্ম জীবন বিধান নয়, অতএব ওসবের দ্বারা জীবন গড়ার কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না। আর জীবন গড়ার প্রশ্ন উঠতে পারে না বলেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সাথে তা সামঞ্জস্যশীল নয় বা হতে পারে না।

এই সামঞ্জস্যশীল নয় বা হতে পারে না বলে পৃথিবীর অন্যান্য সকল রাষ্ট্র, জীবনও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা থেকে ধর্ম বাদ দিয়েছে এবং নিজেদের ইচ্ছা ও প্রয়োজনানুযায়ী ‘ধর্মনিররপেক্ষ’জীবন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।

জীবনকে ধর্ম থেকে পৃথক বা নিরপেক্ষ করা যায় কি না জানি না। তবে আমরা যা জানি এবং যা সত্য ও স্বাভাবিক বলে মনে করি তাহলো, মানব জীবনকে অবলম্বন করেই ধর্মকে টিকে থাকতে হয় এবং অনুরূপভাবে ধর্মকে ধারণ বা অবলম্বন করেই মানজীবনকে সুন্দর ও সফল করতে হয়। অর্থাৎ একটির সাথে অন্যটির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

অতএব ব্যক্তি-জীবনকে যদি ধর্ম-নিরপেক্ষ করা না যায়, তবে পারিবারিক সামাজিক, রাষ্ট্রীয় প্রভৃতি জীবনের কোন পর্যায়কেই ‘ধর্ম-নিরপেক্ষ’করা যেতে পারে না।

এমতাবস্থায় যারা ধর্ম-নিরপেক্ষতার কথা বলেন, তাঁরা হয় জীবন এবং ধর্ম-বিধান’শব্দের তাৎপর্য যতাযথভাবে অনুধাবন করুন এবং ইসলামকে যাঁরা জীবন-বিধান বলে বিশ্বাস করেন এবং যে দেশের অধিবাসীদের মধ্যে শতকরা নব্বই জন ব্যক্তির মনেই এই বিশ্বাস বদ্ধমূল রয়েছে, সেই দেশে ধর্ম-নিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা চলতে পারে কিনা সেকথা একবার ভেবে দেখুন।

আপনারা যে চলতে পারে না’বলেই রায় দিবেন সে বিশ্বাস আমার রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় চলতে পারে না একথা যত সত্য এবং যত বাস্তব হোক, এদেশের শতকরা নব্বইজন অধিবাসীর উপরে সেই ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’শাসন ব্যবস্থাই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

তবে ‘ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ’এবং ‘ধর্ম-নিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা’চাপিয়ে দেয়ায় কিছুটা সুবিধাও হয়েছে। আর তাহলো মুসলমান হিসাবে চলে আসা স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য মিটে গিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষ বিশেষ করে ভারতীয় হিন্দুদের সাথে একাকার হয়ে যাওয়ার পথটা যথেষ্ট পরিমাণে সহজ ও সুগম হয়েছে।

আর অসুবিধা যা কিছু হয়েছে তার সবটাই হয়েছে আমার মতো নও-মুসলিমদের জন্যে। কেননা, বড় সাধ করে মুসলমান হতে এসে আমি না থাকলাম হিন্দু আর না হতে পারলাম মুসলমান- অন্য এক অভিনব জাতীয় তার অঙ্কুশে আটকে পড়ে ত্রিশঙ্কু রাজার মতো মাঝপথে ঝুলে রইলাম।

১ম পর্ব    ২য় পর্ব য় পর্ব  ৪র্থ পর্ব ৫ম পর্ব ৬ষ্ঠ পর্ব ৭ম পর্ব   ৮ম পর্ব  ৯ম পর্ব ১০ম পর্ব  ১১ পর্ব ১২তম পর্ব ১৩তম পর্ব ১৪তম পর্ব ১৫তম পর্ব

Related Post